শেহজাদী পর্ব ৩ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ৩
Arishan Nur

উদাসিন মেঘেরা দল বেঁধে আকাশে লুকোচুরি খেলছে। এই কালো তো এই নীল আকাশ! আমি আকাশের পানে তাকিয়ে আছি। আপাতত এই মূহুর্তে আমি ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছি আর মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ছি কারণ অনেক বড় একটা পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। তাহলো বাসা থেকে পালিয়ে যাব। ব্যাপার টা অতিমাত্রায় সাংঘাতিক এবং ভয়ংকর আমার জন্য। এর চেয়ে কঞ্জুরিং মুভিও কম ভয়াবহ। ভয়, উত্তেজনা যেন আমাকে ঝেঁকে বসেছে। আমি ঘণ ঘণ শ্বাস নিচ্ছে। আমার বুকের মধ্যে কি চলছে সেটা কেবলমাত্র আমি জানি। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। আবিরকে এই নিয়ে দুইবার টেক্সট করেছি। সে এখনো রিপ্লে অব্দি দিচ্ছে না। সে রিপ্লে না দিলে আমি কার আশায় বাড়ি ছেড়ে পালাব? কিন্তু ইমান ভাইয়াকে বিয়ে করলেও তো তাকে ঠকানো হবে।আবিরকে ঠকানো উচিৎ হবেনা।

ইমান ভাইয়ার সঙ্গে বাবা, বড় আব্বু বেশ আয়োজন করে দেনমোহর নিয়ে আলোচনা করছে। মা একবার সেই আসরে আমাকে ডেকেছিল। মায়ের ডাক উপেক্ষা করার সাহস আমার নেই তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছিল৷ যাওয়ার আগে আবার আপা আগ বাড়িয়ে আমার মাথায় ওড়না পেচিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিলো।মায়ের সামনে মাথায় কাপড় নামাতেও পারছিলাম না। মাথার ওড়না দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মধ্যে কেমন নতুন বউ-বউ ভা এসে গেল। অদ্ভুত এক অনুভুতি লাগতে শুরু করলো।

মা ড্রয়িংরুমে নিয়ে যেতেই ইমান ভাইয়ার চোখ বরাবর গিয়ে দাঁড়ালাম। চোখ তুলে তাকালেই তার মুখ দেখা যেতে লাগলো। তিনি দাদীর পাশে বসে আছেন।দাদী নিজের একটা হাত দিয়ে তার হাত চেপে ধরে, উনার মাথায় আরেক হাত দিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দাদীর যত্তোসব আদিখ্যেতা সব ওনার জন্য। এমন দামড়া ছেলেকে কে ওইভাবে আদর করে? কই আমি তো সারাদিন তার চোখের সামনে ঘুরঘুর করছি, একদিন ও তো এভাবে আদর করেন না। হুহ! ওনার জন্য দাদী কুরবানির ঈদের পরপরই কাবাব বানিয়ে ফ্রিজে রাখে। কারণ জনাব সাহেবের দাদীর হাতে বানানো কাবাব প্রিয়। সেই কাবাব আমাদের খাওয়া নিষেধ। উনি আসলেই এই কাবাব ভাজা হয়। তাও সেই কাবাবের তেল আমাকেই গরম করা লাগে কিন্তু কাবাব আমার ভাগ্য জুটে না।

আচমকা উনি দাদীর সঙ্গে কথা বলা থামিয়ে আমার দিকে তাকালো। ক্ষণেই আমাদের চোখাচোখি হয়ে গেল। উনি আমাকে দেখামাত্র একটু ভড়কে গেল যেন। এরপর দু’দন্ড পর আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই ভ্রু নাচালো সে। ওনার ভ্রু নাচানো দেখেই আমার রক্ত টগবগ করতে লাগলো। উনি ভ্রু নাচানো শেষ করেই আমাকে দেখে বাঁকা হেসে ইশারায় কি যেন বুঝালো যা আমার বোধগম্য হলো না। তাই আমি ওনার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই উনি সবার অগোচরে আমাকে চোখ মারে। ওনার এমন ভাবভঙ্গি দেখে আমার মুখ হা হয়ে যায়। একটা মানুষ কিভাবে এতো অসভ্য হয়?
এবারে বড় আব্বু গলা খাকিয়ে নিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলেন। নিশ্চয়ই দীর্ঘ বক্তব্য শুরু করবেন উনি।

বড় আব্বু গম্ভীর গলায় বলে উঠে, মিরা মামণি আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলছি। জানোই তো কাল তোমাদের বিবাহ। ইমান দেনমোহর স্বরুপ তোমাকে পাঁচ লাখ টাকা বিয়ের দিনই শোধ করে দিবে। তোমার কোন সমস্যা আছে?
আমি কি বলব বুঝে পাচ্ছি না। উনাকে বিয়েই করতে চাই না৷ আবার দেনমোহর নিয়ে ভাবা তো দূরের কথা!

আমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ইমান ভাইয়া নিজ গরজে বলে উঠে, এই পাঁচ লাখ আমার নিজের উপার্জিত টাকা। মিরার যদি এতো কমে কোন সমস্যা থাকে তাহলে আই উইল ম্যানেজ সামহাউ।
ওনার কথা শুনে আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল। উনি কি আমাকে সবার সামনে লোভী হিসেবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছেন? আমিও বেশ সোজাসাপ্টা বলে দিই, আমার কোন সমস্যা নেই।

এতেই যেন সবার মুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠে। আমি আর অপেক্ষা না করে ড্রয়িংরুম ছেড়ে বাসার বাইরে বের হলাম। পিছে কেউ ডাকলো না। কিন্তু সদর দরজা অতিক্রম করতেই উনি বলে উঠে, মিরা এই ভর বিকেলে বাইরে কেন যাচ্ছিস?

আমি থমকে দাড়ালাম। আমার আব্বু-আম্মুর কোন সমস্যা নেই৷ অথচ উনি উড়ে এসে জুড়ে বসা এক মশা কিনা আমাকে আমার বাসায় প্রশ্নবিদ্ধ করছে! ওনার গলায় স্পষ্ট অধিকার বোধ ছিল।
আমিও কম না। উনার সামনেই মাথা থেকে ওড়নাটা ফেলে দিয়ে কোন উত্তর না দিয়ে গটগট করে ছাদে এসে দাঁড়ালাম। ছাদে আসতেই মন ভালো হয়ে গেল। বৃষ্টি নামার আগ মূহুর্তের পরিবেশ এখন। চারিদিক কালো হয়ে গেছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। আমি ঠিক করলাম আজকে বৃষ্টি নামলে আমি ভিজব। খুব করে ভিজব।

সেই থেকে বৃষ্টির অপেক্ষায় আছি। এরই মধ্যে পালানোর প্লান ও করে ফেললাম। কিন্তু আবির! সে অনলাইনেই নেই। আমি চিন্তায়-চিন্তায় মগ্ন হয়ে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাড়ালাম। ঠিক ওই সময় ইমান ভাইয়াকে আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে যেতে দেখলাম। উনি বের হয়ে হেটে হেটে মসজিদ ক্রস করে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। এরপর পাঁচ মিনিটের মধ্যে রিকশা পেতেই সে উঠে পড়ে ফোন বের করলো। ছাদ থেকে আবছা আলোয় সবই দেখা যাচ্ছে। আমাদের বাসার পাশেই একটা মসজিদ আছে।

ফোনের টুংটাং শব্দে আমি বাস্তবতায় ফিরে আসি। ফোন হাতে নিয়ে দেখি আবির রিপ্লে দিয়েছে৷ আমি কিছুটা স্বস্তি অনুভব করি। কিন্তু ও এতো দেরি কেন করলো আজ? সবসময়ই আবিরকে অনলাইনে পাওয়া যায়। আজ যখন প্রয়োজন সে এক্টিভ ছিল না। আমি দেরি না করে ম্যাসেজ পাঠালাম যে আমি ওর সাথে পালিয়ে যেতে চাই। ও একটা অবাক হওয়া ইমোজি সেন্ড করলো তা দেখে আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। আমি তৎক্ষণাৎ ওকে কল দিলাম কিন্তু ব্যাটা ফাজিল কল কেটে দিলো। আবিরের এই এক সমস্যা। সে কোন দিন কলে আসে না। এমন কি মিটও করেনি আমার সঙ্গে কোন দিন। কতো বলেছি আসো মিট করি কিন্তু করোনার জন্য সে কোথাও বের হবে না। আজকে যদি আবির করোনার ভয়ে আমার সঙ্গে পালাতে রাজী না হয় তবে আমার বিয়ে কালকে ইমান ভাইয়ার সঙ্গে হবে। দুশ্চিন্তায় আমার কপালে চিন্তার ভাজ।

