শেহজাদী পর্ব ৪০ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ৪০
Arishan Nur

দিনের শুরুটা মিরার খুব দারুণ গেল। সে ঘুমের মধ্যে একটা মিষ্টি স্বপ্ন দেখে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই হাসলো। এরপর এলার্ম বাজতেই উঠে সারা ঘরময় পায়চারি করতে করতে ব্রাশ করলো। ব্রাশ করে শাওয়ার নিয়ে লাল রংয়ের একট সালোয়ার কামিজ পড়লো। এরপর হালকা সাজলো।আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে একবার দেখে নিয়ে কি ভেবে যেন মাথায় ওড়না দিয়ে দুটো সেলফি তুললো। এরপর সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে সেন্ড করলো অর্থাৎ ইমানের ম্যাসেঞ্জারে সেন্ড করে। সেও ও প্রান্ত থেকে সিন করে এক মিনিটের ব্যবধানে রিপ্লে দিলো, মাই লাভ এরপর একটা রেড কালারের লাভ ইমোজি। এরপর ম্যাসেজে লিখলো, আমার লাল শেহজাদী।

সে মুচকি হেসে নাস্তা করতে বের হলো। কয়েকদিন ধরে মিরা তাদের অফিসের মেইন ব্রাঞ্চে বসছে। টুকটাক কাজ করছে সে। বড় আব্বুই বসতে বলেছেন।

খাওয়ার টেবিলে বসতেই ইরার সঙ্গে দেখা। ইরা পড়ছে আর নাস্তা করছে। সুপ্তি বেগম মিরাকে দেখে বলে, কাল বাদে পড়শু বিয়ে তোর। কি দরকার বাইরে যাওয়ার? বাসায় থাক মা।
মিরা পরোটা খেতে খেতে বলে, আজকেই আমার লাস্ট ডে। এরপর বিয়ের পর অফিস যাব। আজকে একটা ফাইল ঠিক করতে হবে।
— যাওয়াটা দরকার?
— হ্যাঁ মা।
— আচ্ছা। নাস্তা কর। বিকেলের আগে আসিস। দর্জিওয়ালা আসবে। জামা গুলো সিলাই করতে হবে।
— আচ্ছা৷

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তখনই সোনালী আপু তার নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে ডাইনিং রুমে আসতেই, মিরা বেবিকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। সোনালী আপু হেসে বলে, তোদের দুইবোনের খাওয়া হলো?
মিরা মাথা নেড়ে বলে, হু। আমি অফিসে যাব। বেবিকে নিয়ে যাই?

— পাগল তুই!
মিরা আরো কিছুক্ষণ সারাকে আদর করে সোনালী আপুর কোলে দিয়ে বাবার রুমে গেল। যাওয়ার আগে একবার ইরার মুখের সামনে ধরা বইটা টান দিয়ে ডিস্টার্ব করলো। এতে ইরা বিরক্তিসূচক শব্দ করলো মুখ দিয়ে। সে খিলখিল করে হেসে, বাবার রুমে গিয়ে নম্র করে বলে, আব্বু অফিস যাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।

জয়নুল সাহেব হালকা হেসে বলে, যাও।
মিরা প্রতিদিনই বাবাকে বলেই বের হয়। তাদের কথোপকথন প্রতিদিন এই জায়গায় এসে থামে কিন্তু আজ মিরা কথা শেষ করেও দাঁড়িয়ে রইল। তা দেখে জয়নুল সাহেব বলে, কিছু বলবে?
মিরা বাবার রুমে প্রবেশ করে বলে, আব্বু সর‍্যি। আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?

— যায় তো!
— তাহলে করছো না কেন?
— কই? করেছি তো।
— উহু আগে সবসময়ই মা বলে ডাকতে, এখন ডাকো না। আমার কষ্ট হয়।
— কষ্ট পায় না মা আমার। আব্বু সবসময়ই তোমার জন্য দোয়া করে।
বাবার কথায় মিরার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে অনেকদিন পর বাবার চোখে প্রফুল্লতা দেখলো।
উনি বলে উঠে, তোমরা সবসময়ই সুখে থাকো এটাই আমার চাওয়া। এবার অফিস যাও মা।

