শেহজাদী পর্ব ৩৫ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ৩৫
Arishan Nur

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি হলো যখন আমরা জানতে পারি, আমি যাকে ভালোবাসে মরছি সেও আমার জন্য কাতর। এটা বুঝি সবচেয়ে মধুর অনুভূতি! মিরা আনন্দে সিক্ত হলো। দু’চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। তার ঠোঁটের কোনে প্রশান্তির হাসির রেখা ফুটে উঠে। সে সাদের দিকে অবিশ্বাস্য চাউনী নিক্ষেপ করে বলে, শেহজাদী বলে ডাকে?

— হ্যাঁ।
মিরা নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, তাহলে ওর শেহজাদী কি আমিই? ওইদিন শুধু শুধু মিথ্যা কেন বললো?
মিরা গভীর ভাবনায় তলিয়ে যেতে ধরলো কিন্তু সাদের কথায় ভাবনা থেকে বিরতি নিতে হলো।
সাদ বলে উঠে, আপু আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। অপর দিকে পৃথিবীতে মা-বাবার পর আমি ভাইয়াকে মানি। ভাইয়া আপনার জন্য ভেতরে ভেতরে, প্রকাশ্যে কষ্ট পেয়েছে। যেদিনটায় আপনাদের বিয় ভেঙে যায়, ভাইয়া বাসায় ফেরেনি। দুইদিন পর ফিরেছিল। কি বিধ্বস্ত লাগছিল তাকে। আমি তখন ভাইয়ার অসহায় মুখ দেখে কেঁদে দিয়েছিলাম। এরপর ওই যে ভাইয়া ঘরে ঢুকলো। পরেরদিন দুপুরে বের হয়েছিল। মাঝে এক গ্লাস পানিও পান করেনি।

মিরা কথাগুলো শুনে অনুতপ্তবোধ করতে লাগলো। ইমান কি পারত না? একবার নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে? কি হত সেদিন বলে দিলে যে সে তাকে ভালোবাসে। এমন কিছুই তো বলেনি সে! উলটো কি বলত? ইমান তাকে দাদী কথায় বিয়ে করছে৷ এমন সব বাজে বকলে কোন মেয়ে তার উপর দয়া দেখাবে?
মিরা চোখ তুলে তাকিয়ে বলে, তোমার ভাই একটা ক্রিমিনাল।
সাদ শব্দ করে হেসে দিলো এরপর বললো, ভাইয়া আবার কি ক্রাইম করলো?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— আমাকে সবসময়ই মিথ্যা কথা বলে এসেছে৷
— ভাইয়া আপনাকে কি বলেছে?
— বলেছে সে মুভ অন করে ফেলেছে। তার লাইফে অন্যকেউ আছে৷
— ভাইয়া আর অন্য কাউকে লাইফে আসতে দিবে? জোক অফ দ্যা ইয়ার! ও হচ্ছে একা বিংশ শতাব্দীর দেবদাস! যাইহোক বেস্ট অফ লাক ভাবী? আপনাকে কি ভাবী বলে ডাকতে পারি?
— পারো৷

সাদ মুচকি হাসলো, এরপর বলে উঠে, ভাইয়া ছোট থেকে চাপা ধরনের। ইন্ট্রোভার্ট না কিন্তু নিজের সমস্যা-অসুবিধা, সংকটের কথা কাউকে বলবে না সে।দুর্বলতা প্রকাশ করেনা এমনকি ভালোবাসাও না। এইযে আমি ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসি, একথা সাবলীল ভাবে বলে বেড়াচ্ছি। কিন্তু সে কোনদিন বলবেনা। অথচ আমি জানি ভাইয়া আমাকে কতোখানি ভালোবাসে। জীবনে একবারই ভাইয়া আমাকে আদর করে খাইয়ে দিয়েছে৷ সবসময় প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলে না। ভালোবাসা দেখায় না। লুকিয়ে রাখে।

— ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয়।আমার কি মন বুঝার ক্ষমতা আছে যে বুঝে নিব তার মনের অব্যক্ত কথা গুলো?
সাদ ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বলে, ভাইয়া যে বড়মাকে খুব ভালোবাসে তা কি জানেন?
— জানি।
— ভাইয়ার মনে একটা কুসংস্কার বাসা বেঁধেছে তাহলো সে যাকেই ভালোবাসবে, ভালোবাসা দেখাবে, প্রকাশ করবে, সে ব্যক্তি তাকে রেখে অনেক দূরে চলে যাবে। আদৌ এমন চিন্তার কোন ভিত্তি নেই।ভাইয়া বড়মাকে খুব ভালোবাসত, সারাদিন মায়ের আঁচল ধরে থাকত, হুট করে আকষ্মিক তার মৃত্যু সামলাতে না পেরে এমন ভিত্তিহীন কুসংস্কার মনে লালন-পালন করছে সে।ভাবী আমি চাই ভাইয়া খুব সুখী হোক। আপনাদের মধ্যে বোধহয় বোঝাপড়া আছে, একজন আরেকজনের শক্রুও হতে পারেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, ভাইয়া আপনাকে ছাড়া সুখী হবে না। আপনি ওর শক্রু হলেও, তার সুখ আপনার আঁচলে গিট দিয়ে বাঁধা।

