শেহজাদী পর্ব ২২ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ২২
Arishan Nur

মিরা চোখ-মুখ খিঁচে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সে এতোটাই নির্বোধ বনে গেছে যে পায়ে হেঁটে দু কদম পিছিয়ে যাওয়ার বুদ্ধিটাও আর মাথায় নেই। এইজন্যই লোক মুখে প্রচলিত আছে, বিপদ পড়লে মাথা কাজ করেনা। প্রচলিত বাণীটি পুরাপুরি ভুল নয়। মিরার বেলায় খেটে গেল যে!
পাশে কোথাও ঘুঘু ডাকছে। শিরশির করে বাতাস বইছে। বাতাসের ঝাপ্টা শরীরে লাগতেই গা কাঁটা দিয়ে উঠে তার। আচমকা কারো শীতল স্পর্শে ভয় পাওয়া মনে আরো ভয় লেগে গেল তাত । ডান বাহু বরাবর অত্যাধিক শীতল কোন হাত তাকে ছুঁয়েছে। কে সে? যমদূত?

ট্রাক তার সামনে চলে এসেছে। মিরা আঁতকে উঠে। কতোক্ষণ কেটে গেল সে জানে না। তার যখন ঘোর কেটে, বাস্তবতায় ফিরে এলো, তখন কেউ তাকে পাজকোলে তুলে নিল। মিরা চেঁচিয়ে উঠে।
কেউ একজন তাকে ধমকে বলে, মরতে যখন বসেছিলে, তখন পিন ড্রপ সাইলেন্স আর বাঁচাতে আসলাম, তখন ডাকাত পড়া চিৎকার দিচ্ছো কেন? চুপ একদম চুপ!
মিরা পিটপিটিয়ে চোখ খুলে তাকিয়ে সেই চেনা পরিচিত মুখ টা দেখতে পেল। আহা! শান্তি! যাক এই যাত্রায় রক্ষা পেল সে। মিরা বুক ফুলিয়ে আরামের শ্বাস নিল। তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।
ইমান তাকে কোলে নিয়েই রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ালো এবং কোল থেকে নামিয়ে বলে, মিরা তুমি যে পাগল এটা কি তোমার জানা আছে?

মিরা শুনলো কিনা কে জানে? সে মাথা ঝাকালো, যার অর্থ সে জানে, সে পাগল।
এতো এতো জটিল পরিস্থিতিতে থাকা সত্ত্বেও ইমান হেসে ফেললো। তারপর নিজেকে শান্ত করে, মুখে অতিরিক্ত গাম্ভীর্যতা এনে বলে উঠে, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নৃত্যচর্চা করছিলে?
মিরা হতভম্ব হয়ে বলে, আমি রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলাম?
— আল্লাহ যে চোখ দিয়েছে দুইটা সেই চোখ দুটো কাজে লাগাও।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মিরা মুখ ফুলিয়ে আশেপাশে তাকিয়েই আঁতকে উঠে। হায় কপাল! সে তো হাইওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রাস্তা ফাঁকা। ভীষণ বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। যানবাহন নেই বললেই চলে। কখন এতোদূর চলে এলো সে। হোটেল থেকে হাইওয়ে একঘন্টার মতো দূরত্ব! গুগল ম্যাপে সো করছিল, মিরা খেয়াল করেছিল! এতো দূর রাস্তা সে একা একা হেঁটেছে? অবশ্য মিরার হাঁটতে দারুণ লাগে। সিডনিতে মর্নিং ওয়াকে প্রায় এক ঘন্টাই তো হাঁটা হতো তার!