মিরা অফিস যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলো খুশি মনে। অফিসে তেমন কাজ নেই। মিরা ফাইল নিয়ে বসলো।এর মধ্যে একবার ইমানের সঙ্গে কথা হয়েছে তার। ইমান আগামী ছয়দিনের মধ্যে দেশে আসবে। খুশির সংবাদটা শোনামাত্র মিরার আনন্দে নেচে উঠে। সে ইমানের জন্য সারপ্রাইজ হিসেবে একটা ফোন অর্ডার দেয়। পারসেল রিসিভ করার জন্য ইমানের নাম্বার দিয়ে দেয়।
দুপুর বারোটায় সে অফিসের কলিডোরে চা খেতে গেলে, তাদের অফিসের ম্যানেজার এসে বলে, আপামনি ব্যস্ত আছেন?
মিরা বলে, না।

— এক জায়গায় যাবেন?
— কোথায়?
— গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে।
— সেখানে গিয়ে কি করব?

ম্যানেজার মিরাকে বোঝাতে লাগে, আপা আমরা তো নতুন প্রজেক্ট এই ফ্যাক্টরির সঙ্গেই ডিল সাইন করেছি। আপনারা মালিকপক্ষের কেউ একবার গিয়ে ভিজিট করলে ক্লাইন্ট খুশি হবে৷ যাবেন? দুপুরব ওরা খাওয়াবে।
মিরা বলে, যাওয়া যায়।
সে ম্যানেজারের কাছ থেকে সরে এসে ইমানকে কল লাগায়। ওপাশ থেকে ইমান রিসিভ করে বলে, হুম বলুন শেহজাদী?

— এই শোন না! ম্যানেজার আংকেল এক ফ্যাক্টরি ভিজিট করতে বলছে। যাব?
— যাও।
— কিন্তু আম্মু তো বলেছে, কিছুদিন পর বিয়ে জন্য এতো বাইরে না ঘোরার জন্য।
— বিয়ে তো আমারো! আমি তো এক্কেবারে বিদেশে ভ্রমণ করছি।তুমি যাও ঘুরে আসো। দেখো কেমনে ডাইনিং করে। তোমার জন্য শিক্ষাসফর হবে।

মিরা ফোন রেখে ম্যানেজারের সঙ্গে রওনা দেয়। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি নারায়ণগঞ্জ। যেতে তিন ঘন্টা লাগলো জ্যামসহ। ওখানে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে যায়। কাজেই সবার আগে খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে নিয়ে ফ্যাক্টরির এমডির সঙ্গে কিছু সময় গল্প-গুজব করে। এরপর এমডি সাহেব একজন কর্মীকে মিরাদের সঙ্গে রেখে ফ্যাক্টরি থেকে চলে যান। ওনার মিটিং আছে৷

মিরা আর ম্যানেজার সাহেব ফ্যাক্টরির বিভিন্ন সেকশন ঘুরে ঘুরে দেখছে। ফ্যাক্টরিটা বেশ ভালোই। নিট সেকশন, ওভেন সেকশন সবই আলাদা আলাদা করে বানানো। আবার ডায়াজ প্রিন্টিংও আছে। মিরা বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে কেননা এসবে তার ইনটারেস্ট আছে। ওয়েট প্রসেসিং সে সময় নিয়ে দেখলো। অনেক কিছু নতুন শিখলো এবং জানলো।
এরপর শ্রমিকদের সঙ্গে এক-দুইটা কথা বলে। এক মহিলা কর্মী সঙ্গে নিজের পাঁচ বছরের ছেলেকে এনেছে। মিরা বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, বাবু তোমার নাম কি?
বাচ্চাটা সুন্দর করে নিজের নাম বলে। মিরা বলে, তুমি এসেছো জানলে তোমার জন্য চকলেট আনতাম।

বাচ্চাটা একবার তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, আমার জন্য দোয়া করবেন। দোয়া চকলেটের চেয়ে অনেক বেশি ভালো।
মিরা এতো ছোট বাচ্চার মুখে এমন সুন্দর জবাব শুনে মুগ্ধ হলো।
কথা-বার্তার শেষ প্রান্তে, তার হুট করে পেট ব্যথা করে উঠে। সে ভাবলো, তার বুঝি পিরিয়ড হয়ে গেছে। সে দ্রুত ওয়াশরুমে যায়। ওয়াশরুম কিছুটা ভেতরে। সে শ্রমিকদের কাছ থেকে বিদায় জানিয়ে, ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা ধরে।