ও রিপ্লে দিলো, আচ্ছা পালায় আসো। আমি খুশিতে গদগদ হয়ে বলি, তুমি আমাকে নিতে আসবে?
সে রিপ্লে দিলো, পুরান ঢাকায় যেতে পারব না। তুমি ধানমণ্ডি আসো। ওখান থেকে পিক করব তোমাকে।
আমার ভেতরকার সকল সুখকর অনুভূতি চুপসে গেল। আত্মা শুকিয়ে আসলো। আমি একা কোনদিন ধানমন্ডি যাইনি। আর গেলেও গাড়িতে করে যাওয়া-আসা করি। বাবার কড়া আদেশ আমরা বোনেরা যেন গাড়ি ছাড়া না চলাচল করি। রাতের বেলা একা একা ধানমণ্ডি যাব কিভাবে? রাস্তা চিনি কিন্তু নিজের প্রতি বিশ্বাস নেই। আমি কিছুটা রাতকানা স্বভাবের। রাত হলে রাস্তায় ভুলো-মনা হয়ে পড়ি। তার উপর আমার অভ্যাস হলো, গাড়িতে উঠেই নিজের প্রিয় গান মোবাইলে অন করে হেডফোন লাগিয়ে চোখ বুজে থাকা।

আমি ছাদ থেকে নামলাম। আমাদের বাসায় সবকিছু নিয়মমাফিক চলে। রাত ন’টার মধ্যে খেয়ে নিই আমরা। এরপর যে যার রুমে চলে যায়। আমি আবার প্রকৃতি প্রেমী। মাঝে মাঝে রাত করে চন্দ্রবিলাসের জন্য ছাদে যাই। আমার ছোট বোন ইরা সারাদিন ফোনে ব্যস্ত থাকবে। সায়েমা আপার জীবন দুলাভাইময় আর সোনালী আপা বইপড়ুয়া। ওরা কেউ ছাদে আসতে পছন্দ করেনা কিন্তু দিনে একবার ছাদে না আসলে আমার চলবেই না।

আজকেও ব্যতিক্রম হলো না। আমরা সবাই খেতে বসলাম। আমার গলা দিয়ে ভাতের দলা নামতেই চাইছে না। জোর করে কয়েক লোকমা খেয়ে নিলাম। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আম্মু-আব্বুকে ছাড়া কিভাবে থাকব আমি? এমন একজনের হাত ধরতে যাচ্ছি যাকে কোন দিন আমি দেখিই নি নিজ চোখে। লোকে বলে ভালোবাসায় মানুষ অন্ধ হয়– আমি এর জলজ্যান্ত প্রমাণ।

শেহজাদী পর্ব ২

রাত বাড়তেই যে যার রুমে চলে গেল। যেহেতু আমি ব্রাইড তাই আমাকে একলা এক রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে। আমি একটা ছোট ব্যাগে সাত হাজার টাকা ভরে নিলাম। এগুলো সব আমার বিগত ইদের সালামী। সঙ্গে মায়ের একটা ওড়না নিলাম। বাবার পানি খাওয়ার মগ সেটাও নিয়ে নিলাম। এরপর রাত দশটা বাজার অপেক্ষায় থাকলাম।

দশটা বাজার বিশ মিনিট আগেই আমি বাসা থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লাম। এরপর প্রায় বিড়ালের মতো নিরবে বাড়ির বাইরে এসে এক ভো দৌড় দিয়ে চৌরাস্তার মোড়ে গেলাম। উবার ডাক দিয়েছি। উবারের জন্য অপেক্ষা করছি আমি। উবার আসতেই গাড়িতে বসে ধানমণ্ডির দিকে রওনা হলাম। আমি আবিরকে ম্যাসেজ দিলাম। ও যেন আমার আগেই পৌছে যায় এটা মনে মনে চাচ্ছি আমি। ধানমন্ডির কেবি স্কয়ার বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এখানেই আসার কথা আবিরের। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। আশেপাশে তেমন কেউ নেই। আমি ফোন হাতে নিতেই পিলে চমকে উঠি। আবির আমাকে ম্যাসেঞ্জার থেকে ব্লক করে দিয়েছে!

শেহজাদী পর্ব ৪