শেহজাদী পর্ব ৯ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ৯
Arishan Nur

সেকেন্ডের কাটা ১২ থেকে ঘুরতে ঘুরতে আবার ১২ টায় ফিরে আসতে লাগলো। মিনিটের কাটা টা ও তড়িঘড়ি করে চলতে লাগল অবিরাম বেগে সেই সাথে ঘন্টার কাটাটা আস্তে আস্তে ১২-১২ একই জায়গায় ঘুরেফিরে আসতে লাগলো। টিকটিক করে ঘড়ি চলেই যাচ্ছে সেই সাথে মহামূল্যবান সময়গুলো ও৷

সময় আর নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। তাই সময়গুলো ইমানের জন্য অপেক্ষা করেনি। এটা যে তার বৈশিষ্টের মধ্যে পড়ে না। সেজন্যই তো সময় একবারো ফিরে তাকালো না সদ্য মনভাঙা ছেলেটার দিকে৷ কেটে গেল ছয়টা বছর। হ্যাঁ! ছয় বছর। ইংরেজিতে সিক্স ইয়ার। এক যুগের অর্ধেকটা সময় কেটে গেছে। ইমানের চেহারাটাতেও আর বাচ্চামো ভাব নেই বরং চেহারায় গাম্ভীর্য ভাব এসে হানা দিয়েছে৷

ইমান অফিস ডেস্কে ভ্রু কুচকে বসে আছে। ফাইল হাতে নিয়ে বসে আছে৷ তার মেজাজ ভয়াবহ খারাপ। প্রচন্ড রেগে আছে সে। তার মনে হচ্ছে ডেস্কের সবকিছুই ভেঙে-চুরে ফেলতে।
ইমান অতিরিক্ত রাগান্বিত গলায় ডেকে উঠে, আজাদ ভাই! আজাদ ভাই!
সঙ্গে সঙ্গে এক মধ্যবয়সী লোক প্রায় দৌড়ে এলো। ওনার মুখে চিন্তার ভাঁজ।
উনি রুমে দরজা ঠেলে ঢুকতেই ইমান থমথমে গলায় বলে উঠে, এইসব কি দেখছি আমি?
আজাদ নামক লোকটি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে গেল এবং বললো, স্যার,,,,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–, আজাদ ভাই আমি কোন অযুহাত শুনতে চাচ্ছি না! আপনি আমাকে শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দিন, আমাদের কোম্পানি মাত্র তিন মাসে সাড়ে সাত কোটি লস কিভাবে খাইলো?এতোগুলা টাকার ধাক্কা কোম্পানি সামলাবে কিভাবে? আমি কি নিজের পকেট থেকে টাকা দিব এখন? আপনাদের কোন কাজটা করার জন্য হায়ার করা হয়েছে শুনি?
— স্যার আসলে, প্রতিপক্ষ দলেরা অনেক পাবলিসিটি পাচ্ছে এজন্য আমাদের কোম্পানি লসের মুখে চলে যাচ্ছে !

— পাবলিসিটি আর কতোই বা পাবে যে একেবারে তিন মাসে সাড়ে সাত কোটি গচ্চা যাবে? এতো দিন তো ঠিকই আমাদের প্রডাক্টস বাজারে চললো? এখন এমন কি ঘটলো যে আমাদের প্রডাক্ট আর মার্কেটে প্লেস পাচ্ছে না।

— স্যার আসলে রিসেন্টলি “ড্রিম এটিয়ার “( Dream Attire) খুব মার্কেট পাচ্ছে। ওরা গত চার-পাঁচ মাসে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। শুধু তাই না অনলাইন ও মাতিয়ে রেখেছে। ওদের পাবলিসিটির কাছে আমাদের শপ, আউটলেট প্রডাক্ট সব তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ আর কষ্ট করে শো-রুম ভিজিট না করে অনলাইন শপিং করছে৷
ইমান একাউন্টটিং ফাইলটা ডেস্কে রেখে বলে উঠে, ড্রেম এটিয়ার না ফাটিয়ার এই বুটিক হাউজ কি অনলাইন শপ?

— জি স্যার৷
— আজাদ ভাই আপনি একটা সামান্য অনলাইন দোকানের কথা আমাকে কেন শুনাচ্ছেন? সারা বাংলাদেশে আমাদের আউটলেট দশটা। গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডি, বারিধারা বসুন্ধরা ঢাকার চারটা মোস্ট হাই রেটেট প্লেসে আমাদের আউটলেট আছে। এরকম একটা ব্র‍্যান্ডের সাথে কোন বেসিকে আপনি একটা সামান্য লাইভে এসে আপু আপু করা সস্তা দোকানদারের তুলনা করছেন?
আজাদ কিছু বললো না। চুপ থাকলো। স্যারের মুড ভালো নেই। এখন ভালো কথা বললেও ঝারি খেতে হবে তাকে।