বাথরুমে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে নিল। প্রচুর ক্লান্ত লাগছে। এখনি বাসার উদ্দেশ্য বের হতে হবে। পুনরায় হাত-মুখ ধুয়ে যেই না বাথরুম থেকে বের হলো, প্রচুর হৈচৈ কানে এসে বাজতে লাগলো। সে ভ্রু কুচকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শ্রমিকদের চেচানোর আওয়াজে তার কান ফেটে যাচ্ছে। একজন চিল্লাচ্ছে না, মনে হয় সবাই চিল্লাচ্ছে। তার বুক কেঁপে উঠে। খারাপ কিছু হয়নি তো? সামনে আগানোর সাহস নেই তার।

চিৎকার-আর্তনাদ ভেসে আসছে। কেউ বা আল্লাহ বাঁচাও বলছে তো কেউ মা বলে হাক পারছে৷ মিরার মাথা ঘুরে যায়। পা ঝিম মেরে উঠে। সে নির্বাক হয়ে রয়। মিনিট এক পর নাকে এসে লাগে পোড়া গন্ধ । এবারে তার টনক নড়ে। সে চোখ নাটা পাকিয়ে আশেপাশে তাকালে, লক্ষ করলো, চারপাশে ধোঁয়া আর ধোঁয়া। মুহূর্তের মধ্যে ধোঁয়ার পরিমাণ এতোটাই বেরে গেল যে তার কাশি হতে লাগলো। তার চোখ ফেটে জল পড়লো। মানুষ-জনের চিৎকারে মাথা ব্যথা করে উঠলো। সে বহু কষ্টে পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে, ফ্যাক্টরির মাঝ বরাবর আসতেই যে দৃশ্য দেখলো! তা দেখার পর ভয় পেয়ে গেল। প্রচন্ড ভয় তাকে গ্রাস করে ফেলে। ভয়ে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো৷ প্রত্যকটা স্নায়ুকোষ কাজ করা বন্ধ করে দেয় তার। ঢোক গিলতে পারছে না।

গার্মেন্টস এর একটা মেশিনে আগুন ধরে গেছে।সেখান থেকে তরতর করে আগুন অন্য জায়গায় লেগে যাচ্ছে। শ্রমিকরা মেইন গেইটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিন্তু বের হতে পারছে না। মেইন গেইট বাহির থেকে লাগানো। দরজা ধাক্কাচ্ছে সবাই।
মিরার পাশে ম্যানেজার সাহেব এসে আহাজারি করে বলে, মাগো! কি সর্বনাশ হয়ে গেলো। এখন কি করব? আমরা আর বাঁচবো না।

স্তব্ধ মিরার চোখে শ্রমিকদের আহাজারি, আর্তনাদ, বাঁচার আকুলতা, মিনতি ভেসে আসছে। কানে বাজছে তাদের বাঁচার জন্য চিৎকারের ধ্বনি।
ম্যানেজার সাহেব বলে, আপামনি আপনি দূরে সরে যান৷ আগুন এদিকেও লেগে যাচ্ছে। সব জ্বলে যাচ্ছে আপা। সব ছাই হয়ে যাচ্ছে।
বলতে বলতে কান্না শুরু করেন উনি। দুর্বল, ভীতু মিরা আজ কাঁদছে না। তার ভয় করছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত মস্তিষ্ক ঠিকঠাক ভাবে কাজ করতে না। শক বেশি লাগায় অকেজো হয়ে আছে।

ম্যানেজার জোর করে তাকে টেনে আরো ভেতরের দিকে নিয়ে যায়। মিরার মোবাইল পড়ে যায় হাত থেকে। সে চোখ বুজে দোয়া পড়ছে।
মিরাকে বাথরুমের ভেতরে ঢুকিয়ে ঝর্ণা ছেড়ে দেন ম্যানেজার সাহেব। উনি বলে উঠে, আপামনি আপনি বের হবেন না। আমি আসছি৷
মিরা অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি আমাকে কেন রক্ষা করছেন? নিজেকে সেইভ না করে আমাকে করছে কেন?

