শেহজাদী পর্ব ২৮ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ২৮
Arishan Nur

বিছানায় মটকা মেরে ঘুমিয়ে আছে মিরা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। সে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।

ইরা রুমে এসে জানালা আর বারান্দার দরজা খুলে দিলো৷ ভ্যাপসা গরম হয়ে আছে রুমটা। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাচ্ছে। উঁকি মেরে দেখে নিল মিরাকে। সকালেই তারা পৌঁছে গিয়েছে ঢাকায়। এখন ভরদুপুর। খাওয়া-দাওয়া সেড়ে আপু আবারো ঘুমুতে গেছে৷ ইরার কানে উড়ো খবর এসেছে যে আপু নাকি সাত দিনের মধ্যেই আবারো সিডনি ব্যাক করছে। সে যতোদূর জানে, আপু তিন মাসের জন্য এসেছে ঢাকায়৷ অথচ এখনো এক মাস ও পূর্ণ হলোনা৷ এতো দ্রুত যাবে কেন? অবশ্য ইরা সম্পূর্ণ জানে না৷ আংশিক জানে৷ মা ইতিমধ্যেই একদফা কেঁদে ফেলেছে।

ইরা গুনগুনিয়ে গাইতে লাগে,
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে,
রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে,
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে।
ওপাশ থেকে মিরার কণ্ঠ ভেসে আসে, আরো জোরে গা ইরু। আমার কান অব্দি তোর গানের সুর আসছে না৷
ইরা চমকে উঠে। আপু জেগে ছিলো! সে ভেবেছে ঘুমুচ্ছে। সে এগিয়ে এসে রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলে, তুমি জেগে ছিলে আপু?
মিরা মাথা ঝাকিয়ে বলে, হুম।
ইরা বিছানার একপাশে বসে বলে, শুনলাম তুমি নাকি সিডনি ব্যাক করছো?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— কার কাছে শুনলি তুই?
— আম্মু বললো৷
— ঠিক বলেছে আম্মু৷
ইরার মধ্যে কোন ভাবান্তর হলোনা। একবারও জিজ্ঞাসা ও করলো না কেন চলে যাচ্ছে আপু। সে যেভাবে বসে ছিলো সেভাবেই বসে রইল৷ শুধু চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো৷
মিরা আদুরে কণ্ঠে বলে, ওতোদূর বসে আছিস ক্যান? কাছে আয়। তোর সঙ্গে কথা আছে৷
ইরা হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে এগিয়ে এসে মিরার পাশে গা এলিয়ে দিলো। মিরা তার চুলে হাত দিয়ে বলে, ভার্সিটির দিনকাল কেমন চলে?

— ভালোই৷
— তোদের ভার্সিটিতে নাকি র‍্যাগিং-ফ্যাগিং হয়! তোকে কোনদিন র‍্যাগ দেয়নি?
ইরা ভাবলেশহীন ভাবে বলে, দিয়েছিল৷
মিরা আতংকিত গলায় বলে, কি করতে বলেছিল?
ইরা আয়েশ করে শুয়ে বলে, এক সিনিয়র ভাইয়াকে লাভ লেটার দিতে বলেছিল৷
মিরা চোখ বড় বড় করে বলে, ওহ মাই গড! এরপর?
— এরপর আর কি! ভাইয়াটা ভালো ছিল৷ ঝামেলা করেনি এই যাহ!
মিরা ইরার চুল নাড়তে লাগে। ইরার খুবই অপছন্দের কাজ এটা। কেউ তার চুলে হাত দিলে সে বিরক্ত হয়।

মিরা হালকা গলায় বলে, তুই কারো সঙ্গে প্রেম করিস নি?
ইরার মুখ মলিন হয়ে এলো। সে মৃদ্যু গলায় বলে, আমি কারো অনুভূতির মায়াজালে আবদ্ধ হয়নি। হতেও চাই না৷