মিরা চুপ রইল। তার না আছে কোন প্রশ্ন আর না আছে কোন জবাব। সাদের কথাগুলো ভাবাচ্ছে তাকে।
সাদ আবারো বলে, আমি কিন্তু সাইকোলজির স্টুডেন্ট ছিলাম কাজেই একটু হলেও মানুষের মন বুঝতে পারি।
মিরা হাসল। তৃপ্তির হাসি হেসে বলে, আজকে থেকে তোমার ভাইয়াকে সুখে রাখার দায়িত্ব আমার!
সাদ কিছু বললো না, উঠে দাড়িয়ে বলে, যাই তাহলে।
মিরা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। সাদ যেতেই সে ফোন হাতে নিয়ে অনবরত ইমানকে কল লাগাতে লাগে। কিন্তু ওপাশ থেকে ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। মিরার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা ফোন বন্ধ করে কেন বসে আছে?

সে সারা রাত ধরে আয়নার সামনে বসে রইল। অনেককিছুই এই ছোট্ট মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ইমান তাকে ক্লাস টেনে পড়াকালীন সময় থেকেই গোপনে ভালোবাসছে! কই মিরা তো টের পায়নি? আচ্ছা সবাই যে বলে, সে বোকা! এটা কি তবে সত্য? হতে পারে। না, না হতে পারে না। তারা একদম ঠিক বলে। বোকা নাহলে নিশ্চয়ই ইমানের আচরণ দেখেই সে বুঝে নিত। এইজন্যই বুঝি বুদ্ধিমানদের ওতো কদর করা হয়! কারণ বোকা কোনকিছুই ঠিকঠাক ভাবে করতে পারে না৷
মিরা আবার ফোন লাগানো কিন্তু ইমানের ফোন অফ। সে ঠোঁট উলটে ফেলে। এক্ষুনি কান্নারা দলে পাকিয়ে চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পড়বে।

ইমান পুরান ঢাকা থেকে সোজা তার ফ্রেন্ডের বাসায় এসেছে। আসলে ফ্রেন্ড না বরং বড় ভাইয়ের মতো এক ভাইয়ের বাসায় এসেছে। প্রিয়তমা অনুষ্ঠানটার স্পন্সারার আকাশ ভাইয়ের সঙ্গে ইমানের খুব গভীর বন্ধুত্ব। যদিও সে ইমানের চেয়ে বেশ কিছু বছরের বড়।
আপাতত সে ডাইনিংরুমে বসে আছে। টেবিলে এক কাপ চা রাখা আছে। সঙ্গে ডোরিও বিস্কুট। ইমান কিছুই খায়নি সেই থেকে। ভাই অবশ্য অনেক জোড়াজুড়ি করেছে কিন্তু লাভ হয়নি। তবে এক কাপ চা খেতে রাজী হয়ে ইমান৷ খেতে ইচ্ছা করছে না তার।

আকাশ ভাই সোফায় বসে বললো, কিরে? মূর্তির মতো বসে আছিস সেই থেকে? ব্যাপার কি? তোর তো বউও নাই যে ঝগড়া হবে। কাহিনি তো কিছুই বলছিস না। না বলবে জানব কিভাবে?
ইমান চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলে, আজকে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। যার কাছ থেকে কষ্ট পেয়েছি চাইলেও তাকে কষ্ট দিতে পারব না।

— কে আবার তোকে কষ্ট দিল? তুই তো বিয়াও করিস নি। বউ হলে একটা কথা ছিল৷ বউ মানেই প্যারা বুঝলি। সারাদিন খালি ঝগড়া করবে! কিন্তু তুই যদি কথার পিঠে সঠিক উত্তর দিস, ব্যস, কেল্লাফতে। তখনই ব্যাগ নিয়ে বাপের বাড়ি যাবে৷
ইমান বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে ফেলে। আকাশ ভাই মানুষটা ভালো হলেও ওনি দিনের বেশিরভাগ সময় বউ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।

আকাশ ভাই হাসি মুখে বলে, কথায় কথায় আসলই কথাটাই মাথা থেকে আউট হয়ে গেসিলো। শোন, ইমান! একেবারে পাকিস্তানি নায়িকাদের মতো সুন্দরী একটা মেয়ে আমার হাতে আছে। তুই খালি রাজী হো, সাত দিনের মাথায় তোদের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হবে।
ইমান বলে উঠে, বিয়ে করলে আমি মিরাকেই করব।
— মিরা কে? চিনি না তো।
ইমান বাঁকা হেসে বলে, চিনতে হবে না। শুধু জেনে রাখো মিরাই তোমার ভাইয়ের বউ হবে৷
আকাশ ভাই বলে, বিয়ে-শাদি মনের মর্জিতে করতে হয়।