ইমান নিজের ফোন হাতে নিয়ে বলে, নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করবেন না। আপনাদের গড়িমসির জন্যই আমাদের কোম্পানি লসের মুখোমুখি হলো। নেক্সটে যেন এমন না হয়।
— স্যার ওদের সিল্ক, ডাবল জর্জেট খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
— ওদের বলতে কাদের? ( ফোন চালাতে চালাতে প্রশ্ন ছুড়ে ইমান।)
— ড্রিম,,,,,

আজাদকে আর কিছু না বলতে দিয়ে ইমান বলে, যান তো আপনি।আর একবার ওই কোম্পানির নামে প্রশংসা করলে আপনাকে আমাদের কোম্পানি থেকে বের করে ওই দোকানের মালিকের এসিস্ট্যান্ট বানানো হবে।
আজাদ হালকা হাসলো। ইমান স্যার অল্পতে রেগে গেলেও মানুষ টা খুবই ভালো। সে পেছনে ফিরে হাঁটা ধরলো।

আজাদ যেতেই ইমান চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরালো। পড়ালেখা শেষ করে সে বাবার বিসনেস সামলাচ্ছে। বিগত ছয় বছরে এতো বড় লসের সম্মুখীন হয়নি ইমান। বাবাকে কি জবাব দিবে সে?
সিগারেটে ঠোঁটে নিয়েই ব্যবসা সংক্রান্ত চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগে তার৷ আসলে চিন্তা ব্যাপার টা কিছুটা প্যাঁচ লাগানো সুতোর ন্যায়। একটা চিন্তা থেকে পলকেই অন্য কোন অবান্তর চিন্তা মস্তিষ্কে প্রবেশ করে বসে। এই যে! ব্যবসা নিয়ে ভাবা শুরু করলেও ইমানের চিন্তাগুলো শেষমেশ মিরা নামক এক কালনাগিনীর কাছে গিয়ে ব্রেক মারলো। ইমানের মস্তিষ্ক প্রথমেই মিরা দুষ্টু হাসিটা নিয়ে ভাবলো। মিরা হাসলে ওর ডাল গালে খুবই সুক্ষ্ম ভাবে একটা টোল পড়ে। টোল পড়া হাসিতে মেয়েটাকে পূর্নিমার শুভ্র আলো লাগে। সঙ্গে সঙ্গে ইমান বিড়বিড় করে বলে, গালে পেশি বিকৃতির জন্য টোল পড়ে। এতে সৌন্দর্যের কিছু নেই।

এরপর ইমানের চিন্তাগুলো ছয় বছর আগে গিয়ে ঝাঁপ মারলো। নিজ উদ্যোগে নিজের হবু বৌকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার পরের দিন গুলো খুব দুর্বিষহ হয়ে পড়ে ইমানের জন্য। ঢাকা থেকে নিজের দাদাবাড়ী ফরিদপুর গিয়ে টানা পাঁচ মাস কাটিয়েছিল ইমান। এই পাঁচ মাসে সবকিছু বদলে যায়। ইমানের ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হয়। এমনকি মিরা নাকি পালিয়ে যাওয়ার সাত দিনের মাথা বাড়ি ফিরে এসেছিল।। এরপর মিরা ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়ার জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়।

এতটুকুই জানে সে।এর বেশি জানে না। এগুলো সে উড়ো খবর পেয়েছে আত্মীয়দের মাধ্যমে। মিরার বাবা-মায়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। কিন্তু বড় মামা প্রতি ইদের ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বলে। দাওয়াত দেয়। ইমান যায়নি। মিরা বিদেশ যাওয়ার পরপরই ইমান ঢাকা ফিরে এসে বাবার কোম্পানিতে ইন্টার্ণ করে। নাম মাত্র ইন্টার্ণশীপ যাকে বলে! কারণ জব তো বাবার কোম্পানিতেই করবে সে!
ইমান ভাবনার সুতো ঠিক তখনই ছিন্ন হলো যখন তার ঠোঁটে জলন্ত সিগারেটের আগুন লাগলো। সে হচকচিয়ে উঠে সিগারেট মুখ থেকে ফেলে দিলো। আরেকটু হলেই ঠোঁট পুড়ে যেত!
সে উঠে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হলো। চোখে-মুখে পানির ছিটা দিয়ে বের হলো। আজকে দুপুরে অফিশিয়াল এক মিটিং এ একটা রেস্টুরেন্টে যেতে হবে তাকে। এখনই রওনা দেওয়া যাক। আগে আগে পৌঁছে গেলে রেস্টুরেন্টে বসে এক কাপ কফি খাওয়া যাবে।

