আযদাহা পর্ব ৩৭
সাবিলা সাবি
সকালে সূর্যের মোলায়েম আলো মাউন্টেন গ্লাস হাউজের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।ফিওনা আজ বেশ ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছে।তার গলা প্রচণ্ড ব্যথা করছে; কাল রাতে জ্যাসপারের আনা ঠান্ডা বেশ কয়েকটা আইসক্রিম খাওয়ার ফল।গলা ব্যথার কারণে একটু গরম চা খাওয়ার তাগিদে সে কিচেনের দিকে পা বাড়ায়।
লিভিং রুম পার হতে গিয়ে সে কিচেন থেকে কিছু অদ্ভুত শব্দ শুনতে পায়।তার মনে হয়,হয়তো অ্যাকুয়ারা আজ তাড়াতাড়ি উঠেছে।ভাবতে ভাবতে সে কিচেনের দিকে এগোতে থাকে।
ঠিক তখনই,কিচেন থেকে বেরিয়ে আসে জ্যাসপার। তার হাতে একটি ডিভাইস ধরা,যার মাঝখানে নীল আলো জ্বলছে।তবে ফিওনার উপস্থিতি দেখে সে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়।
ফিওনা ঘুমঘুম চোখে,এলোমেলো চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাতের সিল্কের নরম নাইট স্যুটে,চারপাশের সুর্যের আলো তার ওপর পড়ে যেন তাকে স্নিগ্ধ ফুলের মতো করে তুলেছে।মুহূর্তের জন্য জ্যাসপার মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকে।
জ্যাসপারের চাহনিতে ফিওনার মনে হঠাৎ গতকালের কথা ভেসে ওঠে।তার মনে পড়ে,কিভাবে সে জ্যাসপারকে ঘাড়ে লাভ বাইট দিয়েছিল।এতেই তার মুখ লজ্জায় গরম হয়ে যায়।সে চোখ বন্ধ করে রাখে, যেন জ্যাসপারের চোখে আর না পড়ে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে এগিয়ে আসে। তার ঠোঁটের কোণে সেই মৃদু,রহস্যময় হাসি।
ফিওনা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।তার মনে হচ্ছে যেন চারপাশের সবকিছু থেমে গেছে।হঠাৎ,সে অনুভব করে কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস তার মুখের কাছাকাছি। নিঃশ্বাসের সাথে মিশে থাকা সেই পারফিউমের পরিচিত ঘ্রাণ,যা তাকে আর কাউকে ভাবতে দেয় না—জ্যাসপার।
সে বোঝে,জ্যাসপার তার একদম সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে যায়।লজ্জা আর অস্বস্তির মিশ্রণে সে চোখ খোলার সাহস পায় না।
জ্যাসপার মৃদু হেসে বলে ওঠে,
“হামিংবার্ড,আজ এত সকাল সকাল দর্শন পেলাম? এটা সত্যিই সৌভাগ্যের দিন মনে হচ্ছে।”
ফিওনা কোনো উত্তর দেয় না।তার লজ্জা আরও বেড়ে যায়,আর সে তার চোখ বন্ধ রেখেই দাঁড়িয়ে থাকে।
জ্যাসপার তার মুখ আরও কাছে নিয়ে আসে।তার কণ্ঠে শয়তানি মিশ্রিত মৃদু সতর্কতা,”চোখ খুলো।নাহলে কিন্তু…চুমু দিয়ে দিবো।”
ফিওনার মুখ পুরো লাল হয়ে যায়।তার শরীর জমে যায়,যেন কোনো প্রতিক্রিয়া করার ক্ষমতাই নেই।সে দ্রুত চোখ খোলার কথা ভাবে,কিন্তু লজ্জায় তা করতে পারে না।
জ্যাসপার আরও মজা পেয়ে যায় ফিওনার এই অবস্থা দেখে।সে আবার ধীরে ধীরে বলে,”তিন সেকেন্ড দিচ্ছি। তারপর কিন্তু অভিযোগ করতে পারবে না।”
ফিওনা তার ঠোঁট কামড়ে ধরে।মাথার ভেতর হাজারো চিন্তা ঘুরছে।
ফিওনা (মনে মনে):
“উফ!এখন কি করবো?চোখ খুলি? নাকি…উনি কি আসলেই…?”