মিরা রাস্তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইমানের দিকে তাকালো। ছেলেটা ঘেমে জুবুথুবু। নিশ্চয়ই ভয়ে ঘেমে গেছে!
মিরা প্রশ্ন করলো, আপনি এখানে কি করছিলেন? কাজে এসেছিলেন?
ইমান ঘাবড়ে গেল। মিরাকে কিভাবে বলবে সে? যে তাকে ফলো করে, তার পিছু এসেছে? ইমান সিগারেট কেনার জন্য হোটেলের পাশের দোকানে গিয়েছিল। দুই প্যাকেট সিগারেট কিনে ফেরার সময় চোখ গেল লাল টকটকে শাড়ি পরিহিতা রমণীর উপর। চুলে খোপা। খোপায় ঝুনঝুনি লাগানো কাটা। ইমান অপলক চেয়ে রইল এবং উপলব্ধি করলো এটা সেই রমণী যাকে সে ঘৃণা করতে চায়!

মিরাকে একা একা আপন মনে হেলেদুলে মুখে কিছু বিড়বিড় করতে করতে হেঁটে যেতে দেখে আগ্রহ বাড়ে তার। কিছু না ভেবেই মিরার পিছু নেয় আর মিরা বোকা বোকা কর্মকাণ্ড দেখে হেসে কুটকুট সে!
মিরা তো হাত নাড়িয়ে একা একা কথাও বলছিল। একটা পর্যায়ে ইমানের মনে হচ্ছিল, মিরা ড্রিক করে হাই হয়ে গেছে! ওওয়েস্টার্ন দেশে ড্রিক করা খুব নরমাল। মিরার ও এই অভ্যাসটা গায়ে লেগে যেতে পারে! এইজন্য পুরা ব্যাপারটা বোঝার জন্য সে মিরাকে ফলো করে।

এরপর আচমকা মিরা গলা ছেড়ে গান ধরলো এবং বেশ জোরে জোরে হাঁটা শুরু করে মেইনরোডের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো।
ভাগ্যিস ইমান সঠিক সময়ে এসেছিল। আর পাঁচ সেকেন্ড লেইট করলেই মিরা ট্রাকের তলে পড়ে ভর্তা হতো!
ইমান খুকখুক করে কেশে বলে, হ্যাঁ কাজে এসেছিলাম।
মিরা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থেকে আচমকা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলে, আজকে যদি আমি মারা যেতাম?

মিরার প্রশ্নটা শোনামাত্র ইমানের বুক দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো। সে মিরার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে, মৃত্যুর কথা স্মরণ করা ভালো কিন্তু আজ থাক,,,,,,
— আজ বাদ যাবে কেন?
— আমার সহ্য হয় না তাই।
মিরা নিশ্চুপ হয়ে ইমানের পানে চেয়ে থেকে বলে উঠে, আই এম সর‍্যি।
ইমান ভ্রু কুচকে বলে, কি জন্য?
— ইউ বেটার নো।
— কারণটা সত্যিই আমার জানা নেই।

— আমার জন্য আপনাকে অনেক পোহাতে হয়েছিল তাই না? আপনাকে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সর‍্যি। তখন অবুঝ ছিলাম। যা ভাবতাম সেটাই সঠিক মনে হতো।ঠিক-বেঠিক বোঝার জ্ঞান ছিল না।
ইমান প্রশ্নের পিঠে জবাব না দিয়ে বলে, ফিরে যাওয়া যাক। বৃষ্টি হবে। রাস্তা ঘাট একেবারেই খালি।
— আপনি তো কিছু বললেন না?
— আজকে কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। তার চেয়ে বরং তুমি বলো। আমি শুনে যাই। অন্য কোনদিন আমি বলব।

মিরা শুকনো গলায় বলে, এট লিস্ট এটা তো বলুন ক্ষমা করেছেন নাকি করেন নি?
ইমান এবারো উত্তর না দিয়ে হাসলো। এই হাসির দুটো মানে হতে পারে, এক, ক্ষমা করে দিয়েছি। দুই, তোমাকে ক্ষমা করার প্রশ্নই আসছে না!
এখন কোনটা হতে পারে এটা মিরা জানে না। সে অনেকক্ষণ ইমানের দিকে উত্তরের জন্য চেয়ে রয়ে হতাশ হলো।
হুটহাট ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হতেই তারা বিপাকে পড়ে গেল সে। এখন এই মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে হবে?কি মুশকিল!

