Death or Alive part 14
priyanka hawlader
সকালের আলো এখনও পুরোপুরি রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়েনি, কিন্তু পারস্যের আকাশে অদ্ভুত এক অস্থিরতা। রাজপ্রাসাদের অলিন্দ থেকে শুরু করে শহরের গলি, মহল থেকে আকাশচুম্বী টাওয়ার—সবখানে যেনো এক ছায়াঘেরা আতঙ্ক। চারদিকে কোলাহল, চিৎকার, জ্বীনদের ফিসফাস আর কানপথ চিরে আসা আতঙ্কের গন্ধ।
প্রাসাদচত্বরে পদচারণ করছে অগণিত জ্বীনযোদ্ধা। তাদের চোখ জ্বলছে ক্রোধে, কণ্ঠে ফিসফাসে একটাই কথা ভেসে আসছে—
“অর্ষা পালিয়েছে।”
এই কথাটি যেন বজ্রাঘাতের মতো আঘাত করেছে রাজ্যের বুকে।
এটা কেবল পালানো নয়—এটা ছিল রাজপ্রথা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং পরাক্রমশালী ওয়াজফানের সম্মানের বিরুদ্ধ এক স্পর্ধা।
অর্ষা ছিল তার বন্দিনী, তার অধিকার, তার রাজহংসী। আর আজ সেই অর্ষা…!
পালিয়েছে?
সাম্রাজ্যের শক্তি আর গৌরবের প্রতীক এই প্রাসাদে, এমন ঘটনা যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না কেউ।
নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে কেউ কি সত্যিই পালাতে পারে?
বাহিরের চিৎকার আর উত্তপ্ত পরিস্থিতির মাঝে একমাত্র ব্যতিক্রম এক পুরুষ।
ওয়াজফান।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তার চিরচেনা অগ্নিদৃষ্টির গভীরে আজ কোনো আগুন নেই, বরং এক ধরণের নিস্তব্ধ ক্ষরণ।
তিনি বসে আছেন, প্রাসাদের সিংহাসন কক্ষে, এক পাথরের মূর্তির মতো স্থির।
কোনো প্রহরী, কোনো মন্ত্রী, এমনকি তার বিশ্বস্ত দেহরক্ষীরাও সাহস করছে না তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার।
ওয়াজফানের চোখ স্থির।
সেই চোখে নেই কোনো বিস্ময়, নেই আতঙ্ক, নেই রাগের প্রকাশ—তবে তার স্থিরতা যেনো এক পূর্বাভাস, এক নিঃশব্দ ঝড়ের ঘনঘটা।
যে ঝড় শুধু ভাসাবে না, গিলে ফেলবে।
তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়া হাহাকার, ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠগুলো যেনো তার কাছে এক নির্বিশেষ শব্দমাত্র।
সে জানে, অর্ষার এই প্রস্থান কোনো হঠাৎ সিদ্ধান্ত নয়।
এটা পরিকল্পনা। এটা অভ্যুত্থান। এটা… বিদ্রোহ।
আর ওয়াজফান?
সে বসে আছেন, মাথা উঁচু করে, ঠোঁটে চাপা একটা হিমশীতল প্রশান্তি নিয়ে।
বাইরের ঝড়ের মাঝে রাজ্যের কেন্দ্রে তিনি—নির্বিকার, নিস্তব্ধ।
যেনো সমুদ্রের গভীরতম তলদেশ, যেখানে ঢেউয়ের কোনো শব্দ নেই, কিন্তু তলদেশে জন্ম নিচ্ছে ভূমিকম্প।
আজ রাজ্য কাঁপছে, কিন্তু ওয়াজফান এখনো কাঁপেনি।
কারণ ওয়াজফান জানে—
এই খেলাটা সে শেষ করবে। নিজের নিয়মে। নিজের শর্তে।
হঠাৎ ধীরে ধীরে আয়রাক কিছুটা সাহস যুগিয়ে বলে উঠলো,
— বাদশা, ওই মেয়েটা পালিয়েছে। আপনি অনুমতি দিলে আমরা যাব, তাকে খুঁজে বের করে ধরে নিয়ে আসবো। আপনি শুধু একবার অনুমতি দিন।
ওয়াজফান মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল, তারপর ঠোঁটে এক তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। কণ্ঠ ছিলো বরাবরের মতোই নির্ভার, অথচ ভয় জাগানো।
তার কোন দরকার পড়বে না।
এই পারস্য রাজ্যে আমার অনুমতি ব্যতীত যেমন কেউ ঢুকতে পারে না, তেমনি আমার অনুমতি ছাড়া এখান থেকে পালিয়ে যাওয়াটাও এতটা সহজ নয়।
এ রাজ্যের পাতাটাও আমার অনুমতিতে চলে আর এত বড় কোহেকাফ পাহাড় থেকে ওর মত দুর্বল মানব কন্যা পালাবে এটা ওর বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।
সে এক পা এগিয়ে এল, জানলার বাইরে অন্ধকার জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
— ও পালিয়েছে? ওকে একটু বাহিরটা ঘুরে আসতে দাও।
ও নিজেই বুঝে যাবে… আমি না চাইলে আমার রাজ্য থেকে কেউ যে পালিয়ে যেতে পারে না।
তার চোখ জ্বলতে লাগল ভয়ঙ্কর ভাবে,
— আমি জানি এই জঙ্গলটা কতটা ভয়ঙ্কর। সেটা ও খুব শিগগিরই বুঝে যাবে।
ও নিজে থেকে পালিয়েছে, দেখবে… কিছুক্ষণ যাক,
এই জঙ্গলের ভয়ংকর মজাটা নিয়ে নেক।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াজফান জোর দিয়ে বলল,
আমার কাছ থেকে পালিয়ে… ও কোথায় যেতে পারবে?