জ্যাসপার গুনতে শুরু করে,
“এক…দুই…”
ঠিক তিন বলার আগেই ফিওনা দ্রুত চোখ খুলে ফেলল।জ্যাসপার তার হাসি চেপে বলে,
“বেঁচে গেলে,হামিংবার্ড।কিন্তু খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম।”
ফিওনা কিচেনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর চেষ্টা করে,কিন্তু জ্যাসপারের শয়তানি হাসি আর দুষ্টুমি তাকে পিছু ছাড়ে না। তার মজার কণ্ঠে,ফিওনা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,”আপনি সবসময় এমন করেন কেনো?আমাকে লজ্জা দেন।”
জ্যাসপারের হাসি খানিকটা ম্লান হয়ে যায়।তখনই ফিওনার ঠান্ডায় ভাঙা গলার আওয়াজে তার কপাল কুঁচকে যায়।
“হামিংবার্ড,”জ্যাসপার গভীর গলায় বলে,”তোমার কি ঠান্ডা লেগেছে?অসুখ হয়েছে?”
ফিওনা জবাব দেয়,”হ্যাঁ,আমিতো হিউম্যান।আপনার মতো তো আর ড্রাগন না যে ঠান্ডা বা গরম কিছুই প্রভাব ফেলবে না।আপনি নিজে এতো এতো আইসক্রিম কাল খাওয়ালেন আর ভাবলেন আমি সুস্থ থাকবো?স্বাভাবিকভাবে গলা ব্যথা তো হবেই।”
ফিওনার কথায় জ্যাসপারের মুখে হালকা অনুশোচনা ঝরে পড়ে।সে কিছু না বলে তার শক্ত হাতে ফিওনাকে ধরে লিভিং রুমের নরম সোফায় বসায়।
“তুমি এখানেই বসো।একদম নড়াচড়া করবে না,” সে আদেশের সুরে বলে।তার চোখে ভয়ের ছায়া ফুটে ওঠে। “আমি কিছু একটা করি।তোমার এই অবস্থায় আমি কিছুতেই স্বাভাবিক থাকতে পারবো না।”
ফিওনা মৃদু হেসে বলে,”আপনি এভাবে দুশ্চিন্তা করছেন কেনো?আমি কোনো সিরিয়াস অসুখে ভুগছি না।একটু গলা ব্যথা হয়েছে,চা খেয়ে ঠিক হয়ে যাবে।”
জ্যাসপার এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায়।
“চা?তুমি কীভাবে বানাবে?আমি বানিয়ে আনছি।”
ফিওনা একটু অবাক হয় তার দ্রুত সিদ্ধান্তে।
“আপনি চা বানাতে পারেন?”
জ্যাসপার থেমে যায়,তারপর খানিকটা গম্ভীর কণ্ঠে বলে,”ড্রাগনরা যা চায় তা করতে পারে,হামিংবার্ড।”
ফিওনা একটু হেসে বলে,”তাহলে আমি আপনার এই ড্রাগন-তৈরি চা দেখতে চাই।”
জ্যাসপার দৃঢ় ভঙ্গিতে কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়, ফিওনাকে আরেকবার সতর্ক করে,”এখানে বসে থাকো।আর কোনো কথা না।আমি ড্রাগনের মতোই এই সমস্যার সমাধান করব।”
ফিওনা হাসতে থাকে,আর তার মনের ভেতর এক মুহূর্তের জন্য ভাবনা আসে—ড্রাগনের এই মৃদু যত্ন আর রাগ মেশানো ভালোবাসা যেন তাকে আরও কাছে টেনে নিচ্ছে।
জ্যাসপার কিচেনে ঢুকে ঠান্ডা মাথায় কাজ শুরু করে। তার চোখে গভীর মনোযোগ আর হাতে দক্ষতার স্পষ্টতা।কাঁচের জারের ভেতর থেকে বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক উপাদান বের করে সে একের পর এক চায়ের পাত্রে যোগ করতে থাকে—আদা, তুলসী পাতা, দারুচিনি,মধু,আর লেবুর রস।
