অন্তঃদহন পর্ব ২৩
DRM Shohag
হসপিটালের সামনেই অ্যাম্বুলেন্স থামানো। সৌম্য দু’হাতে চোখজোড়া ডলে নিজেকে সামলে নেয়। হাতঘড়িতে একবার সময় দেখল, লেইট হয়েছে ভালোই। সৌম্য একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিলে ইরাকে দু’হাতে কোলে তুলে নেয়। এরপর অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে ইরার মায়ের উদ্দেশ্যে মৃদুস্বরে বলে,
– আন্টি আসুন।
ইরার মা হিজাবে চোখের পানি মুছে সৌম্য’র পিছু পিছু যায়। ইরার শরীর ছেড়ে দেয়া, অনেক শুকিয়েছে মেয়েটা। সৌম্য চোখ নামিয়ে নিস্তেজ ইরার পানে তাকায়। তার ইরাবতী কি আর সুস্থ হবে না? ঢোক গিলল। সে ঠিক সুস্থ করে তুলবে তার ইরাবতীকে।
ডক্টর ইরাকে লাইফ সাপোর্টে রেখেছে। জানিয়েছে উন্নতি, অবনতি কোনোটাই হয়নি। আগের মতোই। সৌম্য’র অফিসে লেট হয়েছে। সে ইরার মায়ের সামনে গিয়ে বলে,
– আন্টি ইরাকে কোথাও নিয়ে যাবেন না প্লিজ! হসপিটালে রেখে ওর চিকিৎসা করালে ও দ্রুত সুস্থ হয়ে যেতে পারে।
একটু থেমে আবার-ও বলে,
– আর আমি দুই-তিন ঘণ্টা পর আসছি। অফিস থেকে ছুটি নিতে হবে। আপনি থাকতে পারবেন না একা?
ভদ্রমহিলা মৃদুস্বরে বলে,
– আচ্ছা বাবা আসো। আমি আছি।
সৌম্য পাশেই একজন অপরিচিত ছেলের দিকে তাকায়, যার দৃষ্টি তার-ই দিকে। ছেলেটি ইরার মাথার কাছে বসে ছিল। ব্যাপারটি সৌম্য তখন আমলে না নিলেও এখন বিরক্ত হলো। ইরা যেমন পোষাক পরুক, যেভাবেই থাকুক, ও ছেলেদের সাথে সবসময় অনেক ডিস্টেন্স রাখতো। যেটা সৌম্য’র ভীষণ ভালো লাগতো।
ছেলেটি এগিয়ে এসে সৌম্য’র দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সালাম দিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– ভাইয়া আমি ইরা আপুর মামাতো ভাই ইহাব।
সৌম্য ছেলেটির সাথে হাত মিলিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
– আন্টিকে দেখে রেখ। তবে ইরাবতীর থেকে দূরে থাকবে। ওকে আন্টি দেখে রাখবে। আসছি।
কথাটা বলে সৌম্য দ্রুতপায়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে যায়।
ইহাব ভোতামুখে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে রইল। সে ইরার থেকে গুণেগুণে চার বছরের ছোট। সৌম্য কি বুঝে কথাটা বলে গেল, সে তো বুঝেছে। ইরার মায়ের দিকে তাকালে দেখল সে-ও অদ্ভুদভাবে তার দিকে চেয়ে আছে। ইহাব গলা ঝেড়ে বলে,
– ফুপি আমি ইরা আপুকে বড় বোন ভাবি, সত্যি।
ইরার মা চোখে পাননি নিয়েই মৃদু হেসে বলে,
– পা’গ’ল ছেলে। সৌম্য তোকে ওভাবে চেনে না। তাই এভাবে বলেছে। আমি তো সৌম্যকে দেখে ভেবেছিলাম, ছেলেটা হয়তো বিয়ে করে নিয়েছে। কিন্তু ইরার প্রতি ছেলেটার এখনো কত টান দেখলি! সৌম্য’র অছিলায় আমার ইরা মা সুস্থ হয়ে যাক।
ইহাব তার ফুপির কথা শুনলো। মৃদুস্বরে বলে,
– সৌম্য ভাইয়া যদি বিয়ে করে নেয় ফুপি? ধর, পুরনো প্রেমিকাকে দেখে ইমোশনাল হয়ে গিয়ে ইরা আপুর জন্য এতোকিছু করল। অথচ বাসায় বউ আছে। ড্রেসআপ দেখে তো মনে হলো ভালো মানের চাকরি করে।
ইহাব এর কথায় ইরার মায়ের চোখেমুখে অসহায়ত্ব দেখা দিল। সত্যি-ই তো! এরকম হলে কি হবে? তার ইরা কি আর সুস্থ হবে না? ভাবনার মাঝেই পিছন থেকে সৌম্য ইহাবের শার্টের কলার টেনে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– বে’য়া’দ’ব ছেলে। কোন সাহসে তুমি আমার শ্বাশুড়ির কান ভাঙাচ্ছ?