— মর্জিতেই হবে।
— চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তো। খা।
— ভাইয়া, আমাদের ফেসবুক পেজ আছে?
— কিসের? রেডিও শোয়ের?
— হুম।
— হ্যাঁ আছে তো। তোর পাবলিসিটি অনেক ছিল। মানুষ-জন এখনো তোর খোঁজ করে। নতুনরা তোর জায়গা রিপ্লেস করতে পারেনি। তাছাড়া এই যুগে কেউ আর রেডিও শুনে কই?

— আজকে লাইভে আসি?
আকাশ ভাই প্রথমে বুঝলেন না। পরমুহূর্তেই তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। সে আনন্দিত হয়ে বলে, লাইভ আসতে চাস?
— হ্যাঁ। কেন? সমস্যা আছে লাইভে আসলে?
— আবার জিগায়! সমস্যা থাকবে কেন? এক্ষুনি আসবি?
— না। ঠিক রাত বারোটায় আসব লাইভে৷

ইমান চা শেষ করে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরালো। ভাবী বাসায় নেই। দুই বাচ্চা নিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে ঝগড়া করে, বাবুদের নানুবাড়ি গেছে। ইদ সেখানেই করবে।
সে ফোন বের করে, অন করতেই মিরার ত্রিশটা মিসড কল এবং চল্লিশের উপরে ম্যাসেজ দেখে ভড়কে গেলেও ব্যাপার টাকে আমলে নিল না। মিরা আজ অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করেছে।এর পেছনের কারণ হলো তাকে শাসন করা হয়না। ইমান তাকে কঠিন বকা দিতে চায় কিন্তু পারছে নান।এইজন্য নিরব ঘাতকের মতো নিরব আছেন।দেখা যাক! তার নিরবতায় মিরা কেমন রিয়্যাক্ট করে।

ইমান আর নিজ থেকে মিরার সঙ্গে কথা বলবে না৷ সে ফোন পকেটে রেখে দিয়ে লাইভে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। আজকে অনেকদিন পর এভাবে সবার সামনে কথা বলতে হবে ভেবেই তার নার্ভাস লাগছে।
সে ঢকঢক করে পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে লাইভ প্রোগ্রাম শুরু করে। প্রথম দিকে তেমন কেউ লাইভে ছিল না। কিন্তু ইমান যখন ওই অল্প কিছু সংখ্যক ফ্যানদের সঙ্গে গল্প-গুজব শুরু করে দেয়, মুহূর্তের মধ্যে লাইভটায় মানুষ জয়েন হতে থাকে।
ইমান বেশ ফুরফুরে মেজাজে সবক’টার উত্তর দেয়। এটাও বলে দেয় যে সে খুব দ্রুত সিংগেল থেকে মিঙ্গল হতে যাচ্ছে।

শেহজাদী পর্ব ৩৪

পরেরদিন খুব সকালে মিরার ঘুম ভেঙে যায়। উঠে বসতে চাইলে, সে বুঝতে পারলো, তার মাথা ভার হয়ে আছে। মাথা উঠাতে চাইলেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সে হড়বড়িয়ে মুখ ভর্তি বমি করে দেয়। বমি করার পর ভীষণ অসুস্থ লাগতে শুরু হলো। মনে হচ্ছে অন্য কোন জগৎ থেকে তার ডাক এসেছে, তাকে যেতে হবে।দূর, বহুদূর!

তার চোখ উলটে আসছে। সে নেতিয়ে পড়ে বিছানায়। সম্ভবত জ্ঞান হারাচ্ছে। সূর্যের আলো চোখে এসে লাগছে। খুব করে আম্মু বলে ডাকতে মন চাচ্ছে তার। কিন্তু এক ফোটা শক্তি অবশিষ্ট নেই তার শরীরে। আচমকা এমন শরীর খারাপ হলো কেন? সে কি মারা যাচ্ছে? মাথা ভোভো করছে তার। মনে হচ্ছে মাথায় কোন পোকা ঢুকে গেছে এবং ভোভো করে ডাকছে। ভীষণ যন্ত্রণা হতে লাগলো। সে আবারো বমি করতে লাগলো। জ্বরে গা কাঁপছে, হাত কাঁপছে, ঠোঁট কাঁপছে। আস্তে আস্তে চোখ বুজে আসলো তার। এবারে বুঝি সত্যি সত্যি জ্ঞান হারালো সে।

শেহজাদী পর্ব ৩৬