শেহজাদী পর্ব ৩৮ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ৩৮
Arishan Nur

ইমান মিরার কাছাকাছি আসতেই, মিরা পরপর তিন হাঁচি দিয়ে দিলো। ইমানের মুখ কালো হয়ে গেলো। এরকম রোমান্টিক পরিবেশেও কেউ হাঁচি দেয়? তার মিরার উপর বড্ড রাগ হতে লাগলো। মেয়েটা তার প্রেমিকা হলেও রোমান্সের শক্রু।
মিরা মেকি হেসে বলে, সর‍্যি।
ইমান জোরপূর্বক হেসে বলে, ইটস ওকে। একেবারে বিয়ের পরই যা হবার হবে। এবার বাসায় চল। তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাচ্ছে ছাদে বেশিক্ষণ থাকার জন্য ।
মিরা বলে, আমার অভ্যাস আছে ছাদে থাকার।

— কখনো কখনো অভ্যাস ছুটে যায়।ওয়াদা ভেঙে যায়। এইযে দেখো না, প্রায়ই ছাদে গুনগুনিয়ে গান গাও, নাচো, একা একা কথা বলো কিন্তু ঠাণ্ডা লাগেনা অথচ আজ একটু রোমান্স করতে চাইলাম, ঠাণ্ডা বাঁধিয়ে দিলে।
মিরা আরেকটা হাঁচি দিয়ে দিল এবং এরপর বলে, আপনাকে কে বলেছে আমি ছাদে এসে নাচ-গান করি?
— কেউ বলেনি৷
— তাহলে জানলেন কিভাবে?
— সে এক ইতিহাস।
মিরা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বলে, আপনার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে কিনা?
ইমান মুচকি হাসলো। আপাতত তার বলতে ইচ্ছা করছে না যে এককালে সে মিরার বাড়ির সামনে এসে ছাদের দিকে তাকিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করত। কাজেই সত্যটা লুকাতে সে নিরব রইল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এরপর তাড়া দিয়ে বলে, বাসায় চল। দেরি হয়ে গেছে।
দুইজনে একসঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আস্তে করে বাসার মেইন গেট খুলে যে যার ঘরে ঢুকে যায়।
মিরা আর সোনালী আপু একসঙ্গে ঘুমাচ্ছে ক’দিন যাবত। সে ভেবেছিল আপু ঘুমুচ্ছে কিন্তু যখনই মিরা রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো সঙ্গে সঙ্গে তার কানে আপুর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
সোনালী আপু বলে উঠে, তোদের লায়লা-মজনু খেলা শেষ হলো?
মিরা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো আপুর দিকে। আপু মুচকি হেসে শোয়া থেকে উঠে বসে, বিছানায় হেলান দিয়ে বলে, কিরে? মুখ ওমন হা করে ফেললি কেন?

— তুমি কিভাবে জানলে?
— কি জানি আমি?হু?
সোনালী আপু সব জেনেও না বুঝার ভান ধরে মিরার সঙ্গে মজা নিচ্ছে। মিরা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, তোমাকে নিশ্চয়ই ইমান সব বলে দিয়েছে?
সোনালী আপু অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলে, না রে। খাওয়ার টেবিলে আব্বুর পায়ে যেই বিড়ালটা গুতো মারলো না! ও এসে আমাকে সব বলেছে৷ বিনিময়ে এক বাটি দুধ খেতে দিয়েছি। হাহাহা।
মিরার তো লজ্জায় যায় যায় অবস্থা।ইমানের মাথা ফাটাতে মন চাচ্ছে তার। ব্যাটার দরকার কি ছিল বড় আব্বুর পায়ে গুতা মারার? যত্তোসব! কাজ করবেই না বরং অকাজের পাহাড় গড়বে।
সোনালী আপু বলে, তোরা যে তলে তলে টেম্পু চালাচ্ছিলি আমি আগেই হালকা সন্দেহ করেছিলাম। তা বাসায় কেউ জানে?

— উহু।
— তুই সত্যি ভালোবাসিস ইমানকে?
মিরা মাথা ঝাঁকালো। সোনালী আপুর হাসি বিস্তৃত হলো । সে বলে উঠে, কাছে আয় তোকে একটু আদর করে দিই। জীবনে প্রথম ভালো কাজ করেছিস।
মিরা গুটি গুটি পায়ে আপুর কাছে গেল। সোনালী আপু তার কপালে দুটো চুমু দিল৷ তখনি মিরার ফোন বেজে উঠল। ইমান কল দিয়েছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠে ইমান নামটা। তা দেখতেই মিরার গা বেয়ে মৃদ্যু কম্পন বয়ে যায়।মনের মধ্যে অদ্ভুত ভালোলাগা গ্রাস করে।

