স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৩
সানজিদা আক্তার মুন্নী
শিকদার বাড়িতে আজ ভারী গোলমাল পেকেছে। নাযেম চাচা, মিনহাজ মামা, রুদ্র, নুহমান, কেরামত, তৌসিরের মেঝো চাচার দুই ছেলে বড়জন ধ্রুব আর ছোটজন কাব্য, সাথে তৌসিরের ফুফাতো তিন ভাই এলহান, ইযদান, জায়রান সবাই করিডরে হাঁটাহাঁটি করছে, সাথে পরামর্শ করছে একটা বিষয় নিয়ে। রুদ্রকে সবাই জোরাজোরি করছে হাতে একটা ছোট প্লাস্টিকের মাইক ধরিয়ে তৌসিরের রুমের সামনে যেতে, কিন্তু রুদ্র যাচ্ছে না উল্টো সে মিনহাজ মামাকে বলছে,“মামা, তুমি যাও না?”
মিনহাজ মামা এটা শুনে ঝাড়ি দিয়ে বলেন,“আরে দূর! আমি কেমনে যামু? আমি মামা না, তুই দেবর আছোস!”
নাযেম চাচাও রুদ্রের কাঁধ চেপে ধরে বলেন,“যা ব্যাটা ব্যাঙ, গিয়া যা, যা কইবার ক।”
এ বলে রুদ্রকে ধরে বেঁধে নিয়ে সবাই তৌসিরের রুমের সামনে দাঁড়ান।বেলা এখন সকাল সাতটা বাজে। নাজহা নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছে। তৌসির তো আর রেগুলার নামাজি না যে নামাজ পড়বে ইচ্ছে হলে পড়ে যেদি মন চায়, তাই আগের মতোই ঘুমাচ্ছে। প্রতিদিন তৌসির ছটার দিকে উঠে গেলেও আজ ঘুম ভাঙেনি।
নাযেম চাচা সবাইকে বলেছেন কাল রাতের আয়োজনের কথা। সবাই মনে করছে, এর জন্যই হয়তো দেরি হচ্ছে। তাই এই সুযোগে একটু মজা নেওয়া যাক।রুদ্রের হাতের মাইকটা নাযেম চাচা ওর হাত চেপে ধরে মুখের সামনে ধরে বলেন,“ক ক
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
রুদ্রের হাসি পাচ্ছে, কী করে যে বলবে! ছিঃ, ছিঃ, কী লজ্জার কথা!রুদ্র মাইকটা মুখের সামনে ধরে হাসতে হাসতে উচ্চারণ করে,“নাজহা ভাবি, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? ভাবি, দয়া করে নিজের আঁচলের নিচ থেকে তৌসির ভাইকে বের করে আমাদের কাছে একটু আমাদের কাছে দিন। উনাকে আমাদের প্রয়োজন, মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য দিন।”
ওর কথায় সবাই হাসতে হাসতে শেষ। রুদ্রের নিজেরও ভিতর ফেটে যাচ্ছে হাসিতে।মাইকের আওয়াজ নাজহার কানে যেতেই এক লাফ দিয়ে তৌসিরের বুক থেকে উঠে বসে। চারপাশে আবুলের মতো তাকায় স্বপ্ন টপ্ন নাকি? নাহ, স্বপ্ন না, বাস্তব! মাইকের আওয়াজে কান ফেটে যাচ্ছে!ও তাড়াতাড়ি তৌসিরকে ডাক দিয়ে বলে,
“উঠুন!”
নাজহার ডাক আর মাইকের আওয়াজে তৌসিরের ঘুম ভেঙে যায়। থতমত খেয়ে উঠে বসে নাজহার দিকে তাকিয়ে বলে,“কে মাইক লাগাইছে?”
এটা বলতে না বলতেই তাড়াতাড়ি কানে আসে রুদ্রের টিটকারি মারা গলার সুর,যেখানে সে বলছে,“ভাবি, আমাদের ভাইকে পাঁচটা মিনিটের জন্য হইলেও আমাদের কাছে দিন, দয়া করেন একটু। ভাইরে কতদিন হয় দেহি না!”
তৌসির এটা শুনে হতবাক হয়ে চারপাশে তাকায় আর বলে,“কি লেভেলের মাদা**রচুত গারিয়া গুলো!”
এ বলে লুঙ্গির গিট ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে নাজহারকে বলে,“তুমি পাটিটা তুইলা যাও, বাথরুমে গিয়া মুখ ধইয়া আয়, তাড়াতাড়ি যাও।”
এ বলে বিছানার দিকে গিয়ে বিছানার চাদরটা এক টানে তুলে নাজহার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলে,“বাথরুমে যাইবার সময় একটু দয়া কইরা এটা নিয়া যাইও।”
নাজহা কটমট করে তৌসিরের দিকে তাকায়, কিন্তু কিছু বলে না। চুপচাপ পাটিটা গুছিয়ে রেখে চাদর নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। এখন সিচুয়েশনে খারাপ নয়তো আদেশ দেওয়া বের করে নিত।নাজহা ওয়াশরুমে যায় আর তৌসির গিয়ে দরজা খুলে। রুদ্র উড়ায়া দিতেছে সব! মাইক ফাটিয়ে দিতেছে “তৌসির ভাইকে দিন, ভাবি দিন, ভাবি!” বলতে বলতে।তৌসির দরজা খুলে ওদের দিকে এক পলক তাকায়, ওকে দেখে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে সবাই।তৌসির বিরক্ত সুরে রুদ্রকে বলে,“এই খবিসের খবিস, কি সাউয়া বকতাছোস?”
তৌসিরকে বের হতে দেখে সবাই একপ্রকার হামলে ওর দিকে এগিয়ে এসে রুমে উঁকি দেয়।রুদ্র তৌসিরের সামনে এসে কুটিল হাসি দিয়ে বলে,“কি ভাই, চাচা হইয়া যাইমু নাকি?”
তৌসির প্রতিত্তোরে বলে,”হ্যাঁ, হইয়া যাবি। কাল চাচা হবি, আর পরশু শ্বশুর হইয়া যাবি, হালা ইতর!”
রুদ্র তৌসিরের কথায় হাসে।নুহমান রুমে উঁকি মারতে মারতে বলে,“ভাই, বিছানার চাদর কই?”
ইযদান ওর পেটে ঘুষি মেরে বলে,“আর দূর ভাই, ধুইতে দিছে!”
তৌসির লুঙ্গির কোণা হাতে নিতে নিতে বলে,“এই তোরা এন থাইকা যাবি? নাকি আমি বিবিজানরে কইতাম!”