ম্যানেজার সাহেব বেদনা ভরা কণ্ঠে বলে, দায় আছে আমার। আপনার বড় আব্বুর উপর আমি কৃতজ্ঞ। তার জন্য আমার মেয়ে আজ মরতে মরতে বেঁচেছে। উনি যদি টাকা দিয়ে সাহায্য না করত আমার মেয়েটা ক্যান্সারে মারাই যেত বুঝি। ওনার উপর ঋণ আছে আমার। আজকে ওনার মেয়েকে না বাঁচালে, আল্লাহ গজব দিবে। আপা আপনি বের হবেন না। ফায়ার সার্ভিসের লোককে৷ ডাকার ব্যবস্থা করি। উপায় হবেই৷ আল্লাহ আছে সঙ্গে।
মিরা বাকহারা হয়ে চেয়ে আছে৷ এমন এক পরিস্থিতি যে না পারছে কথা বলতে, না পারছে কাউকে সাহায্য করতে।

ঝর্ণার পানিতে ভিজে যাচ্ছে সে। ম্যানেজার সাহেব তাকে তো বাচিয়ে দিল কিন্তু বাকি শ্রমিকরা কি করবে? আদৌ কি সে বেচে যাবে? এদিকে কি আগুন ধরবে না? কে জানে?
কতোক্ষন পেড়িয়েছে তা জানা নেই মিরার। সে ঠাঁয় এক জায়গায় জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পানির ফোটা গুলো কাঁটার মতো বিঁধছে। আশপাশ থেকে চিৎকার-চেচামেচি কমেনি একবিন্দু। মিরা এবারে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। হাঁটু গেড়ে বসে কান্না করতে করতে বলে, আমি বাসায় যাব। আল্লাহ সাহায্য করো আমাকে। কেউ আমাকে বাসায় পৌঁছে দাও। ইমান! কোথায় তুমি? আমাকে বাঁচাও প্লিজ। আমি বাঁচতে চাই।

তার হাতে এখনো ইমানের দেওয়া আংটি জ্বলজ্বল করছে। হাতের আঙুলে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে বলে, আমি যদি মারা যাই প্লিজ তুমি অন্যকাউকে শেহজাদী বলে ডাকবে না। বিশ্বাস করো আমি খুব হিংসুটে। নিজের ভাগের ভালোবাসার এক আনাতেও কারো সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করতে চাই না। আল্লাহ! বাঁচাও!

শেহজাদী পর্ব ৩৯

তখনই বেশ শব্দ করে কিছু ভেঙে গুড়গুড় হলো। মিরার আত্মা কেঁপে উঠে। আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়ার উপস্থিত যেন ক্ষণেই দশগুণ বেড়ে গেল। মিরা বুঝে গেল খুব নিকটে কোথায় আগুন ধরে গেছে। এখন উপায় কি? এখান থেকে বের হবে? বের হয়েও বা যাবে কই? ফায়ার সার্ভিস এসেছে? মেইন গেইট কেন খুলছে না কেউ? তাহলেই তো বেঁচে যায় তারা।
তার কান্নার বেগও বাড়ছে। ধোঁয়ার জন্য নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট শুরু হতে দেরি নেই। মিনিট একও লাগলো না বাথরুমের দরজা ভেদ করে আগুন ধরে যেতে। দাউদাউ আগুনের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে,মিরা গগনচুম্বী চিৎকার করতে লাগলো।

আর্তনাদ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসে নিজের কানে লাগতেই, মিরা ভয় পেয়ে যায়। এতো ভয়াবহ কেন এই চিৎকার! আত্মা কেঁপে কেঁপে উঠছে তার৷ ধীরে ধীরে বাথরুমের দরজা খসে পড়ে। আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। আগুনের শিখায় ভষ্ম হচ্ছে চারপাশ। মিরার গায়ের উপর ঝিরিঝিরি পানি পড়ায় তার শরীর রক্ষা পাচ্ছে কিন্তু আগুনের এতো কাছে থাকায় উত্তাপে মনে হচ্ছে, গা গলে গলে পড়বে। সামান্য আঁচ লাগাতেই সে যন্ত্রনায় ছটফট করছে। ঘেমে একাকার সে। ঘাম, পানি একসঙ্গে মিলেমিশে একাকার।

শেহজাদী শেষ পর্ব