সোনালী আপু বলে, ধরো তোমার মজনু কল দিয়েছে। কথা বল। আমি ঘুমুতে গেলাম।
উনি শুয়ে পড়লেন। এদিকে মিরা ফোন রিসিভ করতেই ইমান বলে, এতোক্ষণ লাগে বুঝি ফোন ধরতে?
মিরা মৃদ্যু হাসে, তার কাছে সবকিছুই স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এ এক মধুর স্বপ্ন! যার শুরু আছে, শেষও আছে। কিন্তু শেষ আসতে বহু সময় বাকি।
মিরা তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, আই লাভ ইউ।

ওপাশ থেকে কিছু শোনা গেল না। কিন্তু একটু পর ইমান বলে উঠে, জানো মিরা যেদিন তুমি চলে গেলে না? ওইদিন আমি আল্লাহর কাছে অনেক অভিযোগ করেছিলাম। কেন আমার সঙ্গে উনি এমন করলেন? সব দুঃখ কেন আমার ভাগেই ঢেলে দিল। কিন্তু বিলিভ মি আজকে মনে হচ্ছে, হি ইজ দ্যা বেস্ট প্লানার। পরম করুণাময় আমাদের জন্য যা ভেবে রাখেন সেটাই উত্তম। আজকে আমি অনেক খুশি।

— আপনার জীবনে নিজের অবস্থান তৈরি হতে দেখে আমিও পুলকিত।
— মিরা?
— হু বলেন।
— ওয়াদা করো কোনদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না? এবার ছেড়ে গেলে, আমি নিজেকে সামলাতে পারব না৷ নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলব। তাই এখনি, আজকেই ওয়াদা করো, যতো ঝড়ই হয়ে যাক না কেন, ইউ উইল নেভার লিভ মি এলোন৷
— ওয়াদা করলাম। মৃত্যু ব্যতীত আপনাকে ছেড়ে যাব না।
— তাও ছেড়ে যাওয়ার কথা বলতে হলো?
— ভুল কিছু বলেছি? মানুষ কি মরণশীল নয়?
— জানি না৷

— বাদ দিন। সোনালী আপু সব কিভাবে যেন বুঝে গেছে৷
— বলো কি! ইরামনিও আমাদেরকে রোমান্স করার সময় দেখে ফেললো।
— সেকি কখন!
— ছাদে।
— আমাকে বলেননি কেন আগে?
— লজ্জা পাবে তাই। ও কেক খেতে চেয়েছে।
— আল্লাহ! এখন ওর সামনে আমি যাব কি করে? লজ্জায় ওর দিকে তাকাতে পারব না।
— সেটা তুমি জানো। বোনদের মধ্যে আমি নেই। তোমার সাদকে কেমন লাগে?
— আপনার ভাই সাদের কথা বলছেন?
— হ্যাঁ।
— হি এজ আমেজিং। এ গোল্ডেন হার্ট বয়।
ইমান হেসে বলে, আর আমাকে কেমন লাগে?
— খুব পচা।
— নট ফেয়ার।

ওইরাতে পুরাটা সময় তারা ফোনে কথা বলে কাটালো। সকালের দিকে ফোন কেটে দুইজনে ঘুমাতে গেল৷
ইরা সকালে উঠে নাস্তা করলো না। তার নাকি খেতে ইচ্ছে করছে না৷ বাসায় বিরক্ত লাগছিল তার। ছাদে যেতেও মন চাচ্ছে না। কাজেই বারান্দাতে গিয়ে বসলো সে। বেশ কিছুক্ষণ বারান্দার সামনের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। আজকে কেন যেন রাস্তা কিছুটা হলেও ফাঁকা।

আচমকা সাদের আগমন ঘটলো বারান্দায়। এতে খানিকটা বিব্রতবোধ করে ইরা। একাকী সময় কাটাতে চায় সে। অন্য কারো বিচরণ দরকার নেই৷ কিন্তু কিছু বলাও যাবেনা৷ বাসার মেহমান ও। তার উপর ফ্রেন্ড হয়৷
সাদ কফি হাতে নিয়ে এসেছে৷ বারান্দায় একটা বসার জন্য লম্বা ব্রেঞ্চ আছে। ইরা একপাশে বসে ছিল।
ইরা যেই প্রান্তে বসেছে, তার বিপরীত প্রান্তে সাদ বসলো। ফলে দুজনের মধ্যে কিছুটা জায়গার দূরত্ব রয়ে যায়৷
সাদ হালকা হেসে বলে, তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ঘুম হয়নি?