নাযেম চাচা ওর হুমকি শুনে ছ্যাত করে বলেন,“এ ব্যাটা এত লাফাইছ না, সব অবদান আমার!”
তৌসির এবার নাযেম চাচার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে চঞ্চল রাগ নিয়ে বলে,“হালা বদমাশের ঘরে বদমাশ সাউয়ার নাতি, তোর এই অবদানের লাইগা তোর পাছায় আমি দশটা নোবেল সাটার ব্যবস্থা করতেছি, খাড়া!”
ধ্রুব এ ফাঁকে বলে ওঠে,“বড় ভাই, তাড়াতাড়ি সালামি বের করেন, আপনার বাসর ঘর আমি সাজাইয়া দিছি!”
তৌসির ওর কথায় বলে,“তুইও বিয়া কইরা নে, তোর ঘর আমি সাজাইয়া দিমু, ব্যাস হিসেবট বরাবর!”
কাব্য উচ্ছ্বাসময় হাসি দিয়ে বলে,“গাজাব বেইজ্জতি!”
এলহান, ইযদান, জায়রান তিন ভাই একসাথে হাত নেড়ে নেচে উঠে বলে,“ভাবি তো বস! আমরা ভাবির কাছ থেইকা টাকা নিমু! তুমি দিবা না জানি!”
মিনহাজ মামা দুঃখের সহিত বলেন,“তোরা তো পাইয়া যাবি, কিন্তু আমি কোন মুখে কমু! আমি তো মামাশ্বশুর!”
ওরা সবাই মিলে তৌসিরের সাথে মজা করতে থাকে, তৌসিরও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জবাব দিতে ব্যস্ত। এমন সময় নাজহা ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসে।
নাজহাকে আসতে দেখেই রুদ্র, কাব্য, ধ্রুব, এলহান, ইযদান, জায়রান সবাই রুমের ভেতর আসতে চায় সালামি নিতে, কিন্তু তৌসির ওদের হাত দিয়ে আটকিয়ে বাধা দিয়ে বলে,“এই বাইনচুদরা, আমার বউয়ের কাছে টাকা নাই, ও টাকা কই পাইবে?”
রুদ্র নাজহাকে আওয়াজ দিয়ে বলে,“ভাবি, আমাদের সালামি দিন।”
নাজহা এটা শুনে দু’কদম এগিয়ে এসে ওদের এক এক করে তাকায়, বুঝতে পারে এরা কেন এসেছে মজা নিতেই এসেছে।নাজহা বুঝতে পেরেও ভ্রু কুঁচকে বলে,
“সালামি?”
কাব্য সাথে সাথে বলে,“হ্যাঁ ভাবি, ভাইয়ের বিয়া উপলক্ষে কোনো সালামি পাই নাই, আপনি দেন, ভাই দিতাছে না।”
নাজহা এটা শুনে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর মাথা নাড়িয়ে ওয়ারড্রবের দিকে যায়।এ দেখে তো তৌসিরের হার্ট অ্যাটাক করার অবস্থা ও সত্যি সত্যি দিয়া দিবে নাকি!তৌসির নাজহাকে আওয়াজ দিয়ে বলে,“বিয়া করছি আমি, সালামি ওগো ক্যান দিবা! নাজহা, এক টাকাও বের কইরো না!”
নাজহা ওর কথায় কি আর পাত্তা দেয়! ওর কথার তোয়াক্কা না করে নিজের কাছে থাকা কিছু টাকা থেকে আঠারশো টাকা হাতের মুঠোয় নিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়।নাজহাকে টাকা নিয়ে আসতে দেখে তৌসির মেলে রাখা হাত ছেড়ে ওকে রাগি গলায় বলে,“এক টাকাও দিবা না কইলাম!”
নাজহা তৌসিরের কথা শুনেও না শুনার ভান করে হাত বাড়িয়ে রুদ্রের হাতে টাকাগুলো দিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“নিন ভাই, ভালো-মন্দ কিছু খেয়ে নিয়েন। আমিই দিলাম, কারণ আপনাদের ভাইয়ের থেকে তো এই জন্মে সালামি পাবেন না।”
তৌসির নাজহার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয় আর ভাবে,
“এই মাইয়া তো আমারে দুইদিনে ফকির বানাইয়া দিবে।”
নাজহা রুদ্রের হাতে টাকা দিয়ে নাযেম চাচার দিকে চোরা চোখে তাকায়।ওর তাকানো দেখে নাযেম চাচা ভেল্কি মারা হাসি দিয়ে বলেন,“কেমন আছো, বউমা?”
নাজহাও টিটকারি মারা হাসি নিয়ে বলে,“ভালো ছিলাম, কিন্তু ভালো থাকতে তো দিলেন না ছোট চাচা শ্বশুর মশাই।”
নাযেম চাচা এতে বড্ড লজ্জায় পড়ে যান। নাজহা যে কি বুঝালো, তা উনি বুঝতে পেরে শরমে সবাইকে বলেন,
“এই চল, চল সবাই, এন থাইকা আয়, এখন সালামিও পেয়ে গেছিস।”
নাজহা আর দাঁড়ায় না, চুপচাপ সরে আসে। তৌসিরও নাজহার পিছে পিছে পা ফেলে।ওরা সবাই সালামি পেয়ে হইহট্টগোল করতে করতে চলে যায়।
নাজহা এসে বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়ায়। তৌসিরও তড়িৎ গতিতে পা ফেলে নাজহার পাশে এসে দাঁড়ায়।এই মেয়েকে একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত নয়তো তিন পথের মোড়ে থালা নিয়া বসাইতে সময় নিবে না!
ও নাজহাকে তিক্ত সুরে বলে,“এই সিনাল, তোর বেশি টাকা হইয়া গেছে যে এত টাকা দিয়া দিলি?”
নাজহা আকাশ পানে তাকিয়ে স্থির গলায় বলে,
“আমার টাকা, আমার দেবরদের আমি দিয়েছি, তাতে আপনার কি?”