মিরা অবাক চোখে বোনের দিকে তাকালো। ইরাকে মূহুর্তের মধ্যে অনেক বড় লাগতে শুরু করলো তার। তার মনে হলো, এই ইরা আগের ছোট ইরা না! আগের ইরা মোবাইলপোকা ছিল। এই ইরা অন্যকেউ! যাকে সে চেনেনা। যে গোপনে কান্না করে মধ্যরাতে! তার বোনের কি এতো যন্ত্রণা যে মধ্যরাতে কাঁদতে হবে তাকে? মিরা এই প্রশ্নটা করে তাকে বিভ্রান্ত করতে চাইলো না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে উঠে, ইরু! তোর কাছে ভালোবাসা মানে কি?
ইরা কঠিন গলায় জবাব দেয়, নিষিদ্ধতার প্রতীক।

— ভালোবাসা নিষিদ্ধতার প্রতীক হয় কিভাবে?
— মিলিয়ে নিও যাকে ভালোবাসবে সে তোমার হবে না। সে অন্য কারো ভীষণ ব্যক্তিগত রত্ম হবে। তাহলে তো ভালোবাসা নিষিদ্ধতার প্রতীকই বটে।
মিরার বুক ছ্যাত করে উঠে। তার চোখে ইমানের মুখটা ভেসে উঠে। সে ইরার দিকে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে বলে, তুই কাউকে ভালোবাসিস তাই না? মিথ্যা বলবি না! সবাইকে ফাঁকি দিলেও আমি ঠিক ঠিক জানি তুই রাতে মাঝে মাঝে একলা কান্না করিস৷
ইরা চমকে উঠে। হতবিহ্বল হয়ে পড়ে সে।এরপর ইনিয়েবিনিয়ে বলে, ভালোবাসায় ব্যর্থ হলেই কি শুধু কান্না করে মানুষ? আরো কতো-শত কারণ থাকে৷

— তা অবশ্য থাকে কিন্তু তোর কান্নার ধরণ আলাদা ছিলো।
— কান্নার কোন ধরণ হয়না আপু! কান্না তো কান্নাই!
মিরা চুপ মেরে গেলো। ইরা যে তাকে সত্যটা বলবে না তা বোঝা হয়ে গেছে তার৷
প্রতিটা ব্যক্তির জীবনে একটা না একটা অস্বীকারযোগ্য সত্য থাকে। যা সবার আড়ালে পীড়া দেয়। এ সত্যের ব্যাপারে কাউকে বলা যায়না। সয়ে যেতে হয়।
ইরা উঠে বেরিয়ে গেলো। তখনি সুপ্তি বেগম রুমে এসে বলে, মিরু! তোর কি হয়েছে বল তো! কেন এতো তাড়াতাড়ি ফেরত যাবি?
মিরা স্মিত হেসে বলে, ফেরত তো যেতেই হত। ক’দিন আগেই যাচ্ছি। কাজ পড়ে গেছে। যেতেই হবে। কিছু করার নেই।

— তোর বাবাকে বললাম, সাহেব বলে, যেতে চাইলে চলে যাবে। আর তোর বড় আব্বু মন খারাপ করছে৷
আব্বুর কথা ভেবে মিরার মন খারাপ হলো। বাবার কথা রাখা হলোনা। যাক গে, বাবা চায় ইমান সুখে থাকুক! আর মিরাও এখন এটাই চাচ্ছে। ইমান নিশ্চয়ই তার শেহজাদীকে নিয়ে ভীষণ সুখের এক সংসার পাতবে!
সুপ্তি বেগম বলে উঠে, কোথায় ভাবলাম তোর বিয়ে দিব! তোর একটা ছোট বোন আছে৷ ওকেও তো কিছুদিন পর বিয়ে দিতে হবে। তোর বিয়ের বয়স পাড় হয়ে যাচ্ছে। তোদের বিয়ে দেওয়া আমার আর তোর বাবার দায়িত্ব।