স্বপ্ননীড় ভিলায় আজ খুশির আমেজ।
চারিদিকে খুশি আর হাসির কলকলানির শব্দে ভরপুর বাসাটা। সুপ্তি বেগম বেশ ব্যতিব্যস্ততা দেখিয়ে রান্না করছেন। কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না হয়ে গেছে। গরুর মাংসটা কষানো বাকী। ভাগ্যিস সায়েমা রোস্ট বানিয়ে এনেছিল। নাহলে সে একা হাতে এতোকিছু সামলাতে পারতেন না।
সুপ্তি বেগম আপাতত চিংড়ির মালাইকারী রান্না করছেন। সুপ্তি বেগমের হাতের রান্না চিংড়ির মালাইকারী মিরার খুবই প্রিয়। তাদের বাসার প্রতি টা সদস্য আজকে খুশি কারণ মিরা প্রায় ছ’বছর পর বাসায় ফিরছে। তার ছোট্ট মিরু কত বড় হয়ে গেছে! আর আগের মতো ছোট নেই।

বুদ্ধিমান, বিচক্ষণশীল হয়ে গেছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে আছে। হাজার হোক মা তো সে! মেয়ে যতো ভুলই করুক না কেন মা কখনোই তাকে ভালোবাসা দেওয়া থেকে বঞ্চিত করবে না। তিনি চিংড়িতে নারিকেল পরিমাণ মতো দিলেন৷ অনেকে ভাবে মালাইকারীতে ইচ্ছামতো নারিকেল দিলে স্বাদ দ্বিগুন হয় কিন্তু এটা ভুল ধারনা।

কোন কিছু তেই বেশি বা অতিরিক্ত কল্যাণ বয়ে আনে না। হোক সেটা জীবনে কিংবা তরকারি রান্নায়!
মালাইকারী তেও বেশি নারকেল দিলে একদম ই বাজে স্বাদ হয়!
সুপ্তি বেগম জোরে চিল্লিয়ে বলে, ইরা! এই ইরা এদিকে আয় তো।
ইরা বিরক্তি মুখ নিয়ে রান্নাঘরে এসে বলে, কি হয়েছে আম্মু?
সুপ্তি বেগম ইরাকে দেখে নিলেন একবার। ইরাকে দেখতেই তার বুক ছ্যাত করে উঠে। কি সুন্দর দেখতে হয়েছে তাদের ইরা!

— আম্মু কিছু বলবে?
— দেখতো কয়টা বাজে?
— আম্মু! মিরা আপু সন্ধ্যায় আসবে৷ এখন তো দুপুরই হলো না আর তোমার অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে?
সুপ্তি বেগম হেসে বলে, মেয়েটাকে দেখার জন্য চোখ দিশেহারা হয়ে আছে। তোরা বুঝবি না। তুই আর তোর বাপ দুইজনই গাছ।
ইরা শব্দ করে হেসে বলে, এইসব অনুভূতি প্রকাশ ন্যাকা-ন্যাকা ভালোবাসা আদান-প্রদান আমার অপছন্দ। কাজে সাহায্য লাগবে? পায়েসটা রেধে দেই?

— না। একদম না। তুই পায়েস রান্না করতে পারিস না। মিরুর জন্য আমি নিজ হাতে রান্না করব৷
— খুবই উত্তম। আচ্ছা শুনো, তুমি হয়তোবা আপু আসার খুশিতে ভুলে গেছো কালকে আমার পরীক্ষা তাই দয়া করে আর ডাকবে না। আমি পড়ব এখন। চারটা চ্যাপ্টার রিভাইজ দেয়া বাকি৷ ডু নট ডিস্টার্ব মি আর হ্যাঁ শুনো, আমি এয়ারপোর্টে ও যাব না।

শেহজাদী পর্ব ৮

সুপ্তি বেগম চোখ বড় করে ইরার দিকে তাকিয়ে বলে, কি বলবি তুই? এয়ারপোর্টে কেন যাবি না?
— পড়া আছে আমার। এভাবে দেখানোর কিছু নেই৷ আপু এমন কেউ না যে তাকে দল বেঁধে রিসিভ করতে যেতে হবে।
— তোর যেতে না ইচ্ছা করলে যাবি না।
— আমার ইচ্ছার মূল্য আছে?
— ইরা সামন থেকে দূর হ৷
— আর জ্বালাবে না আমাকে।

ইরা রুমে বসে নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো। ছয় মিনিটের মাথায় আম্মুর ডাক পড়লো। ইরা পুনরায় দরজা খুলে বের হলো৷

ঠিক সন্ধ্যা নামলে, এয়ারপোর্ট থেকে খুবই সুন্দরী একটা তরুণী শাড়ি পড়ে বের হলো। যার আঁচলের প্রতি ভাঁজে মায়া বাঁধা আছে। যার চোখে মুখে আনন্দের শুভ্র ছাপ স্পষ্ট! যার ঠোঁটের কোনে ভুবনমোহিনী সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে।
তরুণীটা এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে একটা চমক খায়। তার নজরে এলো বিশাল বড় প্লাকাডে লেখা ওয়েল টু বাংলাদেশ!
সে হেসে উঠে আস্তে করে আপন মনে বলে , লাভ ইউ ওল!

শেহজাদী পর্ব ১০