“দেবর” কথাটা শুনে তৌসির ঠোঁট বাঁকায়। মনে মনে ভাবে,“মাইয়া তো দেখি বহুত ভেত্তমিজ। এমনে কয় জামাই মানে না, আর ওমনে এত টাকা ফালায়া দিল দেবর মারাইয়া! ওহ খোদা! ইয়ে কিয়া হ্যায়? ইয়ে কউন সি ঘাটিয়া লজিক হ্যায়?”তৌসির নাজহার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বলে,“সিনালের সিনাল, আমারে কস আমি জামাই মানি না, আর এখন দেবর মারাস! বুঝছি, তোর সাউয়ায় বারি লাগাইতে হইবো, নাইলে তুই সোজা হবি না।”
নাজহা তৌসিরের দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে বলে,“মুখ সামলান বলতেছি।”
তৌসির তির্যক কটাক্ষ করে বলে,“আগে নিজে ঠিক হ। বিলাসিতা ছাড়, আর টাকা-পয়সারে হাতের ময়লা না ভাইবা বক্ষে বাইন্ধা রাখ।”
নাজহা এটা শুনে তাচ্ছিল্যের সহিত বলে,“আপনার মতো খাইষ্টা না আমি, যে দু’টাকা নিয়েও কিপ্টামি করব।”
তৌসির ওর কথায় ভুরু নাচিয়ে তাগিদ দেওয়া গলায় বলে,“এই বেডি মুখ সিনাল! মুখ সামলা! লোক আমি মন্দ হইলেও তোর-ই জামাই। জামাইরে সম্মান দিয়া কথা ক।”
নাজহা ওর কথায় ঠোঁট আগলিয়ে খানিকটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,“আমিও তো আপনার বউ। আপনি অসভ্য ভাষায় গালি দিতে পারেন, তাহলে আমি কেন পারব না?”
তৌসির নাজহার কথায় ভুরু নাচিয়ে আড়চোখে নাজহার দিকে তাকিয়ে ভাবে,“গাদ্দারনি কোথাকার! জামাই মানস না কস, আর আবার বউও কস!”তৌসির আনমনে বলে,
“তোমারে তোমার অভ্যাসেই কই, এমনি এমনি কই না।”
নাজহা তৌসিরের কথা শুনে বিছানার দিকে যেতে যেতে বলে,“আমিও আপনার অভ্যাসে আপনাকে দেখতে পারি না।”
তৌসিরও ওর পিছনে পিছনে গিয়ে বলে,“দেখতে পারবি কেমনে! খাঁটি জিনিস তো আর তোর চোখে লাগতো না।”
নাজহা ওয়ারড্রব থেকে বিছানার জন্য চাদর নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে মেরে বলে,“এত কথা বলবেন না তো! নিন, আমায় বিছানার চাদর বিছাতে সাহায্য করুন।”
তৌসির নাজহার কথায় বিছানার দিকে এক পলক তাকায়, তারপর নাজহার মুখের দিকে তাকায়।
মস্তিষ্ক চায় বলতে,“আমি ক্যান বিছামু? তুই বউ, তুই কাম কর।”কিন্তু মন বলে,“এটা বললে পরে জুতা না মারে! তাই ইজ্জত নিয়া কাম কইরা নাও।”
মনের কথায় সায় দিয়ে তৌসির বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে নাজহাকে বলে,“তুমি বালিশের কভারগুলো বদলে নাও, আমি বিছাইয়া দিতাছি।”
নাজহা তৌসিরের কথায় হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ায়।
ওর এমন সাধু রূপ দেখে মনে মনে আফসোস করে বলে,
“ইসস রে আমার ডাকাইতনি! এমনে যদি সবসময় আমার কথা শুনতি, তাইলে কতই না সুখী হইতাম আমি।”
এসব মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে তৌসির বিছানার চাদরটা সুন্দর করে বিছিয়ে নেয়। পুরুষ হলেও ঘরের কাজকর্ম টুকটাক যাই পারে, একদম পারফেক্ট ভাবেই পারে।নাজহা বালিশের কভারগুলো লাগিয়ে আগেরগুলো খুলে নেয়।ও বালিশগুলো যখন বিছানার উপর রাখতে যাবে, তখনই দেখে তৌসির যে নিজের জুতো রেখে বিছানায় উঠেছে, তাতে একটা তেলাপোকা।
যদিও তেলাপোকা, টিকটিকি এগুলোতে মোটেও ভয় পায় না নাজহা। কিন্তু হঠাৎ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে দূরে সরে যেতে মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায়,“তৌসির!”
নাজহার মুখে হঠাৎ নিজের নাম শুনে থমকে যায় তৌসির। তড়িৎ গতিতে ঘাড় ফিরিয়ে নাজহার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,“কি হইছে?”
নাজহা নিজের কাজেই লজ্জায় পড়ে যায়।ছিঃ ছিঃ! তেলাপোকা দেখে এমন পাপারির মতো নাটক করা ওর সাথে অন্তত যায় না।নাজহা আমতা আমতা করে বলে,
“না, কিছু না, ঐ একটু ভয়….. আরকি, তেলাপোকা।”
তৌসির এটা শুনে কটাক্ষ করে বলে,“কি মারাত্মক কথা! তেলাপোকা দেইখা নাকি ভয় পায় বিষাক্ত বিচ্ছু”
“বিচ্ছু” কথাটা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে নাজহার চিত্ত।নাজহা ক্রোধভরা নজরে তৌসিরের দিকে তাকায়।
অতিরিক্ত বলে ফেলতেছে লোকটা! যদিও পণ করেছিল, ওর কোনো কথাই কানে নিবে না, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পণ ভঙ্গ করতে হবে।ওর এই ক্রোধি চাহনি তৌসির গায়ে না মেখে উল্টো বলে,“তুমি এমনে তাকাইও না, তোমারে বলি নাই, তুমি তো ইচ্ছাধারী নাগিনী ।”
তৌসিরের কথায় নাজহা ধমকে বলে,“ইবলিশও আপনার থেকে ভালো আছে।”
“তাইলে যা, ইবলিশ রে লাঙ বানাইয়া নে, আমার থাইকা যখন ও ভালা।”
নাজহা তৌসিরের এমন কথায় আক্রোশে ফেটে পড়ে। বালিশগুলো বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বলে,“ছিঃ ছিঃ ছিঃ! কতটা নিকৃষ্ট আপনার মুখের বাণী!”
“এটা নিকৃষ্ট না, এটা আমার স্টাইল বুঝলা, রুদ্রকেশী।”
‘রুদ্রকেশী’? সে আবার কি?নাজহা এটা ভেবে নাক মুখ কুঁচকে আনমনেই বুনে,“রুদ্রকেশী?”
তৌসির ওর ছোঁড়া বালিশগুলো ঠিক করে রাখে, অতঃপর বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে,“খবিসের মতো রাগ তোমার, আর অলকবতীর মতো তুমি কেশওয়ালি। ডাকাইতের মাইয়া, তাই নাম দিলাম তোমার ‘রুদ্রকেশী’।”
এ বলে নাজহার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।নাজহা নাক মুখ ছিটকে বলে,“কত রঙ আর কত ঢং দেখব?”