সে আমার কাছে, ওকে ফিরে আসতেই হবে।
দেখে নিও।
আর মনে মনে বলে পালিয়েছো লিটল মনস্টার কিন্তু যখন ফিরে আসবে এবারের শাস্তিটা এমন হবে যে তোমার রুহ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে।
জঙ্গলের গহীনে দৌড়াচ্ছে অর্ষা।
তার চোখেমুখে আজ অদ্ভুত এক প্রশান্তির ছাপ।
সেই উদার সবুজের মাঝে, যেন তার মনে লুকিয়ে থাকা পাখিটা ডানা মেলেছে।
হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে সে ধন্যবাদ জানাচ্ছে একজনকেই।
সে—যার জন্য আজ এই মুক্তির স্বাদ।
অল্প কিছুক্ষণ আগেই…
অর্ষা বসেছিল জ্যাইমের সাথে। দীর্ঘক্ষণ ধরে দু’জনের মধ্যে চলছিল কিছু মন খোলা আলাপ।
তবে আজ অর্ষার চোখে ছিল এক অন্য রকম ব্যাকুলতা, আর সেই ব্যাকুলতাই ধীরে ধীরে ঠাঁই পেল তার কণ্ঠে।
অর্ষা হঠাৎ করেই অনুরোধ করে বসে,
আমার আর এখানে বন্দি হয়ে থাকতে ভালো লাগছে না, জ্যাইম।
এই জায়গাটা যেন আমার নিঃশ্বাস আটকে দিচ্ছে।
দেখো, বাহিরের প্রকৃতি কত সুন্দর!
আকাশটা নীল, বাতাসটা মুক্ত।
কিন্তু আমি যেতে পারি না… চেষ্টা করলেই শক্ত এক দেয়ালে আটকে যাই।
তুমি যদি একটু অনুমতি দাও… আমি শুধু একটু বাইরে যেতে চাই, একটু হাঁটতে চাই…
পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে একটু নিঃশ্বাস নিতে চাই।
একটুখানি স্বাধীনতা… শুধু কিছুক্ষণ, কথা দিচ্ছি, ফিরে আসব।”
তার চোখে তখন এক শিশুর মত অনুরোধ—
যেন ছোট্ট একটা পাখি তার খাঁচার দরজায় ঠুকরে বলছে, “একটুখানি আকাশ, একটু ওড়ার সুযোগ দাও।”
জ্যাইম অর্ষার কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তারপর একটু গম্ভীর কণ্ঠে, তবে ভ্রাতৃত্বসুলভ স্নেহে ভরা সুরে বলে ওঠে,
— “দেখো অর্ষা, তোমাকে এখানে এনেছে আমার দা’ভাই। তার অজানায় যদি আমি তোমাকে বাইরে যেতে দিই, তাহলে সে সেটা মোটেই ভালোভাবে নেবে না। তার রাগ তুমি চেনো না, আমি তো আরো ভালো করে জানি। আমি চাই না তার বিশ্বাসভঙ্গ হোক আমার কারণে।”
অর্ষা একটু ঘাড় নিচু করে, যেন নিজের অন্তর থেকে আবেগ গুলোকে টেনে তোলে। কণ্ঠস্বর নরম হয়ে আসে, কাকুতি-মিনতির আভায় মোড়া। সে বলে,
— “প্লিজ, জ্যাইম… তুমি তো আমাকে বোঝো। আমি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না। আমি শুধু একটু ঘুরে আসতে চাই, কিছু সময়ের জন্য… দা’ভাই তো এখন কাজে ব্যস্ত। তিনি জানতেই পারবেন না আমি বাইরে গিয়েছিলাম। আমি তার ফিরে আসার আগেই আবার ফিরে আসব। বিশ্বাস করো… শুধু একটু হাওয়া বদল দরকার আমার। প্লিজ, আমাকে একটিবার যেতে দাও।”
জ্যাইমের চোখে কিছুক্ষণের জন্য একটি দ্বিধা খেলা করে। একদিকে ভাইয়ের কঠিন রাগ, অন্যদিকে অর্ষার অসহায় মিনতি—সে দোটানায় পড়ে যায়।
এবার অর্ষার চোখে অনুনয়ের জলের রেখা।
অবশেষে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে জ্যাইম মাথা হেঁট করে বলল,
— “আচ্ছা, ঠিক আছে… কিছুক্ষণের জন্য তোমাকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিলাম। তবে মনে রেখো, ভুল করেও পালানোর চেষ্টা করো না। এখানে থাকা যত কঠিন, এখান থেকে পালানো তার চেয়েও কঠিন। তুমি ভাবছো হয়তো সুযোগ পেলেই পালাবে, কিন্তু সেটাই সবচেয়ে বড় ভুল হবে। আমি তোমায় বিশ্বাস করে বাইরে যেতে দিচ্ছি— দয়া করে আমার বিশ্বাসটাকে ভাঙো না।”
অর্ষার মুখে আলো ছড়িয়ে পড়ল। সে এক পবিত্র আনন্দে ভরে উঠল, যেন বহুদিনের বন্দিত্বে একটু আলো ও হাওয়ার স্পর্শ পেতে চলেছে।