ইহাব চোখ বড় বড় করে তাকায় সৌম্য’র দিকে। সৌম্য খেয়ে ফেলা চোখে ইহাবের দিকে চেয়ে আছে। ইহাব ঢোক গিলল। সৌম্য চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
– সৌম্য’র দেহে প্রাণ থাকতে, সে তার ইরাবতী ছাড়া অন্যকাউকে কল্পনা করার কথা কখনো ভাবেনি, আর না তো কখনো ভাববে।
তোমাদের মতো ফাঁপা মাথার ছেলেরা এসব বুঝবে না।
কথাটা বলে সৌম্য ইহাবের কালর ছেড়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই ইরার এই অবস্থায় সে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে এই ছেলেকে তার বিরক্ত লাগলো, এখন এই ছেলে তাকে পুরো বিবাহিত বানিয়ে দিয়েছে। এতো রা’গ লাগছে! চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করল। এরপর ইরার মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
– আন্টি স্যরি! আপনার নাম্বারটা দিন।
ইরার মা সৌম্য’র দিকেই চেয়ে আছে। তিনি কি রিয়েকশন দিবেন সেটাই বুঝতে পারছে না। নিজেকে সামলে তার নাম্বার বললে সৌম্য তার ফোনে নাম্বারটি সেভ করে নেয়। এরপর দ্রুতপায়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে ইহাবের দিকে শক্ত চোখে তাকায় একবার। ইহাব ঢোক গিলে। মনে মনে তওবা করল, আর জীবনে ধারণা করে একটা কথা-ও বলবে না।
ইরার মা ইহাবের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– কি যেন বলছিলি?
ইহাব আমতা আমতা করে বলে,
– আমি তো ইরা আপুর কথা ভেবেই বলছিলাম। তোমাদের নিয়ে আর কিছু বলবোই না আমি।
ইরার মা একটু হাসলো। আশেপাশে তাকালো। তার ভাই অর্থাৎ ইহাবের বাবা এসেছে সাথে। কি যেন কাজে কই যে গেল!
আকাশ কলেজ থেকে উল্টোপথে কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামায়। গত একবছর যাবৎ ঢাকা উত্তর মহানগরের সভাপতি আছে আকাশ। এতোদিনে মন্ত্রী হয়ে যাওয়ার কথা তার। কিন্তু আকাশ এমপি পদ টুকু-ও গ্রহণ করেনি। সে সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেই হিমশিম খায়। কারণটা অবশ্যই সন্ধ্যা। মাঝে মাঝে এতো ডিপ্রেসড হয়ে যায়, কোনো কাজ-ই করেনা। তার সভাপতির খবর তার মা জানে। কিছু বলেনি আকাশকে। সন্ধ্যা পুড়ে গিয়েছে, এরপর থেকে আকাশ অনেক অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। আসমানী নওয়ান নিজেকে সামলাতে পারতেন না, ছেলেটাকে দেখে-ও ভীষণ বুক পুড়তো। আকাশ যদি একটু-আধটু স্বাভাবিক হয়, এজন্য সে আকাশকে এই পদ থেকে সরতে বললেননি। উল্টে আকাশের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন আকাশ চাইলে উপর পদগুলো নিতে পারে। আকাশ মত দেয় না। সে পারবে না। সবার কথা ভাবতে গিয়ে সে তার সন্ধ্যামালতীর কথা ভুলতে পারবে না।
আকাশ গাড়ি থেকে নেমে সামনে ক্যাফের দিকে যেতে নিলে নিয়াজকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। আকাশের মায়ের চিকিৎসা নিয়াজ করে সবসময়। আকাশ আর নিয়াজের মাঝে সম্পর্ক দহরমমহরম-ও নয়, আবার একেবারে খারাপ-ও নয়।
নিয়াজ রাজনীতির মাঠ থেকে আপাতত ইচ্ছে করেই সরে আছে। মূলত তার বাবা নিষেধ করেছে। বাবার উপর কথা বলতে পারেনি সে।
আকাশ নিয়াজের দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কিছু বলবে?
নিয়াজ গলা ঝাড়লো। আসমানী নওয়ানকে চিকিৎসার খাতিরে নিয়াজের সাথে আসমানী নওয়ানের, মা ছেলের মতো একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ভদ্রমহিলা নিয়াজকে বলেছে আকাশকে যেন একটু বোঝায়, সে আবার-ও নতুন করে জীবন শুরু করে। নিয়াজ অনেক ভেবেচিন্তে আসমানী নওয়ানের কথা ভেবে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অতঃপর গলা ঝেড়ে বলে,
– হ্যাঁ। তোমার জন্য মেয়ে দেখেছি। মেয়েটি সন্ধ্যার মতো-ই অনেকটা। তুমি মেয়েটিকে কখন দেখতে যেতে পারবে?
আকাশ রে’গে বলে,
– মানে?