নাজহার কথার বিপরীতে তৌসির এবার আর কোনো উত্তর খোঁজে না।আবিষ্ট চোখে ওর পানে চেয়ে থাকে।
কিছু মুহূর্ত পর নিজের হাত বাড়িয়ে নাজহার কোমর পেছিয়ে ধরতে ধরতে রঙ্গিলা স্বরে উচ্চারণ করে,
“এমনে আও কৈতরি চুমু-টুমু দু’একটা খাই, বিয়াইত্তার ফিলিংস আনি।”
এ বলো তৌসির নাজহার কোমর জড়িয়ে টেনে আনে একদম নিজের কাছে। হঠাৎ ওর এমন টানে নাজহার নিঃশ্বাস থমকে যায়। বিস্ময়ে বড় বড় চোখে তাকায় তৌসিরের দিকে। কিন্তু তৌসিরের চোখে ভরা তীব্র তৃষ্ণায়।তৌসির ওর চাহনি উপেক্ষা করে আলতো হাতে নাজহার থুতনি চেপে ধরে, চোখে চোখ রাখে কিছুক্ষণ, তারপর নিঃশব্দে নাজহার গালে নিজের ঠোঁট মুখ ছুঁইয়ে স্নিগ্ধ পরশে প্রগাঢ় চুমু খায় । বারবার নিজের ঠোঁট নাক ছুঁয়ায় নাজহার গালে আর আদুরী গলায় বলে ওঠে“তোমারে যে মায়া লাগে গো আমার কৈতরি।
শব্দগুলো ফিসফিসের মতো মোলায়েম হলেও তাতে মিশে থাকে এক অনির্বচনীয় টান এই শব্দগুলোর মধ্যেই প্রকাশ পাচ্ছে যে তৌসির শিকদার তালুকদারের মাইয়ার প্রেমে মজে যেতেছে।তৌসির এ বলে নাজহার অন্য গালে মুখ রাখে ঠোঁট ঘেঁষে ধরে ওর নরম গালে উষ্ণ শ্বাস ছুড়িয়ে দেয় নাজহার চাঁদমুখে সাথে ফিসফিস করে,“এ বেডি তুই এত সুন্দর ক্যান? এত মায়া লাগে ক্যান তোরে?
অতঃপর তৌসির নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় নাজহার কপালে, চোখের কোণায় গাল। নাজহার শরীর কেঁপে ওঠে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে ওর নিঃশ্বাসের ভেতর মিশে যায় তৌসিরের গরম নিশ্বাস।তৌসিরের দাঁড়ির খসখসে ছোঁয়ায় নাজহার দম বেরিয়ে আসছে। চোখ বুঁজে নেয় ও। কিছু মুহুর্ত তৌসির কে সময় দেয় সরে যাওয়ার জন্য কিন্তু তৌসির তো সরে না। নাজহা বিরক্তিতে তৌসিরের কাঁধে ধাক্কা দিতে দিতে তিতকুটে স্বরে বলে,
“তৌসির, ছাড়ুন। ভারী বিরক্ত লাগে আপনার এই কর্মকাণ্ড।”
তৌসির নাজহার কথায় নিজের মুখ সরিয়ে নিয়ে ভ্রূবদ্ধ দৃষ্টিতে ওর পানে চেয়ে বলে,”ক্যান? আমার ছোঁয়া পছন্দ হয় না?”
তৌসিরের প্রশ্নে নাজহা চুপ করে থাকে। কী উত্তর দেবে? তৌসির যে ওর কোমর পেছিয়ে ধরে আছে, এতেই প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে কষ্টে। মনে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বেদনায়। কী করে বলবে আমার আপনাকে পছন্দ না, আপনার ছোঁয়া পছন্দ না, আমি অন্য কাউকে পছন্দ করি। তৌসির খারাপ হোক আর ভালো সবশেষে চিরসত্য তো তৌসিরই ওর বর্তমান আর তৌসিরই ওর সব। এগুলো তো স্বাভাবিক একজন স্বামীর চাওয়ার মধ্যেই পড়ে। তৌসির তো আর যেচে ওকে বিয়ে করেনি বা কোনো প্রকার জোরও করেনি ওর পরিবারের মতে, ওর নিজের মতে বিয়েটা হয়েছে। তথাপি কেন এত সংকোচ, কেন এত ঘেন্না, কেন এত আপত্তি? কী হবে এসব করে? এসব করলেই কি না-পাওয়া মানুষটা তার হয়ে ফিরে আসবে?
নাজহা মস্তিষ্কে তৌসিরকে মেনে নিলেও অন্তর তা বারবারই প্রত্যাখ্যান করছে। নাজহা অতিশয় দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে চোখ তুলে তৌসিরের দিকে নিরন্তর চাহনি নিয়ে চায়। নাজহার এই চাহনি দেখে তৌসির মৃদু হাসে, তারপর হাত বাড়িয়ে নাজহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্নিগ্ধ সুরে বলে,”যাকে পছন্দ করো, আমার লগে বিয়া না হইলে তার লগে হইতো?”
তৌসিরের এই প্রশ্নে নাজহার অন্তর কেঁপে ওঠে, বিস্ময়বিদ্ধ হয়ে যায়। তৌসির কিভাবে জানলো ওর মনের কথা! নাজহা মেলান সুরে বলে,“সে আমার কখনোই হতো না। আপনার সাথে বিয়ে না হলে ইকরাব ভাইয়ের সাথে হয়ে যেতো হয়তো।”
তৌসির এটা শুনে অনাগ্রহী স্বরে বলে,“তাইলে পাইবা না জাইন্নাও মায়া বুনছো ক্যান?”
তৌসিরের করা প্রশ্নে অন্তরীণের ক্রন্দনে কাতর হয়ে ওঠে নাজহা। সাথে বেশ চমকায়। স্ত্রীর মুখে অন্য পুরুষের কথা শুনেও কী নীরব এই লোকটি। তৌসিরের স্বভাবের সাথে এই নীরবতা বড্ড বেমানান। নাজহা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে তৌসিরের চোখের ন্যায় অবিচল দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“ভালোবাসলেই পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিছু ভালোবাসা বিচ্ছেদেই সুন্দর।”
নাজহার কথায় ঠোঁট আগলিয়ে সল্পমাএায় হাসে তৌসির। বাহ, মেয়েটা বয়সে ছোট হলেও বুঝ তো আকাশ পরিমাণ বিরাজ করছে তার মস্তিষ্কে। তৌসির আলতো সুরে বলে,
“একখানা খাঁটি কথা জানো, তালুকদারের মাইয়া?”
নাজহা মাথা দু দিকে না বোধক নাড়িয়ে ওর দিকে নিবিষ্ট চাহনি চেয়ে বলে,“না!”