সে কোমল কণ্ঠে বলল,
— “তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো জ্যাইম। আমি এরকম কিছুই করব না। তোমার বিশ্বাস আমি ভাঙবো না । আমি সত্যিই শুধু একটু বাইরে যেতে চাই। আচ্ছা, তাহলে আমি এখন যাই? ( যদিও অর্ষা মনে মনে ভাবে আমাকে মাফ করে দাও আমাকে এই ছলনাটা করতেই হবে এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য)
জ্যাইম নীরবে সম্মতি জানাল।
অর্ষা ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল, অথচ মনে রয়ে গেল জ্যাইমের সেই শেষ কথাগুলো— বিশ্বাস, পালানো, আর অনুরোধ।
বাতাসে তখন সন্ধ্যার নরম ছোঁয়া, আকাশে মিশে থাকা কিছু অধরা ইচ্ছা।
অর্ষা ধীরে ধীরে দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জ্যাইম তখনো দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়নি। কপালে তার চিন্তার ভাঁজ, চোখে এক ধরনের অপরাধবোধ—তবুও সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, হয়তো ভেবে নেয় যে অর্ষার একটু মুক্ত বাতাস পাওয়ার অধিকার আছে।
দরজা খুলতেই বাইরের নিঃশব্দ প্রহর যেন হঠাৎ করে এক নতুন ব্যঞ্জনায় ধ্বনিত হলো। বিকেলের নরম আলো আকাশকে রঙিন তুলোর মতো করে সাজিয়েছে। দূরে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়ের ঢেউ, কাছের সবুজ গাছগুলোর মাথায় সূর্যের আলতো ছায়া, আর পায়ে পড়ে থাকা নুড়ি-পাথরের ছোট রাস্তাটা—সব মিলিয়ে এক স্বপ্নঘোর পরিবেশ।
অর্ষা পা ফেলে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। তার চোখে আজ অনেকদিন পর নতুন একটা আলো। এতদিনের বন্দিত্বের পর এই অল্প একটু মুক্তির স্বাদ যেন তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে যায় এক অদ্ভুত প্রশান্তির মতো।
সে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে—রোদ আর ছায়ার খেলায় জমে থাকা একটা মায়াবী জগত। হালকা বাতাস তার চুলে খেলে যায়, যেন প্রকৃতি নিজেই তাকে স্বাগত জানায়।
একটু সামনে গিয়ে সে মাথা উঁচু করে শ্বাস নেয়। গাছে গাছে ফুটে থাকা ফুলগুলো থেকে এক অচেনা, অথচ মাতাল করা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। সে সেই গন্ধ গভীরভাবে টেনে নেয় ফুসফুসে, তারপর চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু সময়। যেন এই মুহূর্তটার মধ্যে হারিয়ে যেতে চায় সে, যেন এই শান্তির পরশ তার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের উপর নরম তুলোর মতো বসে প্রশমন দিচ্ছে।
একটা লাল রঙের ছোট ফুল তুলে নেয় সে, তারপর তাকিয়ে থাকে তার রঙে। “কতদিন হয়ে গেল এইরকম একটা দৃশ্য আমি দেখিনি…” মনের ভেতরে একটি দীর্ঘশ্বাস বয়ে যায়।
পেছনে তখনও দাঁড়িয়ে জ্যাইম, জানালার পাশ দিয়ে তাকে দেখছে। চোখে তার মিশ্র অনুভূতি—ভয়, দুশ্চিন্তা আর খানিকটা সান্ত্বনার। হয়তো ভেবেছিল অর্ষা পালিয়ে যাবে। কিন্তু না—এই মুহূর্তে অর্ষার চোখে পালানোর আগ্রহ নেই। এই মুহূর্তটা সে কেবল উপভোগ করতে চায়।
প্রজাপতির মতো হালকা পদক্ষেপে অর্ষা আরও একটু এগিয়ে যায় বাগানের দিকে। হাতে ধরা ফুলটা সে নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নেয় আবার, মুখে একটি হালকা হাসি খেলে যায়—যা অনেকদিন তার মুখে ছিল না।