নিয়াজ আবার-ও বলে,
– তোমার মা তোমার চিন্তায় দু’দিন পর পর অসুস্থ হয়। আর তাছাড়া জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। তুমি সন্ধ্যাকে ভুলে নতুন কাউকে………
বাকিটুকু শেষ করার আগেই আকাশ নিয়াজকে ধাক্কা দিয়ে একটি দেয়ালের সাথে চেপে ডান হাতে সর্বশক্তি দিয়ে গলা চেপে ধরে। রা’গে আকাশের কপালের রগ ফুলে উঠেছে। বা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখা। চোয়াল শ’ক্ত। ভাবটা এমন যেন, আজ নিয়াজকে মে’রে তবেই দম নিবে। নিয়াজের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। বেচারা বুঝতেই পারেনি আকাশ এরকম কিছু করতে পারে। দু’হাতে আকাশকে কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু সে ঠিক করে নিঃশ্বাস নিতে না পারায়, কায়দা করতে পারছে না।
সামনের ক্যাফে থেকে অরুণ বেরিয়ে এসে আকাশ আর নিয়াজকে দেখে বিস্ময় চোখে তাকায়। যদি-ও আকাশের মুখে মাস্ক। কিন্তু অরুণের চিনতে অসুবিধা হলো না। সে দৌড়ে এসে দু’হাতে আকাশকে পিছন থেকে সাপ্টে ধরে বলে,
– আরে ছাড়। এ্যাই আকাশ? আল্লাহ! নিয়াজ ম’র’বে তো!
অরুণ এসে ধরায় এবার নিয়াজ একটু শ’ক্তি পেয়ে আকাশকে ধাক্কা মে’রে সরিয়ে দিয়ে গলায় হাত দিয়ে সমানে কাশতে থাকে।
আকাশ আবার-ও তেড়ে যেতে নেয়। অরুণ আকাশকে টেনে ধরে বলে,
– তুই কি পা’গ’ল হলি? নিয়াজ কি করেছে?
আকাশ অরুণকে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বলে,
– ওর সাহস কি করে হলো আমার সন্ধ্যাকে ভুলে যেতে বলার? ওকে আজ মে’রে’ই ফেলব আমি। আবার বলছে মেয়ে দেখতে যেতে। ওর চৌদ্দ গুষ্টিকে বিয়ে করিয়ে দিব আমি।
আকাশের কথা শুনে অরুণ আর নিয়াজ চোখ বড় বড় করে তাকায়।
আকাশ কথাটা বলে আবার-ও নিয়াজের দিকে এগিয়ে যেতে নিলে অরুণ আকাশকে টেনে ধরে বলে,
– আরে থাম থাম। ভুল করে বলে ফেলেছে। আর বলবে না। মিস্টেক।
আকাশ অরুণকে সরিয়ে দিয়ে বিরক্তিতে মুখের মাস্ক খুলে ছুঁড়ে ফেলে। অরুণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এতোক্ষণ অনেকে আকাশকে না চিনলেও এবার মাস্ক না থাকায় চিনতে পেরে কেউ কেউ এগিয়ে এসে আকাশকে সালাম দেয়। আকাশ রে’গে তাকায়৷ ছেলেটির কলার ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– সালাম চেয়েছি আমি? কোনো কাজ নেই?
ছেলেটির বয়স আকাশের থেকে দু’এক বছর কম হবে। সে চোখ বড় বড় করে তাকায়। অনুতপ্ত স্বরে বলে,
– স্যরি!
অরুণ হতাশ চোখে চেয়ে রইল। আকাশ ছেলেটির কলার ছেড়ে চোখ পাকিয়ে বলে,
– আরেকবার সালাম দিতে আসলে থা’প্প’ড় একটা-ও মাটিতে পড়বে না।
ছেলেটি দ্রুতপায়ে জায়গা প্রস্থান করে। আরও অনেকে এগিয়ে আসতে গিয়ে আকাশের রিয়েকশন দেখে ওখান থেকেই মোড় ঘুরিয়ে নিয়েছে।
আকাশ নিয়াজের দিকে আরেকবার শ’ক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বড় বড় পা ফেলে তার গাড়িতে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এখান থেকে চলে যায়।
অরুণ পাশের দোকান থেকে একটি পানির বোতল কিনে এনে নিয়াজের দিকে বাড়িয়ে দিলে নিয়াজ পানির বোতলটি নিয়ে ছোট করে বলে,
– থ্যাংক্স!
এরপর বোতলের অর্ধেক পানি খেয়ে নেয় নিয়াজ। অরুণ চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– তুমি আকাশকে সন্ধ্যাকে ভুলে যাওয়ার কথা, আবার অন্যকে বিয়ের কথা বলতে গিয়েছ কেন?
নিয়াজ একবার কেশে বলে,
– আন্টি বলতে বলেছিল।
আসমানী নওয়ানের অসুস্থতার চক্করে নিয়াজের সাথে তাদের সবারই একটা ভালো বন্ডিং তৈরী হয়েছে। এজন্য অরুণ নিয়াজ একে অপরের সাথে এতো ফ্রিলিলি কথা বলছে।
অরুণ অবাক হয়ে বলে,
– আন্টি বলতে বলল, আর তুমি বলে দিলে? আন্টি তো আমাকেও নিয়ম করে বলতে বলে।
নিয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– তুমি আকাশকে বোঝাওনি?
অরুণ অসহায় মুখ করে বলে,
– আমাকে পা’গ’লা কু’ত্তা তো দূর, ভালো কু’ত্তা-ও কা’ম’ড়া’য় নি। এসব বলে নিজের জীবন নিয়ে টানাটানি করব না-কি! দেখলে না, তোমার কি অবস্থা করছিল!