তৌসির ‘না’ শুনে এবার মৃদুস্বরে শোধায়,“নজর আর নসিব দুইয়ের লড়াই চিরন্তন। যা আটকায় নজরে, তা রয় না নসিবে।”
তৌসিরের কথাটা নাজহার অন্তরে লাগে। ও ওর কথায় সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে,“আর এটাই নিয়তির নিষ্ঠুর রসিকতা।”
তৌসির এবার সুযোগ পেয়ে নিজের মনের কথাটা বলে,“আমি লোক মন্দ হইলেও সংসার করার যোগ্য আছি। করবা এই মন্দ লোকের ঘর?”
এই কথাটা বিয়ের দিন বলা উচিত ছিল কিন্তু তা বলা হয়নি আজ মনে এলো তাই বলে দিল।তৌসিরের কথায় নাজহা নিরুত্তর হয়ে রয়। কী উত্তরই বা দেবে? নিজের মতো করে কিছু বলার ভাষাও নেই। সব হারিয়ে ফেলেছে, পরিস্থিতি সমস্ত গুলিয়ে দিয়েছে। নাজহাকে চুপ থাকতে দেখে তৌসির মৃদু হেসে আবারো বলে,“আমি তোমারে এ জীবনে কিছু দিতে পারমু কিনা জানি না, কিন্তু একটা জিনিস দিতে পারমু। তা হইলো তোমার প্রতি আমার ফিডেলিটি।”
‘ফিডেলিটি’ শব্দটা শুনে নাজহা চমকায়। এই লোক তো ইংলিশও জানে! চমকিত হয়ে চায় তৌসিরের মুখপানে। তৌসির ওর চাহনি দেখে রঙ্গের সুরে জবানে ফোটায়,
“গাওয়ালি ভাষায় কথা কই বইল্লা অশিক্ষিত ভাইবো না লো ডাকাইতনি। ইংলিশ মিডিয়ামের ইস্টুডেন্ট আমি।”
নাজহা ‘ইংলিশ মিডিয়ামের ইস্টুডেন্ট’ কথাটা শুনে গা ছাড়া ভাব নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে আলতো মাথা নাড়ায়,
“বাহ, ভালো তো। তা কোন ক্লাস অবধি টিকেছিলেন?”
“টেন পর্যন্ত পড়ছিলাম।”
“তারপর আর পড়েননি?”
“ইন্টারে উঠা ভাবছিলাম লন্ডন বা আমেরিকা যামু। গা, সিলেটি মাইনষের তো একটাই গন্তব্য তা হইলো লন্ডন বা ইউরোপ। কিন্তু বাপ-চাচা জাউরামিতে লাগায় দিছিল আর আমিও জাউরা হইয়া গেছি।”
‘জাউরা’ কথাটা শুনে নাজহা তিক্ত সুরে বলে,“আপনি জাউরা না, আপনি ইবলিশ। আর এগুলো বাদ দিন। এখনও সময় আছে, ভালো কিছু করুন।”
কথাটা শুনে তৌসির আলস্যভরে মাথা নাড়লো। উদাসীন ভঙ্গিতে হেসে বললো,“কি ভালা কাম করতাম?”
ওর প্রশ্নে নাজহা ধারণ করে,“এমন কিছু করুন বা এমন একজন আদর্শ মানুষে পরিণত হোন যাতে আপনার মৃত্যুর পরও আপনাকে মানুষ স্মরণে রাখে।”
ওর এই উপদেশ শুনেই তৌসির আলতো কাঁধ ঝাঁকালো। মনে হলো বাতাসের ফুৎকারে উড়ে যাওয়া ধূলিকণা মাত্র, যার গুরুত্ব ওর কাছে তিল পরিমাণও নয়। কথাটা ওর কানে পৌঁছালো বটে, কিন্তু তৌসির কোনো তোয়াক্কা না করে উল্টো খেলো গলা বলে ওঠে,“তাহলে মরার আগে কারো কাছ থাইকা দুই-তিন লাখ টাকা ধার নিয়া নিমুনে। তাইলে মরে গেলেও আমায় সারাজীবন মনে রাখব।”
নাজহা এই উত্তর শুনে বুঝে যায় এই বজ্জাত মানবের সাথে ভালো কথা যায় না এক্কেবারেই যায় না। রাগি গলায় বলে,“গরু তো গরুই থাকবেন, মানুষ হবেন না।”
এ বলে যেতে থাকে। কিন্তু তৌসির ওকে যেতে দেয় না। ওর টেনে ধরে একদম নিজের নিকট নিয়ে আসে। নাজহা ক্রোধী সুরে বলে,“দূর, ভালো লাগছে না। এসব ছাড়ুন তো।”
তৌসির ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে এক হাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে, অন্য হাতে ওর খোঁপার মাঝে হাত ডুবিয়ে দিয়ে নাজহার গালে আবার ঠোঁট ঠেসে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,“মাইরা নিতাছি না তোরে, বেডি। একটু চুমুই দিমু, বেশি ফ্যাতফ্যাত করিস না।”
বিকেল বেলা
তৌসির, রুদ্র আর নাজেম চাচা বাজারে যাচ্ছেন। আগামীকাল তালুকদাররা আসবেন শিকদার বাড়িতে, সেই উপলক্ষেই বাজার করতে যাওয়া। তালুকদাররা সাফাকে নিয়ে আসবেন, সাফাকে কিছুদিন রেখে যাবেন বেড়ানোর জন্য বাপের বাড়ি। যাওয়ার সময় হয়তো নাজহা কে নিয়ে যেতে পারেন। তৌসিরের তো বিরক্তই লাগছে কেন ওরা আসবে? এসে এত টাকা খরচ, এত আয়োজন, কত পয়সা নষ্ট! যদিও এসবের এক পয়সাও তৌসিরের যাবে না, তারপরও পয়সা তো যাবেই! পয়সার প্রতি বড্ড মায়া ওর, তাই এক আনাও খরচ করতে বুকে ব্যথা লাগে। তৌসির হাঁটতে হাঁটতে নাজেম চাচাকে বলে, “ও ছোটচাচা।”
নাজেম চাচা কিছুটা আগে এগিয়ে গিয়েছেন। ওর ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর মুখপানে চেয়ে বলেন, “কিতা রে?”
তৌসির হেয়ালি করে বলে, “ওরা কাল আমার বউরে লইয়া যাইব না কিতা?”