ইরা হাতে এক কাপ কফি নিয়ে ইমানের হোটেল রুমের দিকে পা বাড়ালো। উদ্দেশ্য হালকা-পাতলা, টুকটাক কথা বলা। যেহেতু ইমান হোটেলে আছে কাজেই তার সঙ্গে কথা বলা অপরাধ নয়।
ইরা তিনশ বারো নাম্বার রুমে গিয়ে থেমে গেল। গেট নক করলো। ওপাশ থেকে সাউন্ডবক্সে গান ভেসে আসছে। ইংরেজী গান।
You are the feel, I Don’t care
Cause i have Never been so high
Follow me to the dark

ইরা গানটা শুনে থমকে যায়। ইমান ইংলিশ গানও শুনে? সে কি ভেবে আর নক করলোনা। বরগেটের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দরজা খুললো এবং সরাসরি রুমে উঁকিঝুকি মারলো। রুম ফাঁকা। এসি চলার জন্য বরফের মতো ঠাণ্ডা হয় আছে রুমটা। বারান্দা থেকে পুরুষ অবয়ব চোখে পড়লো। খালি গায়ে বারান্দায় টাওয়েল নেড়ে দিচ্ছে। ইরার চোখ আটকে গেল। বেহায়া চোখটা গোল গোল হয়ে গেল। নিশ্চয়ই এটা ইমান! এতোবেলায় গোসল কেন করছে সে?
সে কাঁপা গলায় ডেকে উঠে, ইমান ভাইয়া?

বারান্দা থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। ইরা কৌতুহল বশত সামনের দিকে পা বাড়াতেই সেই পুরুষ অবয়ব তার মুখোমুখি হলো এবং দুইজনের আকষ্মিক সাক্ষাৎকার ঘটে যায়।
সাদ সবে গোসল করে এসেছে। গা থেকে সাবান-শ্যাম্পুর গন্ধ ভুভু করে আসছে।
ইরা চোখ বড় করে তাকায়। সাদ চেঁচিয়ে উঠে বলে, তুমি! তুমি এখানে কি করছো?
ইরা হা হয়ে গেল। সাদ আবারো বলে উঠে, একটা ছেলের রুমে অনুমতি ছাড়া কিভাবে আসলেন? লজ্জা করেনা? ঘরে বাবা-ভাই নাই?

ইরা ভ্রু কুচকে বলে, এতো ঢংবাজ লোক কেন আপনি? আমি জানতাম নাকি আপনি জামা-কাপড় ছাড়া টারজেন হয়ে ঘুরঘুর করছেন৷
সাদ একটু মাথা ঝাকাতেই তার চুলে লেগে থাকা পানি গুলো ফোটা ফোটা রুপে আশেপাশে গড়িয়ে পড়ে। দুই-তিন ফোটা ইরার মুখে এসে লাগতেই ইরা বিরক্তি নিয়ে বলে, এতো বড় দামড়া ছেলে হয়েও চুল মোছা শিখেন নি?
সাদ চুলে হাত দিয়ে বলে, এক কাজ করুন! আমার চুল প্রতিদিন মুছে দেওয়ার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নিন।

ইরা ভ্রু কুচকে কটমট করে তাকালো তার দিকে। তখনই সাউন্ডবক্সে জোরে জোরে বেজে উঠল, Love me like you do! Love me like you do!
সাদ এক গাল হাসি উপহার দিলো ইরাকে। ইরা অদ্ভুত চোখে তাকালো। এই চাউনীতে গাদা গাদা বিরক্তি আছে।
সাদ তার হাত থেকে কফির কাপ ছিনিয়ে নিয়ে বলে, থ্যাংকস ফর দ্যা কফি ট্রিট৷

— কফি আপনার জন্য ছিল না।
— কার জন্য ছিল তাহলে?
— ইমান ভাইয়ার জন্য।
— এই কফিতে আল্লাহ আমার রিযিক লিখে রেখেছিলেন বিধায় ভাইয়া বাইরে সিগারেট কিনতে গেছে — এতটুকু বলেই কফিতে চুমুক দিয়ে সে ইরার দিকে চোরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৃদ্যু সুর তুলে গায়, টাচ্ মি লাইক ইউ ডু!