নিয়াজ কিছু বলল না। মনে হচ্ছে এখনো কেউ তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। আসমানী নওয়ানের সাথে তার ভালো সম্পর্ক না থাকলে এই আকাশের মায়ের চিকিৎসা-ই করতো না সে। তার মা নেই। আসমানী নওয়ান খুব মিশুক টাইপ। নিয়াজের মায়া লাগে। আর এজন্য উপকার করতে এসেছিল। কিন্তু রিয়েকশন তো উল্টো হয়ে গেল!
এখন দুপুর একটা। সৌম্য অফিস থেকে দু’দিনের ছুটি নিয়েছে। এরপর রিহানের কাছে গিয়ে ডাকে,
– রিহান?
সৌম্যকে দেখে রিহান চেয়ার থেকে উঠে এসে দাঁড়ায়। ইরার ব্যাপারে সৌম্য তাকে অফিসে এসেই জানিয়েছে। সে কিভাবে সৌম্যকে সান্ত্বনা দিবে সেই ভাষা সে খুঁজে পায় না। মৃদুস্বরে বলে,
– ছুটি পেয়েছিস?
সৌম্য ছোট করে বলে,
– হুম।
– প্রয়োজন হলে কল দিস।
সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– বোনুর বিকাল ৫ টায় ছুটি হবে। তুই বোনুকে নিয়ে হসপিটালে আসতে পারবি?
রিহান সম্মতি দিয়ে বলে,
– আচ্ছা সন্ধ্যাকে আমি নিয়ে আসব। চিন্তা করিস না।
সৌম্য আবার-ও বলে,
– সাথে কাজি নিয়ে যাবি।
রিহান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– মানে? কাজি দিয়ে কি করবি?
সৌম্য কিছুটা রে’গে বলে,
– যা বললাম কর। না পারলে বল। আনি ম্যানেজ করব।
– আরে রে’গে যাচ্ছিস কেন? নিয়ে যাব। চিন্তুা করিস না। কিন্তু….
সৌম্য আর এখানে দাঁড়িয়ে সময় ন’ষ্ট করল না। ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যায়।
রিহান মাথা চুলকে বিড়বিড় করে,
– হসপিটালে কাজি দিয়ে কি হবে?
সৌম্য হসপিটালে আসার সময় কিছু খাবার কিনে এনেছে ইরার মায়ের জন্য। ইরার মা সৌম্যকে দেখে এগিয়ে এসে বলে,
– এতো তাড়াতাড়ি আসতে পারলে বাবা?
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– জ্বি আন্টি। ছুটি নিয়েছি।
পাশ থেকে ইরার মামা বলে,
– তুমি-ই সৌম্য?
সৌম্য ভদ্রলোকটির দিকে তাকায়। হুম বলে সম্মতি দেয়। ভদ্রলোক তার বোনের উদ্দেশ্যে বলে,
– ছেলে তো ভালো। ইরার বাবা মানলো না কেন? আজব!
এরপর এগিয়ে এসে সৌম্য’র কাঁধে হাত রেখে বলে,
– সে যাক, শুনেছিলাম তুমি না-কি বেঁচে নেই। এখন আবার দেখি হেঁটে বেড়াচ্ছ। বেঁচে আছো ভালো করেছ। আমাদের ইরা মায়ের সুস্থ হওয়ার চান্স আছে। চিন্তা কর না। এবার আমি নিজে দাঁড়িয়ে তোমাদের বিয়ে দিব। কি সুন্দর ছেলে!
ইরার মামার কথায় ইরার মা, সৌম্য দু’জনেই কেমন যেন অপ্রস্তুত হলো। ইরার মামার ঠাস ঠাস করে কথা বলার অভ্যাস। তবে মিশুক।
এদিকে সৌম্য অপরিচিত কারো সাথে হুট করে মিশতে পারেনা। ইরার মামার কথায় বেশ বিব্রতবোধ করছে সে। নিজেকে সামলে বলে,
– আমার বাসা এখান থেকে বেশি দূরে নয়। আপনারা আমার বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিন। আমি এখানে আছি।
ইরার মামা স্বভাবসুলভ বলে,
– হ্যাঁ দাও তো চাবিটা। আমি ইরার মাকে বলছিলাম, চাবিটা কেন নিল না! জামাই হওনি। কিন্তু হয়েই তো যাবে! আমরা অযথা হবু জামাইয়ের বাড়ি রেখে সকাল থেকে ক’ষ্ট করছি। এভাবে থাকতে থাকতে অস্থির লাগছে।
ইহাব তার বাবার কান্ডে বিব্রত হলো। সৌম্য এ পর্যায়ে একটু হাসলো। ইরার আত্মীয়দের সাথে কখনো তার দেখা হয়নি। মনে পড়ল, ইরা তার মামাতো বোন। কথাটা ভাবতেই কেমন অদ্ভুদ লাগলো সৌম্য’র।
ইরার মা তার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
– ভাইজান ও জ্যোৎস্নার ছেলে, ইরার ফুফাতো ভাই। ভুলে গেছ?