রুদ্র পাশ থেকে একটু ভেবে উত্তর দেয়, “হয়তো নিয়া যাইব।”
তৌসির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তাইলে একটু বাঁচমু। কুকর্ম মন দিয়া করতে পারি না বউয়ের লাইগা। মাল এনে রাখলে ও ফেইল্লা দেয়। বহুত বজ্জাত এক ঝিজ।”
নাজেম চাচা বলেন, “কথা না শুনলে দিস কানের নিচে দু-একটা লাগাইয়া।”
তৌসির এটা শুনে নাক-মুখ কুঁচকায়, “তোর চরিত্রে দোষ আছে, ব্যাটা। তুই কথায় কথায় নারী নির্যাতনের কথা কস। তোরে মামলা খাওয়ানো উচিত।”
রুদ্র হাসতে হাসতে বলে, “ভাই, চাচারে মামলা না দিয়া বিয়া একটা করাইয়া দেও। ভালো হইব।”
তৌসির রুদ্রের কথায় সায় দেয়, “এইটাও ঠিক কইছোস। মামলার চেয়ে বউয়ের যন্ত্রণা বড় যন্ত্রণা।”
নাজেম চাচা কটাক্ষ করে বলেন, “আমি এসবে নাই। বউয়ের বদলে এক বোতল মাল হইলেই হয়।”
তৌসির ‘মাল’-এর কথা শুনে নাক-মুখ ছিঁটকে বলে, “তোরা যেমনে মাল গিলস, বাপ হওয়ার ক্ষমতা হারাইয়া ফেলবি রে। শেষ কইরা নিতাছোস নিজের জীবন নিজের হাতে।”
রুদ্র তৌসিরের কথায় সিরিয়াস হয়ে বলে, “না ভাই, আমি ভালো হইয়া গেছি। এখন আর এসব গিলি না।”
নাজেম চাচা ওর কথায় ওর দিকে ভ্রূকুটি করে তাকিয়ে বলেন, “ক্যান, গতকালি তো দেখলাম খাইতে তোরে।”
রুদ্র হাবলার মতো হেসে শোধরায়, “আরে, ঐ একটু বাংলাদেশ জিতছিল তাই আরকি।”
তৌসির খেলার কথা শুনে পরিহাসের হাসি দিয়ে বলে, “হায়রে বাংলাদেশ! একশো নয় রানে জিরো উইকেট আর একশো আঠারো রানে ছয় উইকেট।”[ ২ তারিখের ম্যাচ এর কথা]
এ বলে আবার হাসতে থাকে। ওর হাসির তালে নাজেম চাচা বলেন, “এইটাই বাংলাদেশ, ভাতিজা।”
তালুকদার বাড়ির পিছনের অন্ধকার প্রাঙ্গণে চলছে এক ভয়ঙ্কর মরণ খেলা।খেলার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নওমির হাতে নাজহার সেই চতুর উকিল ফুফু।
তারই হুকুমে এক এপমি, যার নাম জামাল তাকে হাত-পা শক্ত করে বাঁধা হয়েছে । দড়ির ফাঁসে ঝুলছে সে উল্টো হয়ে, ঠিক কাছের মোটা কাঠের খুঁটির সাথে। নিচে জ্বলছে দাউদাউ করে আগুন, শিখার লেলিহান স্পর্শ যেকোনো মুহূর্তে তার শরীর ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে এমন অবস্থা। উল্টো ঝুলে থাকা জামালের শরীর গলে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।
এই নৃশংস সাজা বিনোদনের জন্য নয় জামালকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখার পেছনে আছে এক মারাত্মক কারণ তা হলো।এই জামাল অর্থ, ক্ষমতা, রাজনৈতিক পরিচয়ে বলীয়ান এক হিংস্র শিকারি। আর তার শিকার হয়েছিল মাত্র আঠারো বছর বয়সী কলেজপড়ুয়া চিত্রা। একটি পার্টির রাতে, নেশা মেশানো পানীয়, সিসিটিভি বন্ধ, এবং বন্ধ দরজার আড়ালে ঘটে গেছিল ওর সাথে নৃশংস এক ঘটনা। চিত্রা, ধর্ষিত হয়ছিল জামালের হাতে।মেয়েটি ন্যায়বিচারের আশায় জামালের নামে মামলা দায়ের করে। কিন্তু এই আইনি লড়াইয়ে নামতেই চিত্রার জীবনে নতুন করে শুরু হওয়ার সব আলো নিভে যাওয়ার উপক্রম হয়।
জামাল নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য নওমিকে নিযুক্ত করে এবং তাঁকে প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা দেয়। কিন্তু নওমি নিজের ধূর্ত বুদ্ধি ও কৌশল খাটিয়ে তিনি জামালের কাছ থেকে আরও দশ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত আদায় করে নিয়েছেন।
নওমি মামলাটি হাতে নিলেও, দ্রুতই জানতে পারেন যে অপরাধের সব অকাট্য প্রমাণ রয়েছে ধর্ষিত মেয়ে চিত্রার কাছেই। এই প্রমাণগুলি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে জামালের মুক্তি অসম্ভব।আর সাথে উনার কেস জেতার আসংখ্যা।প্রমাণগুলো চিত্রার হাতে আছে জানার পর, নওমি এক অপ্রত্যাশিত এবং মারাত্মক ডিল করার জন্য সরাসরি চিত্রা ও তার বাবা-মায়ের কাছে যান। সেই ডিলটি ছিল ইচ্ছাকৃত পরাজয় অর্থাৎ চিএা ও তার পরিবার স্বেচ্ছায় আদালতে মামলায় হেরে যাবেন। এমনভাবে সব প্রমাণ কোডে পেশ করবেন, যাতে জামালের দোষ প্রমাণ না হয়।