ঠিক এই মুহূর্তেই মনে হয়, সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে কিছুটা। জীবনের সকল তীব্রতা, সব অশান্তি, সব যন্ত্রণা যেন কিছুখনের জন্য হলেও এই শান্ত বিকেলের আলো আর ফুলের সুবাসে মিলিয়ে যায়।
দূরে কোথাও একটা পাখি ডাকে। অর্ষা তাকায় আকাশের দিকে। সেই দৃষ্টিতে কিছু ছিল—মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, জীবনের খোঁজ, কিংবা হয়তো পুরনো সেই হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোর ক্ষীণ ছায়া।
তবে তার জানা নেই, এই সামান্য মুক্তির পেছনেও অনেক বড় ঝড় অপেক্ষা করে আছে ভবিষ্যতের কোনো কোণে।
কিন্তু আজ? আজ অর্ষা কেবলমাত্র কিছুটা মুক্ত বাতাস নিচ্ছে। আজ সে কেবল কিছুটা বাঁচতে চায়।
জ্যাইম দূর থেকে চুপচাপ দেখছিল তাকে। অর্ষার চোখেমুখে ছিল একধরনের প্রশান্তি, কিন্তু তার গভীরে লুকিয়ে ছিল এক গভীর বেদনা, এক ব্যাকুলতা—মুক্তির। কয়েক মুহূর্ত পর জ্যাইম নিরবেই চলে যায় তার কাজে, নিঃশব্দে সরে যায় যেন অর্ষার একাকিত্বকে সম্মান জানাতে।
আর ঠিক তখনই অর্ষার চোখে ভেসে ওঠে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য—একটি ফাঁকা রাস্তা, কিছুটা দূরে ছোট একটি ঢালু পথ যা জঙ্গলের দিকে হারিয়ে গেছে। মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় অর্ষা, এরপর হঠাৎ করেই দৌড়াতে শুরু করে। বুকভরা সাহস, চোখভরা মুক্তির স্বপ্ন।
তাঁর প্রতিটি পা যেন জমিনকে বিদীর্ণ করে এগিয়ে যাচ্ছে অজানার পথে। পেছনে ফেলে আসছে ভয়, বন্দিত্ব আর অবরুদ্ধ শ্বাস। পাখিরা আশ্চর্য চোখে তার দৌড় দেখা বন্ধ করে দেয়, গাছের পাতা থেমে যায় নড়াচড়া করা। অর্ষা ছুটে চলেছে প্রাণ খুলে, প্রাণপণে। তার বুকের ভেতর স্পষ্ট শব্দে ধ্বনিত হচ্ছে—”আজই সুযোগ, আজই মুক্তি!”
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুটে চলা অর্ষার গায়ে ঘাম জমছে, পা কাঁপছে, কিন্তু থামার কোন লক্ষণ নেই। তার চোখে এখন একটাই দৃশ্য—স্বাধীনতা। হোক না বিপদ, হোক না ধরা পড়ার ভয়, আজ সে থামবে না।
এই ছোট্ট মুক্তির স্বাদই যেন তাকে নতুন করে বাঁচার শক্তি দিল।
এভাবেই ঝড়ের গতিতে দৌড়াতে দৌড়াতে অর্ষা মিলিয়ে যায় ঘন জঙ্গলের সবুজ ছায়ায়…
বর্তমান,
অর্ষা দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে। শরীর ভার হয়ে আসছে, বুকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে ধকধক করছে। তবু থেমে যেতে পারছে না। শেষ মুক্তির আশাতেই আজ সে প্রাণপণে ছুটছে। কিন্তু এবার আর শরীর সায় দিচ্ছে না। একটুখানি বিশ্রামের জন্য সে থেমে দাঁড়াল। দু’হাত হাঁটুতে রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে শ্বাস নিতে নিতে তাকাল চারদিকে।
চারপাশটা যেন নিঃসীম। শুধুই ঘন জঙ্গল। গা ছমছমে নীরবতা। পাখির ডাক পর্যন্ত যেন থেমে গেছে। আশেপাশে কোথাও কোনও পথের চিহ্ন নেই—না মানুষের পায়ের ছাপ, না কোনও খোঁড়ার দাগ। শুধু সবুজ আর সবুজ, আর তার মাঝে সে একা, বিভ্রান্ত। এক মুহূর্তে তার মনে হলো, সে বুঝি একটা বিশাল গোলকধাঁধায় আটকে পড়েছে। এ জঙ্গল থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও পথ যেন নেই। একেকবার মনে হয়, এই দিকটাই হয়তো ঠিক। আবার ঘুরেফিরে আসে সেই একই জায়গায়, একই গাছ, একই গন্ধ, একই অন্ধকার।