ইরার মামা জিহ্বায় কা’ম’ড় দিয়ে বলে,
– ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ। ভুলেই গিয়েছিলাম।
সৌম্য পকেট থেকে চাবি বের করে দেয়। তার বাসার এড্রেস দেয়। এখানের ক্যান্টিন থেকে তিনজনের জন্য বেশি করে খাবার কিনে ইরার মায়ের হাতে দেয়। ইরার মা, মামা নিতে চাইছিল না। সৌম্য জোর করে ধরিয়ে দিয়েছে।
সৌম্য দরজা ঠেলে আইসিইউ রুমে প্রবেশ করে। ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে ইরার মাথার কাছে দাঁড়ায়। চোখেমুখে অসহায়ত্ব। শেষবার যেদিন সৌম্য ইরাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। সেদিনের কথা মনে পড়ে যায়। ইরা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। কেঁদে কেঁদে বলছিল, তাকে বিয়ে করে নিতে। তার সাড়া না পেয়ে এক পর্যায়ে পা ধরে কত কাঁদলো। সৌম্য স্বার্থপরের মতো তার ইরাবতীকে বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল। ইরার বলা কিছু কথা কানে স্পষ্ট বাজলো,
– তবে তুই আমাকে ভালোবাসবি সৌম্য?
– অনেক ভালোবাসি।
– ২৫ বছরের মেয়ে হয়ে ১৫ বছরের মেয়ের মতো পা’গ’লা’মি করে তোকে অনেক বিরক্ত করেছি। পারলে ক্ষমা করিস সৌম্য। ভালো থাকিস।
সৌম্য’র চোখজোড়া ঝাপসা হয়। একটুখানে ঝুঁকে ইরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ভারী গলায় মৃদুস্বরে আওড়ায়,
– তোকে অনেক ভালোবাসবো ইরাবতী। তুই ১৫ বছরের মেয়ের চেয়ে-ও বেশি পা’গ’লামি করবি? তোর ভাষায় আবার আমায় কবে বিরক্ত করবি ইরাবতী?
আমি তোর জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করব। আমাকে একা ফেলে যেন যাস না। একদিন হলেও তোকে ভালোবাসার সুযোগ দিস। নয়তো আমি ম’রে গিয়েও শান্তি পাবো না।
কথাগুলো বলতে বলতে সৌম্য’র চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। সৌম্য নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শার্টের হাতা দিয়ে চোখজোড়া মুছে নেয়। ডান হাত ইরার মাথায় রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– তোর সৌম্য তোকে ছাড়া একটু-ও ভালো নেই ইরাবতী। দ্রুত অভিমান ভেঙে উঠে পড়। আমি আমার ইরাবতীর অভিমান ভাঙানোর অপেক্ষায়, আমার ইরাবতীকে ভালোবাসার অপেক্ষায় আছি।
কথাগুলো বলে সৌম্য বেশ কিছুক্ষণ ইরার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। যেন কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে তার ইরাবতী। সৌম্য চেয়ার টেনে ইরার মাথার কাছে বসল। মলিন মুখে ইরার দিকে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ পেরোতেই সৌম্য’র চোখজোড়া আবার-ও ঝাপসা হয়। বিড়বিড় করে,
– আমার ইরাবতীর ঘুম ভাঙিয়ে দাও আল্লাহ!
সন্ধ্যা কমন রুমে বসে আছে। সে আজ একটা ক্লাস-ও করেনি। লামিয়া বাইরে গিয়ে তার জর্জেট ওড়না খুঁজেছিল, পেয়েছিল-ও। কিন্তু ওড়নাটি ময়লার স্তূপ এর মধ্যে যাচ্ছেতাই হয়ে গিয়েছে। তাই সন্ধ্যা মাথায় দেয়ার মতো কিছু পায়নি। লামিয়া সন্ধ্যাকে ঝাঁকিয়ে বলে,
– কি ভাবিস?
সন্ধ্যা তার ফোনে কিছু টাইপ করে লামিয়ার দিকে ধরে। লামিয়া লেখাটি পড়ল,
– তোদের সভাপতির স্বভাব ন’ষ্ট। মেয়ে মানুষের জামাকাপড় ধরে টানাটানি করে। এসব মানুষ সভাপতি বলেই সমাজের আজ এতো করুণ অবস্থা!
লামিয়া লেখাগুলো পড়ে চোখ বড় বড় করে তাকায়। সন্ধ্যার হাত থেকে ফোনটি কেড়ে নিয়ে মেসেজটি তার হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড করে সন্ধ্যাকে সন্ধ্যার ফোন ফিরিয়ে দেয়। সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। লামিয়া মিটিমিটি হেসে সন্ধ্যার দিকে ফোন তাক করে বলে,
– তোর নাম্বার থেকে সভাপতিকে নিয়ে একটা বেফাঁস কথা বেরিয়েছে। এটা যেকোনো সময় আমি পাবলিক করে দিয়ে তোকে বাঁশ খাওয়াতে পারি। দারুণ না!