— না৷
ইরার মুখে ঘুম হয়নি শুনে সঙ্গে সঙ্গে কফির মগটা তার দিকে এগিয়ে বলে, খাও। ভালো লাগবে৷
— থ্যাংকস।
সে কোন ধরনের জড়তা না দেখিয়ে কফির কাপে চুমুক দিলো।
দুইজনেই চুপ। রাস্তায় ছুটে যাওয়া রিকশার টুংটাক বেলের আওয়াজ। ঢাকা শহরের বিখ্যাত কাকের কাকা শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই৷
হুট করে ইরা বিষন্ন গলায় বলে, জানো সাদ? আমি একজনকে খুব করে ভালোবাসি মানে বাসতাম কিন্তু,,,,,

— এখন আর বাসো না?
— ভুলে যাবার চেষ্টা করছি৷
— সেকি কেন? একবার ব্যাটার নাম বল, তোমার সামনে ধরে আনব। আমার ফ্রেন্ডের মন ভেঙে ব্যাটা আয়েশ করবে তা হয় না। নাম বল।
ইরা হাসলো তার কথা শুনে। এরপর ভারিক্কি গলায় বলে, তার নাম জানার দরকার নেই।সে আম্র জন্য নয় বা আমি তার জন্য নই৷ আচ্ছা মনে করো,তুমি একটা জুতার দোকানে গেলে, সেখানে খুব চমৎকার একটা জুতা তোমার পছন্দ হলো বাট আফসোস জুতো জোড়া তোমার ছোট হয়।জুতো পড়লে পায়ের গোড়ালি,পায়ের আঙুলে যন্ত্রনা হয়, তারপরও কি সেই জুতা কিনবে?

— টাকা লস দেওয়ার শখ নেই।
— জুতো জোড়া আর নিজের হবে না কেননা সেটা তো আর আমার মাপের না। আমার জন্য না। আমার জন্য উপযুক্ত না। আমি যাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম সেও আমার জন্য নয়। আমার মাপের নয়।
সাদ মনে মনে একথা শুনে খুশি হলো।
ইরা টলমল চোখে বলে, আমি কাল রাতে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।বাবার কাছে যে পরিবার থেকে প্রস্তাব এসেছে তাকে বিয়ে করব। সে টাকলা, ভুড়িওয়ালা, বুড়া হলেও তাকেই করব।

— এটা কেমন কথা? আগে তার সঙ্গে কথা বলো। দেখা কর, চিনো একজন আরেকজনকে।
— আমার ভাগ্যে এসব মধুর মুহূর্ত নেই।
— কিভাবে জানতে তোমার ভাগ্যে এসব নেই? হতে পারে কেউ তোমাকে খুব ভালোবাসে। সে কেবল তোমার মাপের সৃষ্টি। যার কাছে তোমার হাসি মূল্যবান। থাকতে পারেনা এমন কেউ?
— পারে হয়তোবা৷
সাদ উঠে দাড়ালো এবং বলল, তাকে সামনে পেলে কি করবে?
— কাকে?

— যে তোমাকে ভালোবাসে৷
ইরা কিছু একটা ভেবে বলে, কিছুই করব না আবার বিয়েও করতে পারি।
সাদ স্মিত হেসে বলে, আশেপাশে খুঁজো। পেলেও পেতে পারো।
সাদ ইঙ্গিত দেওয়া কথায় ইরা ভ্রু কুচকে ফেলে। কিন্তু কিছু বললো না। সাদের সঙ্গে কথা বলে তার নিজেকে হালকা লাগছে। যাক অন্তত কেউ একজন তো জানে তার মনের ভেতরের লুকায়িত কথাগুলো।

বিকেলের দিকে মিস্টার চৌধুরী মিরার অসুস্থতার খবর পেয়ে তাকে দেখতে এসে অবাক বনে গেলেন। ইমানকে মিরাদের বাসায় দেখে সে ভারী বিষ্মিত হলেন।
ইমান হাসতে হাসতে বলে, চৌধুরী ভাই এতো অবাক হওয়ার কিছু নাই। এটা আমার মামাবাড়ি আবার কয়েকদিন পর শ্বশুড়বাড়িও হয়ে যাবে। আসুন। মিষ্টি খান৷

শেহজাদী পর্ব ৩৭

— মিষ্টি কেন?
— বিয়ের মিষ্টি।
— কার বিয়ে?
— আমার।
— বলো কি! অভিনন্দন৷
— ধন্যবাদ।
আজ দুপুরেই ইমান তার নানীর কাছে বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করেছে। সে বলেছে, তাদের মধ্যে সব ঝামেলা মিটে গেছে কাজেই এখন শুভ কাজ সেরে ফেলতে চায়। আর দেরি করতে চায় না। নানী যখন আবারো সবার সামনে প্রস্তাব রাখে ইমানের কথামতো তখন সবাই খুশি হয়েছিল৷ সুপ্তি বেগম সঙ্গে সঙ্গে সদকা দেওয়ার নিয়ত করেন৷

ইমান পারলে আজকেই বিয়ে করে ফেলে কিন্তু বড় মামা অমত পোষণ করেন। এই মাসটা তাদের জন্য শোকের মাস। এই মাসেই ইমানের মা মারা যান কাজেই বিয়ে এই মাসে হবে না। পরের মাসে মিরার জন্মদিন। জন্মমাসে বিয়ে করা নাকি অমঙ্গল তাই নানী আরো পিছিয়ে দিয়ে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলাও, আগামী দুইমাস পর। প্রথম শুক্রবারেই দুপুরে বিয়ে পড়ানো হবে।
ইমান শোনামাত্র বলে উঠে, আলহামদুলিল্লাহ।

শেহজাদী পর্ব ৩৯