তারপরও থেমে গেলে চলবে না। বুকের মধ্যে ভয় জমতে জমতে ভার হয়ে উঠছে, কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। সে আবার দৌড়াতে শুরু করল। ঝোপঝাড় ঠেলে, ডালপালা পেরিয়ে, পায়ের ঘাসে রক্ত লেগে গেলেও থামার উপায় নেই। যতক্ষণ প্রাণ আছে, দৌড়াতে হবে… কারণ এই জঙ্গলই হয়তো তার কবরখানা হয়ে উঠবে—যদি আজ না পালাতে পারে।
অনেকক্ষণ ধরে নিরন্তর দৌড়ে চলেছে অর্ষা। জঙ্গলভরা এই অচেনা পৃথিবীতে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সে শুধু ছুটেছে—জান না বাঁচানোর এক অস্ফুট তাগিদে। গাছপালা, ঝোপঝাড় আর কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের নিচে সে যেন এক ক্ষুদ্র প্রাণী, যার ওপর সর্বদা ভর করছে বিপদের ছায়া।
হঠাৎ হাঁপিয়ে গিয়ে থেমে যায় সে। এক বিশাল ছাতার মতো ছায়া দেওয়া গাছের নিচে বসে পড়ে ধীরে। বুকটা ওঠানামা করছে দম ধরে রাখার ক্লান্তিতে। কপাল ভিজে উঠেছে পরিশ্রম আর আতঙ্কের ঘামে।
নিজেকে জড়িয়ে ধরে সে ফিসফিস করে,
“হয়তো… হয়তো আমি আর কখনোই এখান থেকে বের হতে পারব না… বারবার একই রাস্তায় ফিরে যাচ্ছি…”
তার চোখ পড়ে পাশের ঝরনার দিকে। ওই পানি তো সে কিছুক্ষণ আগেই দেখেছে!
“এই ঝরনা… এখানেই তো আমি এসেছিলাম কিছুক্ষণ আগে… আমি ঘুরেফিরে আবার এই জায়গাতেই চলে এসেছি!”
চোখে জল জমে আসে হাল ছেড়ে দেওয়ার অচেনা এক বিষণ্নতায়। ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনে হল, আশপাশের বাতাসটা থমকে গেছে। চারপাশের পাখিদের ডাকও যেন হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে গেছে।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে মুখ তোলে। আর সেখানেই থমকে যায় তার নিঃশ্বাস।
তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক দৈত্যাকার পাখি—এত বিশাল, যেন আকাশেরই এক টুকরো নেমে এসেছে মাটিতে। তার পাখাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে, চোখ দুটো রক্তমাখা শোলার মতো জ্বলছে, আর ধারালো ঠোঁট যেন এক থাবায় হাতিকেও টুকরো করে ফেলতে পারে।
অর্ষা দাঁড়াতে চায়, কিন্তু পা যেন জমে গেছে মাটিতে। সে বোঝে, সে এখন এই দানব পাখিটার সামনে এক অক্ষম, তুচ্ছ প্রাণ।
পাখিটি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে। তার চঞ্চু তুলে নেয় আক্রমণের ভঙ্গিতে—যেন এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে, গিলে ফেলবে তাকে নিঃসংশয়ে।
অর্ষা চোখ দুটো শক্ত করে বন্ধ করে ফেলে, ভয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়, যেন তাতে কিছু রক্ষা মিলবে…
পাখিটা তার বিশাল ঠোঁট তুলে অর্ষার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার মুহূর্তে হঠাৎ থমকে যায়। তার চোখের দৃষ্টি একলাফে কোথাও স্থির হয়ে থাকে, যেন কোনো ভয়ঙ্কর ছায়া তার চেতনায় ছুরির মতো বিদ্ধ হয়েছে।
অর্ষা ভয়ে চোখ বন্ধ করেছিল। কিন্তু পাখিটার আঘাত না আসায়, সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়।
সামনের সেই ভয়াল পাখিটা এক দৃষ্টিতে কিছু একটা দেখছে—চোখে আতঙ্ক। সে ধীরে ধীরে পেছাতে শুরু করে। এরপর তার ডানাগুলো এক ঝটকায় বিশাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, আর সে ঘন বাতাস কাঁপিয়ে উড়ে যায়… নিঃশব্দে… যেন শিকার নয়, প্রাণ বাঁচিয়ে পালাচ্ছে।
অর্ষার কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে ভেসে আসে ফিসফিস একটা প্রশ্ন, “কী দেখল ও…?”