সন্ধ্যা বিস্ময় চোখে চেয়ে মাথা দু’দিকে নাড়ায়। অসহায় চোখে তাকায় লামিয়ার দিকে। লামিয়া পাত্তা দিল না। সন্ধ্যার কাহিনী সে জানে। সোহা, সাধন থেকে শুরু করে, সন্ধ্যার এক স্বামী ছিল সবই সন্ধ্যা তাকে বলেছিল। তবে সন্ধ্যার স্বামীর নাম জানেনা। সন্ধ্যা-ই বলেনি। সে-ও জিজ্ঞেস করেনি। এসব নিয়ে মাথা ব্য’থা নেই তার।
আসল কাহিনীটা হলো সন্ধ্যা সোহাকে মনে করে মাঝে মাঝেই তাকে বলে, তার কোনো বান্ধবী লাগবে না। লামিয়া যেন তার থেকে দূরে থাকে। লামিয়া রে’গে যায়। এসব কি কথা! আবার সন্ধ্যার জন্য খারাপ-ও লাগে। আসলে সোহাকে হারিয়ে সন্ধ্যা ভ’য় পায়। লামিয়া বোঝে। কিন্তু তাই বলে সে সন্ধ্যার থেকে দূরে থাকবে? কি সুন্দর একটা মেয়ে!
সন্ধ্যা লামিয়ার ফোন কেড়ে নিতে চাইলে লামিয়া ফোন তার পিছনে নিয়ে বলে,
– লাভ নাই। আর একদিন যদি আমাকে বলেছিস, তোর থেকে দূরে থাকতে,, সেদিন তুই ভাইরাল। যে সে ভাইরাল নয়, সভাপতিকে ন’ষ্ট চরিত্র বলায় ভাইরাল।
ওহ আমি তো আরেকটা কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। সে আমাদের এই আধা সরকারি কলেজের-ও সভাপতি, বুঝলি?
তাই এখন থেকে আমার সাথে ভেবেচিন্তে কথা বলবি।
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। এই কলেজের-ও সভাপতি? তার এই কলেজে বোধয় আর জায়গা হলো না। সৌম্য ভাইয়াকে এখন সে কি বলবে? এসব ভেবেই সন্ধ্যার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
আকাশ নিয়াজের সাথে ঝামেলা করার পর বাড়িতে গিয়েছিল। বাড়িতে গিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিলে সন্ধ্যার নুপুরজোড়া পায় না। নুপুর দু’টো সবসময় তার পাঞ্জাবির পকেটে রাখে। কিন্তু আজ কোথায় কিভাবে হারালো? আকাশ তখন-ই বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। সারাদিন রাস্তার ছেলেদের মতো সেই নুপুরজোড়া খুঁজল। কিন্তু কোথাও পায়নি। এখন এসে দাঁড়িয়েছে নিয়াজকে লাস্ট যেখানে মে’রেছিল। এখানে আশেপাশে এতো খোঁজাখুঁজি করল। রাস্তার আনাচে-কানাচে খুঁজল। আশেপাশের অনেকে তাকাচ্ছিল বারবার। পরনে ভদ্রলোকের পোষাক। কাজ বলছিল, রাস্তার ছেলে। তাকানো-ই স্বাভাবিক।
আকাশ সেসব পাত্তা দেয়নি। রাস্তায় বের হলে মুখে মাস্ক সবসময় থাকে, তাই অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এতো খুঁজেও নুপুরজোড়া কোথাও পেল না। আকাশ অসহায় চোখে তাকালো।
সন্ধ্যাকে এই নুপুরজোড়া সে কিনে দিয়েছিল। সন্ধ্যা যে তার দেয়া নুপুর পড়েছিল, আকাশ তা দেখেছিল। হলুদ শাড়ি, আলতা রাঙা পা, দু’পায়ে তার দেয়া নুপুর, লম্বা কেশের অধিকারী এক চঞ্চল ভেজা সন্ধ্যা নৃত্য করছিল।
আজও আকাশের চোখের সামনে সেই দৃশ্য স্পষ্টভাবে ধরা দেয়।
আকাশের দমবন্ধ লাগলো। তার কাছে সন্ধ্যার স্মৃতি হিসেবে তিনটে জিনিসের মধ্যে এই নুপুরজোড়া ছিল একটি স্মৃতি। যেটাতে সন্ধ্যার পায়ের ছোঁয়া ছিল। কিন্তু সে তো হারিয়ে ফেলল। এলোমেলো দৃষ্টি এখন-ও ছোটাছুটি করছে রাস্তায়। ইতিমধ্যে চোখ দু’টো লাল হয়ে গিয়েছে।
তার কাছে থেকে তার সন্ধ্যামালতী হারিয়ে গিয়েছে। মেয়েটির সামান্য স্মৃতিটুকু-ও সে হারাতে বসেছে। আকাশের বাচ্চাদের মতো কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চোখের কোণে জলকণা জমেছে।
দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরে চোখ বুজে বিড়বিড় করে,
– কেন আমাকে একা ফেলে চলে গেলে সন্ধ্যামালতী?
পায়ের কাছে একটি বাচ্চা এসে দাঁড়িয়ে আকাশের পাঞ্জাবি ধরে টানে। আকাশ চোখ মেলে বাচ্চাটির দিকে তাকালে দেখল বাচ্চাটি তার পাঞ্জাবি টেনে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ কিছু বলল না। ডানহাতে চোখ দু’টো ডলে আবার-ও আশেপাশে তাকায়। এরপর বাচ্চাটির দিকে তাকায়। বাচ্চাটিকে দেখে মনে হচ্ছে রাস্তায় থাকে। আকাশ বাচ্চাটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। মেয়েটিকে কিছু কিনে দিবে এটাই উদ্দেশ্য।
কিছু বলতে গিয়ে-ও থেমে যায় বাচ্চা মেয়েটির গলায় চোখ পড়লে। আকাশ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। মেয়েটি সন্ধ্যার নুপুর দু’টো একসাথে করে মালা বানিয়ে গলায় পরেছে। আকাশ অবাক হয়ে বলে,
– এই নুপুর কোথায় পেয়েছ তুমি?