মিরার বলতে মন চাইলো, মা আমি বিয়ে করব না। কোনদিনও বিয়ে করবনা৷ কিন্তু মুখে বলে, বিয়ে কপালে থাকলে হবে, নাহলে না৷ জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। তুমি- আমি কিছু করতে পারব না৷
— তা পারব না আল্লাহর হুকুম ছাড়া৷কিন্তু হাত গুটিয়ে তো থাকা যায় না৷
মিরা ততোক্ষণে ফোন হাতে নিয়ে মিস্টার চৌধুরীকে টেক্সট করতে লাগলো। সবকিছু মিটমাট করতে হবে। সে যে সিডনি চলে যাবে তাহলে এখানকার কাজ হয় ছেড়ে দিতে হবে নাহয় তার অবর্তমানে সব হবে।

ইমান সবে ঘুম থেকে উঠেছে৷ ঘুম ভাংতেই সাদকে নিজের মাথার সামনে আবিষ্কার করলো। সে ভ্রু কুচকে একটা হাই তুলে বলে, কি?
সাদ লাজুক হেসে বলে, ছোট ভাই হিসেবে একটা আবদার আছে৷ ফেলতে পারবে না কিন্তু আমার আবদার।
ইমান উঠে বসে বলে, আগে বল কি আবদার?

— ওয়াদা করো আগে তারপর বলব৷
ইমান হেসে বলে, সাধ্য থাকলে তোকে চাঁদ ও এনে দিব। বল এবার৷
সাদ লাজুক হাসলেও বেহায়ার মতো বড়ভাইয়ের সামনে গটগট করে বলে দেয়, ভাইয়া আমার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। আমাকে বিয়ে দাও। আমি আর পারছি না বউ ছাড়া থাকতে। রাতে ঘুমাতে গেলে বিছানার এক সাইড ফাঁকা দেখলে আমার বুক হাহাকার করে উঠে !
ইমান বিষম খেলো ছোট ভাইয়ের কথায়। সে বালিশটা খাটের সাথে ঠেস দিয়ে লাগিয়ে সেদিকে পিঠ এলিয়ে দিয়ে বলে, তারপর একটা বউ চাই তোমার?

— হ্যাঁ। এখন তো চাকরিও করি। দিয়ে দাও বিয়ে।
— হুট করে বিয়ের পোকা মাথা এলো কিভাবে?
— কারণ ও অনেক সুন্দরী। আমি লেইট করলে অন্য কেউ সিরিয়ালে ঢুকে যাবে৷ তখন হাতছাড়া হলে?
ইমান শব্দ করে হেসে বলে, হু ইজ সি?
সাদ মাথা নিচু করে বলে, তোমার কাজিন৷
ইমানের মুখ কালো হয়ে আসে। তার চোখে মিরার চেহারা ভাসে। মেজাজ বিগড়ে যায়। চোখ রক্তাক্ত বর্ণ ধারণা করতে থাকে৷
সাদ বলে উঠে, আই লাভ হার৷

— মিরাকে? (দাঁতে দাঁত চেপে)
সাদ হতভম্ব হয়ে বলে,আস্তাগফিরুল্লাহ। মিরা আপু আমার।বোনের মতোন সে কেন হতে যাবে? আমি ইরার কথা বলছি।
সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। আজ যদি সাদ মিরার নাম নিত তবে তার মাথা ফাটাত ইমান। সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, কবে থেকে প্রেম চলছে তোদের? আমি কিছু জানি না কেন এইসব?
— প্রেম-ট্রেম কিছু না। লাভ এট ফার্স্ট স্লাইট!
ইমান বলে, দিনে কয়টা মেয়ের প্রেমে পড়স? সেদিনই না ডানাকাটা পরীর মতো এক মেয়ের প্রেমে পড়লি?