এতে নওমি একইসঙ্গে জামালের কাছ থেকে নেওয়া ৪০ লক্ষ টাকা ধরে রাখতে পারবেন, এবং কেসও জিতে যাবেন।চুক্তির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অংশ ছিল এটি জামাল ছাড়া পাওয়ার কিছু মাস পর, নওমি নিজ দায়িত্বে জামালকে চিত্রা ও তার পরিবারের হাতে তুলে দেবেন, যাতে তারা তাকে এক ভয়াবহ ও মর্মান্তিক মৃত্যু দিতে পারে, যা প্রচলিত আইনে সম্ভব নয়। সাথে চিএা কে আরেকটি পরিকল্পনা দেন তা হলো।সেই অকাট্য প্রমাণগুলো ব্যবহার করে চিত্রা যেনো ক্রমাগত জামালকে ব্ল্যাকমেইল করে জামালের থেকে কিছু টাকা হাতিয়ে নেয়। নওমি চিএার পরিবার কে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন এই দেশে আইনের মাধ্যমে জয় হবে না, কখনোই হবে না।জামাল ঠিকই আইনের ফাঁকফুকুর দিয়ে বেরিয়ে যেতো দোষী প্রমাণ হলেও।
আর নওমির প্ল্যান মতো সব যদি হয় তবে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। ব্যাস নওমির পরিকল্পনা মতোই সব কিছু চলতে শুরু করে।নওমির দেওয়া সব নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলে চিত্রা। এই কিছু মাসের মধ্যে সে একটি ভিন্ন পরিচয় ধারণ করে জামালের বিরুদ্ধে যত প্রুফ ছিল তা দিয়ে জামাল কে ব্ল্যাকমিল করতে থাকে। এইভাবে সে জামালের কাছ থেকে মোট পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়।
আগামিকাল ভোরেই তাদের ফ্লাইট।চিএা আর তার পরিবার পাড়ি দেবে ডেনমার্কে নতুন পরিচয়, নতুন জীবন নিয়ে, পেছনে ফেলে যাবে সব রক্ত, সব ভয়, সব নিকৃষ্টতা।
তাই আজ রাতেই সব শেষ করতে হবে।জামালকে মেরে ফেলতে হবে।নওমি নিজে ডেকে পাঠান জামালকে নিজেদের বাড়িতে মেহমান হিসেবে।জামালও আসে, একটুও সন্দেহ করে না।ভাবছিল, হয়তো নওমি আবার নতুন কোনো ডিল করতে চাইছে।
কিন্তু ও তো জানত না।নওমি পেছনে ছুরি নিয়ে অপেক্ষা করছে।ওর কপালে আজ শুধু মৃত্যু লেখা আছে। আবার চিএা জামালকে যেভাবে ব্ল্যাকমেল করেছে,চিএার পরিবার নওমির সাথে যে গোপনে চুক্তি করেছে নওমি সব রেকর্ড করে রেখেছে।ভবিষ্যতের জন্য।যদি কোনোদিন চিএা কিংবা ওর পরিবার নওমিকে ব্ল্যাকমেল করার সাহস করে,তাহলে যেনো প্রমাণ হাতে নিয়ে এক ঝটকায় সব শেষ করে দিতে পারে।
নওমি মানেই ঠান্ডা মাথার শয়তানি।খেলা সে খেলে আগেই বোর্ডে ঘুঁটি বসিয়ে। প্রথমত তিনি ধর্ষকের পক্ষে মামলা জিতলেন আবার সেই ধর্ষকে শাস্তিও দিলেন। তার কাছ থেকে চল্লিশ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিলেন। এতেও হয়নি ওকে এখানে এনে ভয় দেখিয়ে এমপির যত জায়গা-জমি, ফ্যাক্টরি সবই অন্য নাম থেকে নিজের আওতায় নিয়ে। ব্যাংকের টাকাও নিজের করে নিয়েছেন যদিও অ্যাকাউন্টে না নিয়ে, অন্য একজনের অ্যাকাউন্টে সরিয়েছেন। যা পরে তারই অ্যাকাউন্টে যাবে।
সব লুটে নেওয়া শেষে জামাল কে এভাবে ঝুলিয়েছেন মারার জন্য। নাজহার তিন নম্বর চাচা আদনান এবং নাজহার বাবা মিলে এই সফল খেলোয় জড়িত নওমির সাথে।
চিত্রা ও তার বাবা-মাকে এনে দাঁড় করিয়েছেন জামালের সামনে। চিত্রা একদৃষ্টিতে এই মরণ খেলা দেখছে। ওর মা-বাবা অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন, উনারাও দেখছেন। নওমি এগিয়ে এসে চিত্রা হাতে একটি মর্নিং স্টার দিয়ে বলেন,”যাও, নিজের জেদ মিটাও যেভাবে ইচ্ছে, সেভাবে ছেদ দাও।”
চিত্রা কথাটা শুনে কাঁপতে থাকে। হাত-পা কাঁপছে ওর, কিন্তু তারপরও হাতে মর্নিং স্টারটি তুলে নেয়। মর্নিং স্টারটি বেশ ভয়ংকর লম্বা লোহার দণ্ডের মাথায় কাঁটাযুক্ত গোলক সংযুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে এটি। পুরোটা ইস্পাত দিয়ে তৈরি। গোলকে রয়েছে তীক্ষ্ণ স্পাইক গাঁথা।চিএা মর্নিং স্টারটি হাতে ধরে এগিয়ে যায় জামালের সামনে। চিত্রা কে দেখেই জামাল চিৎকার করে ওঠে, বলে,
“দয়া করে এটা দিয়ে মেরো না!”
সাথে সাথে চিত্রার মনে পড়ে যায় সেদিন ও নিজেও বলেছিল এমন,”আমাকে দয়া করো…….একটু দয়া করো!”