বৃষ্টির মধ্যে এলোমোলে পা ফেলছে মিরা। রাস্তা কাদা কাদা হওয়ায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে৷ হুট করে ঝড়ো হাওয়া শুরু হওয়ায় চোখে ধুলোবালি ঢুকে বিশ্রী কান্ড হচ্ছে। হাঁটতেও ভারী বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।
মিরা ভুলভাল কদম দিতেই কাদার সঙ্গে পা লেগে সে চিটপাটাং হয়ে পড়ে যায়৷ ইমান পেছনে তাকিয়ে হতভম্ব হলো। এতো বড় মেয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ব্যাপার টা হাসির! তার উচিত হাসা এবং তার হাসিও পাচ্ছে।
নিজেকে দমিয়ে সে মিরার কাছে গিয়ে বলে, ঠিক আছো তুমি?

শেহজাদী পর্ব ২১

— খুব ঠিক আছি।
— যাক। আলহামদুলিল্লাহ।
মিরা কেঁদে দিবে এমন মুখ করে বলে, এভাবে
রাস্তায় আছাড় খেয়ে পড়ার পর কেউ ঠিক থাকে?
— তবে বললে কেন?
— জিজ্ঞেস করলেন কেন?
ইমান ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মেয়ের ঝগড়া করার বাতিক আছে৷
ইমান হাত বাঁড়িয়ে দিলো। ইরা কাদামাখা হাতটা দিয়েই ইমানের হাত ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে ইমান হালকা কেঁপে উঠে। চোখ মুখ কুচকে ফেলে। হাসফাস লাগা শুরু হলো তার৷
মিরা উঠে দাঁড়ালো এবং আশেপাশে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য চোখে বলে উঠে, এই এটা তো হোটেলের দিকের রোড না। কোথায় এসে পড়লাম?
ইমান ভাবলেশহীন ভাবে বলে, এদিক দিয়েই হোটেল যায়।

— উহু।
— আমার চেয়ে বেশি জানো?
মিরা বলে, হ্যাঁ।
ইমান আর কিছু বললো না। সে নিজের মতো করে হাঁটা ধরলো। মিরাও সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা আরম্ভ করে ভয় ভরা কন্ঠে বলে, আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছেন কেন?
ইমান থেমে গিয়ে বলে, এটা নাকি ভুল রাস্তা?
— হ্যাঁ।
— তাহলে তুমি সঠিক রাস্তা দিয়ে যাও। আমার পিছু আসছো কেন?
— আমি কিভাবে জানব কোনটা সঠিক রোড?
— তাহলে এটা যে ভুল রাস্তা তা কিভাবে জানলে?
মিরা ঢোক গিলে বলে, মনে হলো তাই বললাম!

ইমান হাঁটা ধরলো। ঘন্টা এক বা দেড় হেঁটেও তারা হোটেল বা হোটেলের ধারে কাছেও নেই। বরং মনে হচ্ছে তারা কোন গ্রামে প্রবেশ করে ফেলেছে। কিংবা কে জানে এটা কোন টরিস্ট স্পট? কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। বৃষ্টির জন্য চারিদিকে ধুধু ফাঁকা! সেই সাথে অন্ধকার নেমে এসেছে। ভুতুড়ে অবস্থা। দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে। খানিক দূরে দৈত্যের মতো একটা ল্যাম্পপোস্ট দাঁড়িয়ে আছে।
ইমান দাঁড়িয়ে গেল। এতোদূর হেঁটে আসা ঠিক হয়নি। মস্ত বড় ভুল হয়েছে। বৃষ্টির ফোটা কাটার মতো গায়ে হানছে। এখন বিপদ হলে কি করবে সে?

শেহজাদী পর্ব ২৩