ফিওনা সোফায় বসে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে,কিন্তু জ্যাসপারের এমন দৃঢ় ও সুরেলা গতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।তার ভ্রু সামান্য কুঁচকে যায়,আর সে নিজের অজান্তেই হা করে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিচেনের আলো জ্যাসপারের তীক্ষ্ণ মুখাবয়বের ওপর পড়ছে।তার চুলের ওপর সূর্যের নরম কিরণ যেন তাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে।যখন সে মধু মেশাচ্ছিল, তার হাতের মসৃণ গতিবিধি ফিওনাকে মুগ্ধ করে।
“এভাবে তাকিয়ে থাকলে কি তোমার ঠান্ডা সেরে যাবে, হামিংবার্ড?” হঠাৎ জ্যাসপার পেছনে ঘুরে বলে।তার কণ্ঠে মৃদু মজা ঝরে পড়ে।
ফিওনা মুহূর্তে লজ্জায় পড়ে যায়।তাড়াতাড়ি নিজের দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে।”আমি তো শুধু দেখছিলাম যে আপনি চা বানাতে পারেন কিনা,”ফিওনা বলার চেষ্টা করে,কিন্তু তার গলায় আত্মবিশ্বাসের অভাব স্পষ্ট।
জ্যাসপার হেসে বলে,”ড্রাগনরা শুধু যুদ্ধ করতে জানে না,হামিংবার্ড।যত্নও নিতে জানে ।”
সে চায়ের পাত্রে চা ঢেলে একটি কাপ নিয়ে ফিওনার দিকে এগিয়ে আসে।”এটা খাও। ঠান্ডা আর গলা ব্যথা চলে যাবে,”বলে,কাপটা ফিওনার হাতে তুলে দেয়।
ফিওনা কাপ হাতে নিয়ে চায়ের দিকে তাকায়।তার মন অজান্তেই বলে ওঠে,”একজন ড্রাগন,অথচ কতটা যত্নশীল আর সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি!”
জ্যাসপার ফিওনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
“তুমি যদি আরেকবার এভাবে তাকিয়ে থাকো,তাহলে আমার আবার চুমু দেওয়ার ইচ্ছা হতে পারে,”বলে, তার কণ্ঠে দুষ্টুমি ফুটে ওঠে।
ফিওনা কাপে চুমুক দিতে গিয়ে প্রায় গলা দিয়ে চা উগড়ে ফেলে,”আপনার কি সবকিছুতেই দুষ্টুমি করার অভ্যাস?”
জ্যাসপার হাসে।”তোমাকে বিরক্ত করা তো আমার সবচেয়ে বড় বিনোদন,হামিংবার্ড।”
থারিনিয়াস ল্যাবে প্রবেশ করতেই মিস্টার চেন শিং তার দিকে তাকালেন।তার চোখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট।”আজ আমি ফিওনাকে দেখতে চাই,”চেন শিং বললেন,তার কণ্ঠে একটা অদ্ভুত তাগিদ।
থারিনিয়াস মাথা নাড়ল।”প্রিন্স কাল বলেছিল আমার মনে আছে,আজ দেখাবো।আমি এখনই ডিভাইসটা চালু করছি।”
থারিনিয়াস একটি প্যানেলে কাজ শুরু করল।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সিসিটিভি ফুটেজ চালু হলো।স্ক্রিনে ভেসে উঠল লিভিং রুমের দৃশ্য।
ফিওনা সোফায় বসে চায়ের কাপ হাতে নিচু হয়ে চুমুক দিচ্ছিল।তার মুখে শান্তির আভা।চুলগুলো
এলোমেলো,আর তার গালে যেন হালকা লজ্জার রেশ এখনো রয়ে গেছে।
মিস্টার চেন শিং ধীরে ধীরে স্ক্রিনের দিকে এগিয়ে গেলেন।তার চোখে অশ্রু জমতে শুরু করল।দীর্ঘদিন পর তার প্রিয় নাতনীকে দেখছেন তিনি,যদিও সরাসরি নয়,তবু এতদিনের দূরত্বের পর এই মুহূর্ত যেন অনেক মূল্যবান।
তিনি হাত বাড়িয়ে স্ক্রিনে ফিওনার মুখ ছুঁতে চাইলেন।তার কণ্ঠ অল্প কাঁপছিল।”ফিওনা…আমার ফিওনা ভালো আছে?…”
থারিনিয়াস শান্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিল,সেই আবেগঘন মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে।