মেয়েটি আদোআদো স্বরে বলে,
– এটা আমাল।
আকাশ দ্রুত মেয়েটির গলা থেকে নুপুর দু’টো খুলে নেয়। সে এই নুপুর না চিনলে তার জীবন-ই বৃথা যাবে। দিনে ২৪ ঘণ্টায় ২৪০০ বার কল্পনা করে তার কিনের দেয়া নুপুর পরিহিত সন্ধ্যার পা। আর সে চিনবে না এই নুপুর? এটা হয়?
তাছাড়া এই বাচ্চা এটা কুড়িয়ে পেয়েছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
নুপুর দু’টো খুঁজে পেয়ে আকাশ যেন জানে প্রাণ ফিরে পেল।
বাচ্চাটি কান্নামাখা গলায় বলে,
– তুমি আমাল দিনিস নিচ কেনু?
আকাশ নুপুর দু’টো তার পাঞ্জাবির পকেটে রেখে বাচ্চাটির গাল টেনে মৃদু হেসে বলে,
– বাবু মিথ্যা বললে আল্লাহ জিভ কেটে নেয়। আর কখনো মিথ্যা বলবে না কেমন?
এবার বাচ্চাটি নিজে থেকেই বলে,
– ওটা আমাল না। আমি কুলিয়ে পেয়েচি।
আকাশ মৃদু হাসলো। বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে একটি দোকানে নিয়ে যায়। যা যা কিনে চাইলো, আকাশ সব কিনে দেয়। এরপর বাচ্চাটিকে কোল থেকে নামিয়ে দিলে সে দৌড় দেয় তার মায়ের দিকে। আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
পকেট থেকে নুপুর দু’টো বের করে হাতের তলায় রাখে। নুপুর দু’টো তে দৃষ্টি রেখে মলিন হেসে বিড়বিড় করল,
– হারিয়ে যাওয়া সন্ধ্যামালতীর স্মৃতিটুকু-ই আমার বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় অবলম্বন।
সন্ধ্যা এখন-ও কমন রুমে। আর ৩০ মিনিট পর কলেজ ছুটি হবে। সন্ধ্যা কলম দিয়ে বেঞ্চের উপর গাঢ় করে লিখেছে – [আকাশ + সন্ধ্যা]
সন্ধ্যার দৃষ্টি আটকে আছে লেখাটির দিকে। তার বুক টিপটিপ করছে। সে কেন লিখেছে এটা? চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে সন্ধ্যার।
এই শহরে আসার কতমাস পেরিয়ে গেল, অথচ আকাশকে সে একদিন-ও দেখল না। আকাশ কি তাকে একটু-ও খোঁজে না? একেবারেই ভুলে গিয়েছে তাকে?
সে বকুল ফুলের দু’টো মালা গেঁথেছিল। একটি আকাশকে রাখতে বলে এসেছিল। সন্ধ্যার ধারণা সে নিজের কাছে যে মালাটি এনেছিল, সেটি পুড়ে গিয়েছে। কিন্তু আকাশ কি তার মালাটি রেখে দিয়েছে? না-কি ফেলে দিয়েছে?
সন্ধ্যা বেঞ্চের উপর লেখার আকাশ অংশের উপর তার ডান হাত উপুর করে রাখলো, যেন আকাশকে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে রেখেছে।
এরপর তার হাতের উপর কপাল ঠেকিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। তার ভীষণ মনে পড়ছে আকাশের কথা। সে কেন ভুলতে পারে না ওই মানুষটাকে?
লামিয়া ওয়াশরুমে গিয়েছিল। সন্ধ্যার পাশে এসে সন্ধ্যাকে দেখে অবাক হলো। মেয়েটি থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। সন্ধ্যাকে ঝাঁকিয়ে বলে,
– সন্ধ্যা কি হয়েছে তোর?