তবে দয়া তো দূরের কথা, উল্টো পশুর মতো খাবলিয়েছিল ওকে জামাল। চিত্রা দাঁত চেপে মর্নিং স্টার দিয়ে সজোড়ে আঘাত করে জামালের পেটের সাইডে, সাথে সাথে জামাল কলিজা ফাঠা চিৎকার করে ওঠে। ওর চিৎকার করে শুনে চিত্রার মনে পড়ে সেদিন ও নিজেও এমন চিৎকার করেছিল। ওর চিৎকার শুনে জামালা উল্টো হেসেছিল আরো বেশি অত্যাচার করেছিল। চিত্রা মর্নিং স্টারটা পেটের সাইড থেকে এক টানে বের করে নিয়ে। দ্রুত হাতে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে ওর বডিতে। একেকটা আঘাতে ওর শরীরে একেকটা স্পাইক ঢুকে যায় টুশ টুশ করে। জামালের জিহ্বা অর্ধেক বেরিয়ে আসে। লোহার ধারালো স্পাইকগুলো জামালের শরীরে রগ- হাড্ডি অবধি ছিলে বের করে আনে।চিত্রা যখন সজোড়ে আঘাত করে তখন মর্নিং স্টারের মাথার স্পাইকগুলো টপ টপিয়ে ঢুকে যায় ওর শরীরে মাংসের নিচে, আর যখন চিএা দাঁত চেপে টেনে মর্নিং স্টারটি বের করে আনে। তখন শরীরের রগ সহ মাংস হাড্ডি অবধি বেরিয়ে আসে মর্নিং স্টারের মাথায় লেগে।
রক্ত চিপে পড়তে থাকে। রক্ত গলগলিয়ে নিচে থাকা আগুনে ঝরে পড়ে আগুন নিঁভে গেছে। জামাল একিবারে যখন নিথর তখন নওমি চিত্রার হাতে একটা গ্লেইভ তুলে দেন। চিত্রা এটা হাতে নিয়ে একঝলক নওমির দিকে তাকায়। তারপর পৈশাচিক হাসি দিয়ে সেই গ্লেইভ দাঁতে দাঁত চেপে নিজের সমস্ত ক্রোএ উজার করে জামালের গলায় চালিয়ে দেয়। সাথে সাথে গলগলিয়ে রক্ত নিচে পড়ে মিটেমিটে জ্বলা আগুন নিভে যায়। জামালের অর্ধ জিহ্বা বের করা কাটা গলাটা পাশে উড়ে গিয়ে পড়ে। চিত্রা ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে, জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।
নওমি ওর পাশে এসে বসে, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”কোডে শাস্তি পেলে ও বেইল পেয়েই যেত। আমি এটা করেছি শান্তির জন্য। যাও, এবার তুমি শান্তিতে বাঁচো। আর আমার বিরুদ্ধে কিছু করার চেষ্টা করো না।”
চিএা নওমির কথায় তার দিকে তাকায়। কিছু সময় স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রয় কত মায়াবী একজন নারী, কি সুন্দর তার চোখের চাহনি, কতটা নিস্পাপ তার মুখখানি, অথচ তার ভেতর এত ভয়াবহ শয়তানি!চিত্রা কি করবে বুঝতে পারে না। চিএা ঝাপটে জড়িয়ে ধরে উনাকে, ফুঁপিয়ে বলে,
“ধন্যবাদ ম্যাম, আপনাকে ধন্যবাদ… আপনি না থাকলে আমি বোকামি করতাম।”
নওমি চিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটা উপদেশ দেন,”নিজেকে দুর্বল ভেবো না, মনে রেখো তুমি নারী তোমাতে যেমন আটকায় মমতা তেমনি লুকায় বিবৎসাতা।”
চিত্রা উনার কথায় মুচকি হাসে উনার মুখ পানে চেয়ে।ওী বাবা-মা পাশেই ছিলেন, উনারা এই তৃপ্তি দেখছেন মন ভরে। চিত্রা কে ফ্রেশ করে বিদায় দেওয়া হয়।চিএা কে বিদায় দিয়ে নওমি ছিদ্দিকের কাছে এসে বলেন,”ভাইজান, ভিডিও হইছে তো?”
ছিদ্দিক মাথা নাড়িয়ে বলেন,”হইছে।”
চিত্রা যে জামালকে খুন করেছে এটার গোপনে ভিডিও করা হয়েছে। চিত্রা যদি পাল্টি খায়, তাহলে ওকে শেষ করে দেওয়ার জন্য এই ভিডিওই যথেষ্ট।
আদনান এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন,”ভিডিও করার কী প্রয়োজন ছিল?”নওমি নিজের পড়নের চাদরটা মাথায় টানতে টানতে মুচকি হেসে বলেন,”এই স্বার্থের দুনিয়ায় নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করতে নেই কলিজায় কুপ কিন্তু বিশ্বস্তরাই মারে।”
দশটার কাছাকাছি তৌসির খাওয়া শেষ করে রুমে আসে। রুমে পা রাখতেই চোখ পড়ে নাজহার ওপর সে ওয়ারড্রব থেকে কিছু একটা নিচ্ছে, কিন্তু তাকে দেখেই কেমন আচমকা ঘাবড়ে যায়। তৌসির ওকে এমন আচমকা ঘাবড়াতে দেখে তীক্ষ্ণ চোখে নাজহার দিকে তাকায়। এ ঘাবড়ালো কেন? তৌসিরকে দেখে তো নাজহা কখনোই এমন করে না। তৌসিরের মন ওকে শোধিয়ে নেয় “কুচ তো গড়বড় হ্যাঁ মহাজন, নয়তো তোমার বউ তোমারে দেখে এমন ঘাবড়াইতো না।”
নাজহা আসলে এক বিশেষ কাজে ব্যস্ত ছিল, হঠাৎ তৌসিরকে সামনে দেখে খানিকটা ভরকে যায়। চোখ তুলে এক ঝলক তাকায় তৌসিরের দিকে তাকাতেই কিছু একটায় আটকে যায় চাহনি। আজ এই কিপ্টে লোকটাকে বড্ড মোহনীয় লাগছে। একদম রূপশেখরের মতো রূপ ধরে আছে! কালো পাঞ্জাবি আর কালো লুঙ্গিতে মহাভারী, অদম্য সুদর্শন এক পুরুষ লাগছে।
নাজহা তৌসিরের দিকে তাকাতে তাকাতে নিজের হাতে থাকা জিনিসগুলো ওড়নার নিচে গুঁজে নিয়ে তৌসিরকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে মৃদু হেসে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু তৌসিরের চোখ এড়ায় না কিছুই। তৌসির টের পায়, নাজহা খুলেছিল ওয়ারড্রবের সেই দিকটা যেটা তার নিজের। সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে যায়, ওয়ারড্রবে তো লুকিয়ে রেখেছিল কয়েকটা মেথামফেটামিন নামের ড্রাগসের প্যাকেট, যেগুলো এক ক্লায়েন্টের জন্য ভারতে থেকে আনিয়েছে। এক গ্রামের দামই আট থেকে দশ হাজার টাকা ভারি চড়া দামের মাল।
তৌসিরের মুখের রঙ বদলে যায়। কি হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে চিলের মতো দৌড়ে গিয়ে নাজহাকে ঝাপটে ধরে বলে, “ও সিনাল গো! আমার এত টাকা তুই খয়রাত করতে নিসিলি!”
স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১২
তৌসির ওকে ধরতেই নাজহার হাত ফসকে মেথামফেটামিনের ছোট জিপলক প্যাকেটগুলো ফ্লোরে পড়ে যায়। নাজহা নিজেকে ছাড়াতে চিৎকার করে বলে, “আমাকে ছাড়ুন বলছি! আমি এগুলো ফ্ল্যাশ করব।”
এটা শুনে আর এসব দেখে তৌসিরের মুখমণ্ডল লাল হয়ে যায়, কপাল কুঁচকে যায়, দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। মাথার শিরা-উপশিরাগুলোতে কেউ হয়তো নরম লোহা দিয়ে আঘাত করছে এতটা রাগ হতে থাকে তৌসিরের। সে নাজহাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আক্রোশে ভারী ও চাপা গলায় বলে ওঠে,“হারামজাদী খন্নাসনি! আজ তোরে আমি দয়ালের দরবারে দেখাইয়া নিতাম। আইজ তুই থাকবি, নাইলে আমি থাকমু!”