চেন শিং একবার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।তার চোখে একসাথে আনন্দ এবং কষ্টের মিশ্রণ।”আমার ছোট্ট নাতনীটা নিশ্চয় আমাকে খুব মনে করছে।কিন্তু আমি ওর পাশে থাকতে পারিনি,তবে মনে হচ্ছে ও এখন খানিকাটা ভালোই আছে।”
মিস্টার চেন শিং মুহূর্তে চোখ বড় বড় করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন।মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগেই তিনি দেখেছেন জ্যাসপার হঠাৎ লিভিং রুমে এসে ফিওনার গালে চুমু দিয়ে চলে গেল।চেন শিং হতবাক,তার মুখ থেকে কথা বের হতে চাইছে কিন্তু মনের মধ্যে অগণিত প্রশ্ন।
তিনি অবাক হয়ে বললেন,
“এটা…এটা কি হলো?আমি কি ভুল দেখলাম?জ্যাসপার কেন ফিওনাকে চুমু দিলো?”
থারিনিয়াস দ্রুত ডিভাইস বন্ধ করে দিলো।তার মুখে এক ধরণের আত্মবিশ্বাসী শীতলতা।সে জানত যে মিস্টার চেন শিং প্রশ্ন করবেন,এবং তাকে দক্ষতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে।থারিনিয়াস শান্তভাবে বলল,”মিস্টার চেন শিং,আপনি অবশ্যই ভুল দেখেছেন।আমাদের প্রিন্স কখনো এমন কাজ করবেন না।”
চেন শিং সন্দিহানভাবে বললেন,
“কিন্তু আমি নিজে দেখেছি!এটা ভুল হতে পারে না।”
থারিনিয়াস মাথা নাড়ল।তার কণ্ঠে একরকম দৃঢ়তা।
“আপনার চোখ ধোঁকা খেয়েছে।প্রিন্সের মধ্যে আবেগের ফাংশন নেই,বিশেষ করে প্রেম বা স্নেহজনিত কোনো অনুভূতি।তিনি ফিওনার প্রতি এমন কিছু করবেন না যা আপনার কল্পনায় এসেছে।”
চেন শিং অস্থিরভাবে বললেন,
“তাহলে আমি যা দেখেছি সেটা কী?এটা তো কল্পনা ছিল না!”থারিনিয়াস এবার একটু মুচকি হাসল।
“মিস্টার চেন শিং,হয়তো ক্যামেরার কোনো ত্রুটি হয়েছে,বা আপনি অন্য কিছু ভেবেছেন।আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি,প্রিন্স জ্যাসপার এমন কোনো আবেগে জড়িত নয়। তিনি একান্তই তার দায়িত্ব পালন করছেন।”
চেন শিং কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন,তার মন তখনও ঘটনাটি মেনে নিতে পারছিল না।তবে থারিনিয়াসের দৃঢ়তা এবং আত্মবিশ্বাস দেখে তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না।
থারিনিয়াস মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।সে জানত, চেন শিং সত্যিটা জানলে সবকিছু ভেঙে পড়বে।কিন্তু তার কাজ ছিল এই মুহূর্তে সত্যকে আড়াল করা এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা।থারিনিয়াস মনে মনে বলল,
“প্রিন্স,আমি যতটা সম্ভব আপনাকে রক্ষা করার চেষ্টা করলাম।কিন্তু আপনি যদি এর চেয়ে বেশি সামনে এগোন, তাহলে আমি আর বেশি দিন ঢাকতে পারবো না।”
ভোরের প্রথম আলোতে,ভেনাসের আকাশ যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।অ্যালিসা ও সিলভা তাদের ড্রাগন রূপে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তাদের বিশাল ড্রাগন ডানা সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে।তাদের চোখে একরকম উত্তেজনা এবং অজানা পৃথিবী দেখার অদম্য আকাঙ্ক্ষা।