তার বুকের ভেতরে তখনো ধুকপুক করছে। ভয় আর কৌতূহলের মাঝে সে যেন ঘোরের মতো ভাবছে—এই প্রাণরক্ষা হঠাৎ কেন?
এক পা পেছনে ঘুরে দেখার জন্য সে যতই সাহস সঞ্চয় করছে, ততই হঠাৎ চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে আসে। হাওয়ার আওয়াজ থেমে যায়। শুধু তার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়।
ঠিক তখনই—
এক জোড়া শক্ত বাহু পেছন থেকে তাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে।
ঠান্ডা গলায় তার কানে কানে কেউ ফিসফিস করে বলে ওঠে—
“I caught you… little monster.”
ওই কণ্ঠটা—
অর্ষার সারা শরীর কেঁপে ওঠে। সেই ভয়ানক শীতল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে চেনা কণ্ঠ। তার রক্তে যেন কেউ বরফ ঢেলে দিল।
সে জানে…
কে পিছনে আছে।
সে জানে…
কে তাকে আজ মৃত্যু থেকে বাঁচালো, অথচ হয়তো পরমুহূর্তেই নিজ হাতে—
—মেরে ফেলবে।
অন্ধকার যেন ঘন হয়ে আসে। চোখে মুখে হাওয়া লেগে যায়, হৃদয়ে জমে ওঠে ভয়, রক্তে ঢেউ তোলে রহস্য।
ওয়াজফান হঠাৎই অর্ষার কাঁধে হাত রেখে তাকে ঘুরিয়ে নিজের মুখোমুখি করে দাঁড় করায়। তার ঠান্ডা অথচ গভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছোঁড়ে—
“হয়ে গেছে তোমার এই ভয়ংকর জঙ্গল দেখা? কেমন ফিল হলো? এখনো পালানোর চিন্তা মাথায় আছে? না কি বুঝে গেছো, এই জঙ্গল থেকে পালানো অসম্ভব?”
তার চোখে লাল আভা, ঠোঁটে হালকা বিদ্রূপ। অর্ষা একটু ঘাবড়ে যায়, কিছু বলার আগেই ওয়াজফান আবার বলে ওঠে,
“চাও তো, এই পাখিটার সঙ্গে যেতে পারো। রোপ বার্ড… দেখেছো আগে?দেখবেই বা কি করে এটা শুধু এই জঙ্গলে কোহে কাফ পাহাড়েই থাকে। এটা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। ও ইচ্ছে করলেই একটা হাতিকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে, তো তুমি তো তুচ্ছ এক মানবী। রেখে দিলেই নিয়ে যাবে।
অর্ষা তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে, গলার স্বর কাঁপছে—
“না না! আমি যাব না ওর সাথে… আমি থাকবো… তোমার সাথেই।
তার উত্তর শুনে ওয়াজফানের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় এক হাসি খেলে যায়। একটিও কথা না বলে হঠাৎই অর্ষাকে কোলে তুলে নেয়। চমকে উঠে সে, কিছু বলতে যাবে, তার আগেই বিশাল কালো ডানাগুলো ছড়িয়ে পড়ে পিঠের দু’পাশে— অন্ধকার আকাশ চিরে উড়ে চলে প্যালেসের দিকে।
আকাশে উড়ে চলেছে তারা… অর্ষা নিশ্চুপ। ওয়াজফানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে সে শুধু তার মুখটা দেখতে থাকে। এত শক্তিশালী, এত রহস্যময় অথচ চোখে যেন এক ধরনের শূন্যতা। সেই শূন্যতার গভীরে অর্ষা হারিয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য।
‘এই দানবটা কি আমায় কষ্ট দেওয়ার জন্যই নিয়ে এসেছে? তাহলে কেন বাঁচালো তখন? নীচে ফেলে দিলেই তো হয়ে যেত… তবে কি আরও ভয়ংকর শাস্তির জন্য বাঁচিয়ে রাখলো?’
তার বুকের ধ্বনিতে ধুকপুকুনি স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, যেন প্রতিটি শব্দ হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে তাকে।
ওয়াজফানের চোখ একদম লাল। এটা শুধু তার মনের সুন্দর লাল না এটা যে রাগে লাল সেটা বুঝাই যাচ্ছে। অর্ষা বুঝতে পারে— ওর ভিতরে এখন চলছে কোনো এক ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত… হয়তো আজ রাতটাই তার শেষ রাত।
কিন্তু শাস্তি দিলেও প্রাণে বাঁচালো … তাহলে? ওর চোখে কি একটুও দয়া আছে? নাকি সেটা ছিল কেবল এক ভয়ঙ্কর খেলোয়াড়ের নতুন চাল?