— ওইটাই ইরা। আগে নাম জানতাম না কিন্তু ভাগ্য সহায় জন্য আজ তার ফুল ইনফরমেশন আমার কাছে! এবার আমার বিয়ে দাও ইরার সঙ্গে।
— বিয়ে কি ছেলেখেলা নাকি? যে বলল আর হয়ে গেলো! ইরার মতও দরকার । ওর স্টাডিও শেষ হয়নি। ওর বড় বোনের ও বিয়ে হয়নি।
সাদ মুখ চোখ লাল করে বলে, ইরাকে না পেলে আমি মারা যাব ভাইয়া৷

— ভালোবাসার অভাবে কেউ মরে না৷
— তুমি মরছো না প্রতিদিন?
ইমান হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার হিসাব আলাদা৷
সাদ আগ্রহ নিয়ে বলে, আচ্ছা! তোমার বিয়ে যেন কার সঙ্গে ঠিক হয়েছিল? ওই সময় আম্মু আমাকে তোমার সাথে মিশতে দিত না। দূরে দূরে রাখত! তোমার কি আর কোন কাজিন আছে? বিয়ে ভেঙে যায় কার সঙ্গে?

ইমান বলে উঠে, তোমার প্রিয় মিরা আপুর সঙ্গে।
সাদ হা হয়ে গেল। সে যেন কথাটা বিশ্বাসই করতে পারছে না।
ইমান তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো।
সাদ নিস্তেজ গলায় বলে, তার মানে তুমি মিরা আপুকে ভালোবাসো! আপুর জন্য কেঁদেছিলে?

— কেঁদেছি কোথায়?
— বাসার সবাই জানে তুমি কতোটা ডেস্পারেট ওনার জন্য।
— পুরোনা কথা বাদ দে। আমি মামা-মামীর সঙ্গে তোদের ব্যাপারে কথা বলব।
— লাভ ইউ ভাইয়া৷

সাদ বেরিয়ে যেতেই ইমানের ফোনে মিস্টার চৌধুরীর কল আসে। মিস্টার চৌধুরী ফোনে যা বললো তা শুনে ইমান শকড। কল না কেটেই সে ফোনটা ছুঁড়ে মারে। এরপর বিড়বিড় করে বলে, মিরা আর কতো জ্বালাবি আমাকে? তোকে একটা চরম শিক্ষা না দিলে আমার নাম ইমান খান না! তুই যদি সিডনি চলে যাস, আই সয়ার মিরা! তোকে ড্রেনের পানিতে চুবাবো। আমিও দেখব তুই কিভাবে বিদেশে পালাস! দরকার পড়লে এয়ারপোর্টে তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখব!

ইরা-মিরা আর সোনালী ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। এমন সময় সুপ্তি বেগম রান্নাঘর থেকে এসে বলে, ইরা তোর সঙ্গে আলাপ আছে। তোর বোনদের সামনেই বলছি৷
ইরা কাঠ গলায় বলে, কি বলবে?

শেহজাদী পর্ব ২৭

— তোর জন্য একটা প্রস্তাব এসেছে৷ আমরা রাজী। ছেলে বাবার সাথে ব্যবসা সামলায়৷
ইরা ভ্রু কুচকে বলে, বিয়ে আমি করছি না। সংসার করা আমার দ্বারা সম্ভব না। মানা করে দেও৷
— তোর বাবাকে গিয়ে বল যে বিয়ে করবি না৷

ইরা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। এরপর উঠে দাড়ালো এবং রুমের নিজের রুমে চলে যায়। বাকি সবাই নিস্তব্ধ। হুট করে মিরার ম্যাসেঞ্জার থেকে নোটিফিকেশনের শব্দ ভেসে আসে। মিরা ফোনের স্ক্রিন দেখে চমকে উঠে। পাক্কা ছয় বছর পর আবির হাসান আইডি থেকে ম্যাসেজ এসেছেঃ মিরা তোমার সাথে আমার অনেক বোঝাপড়া আছে। সব সুধে আসলে আদায় করব আর হ্যাঁ আই স্টিল লাভ ইউ!

শেহজাদী পর্ব ২৯