তাদের পিতা,ফ্লোরাজ রাজ্যের মহারাজ,কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললেন,”এই যাত্রা তোমাদের জন্য সহজ হবে না।পৃথিবী ভিন্ন এক জগৎ।সেখানে আমাদের নিয়মের বাইরে অনেক কিছু ঘটে।নিজেকে সামলে চলবে।অ্যালিসা,তুমি বড় বোন হিসেবে সিলভার দায়িত্ব নিয়েছো।তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে।”
অ্যালিসা মাথা নাড়ল।তার লাল চুল আর উজ্জ্বল ড্রাগন রূপে তাকে যেন আরও মহিমান্বিত দেখাচ্ছে।
“হ্যাঁ,পিতা।আমরা আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন,সেখানে প্রিন্স আছেন সে আমাদের অবশ্যই নিরাপদে রাখবেন।”
সিলভা, যে তুলনামূলক কম অভিজ্ঞ এবং কিছুটা দুষ্টু, হাসতে হাসতে বলল,”আমরা তো পৃথিবী দেখতে যাচ্ছি,পিতা! দুশ্চিন্তা করবেন না।আপু আমাকে চোখে চোখে রাখবে।”
পিতা কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন,”তোমাদের যাত্রা দীর্ঘ হবে।ভেনাস থেকে পৃথিবীতে পৌঁছাতে সাধারণ ড্রাগনদের তিনদিন সময় লাগে।যাত্রাপথে সাবধান থাকবে।আর মনে রেখো,পৃথিবীর মানুষ আমাদের মতো নয়।তাদের সম্পর্কে ভুল সিদ্ধান্ত নিও না।”
অ্যালিসা ও সিলভা পিতার সামনে মাথা নত করল।তারপর এক বিশাল ডানার ঝাপটা দিয়ে তারা ভেনাসের আকাশে উড়াল দিলো।
আকাশের বিশালত্ব যেন তাদের ডানার শক্তিকে আরও বাড়িয়ে তুলল।তারা সূর্যের আলোর সাথে মিশে একের পর এক মেঘ পেরিয়ে এগিয়ে চলল।ভেনাসের সবুজাভ আকাশ তাদের পেছনে ফেলে,তারা ধীরে ধীরে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
জ্যাসপার ল্যাবে প্রবেশ করতেই চারপাশে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। বিশাল পর্দায় ডেটা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, আর বিভিন্ন মেশিনে কাজ চলছে।থারিনিয়াস ইতিমধ্যেই কনফারেন্স রুমে উপস্থিত ছিল। তিনি একটি ম্যাপের উপর নজর দিচ্ছিলেন, যেখানে কার্বন সংগ্রহের স্থান এবং সেখানে থাকা মনস্টারগুলোর তথ্য ছিল।
জ্যাসপার: “থারিনিয়াস, প্রস্তুতি কেমন চলছে?”
থারিনিয়াস:(মুখে কিছুটা চিন্তার ছাপ) “সবকিছু ঠিকঠাক আছে, তবে মনস্টারদের সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, সেই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে।”
ঠিক তখনই আলবিরা রুমে প্রবেশ করে।
কনফারেন্স রুমটি একটি আধুনিক এবং প্রযুক্তিগতভাবে সমৃদ্ধ স্থান,যা বিশাল কাচের জানালা দিয়ে উজ্জ্বল।বাইরে দেখা যাচ্ছে ল্যান্ডস্কেপের বিশাল সৌন্দর্য,যেখানে উদ্ভিদ এবং সৃষ্টির নিদর্শনগুলো চোখে পড়ছে।রুমের কেন্দ্রে একটি বড় চিরকালীন সাদা টেবিল রয়েছে,যা চারপাশে উজ্জ্বল আলোতে ঘেরা।
রুমের দেয়ালগুলোতে বড় বড় মনস্টারদের ছবি লাগানো হয়েছে,যা তাদের শক্তি এবং গুণাবলীর প্রতিনিধিত্ব করে। টেবিলের এক কোণে একটি হালকা প্রযুক্তি প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে,যেখানে তথ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে।
জ্যাসপার তখন বললো “মিস্টার চেন শিং কি আসছে?”