ওয়াজফান প্যালেসে প্রবেশ করেই একটিও কথা না বলে অর্ষাকে তার কোল থেকে নামিয়ে দেয়। অর্ষা ধীরে ধীরে নিচে দাঁড়ায়, চোখ সরু করে দেখে, তাদের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাইম।
জ্যাইমের মুখ থমথমে। তার চোখে একরাশ হতাশা, ও অবিশ্বাস। আর অর্ষা—সে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এতক্ষণ দমবন্ধ করা ভয়, এখন রূপ নিয়েছে অপরাধবোধে। সে জ্যাইমের দিকে একবার তাকাতে চায়, কিন্তু সাহস হয় না। সে জানে, বিশ্বাসভঙ্গ করেছে সে।
জ্যাইমও কিছু বলে না। শুধু মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে, যেন কিছু না দেখলেই ব্যথা কম হবে।
অর্ষা ধীরে পা বাড়িয়ে নিজের কক্ষে ফিরে যেতে চায়, ঠিক তখনই পেছন থেকে ওয়াজফানের ঠান্ডা কিন্তু শাণিত কণ্ঠ তার শরীর কাঁপিয়ে তোলে—
“কোথায় যাচ্ছ লিটল মনস্টার? নিজের শাস্তিটা তো নিয়েই যাও।”
বলেই, সে অর্ষার কবজি শক্ত করে ধরে এক টানেই নিয়ে যায় প্যালেসের এক রহস্যময় স্থানে—এক অন্ধকার প্রাচীরঘেরা চেম্বারে। ঘরের একপাশে জ্বলছে অগ্নিকুণ্ড, আর মাটির ওপরে লালচে গরম লাভার মতো জ্বলন্ত কয়লা বিছানো। তার ঠিক মাঝখানে গিয়ে অর্ষাকে দাঁড় করিয়ে দেয় ওয়াজফান।
অর্ষা চমকে ওঠে। কিন্তু এর আগেই তার পা ছুঁয়ে ফেলে সেই জ্বলন্ত মাটিকে। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের পাতা যেন ছ্যাঁকা খেয়ে লাল হয়ে ওঠে। সে কেঁপে ওঠে ব্যথায়। কিন্তু তার মুখ থেকে একটি শব্দও বের হয় না।
ওয়াজফান ঠান্ডা গলায় বলে—
“এখান থেকে নড়লেই এর থেকেও ভয়ংকর শাস্তি পাবে।”
তারপর সে স্থির দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকে।
অর্ষা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে থাকে সেই পুড়তে থাকা যন্ত্রণা। শরীর তার কাঁপছে, কিন্তু মুখ দিয়ে একটাও শব্দ বের করে না। শুধু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। সেই নিরব কান্না যেন আরও বেশি চিৎকার করে।
জ্যাইম দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে আর থাকতে পারে না। সে এগিয়ে আসতে চায়, কিন্তু ঠিক তখনই ওয়াজফান তার দিকে তাকায় এমন এক দৃষ্টিতে—যেখানে আছে অগ্নিকাণ্ডের মতো রাগ আর হিমশীতল হুঁশিয়ারি।
জ্যাইম থমকে যায়। ঠোঁট কামড়ে ধরে, চোখ ঘুরিয়ে নেয়, আর তারপর ধীরে ধীরে চলে যায় সেই স্থান থেকে।
অর্ষা একা দাঁড়িয়ে থাকে জ্বলন্ত শাস্তির মধ্যে, কেবল চোখ দিয়ে গড়ানো সেই নীরব জলই তার যন্ত্রণা প্রকাশ করে।
অর্ষা সেই ভয়ংকর শাস্তি আর সহ্য করতে না পেরে অবশেষে নিথর হয়ে পড়ে। শরীরটা নিস্তেজ, নিঃশ্বাস ভারী আর মলিন। ঠিক তখনই ওয়াজ ফান তার দিকটা এগিয়ে আসে—চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি। রাগ আর যন্ত্রণার মাঝখানে এক অসম্পূর্ণ ব্যথার ছায়া।
“মানবী…!” তার ঠোঁট ফিসফিস করে ওঠে।
তাকে দেখে মুহূর্তেই তার অন্তরটা কেঁপে ওঠে। এতক্ষণ যে মেয়েটি তার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, এখন সে নিঃশব্দ, নিস্পন্দ।
ওয়াজ ফান দ্রুত এগিয়ে গিয়ে অর্ষার নিথর দেহটা নিচে পড়ার আগেই নিজের বাহুতে জড়িয়ে নেয়। তার কোলে অর্ষা যেন আরও বেশি ভঙ্গুর, আরও বেশি মানবীয় লাগে। সে নিজ হাতে তাকে নিজের রুমে নিয়ে যায়—সেই প্রাসাদের সবচেয়ে গোপন কক্ষে, যেখানে অন্য কেউ প্রবেশ করে না।
বিছানায় তাকে শুইয়ে দেয়। একবারও চোখ সরায় না তার মুখ থেকে।
তার বুকটা হঠাৎ করেই চেপে আসে।
“তুমি কি করছো আমার সাথে, মানবী?” ফিসফিস করে বলে ওঠে সে।
“তোমার কষ্ট… আমার শাস্তি হয়ে দাঁড়ালো কী করে?”