লামিয়ার গলা পেয়ে সন্ধ্যা দ্রুত মাথা তুলে বা হাতে চোখমুখ মুছে নেয়। জোরপূর্বক হেসে মাথা নেড়ে বোঝায়, – কিছু না।
লামিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সন্ধ্যাকে তার একটু অস্বাভাবিক লাগে। শান্তশিষ্ট আলাদা। সন্ধ্যা তেমন নয়। তার মনে হয়, সন্ধ্যা মারাত্মক ডিপ্রেশনে থাকে। লামিয়া অবাক হয় না। সন্ধ্যার সাথে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনার পর এই মেয়ে যে সুস্থভাবে বেঁচে আছে এটাই তার কাছে বেশি মনে হয়।
লামিয়া সন্ধ্যার মুখ ভালোভাবে মুছে দিয়ে দিয়ে বলে,
– নাচের রুমে চল। একটু পর ছুটি হবে।
সন্ধ্যা তার ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে লামিয়ার সাথে কমন রুম থেকে বেরিয়ে একটি বড় রুমে যায়, এখানে নাচ প্রাকটিস করে অনেকে। সবাই নাচের রুম বলে। লামিয়া সন্ধ্যার ঘাড় থেকে ব্যাগ তার কাছে নিয়ে বলে,
– আমরা সবাই তোর নাচ দেখার জন্য বসে আছি। নে শুরু কর। না করবি না কিন্তু। তোর নাচ অনেক সুন্দর। আমি দেখেছি। এবার আমার বান্ধবীদের দেখা।
সন্ধ্যা রুমের চারপাশে তাকালে দেখল লামিয়া ছাড়া-ও আরও ছয়জন মেয়ে বেঞ্চের উপর বসে আছে। সন্ধ্যা বিব্রতবোধ করল। সে লামিয়ার সামনে অনেক নেচেছে। এরা সবাই তার ক্লাসের-ই, সন্ধ্যার সাথে কথা-ও বলে। কিন্তু প্রথমবার নাচতে কেমন যেন লাগছে। একজন মেয়ে বলে ওঠে,
– একটু নাচ বইন। লামিয়ার মুখে সারাদিন তোর নাচের প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার বদ’হজম হচ্ছে। তুই নেচে আমাদের দেখার সুযোগ করে দে, সাথে আমার সুহজম হতে হেল্প কর।
মেয়েটির কথায় সবাই শব্দ করে হেসে ফেলল। সন্ধ্যা-ও একটু হাসলো। পায়ের জুতো জোড়া খুলে একপাশে রেখে রুমের মাঝখানে দাঁড়ায় সন্ধ্যা। লামিয়া গান চালু করে,
– যাও বলো তারে, মেঘের ওপারে
বৃষ্টি বন্দনা জুড়ে ধরনীতল
যাও বলো তারে, শ্রাবণ আষাঢ়ে
মেঘের শতদলে ছুঁয়েছি ভেজা জল
গানের তালে তালে সন্ধ্যা নাচতে থাকে। খোপা করা চুলগুলো খুলে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ছুঁয়েছে।
সকলে মৃদু শব্দে তালি দিতে থাকে। লামিয়া সন্ধ্যার ফোনে ভিডিও করছে। সে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে হাসলো। সে জানে সন্ধ্যা নাচলে মেয়েটার মন ভালো হয়। এজন্যই সে সন্ধ্যাকে এরকম অফার করল।
আকাশ শিমুকে নিতে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। সে মূলত সন্ধ্যার নুপুর খুঁজতে এসে ঘড়িতে দেখেছিল সময় হয়ে গিয়েছে। তাই শিমুকে একেবারে নিয়ে যাবে বলে কলেজ এসেছে। গাড়ি ভেতরে সাইড করে রেখেছে। ইম্পর্ট্যান্ট কল আসায় হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে। কথার তালে কখন নাচের রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি। কথা বলার ফাঁকে ঘরের জানালার দিকে চোখ পড়লে আকাশের পুরো শরীর যেন বিদুৎের ন্যায় কেঁপে উঠল।
আকাশ যখন তাকিয়েছিল তখন-ই সন্ধ্যা নাচতে নাচতে একবার ঘোরে।
আকাশে চোখে সন্ধ্যার হাস্যজ্জ্বল মুখ কয়েক সেকেন্ডের জন্য আটকায়।
আকাশ কান থেকে ফোন নামিয়ে ঘরটির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সবার দৃষ্টি সন্ধ্যার দিকে। কেউ আকাশকে খেয়াল করেনি। আকাশের দৃষ্টি সন্ধ্যার হাঁটুর নিচ পর্যন্ত চুলগুলোর দিকে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে তার। বুকে ধুকধুক করছে। বিড়বিড় করে,
– সন্ধ্যামালতী!
ওদিকে ফোনে গান বাজছে –
মাতাল হাওয়ায় ধ্বনি বৃষ্টি কি শোনে না
ময়ূর পেখম তোলে, ধীম-তানা দে রে না।
ধীম তানা, বাজে ধীম-তানা,
বাজে ধীম-তানা দে রে না
অন্তঃদহন পর্ব ২২
সন্ধ্যা নাচতে নাচতে দরজার দিকে সরে এসেছে। নাচের তালে ঘুরতে গিয়ে আকাশের বুকে জোরেসোরে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে যেতে নেয়। তার আগেই আকাশ সন্ধ্যার ডান হাত টেনে ধরে।
সকলে আকাশকে দেখে বেঞ্চ থেকে নেমে দাঁড়ায়। লামিয়া দ্রুত গান অফ করে দেয়। ভ’য়ে সকলের অবস্থা খারাপ। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নাচছে, তাও আবার সেটা স্বয়ং সভাপতির কাছে ধরা খেয়েছে। আজ সবার এই কলেজে শেষ দিন।
সন্ধ্যা পিছনদিকে হেলে পড়ে যাওয়ার মতো করে দাঁড়িয়ে আছে। বেঁকে থাকায় চুলগুলো মেঝে ছুঁয়েছে। সন্ধ্যা স্তব্ধ চোখে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। চোখের কোণে নোনাপানি জমতে শুরু করেছে। আকাশ সন্ধ্যার চোখে চোখ রেখে ঢোক গিলে আওড়ায়,
– স্নিগ্ধপরী!