থারিনিয়াস জবাব দিলো”হ্যাঁ,তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে আসছেন। বিশেষ করে কার্বন অঞ্চল এবং সেখানে থাকা মনস্টার সম্পর্কে।”
তখনি মিষ্টার চেন শিং প্রবেশ করে এবং তার হাতের ল্যাপটপ থেকে বিশাল তথ্য বের করতে শুরু করেন।
মিস্টার চেন শিং তাঁর প্রেজেন্টেশন শুরু করেন। “সকলকে স্বাগতম।আজকের মিশন গুরুত্বপূর্ণ, এবং তোমাদের সঠিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে কাজ করতে হবে।”তিনি প্যানেলে মনস্টারদের ছবি এবং তাদের বৈশিষ্ট্য দেখাতে শুরু করেন।
থারিনিয়াস: “আমাদের পরিকল্পনা এবং সঠিক প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি। মনস্টারগুলোর শক্তি এবং দুর্বলতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে।”
আলবিরা: “আমাদের মাঝে শক্তিশালী যোগাযোগ থাকতে হবে। যদি কোনো সমস্যা হয়,তাহলে দ্রুত সমাধান করতে হবে।”
জ্যাসপার:”আমরা সবাই একসাথে কাজ করলে,কোন চ্যালেঞ্জই আমাদের থামাতে পারবে না। আমাদের লক্ষ্য হলো সফলভাবে কার্বন সংগ্রহ করা।”
কার্বন সংগ্রহের জন্য নির্বাচিত অঞ্চল হলো ক্যারবিন বেসিন, যা একটি বিশাল গভীর সমুদ্রের তলদেশে অবস্থিত।এই অঞ্চলটি পরিচিত তার বিশাল তলদেশীয় কার্বন সঞ্চয়ের জন্য এবং এখানে প্রায়শই শক্তিশালী মনস্টারদের বসবাস হয়।এই অঞ্চলের গভীরতা প্রায় ১০,০০০ ফুট, এবং এটি প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন।এটি একটি বৃহৎ ভূতাত্ত্বিক অঞ্চল যা আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপের কারণে গঠিত হয়েছে।
এখানে কেল্রিম,জোলথান এবং মোরাক্স সহ বিভিন্ন ধরনের মনস্টার রয়েছে, যারা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষা করে।
কেল্রিম এই মনস্টারটি একটি বিশাল পাথরের মতো তৈরি, যার গায়ে বিভিন্ন রঙের রত্ন রয়েছে। এর শক্তি হলো পাথর ভাঙা এবং আক্রমণের সময় কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
জোলথান এই মনস্টারটি বায়ুমণ্ডলে উড়তে পারে এবং বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করে আক্রমণ করে। এটি দ্রুত এবং খুব চঞ্চল।
মোরাক্স এটি একধরনের জলদস্যু মনস্টার, যে শুধু জল এবং কার্বনের অধীনে অবস্থিত। এটি সাঁতার কাটতে পারে এবং জল থেকে আক্রমণ করতে পারে।
মিস্টার চেন শিং তাদের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেন।
মিস্টার চেন শিং আবার বলতে লাগলো “ক্যারবিন বেসিনে আমাদের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করবে মনস্টারগুলোর ওপর। তাদের শক্তি এবং দুর্বলতা সম্পর্কে জানাটা আমাদের জন্য জরুরি।”
জ্যাসপার তখন অবিলম্বে প্রশ্ন করলো
“তাহলে,কেল্রিমের শক্তি কি?”
মিস্টার চেন শিং: “কেল্রিম পাথরের মতো কঠিন।এটি আক্রমণের সময় শেলের মতো আচরণ করে। তবে এর দুর্বলতা হলো এটি দ্রুত চলাচল করতে পারে না,তাই তোমাদের দ্রুততার সুবিধা নিতে হবে।”
থারিনিয়াস:”আর জোলথান সম্পর্কে?”