তার আঙুলে ঝলসে ওঠে অন্ধকার নীল আগুন—তার জাদুশক্তি। ধীরে ধীরে সে অর্ষার পায়ের ক্ষতগুলোর ওপর হাত রাখে, আর ফিসফিস করে প্রাচীন ভাষায় কিছু মন্ত্র পাঠ করে। ক্ষতগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকে, যেন কিছুই হয়নি।
তবু অর্ষার জ্ঞান ফেরে না। নিঃশব্দে সে শুয়ে থাকে, চোখদুটি বন্ধ, মুখে ক্লান্তির রেখা।
ওয়াজ ফান কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে অর্ষার মুখে।
এই মুখটা কি তার দুর্বলতা হয়ে উঠছে?
হঠাৎ সে চোখ সরিয়ে নেয়, যেন নিজের অনুভূতিকে অস্বীকার করতে চাইছে। ধীরে ধীরে সে পেছন ফিরে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করে।
কিন্তু ঠিক বেরিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে সে আবার একবার ফিরে তাকায়।
নিঃশব্দে বলে ওঠে,
“তোমার শরীর ঠিক করে দিলাম, কিন্তু আমার ভেতরের যন্ত্রণা… কে সারাবে মানবী?”
তারপর নিঃশব্দে দরজা খুলে সে বেরিয়ে যায়, আর রুমটা আবার নেমে যায় গভীর নীরবতায়।
রাত গভীর। চাঁদের আলো জানালার কাচ ছুঁয়ে পড়েছে অর্ষার চোখে-মুখে। সে চুপচাপ বসে আছে জানালার পাশে, ঠান্ডা হাওয়ায় তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ছে। চোখ দুটি তার অদ্ভুত ক্লান্ত—অথচ তীব্রভাবে জেগে।
হঠাৎই রুমের দরজা ধীরে ধীরে খুলে যায়। ভারী কিন্তু নরম পায়ের শব্দে অর্ষা বুঝে ফেলে—এই গন্ধ, এই উপস্থিতি… এটি আর কেউ নয়, ওয়াজফান।
সে কিছু না বলেই ঘরে ঢোকে। চারপাশটা যেন আরও গাঢ় হয়ে আসে।
অর্ষা ধীরে ধীরে বলে ওঠে,
“আমি তো কোন পাপ করিনি… তবে আপনি আমাকে কেন বন্দি করে রেখেছেন? আমার দোষটা কী? আমি তো কালো জাদু পারি না, আমি তো এসব বিশ্বাসও করতাম না। আমি ছিলাম একটা মেডিকেল স্টুডেন্ট, বাস্তববাদী, যুক্তিবাদী। আমি জ্বীনকে বিশ্বাস করতাম না—যদি না আপনাকে নিজের চোখে দেখতাম। দয়া করে… আমাকে আমার দুনিয়ায় ফিরে যেতে দিন।”
ওয়াজফানের ঠোঁটে হালকা এক বাঁকা হাসি খেলে যায়।
“এতটুকুতেই হার মেনে নিলে? আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি অনেক সাহসী। কোথায় গেল সেই সাহস, লিটল মনস্টার ?
তার কথায় হালকা কটাক্ষ, কিন্তু চোখে গভীর কিছু অন্য রকম দৃষ্টি।
অর্ষা এবার গর্জে ওঠে।
“সাহস তো আমার কোনদিনও কমে না! কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না—আপনার কাছে যা খেলা, তা আমার পুরো জীবন। আমি খেলনার মতো বাঁচতে চাই না! আমার অধিকার আমার জীবন… সেটা আপনি কেড়ে নিতে পারেন না। আমি এই খেলার পাত্র না!”
Death or Alive part 13
তার গলা কেঁপে ওঠে। চোখে জল, কিন্তু সেই জলও সাহসিকতার প্রতীক।
ওয়াজফান সঙ্গে সঙ্গে তার চুলের মুঠি ধরে নিজের দিকে টেনে নেয় অর্ষাকে। তার চোখে তখন অদ্ভুত এক আগুন, কাঁপা কাঁপা নিঃশ্বাসে ওয়াজফান ঝুঁকে পড়ে, কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় অর্ষার ঠোঁটে। মুহূর্তেই অর্ষার দেহ শিথিল হয়ে আসে, বিস্ময়ে, ভয়ে আর একরাশ অজানা আবেগে সে স্তব্ধ হয়ে যায়। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় তাদের নিঃশ্বাসের টানাপোড়েনে।