মিস্টার চেন শিং: “জোলথান দ্রুত এবং আক্রমণকারী। এটি বায়ুমণ্ডলে বিদ্যুৎ নিয়ে আসে,তাই তোমাদের উচিত দূর থেকে আক্রমণ করা।”
আলবিরা: “এবং মোরাক্স?”
মিস্টার চেন শিং “মোরাক্স জল থেকে দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে।তোমাদের উচিত জলের নিচে নজর রাখা।”
সকলেই নিজেদের কাজের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। জ্যাসপার,থারিনিয়াস,আলবিরা,এবং মিস্টার চেন শিং একত্রে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে তারা কীভাবে মনস্টারগুলোকে মোকাবেলা করবেন এবং কীভাবে কার্বন সংগ্রহ করবেন।
জ্যাসপার সবার উদ্দেশ্যে বললো “তাহলে,কাল সকালে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে।প্রত্যেককে তাদের প্রস্তুতির কাজ করতে হবে।”
থারিনিয়াস: “আমি জোলথানের বিরুদ্ধে মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
আলবিরা: “আমি মোরাক্সের জন্য পরিকল্পনা করছি, জলদস্যুদের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে।”
মিস্টার চেন শিং: “তাহলে,তোমারা কেল্রিমের জন্য আমাদের শক্তি ব্যবহার করবো।”
ল্যাবে কার্বন মিশন নিয়ে আলোচনা শেষ করার পর, থারিনিয়াস ও আলবিরা মাউন্টেন গ্লাস হাউজে ফেরার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। সন্ধ্যা নেমে এসেছে, আর দিনের আলো বিলীন হতে হতে পুরো জায়গাটা যেন এক নতুন রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু তার মধ্যেই জ্যাসপার উঠে যাওয়ার সময় মিস্টার চেন শিং তাকে থামিয়ে দিলেন।
“জ্যাসপার,এক মিনিট থামো। আমি তোমার কাছে একটি প্রশ্ন করতে চাই,” বলে চেন শিং গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
জ্যাসপার একটু চমকে উঠল। “আপনার এমন কেন মনে হলো?” সে প্রশ্ন করে।
মিস্টার চেন শিংয়ের মুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। “আমি আজকের সকালের সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি।”
জ্যাসপার বুঝতে পারল, চেন শিং ফিওনা ও তার মধ্যে ঘটে যাওয়া সব দৃশ্য দেখে ফেলেছেন। তার মনে শঙ্কা জাগল।
“মিস্টার চেন শিং,আপনি জানেন আমি ফিওনার প্রতি যত্নশীল।আমি তাকে কোনো ক্ষতি করতে চাই না,” জ্যাসপার বলল, স্বর নিয়ে আত্মবিশ্বাস বজায় রাখতে চেষ্টা করল।
চেন শিং আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। “আমার নাতনীর নিরাপত্তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। তুমি একজন প্রিন্স, এবং তোমার ক্ষমতা ও আবেগ সম্পর্কে আমি জানি। আমি চাই না সে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক।”
“আমি ফিওনাকে ভালোবাসি,” জ্যাসপার স্পষ্টতার সঙ্গে জানাল, তার কণ্ঠে ছিল এক ধরনের আত্মবিশ্বাস ও আবেগের ঝলক।“আর ফিওনার চোখে আমি সেই ভালোবাসার ছোঁয়া দেখেছি।”
মিস্টার চেন শিংয়ের চোখে রাগের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। “আমিতো শুনেছি তোমার মধ্যে লাভ ফাংশনাল ডিলিট,” তিনি গম্ভীরভাবে বললেন।
“সেটা কোনো এক কারণে অ্যাক্টিভ হয়ে গেছে,” জ্যাসপার উত্তর দিল। “আর সেই কারণটাই ফিওনা।”
“দেখো,” চেন শিং বলতে লাগলেন, “তুমি একজন ড্রাগন,তাও আবার ভেনাসের।আর আমার নাতনী ফিওনা,একজন সাধারণ মানবী পৃথিবীর।তোমাদের মধ্যে কিভাবে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে?এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ আর পরিনতি তুমি জানো কি?ধ্বংস!তোমার ধ্বংস হবে,আর ফিওনাকেও হয়তো এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।একজন এনিম্যাল আর একজন হিউম্যানের মধ্যে কি কখনো মিল সম্ভব?”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “ভালোবাসা কোনো কিছু দেখা হয়না।এটা তো পৃথিবীর প্রবাদ।কিন্তু শুনুন,এই মহাবিশ্বে এমন কিছু হয়,যা আমাদের কল্পনার বাইরে।আমার আর ফিওনার ভালোবাসাটাও সেরকমই।”
“তুমি আগুন নিয়ে খেলছো,জ্যাসপার,” চেন শিং সতর্ক করে দিলেন, তার কণ্ঠে উদ্বেগ ছিল।
জ্যাসপার দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, “আমি আগুনেরই তৈরি।”
“এই মহাবিশ্ব তোমাদের প্রেমের দাম দিবে না,”চেন শিংয়ের মুখে সংশয় ছিল।
“তাহলে আমি এই মহাবিশ্ব ধ্বংস করে দেবো,” জ্যাসপার কঠোরভাবে প্রতিশ্রুতি দিল।
“জ্যাসপার,তুমি এমন কিছু করোনা যাতে ফিওনার ক্ষতি হয়,”চেন শিং সতর্কভাবে বললেন, তার কণ্ঠে উদ্বেগ স্পষ্ট।
জ্যাসপার দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিল, “আমি নিজেকে উৎসর্গ করে দেবো।ফিওনার ক্ষতি আমি হতে দেবো না। যদি প্রয়োজন হয়,আমি নিজেকে এই মহাবিশ্ব থেকে সরিয়ে নেব।”
“ফিওনা তোমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছে,” চেন শিং বললেন, তার চোখে সংশয় ছিল। “এটা ভালোবাসা নয়।”
“আপনার ভুল ধারণা,” জ্যাসপার জোরালোভাবে বলল। “ফিওনা আমাকে ভালোবাসে সৌন্দর্যের জন্য নয়।তার হৃদয়ে আমার জন্য স্থান রয়েছে।”
“তাহলে প্রমাণ করে দেখাও,”চেন শিং চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল। “দেখাও,তোমার সৌন্দর্য তাকে মোহিত করছে না,সে তোমার হৃদয়কে ভালোবাসছে।”
“ঠিক আছে,” জ্যাসপার বলল, তার চোখে দৃঢ়তা ও সংকল্প।“আমি আপনাকে প্রমাণ করে দেখিয়ে দেব। আসি এবার।”
জ্যাসপার বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে চেন শিং কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।তার মাথায় নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনি ভাবতে লাগলেন, “জ্যাসপার আর ফিওনার প্রেমের পরিণতি কী হবে?”
সে জানত, এই সম্পর্কের পরিণতি খুব একটা ভালো হবে না। এই মহাবিশ্ব কখনো তাদের প্রেমকে মেনে নেবে না—না পৃথিবী,না ভেনাস। চেন শিংয়ের মনে ভয় ছিল।
“আমি কি ভুল করেছি?” তিনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন। “তাদের প্রেম কি সত্যিই সম্ভব?আমার কি উচিত এটা হতে দেয়া ?”
আযদাহা পর্ব ৩৬
চেন শিং নিজের অন্তরেও দ্বিধায় পড়ে গেলেন।তিনি জানতেন,প্রেমের মধ্যে যদি কোনো বাধা থাকে,তাহলে তা কতোটা ভাঙ্গন সৃষ্টি করতে পারে।
“না,” তিনি মনে মনে ভাবলেন। “এটা হওয়া উচিত নয়।আমার ফিওনাকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।”
তার চিন্তাভাবনা অস্থির হয়ে উঠল।তিনি জানতেন, জ্যাসপার যেন আগুনের মতো,যা যেকোনো মুহূর্তে তার নাতনীর জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।চেন শিংয়ের চোখে উদ্বেগের ছায়া নেমে এল।তিনি তাঁর নাতনীর সুরক্ষায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন,এবং তাঁর হৃদয়ে একটা অস্থিরতা তৈরি হলো।