আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৪
সাবিলা সাবি
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফিওনা সোজা খরগোশটির দিকে গেল। আজ তাকে খাঁচায় রেখেছে,তাই খাবারটুকু দিয়ে নিশ্চিন্ত হল। এরপর তার পা চলল অ্যাকুয়ারার কক্ষের দিকে, কিন্তু কক্ষ খালি দেখে একটু অবাক হল। কিছুটা চিন্তিত হয়ে দ্রুত কিচেনে এল ফিওনা,সেখানে গিয়ে দেখল অ্যাকুয়ারা ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে।
ফিওনা মৃদু ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কি হলো, অ্যাকুয়ারা? আজ আমাকে ডাকলে না কেনো? আর একা একা কাজ করছো? কেউ দেখে ফেললে তো সমস্যা হয়ে যাবে।”
অ্যাকুয়ারা একটু হাসল, “আরেহ, চিন্তা করো না, ফিও। এদিকে কেউ নেই। আলবিরা, থারিনিয়াস আর প্রিন্স সবাই কোথাও বাইরে গেছে।”
ফিওনা গভীর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। “ওহ, যাক বাবা, তাহলে তো বেঁচে গেলাম।”
অ্যাকুয়ারা ফিওনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,”চলো, দু’জনে নাস্তা সেরে নেই। একটু পরেই ছাদে যাবো।”
ফিওনা একটু দ্বিধার সুরে বলল, “কিন্তু তোমাদের প্রিন্সের অনুমতি ছাড়া ছাদে যাওয়া কি ঠিক হবে?”
অ্যাকুয়ারা নির্ভার ভঙ্গিতে উত্তর দিল, “প্রিন্স তো সকালেই বেরিয়ে গেছেন। ওদের ফিরতে রাত হবে।আমরা তাড়াতাড়ি গিয়ে আবার ফিরে আসব। কেউ জানতেও পারবে না।”
ফিওনা হালকা হাসি দিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, “ঠিক আছে, তাহলে আমি নাস্তা করে একবারে গোসল সেরে নেবো।”
এরপর দুজনে একসঙ্গে মনোযোগ দিয়ে ব্রেকফাস্ট বানাতে লাগল সামনের কিছু মুহূর্তের জন্য নিজেরাই নিজেদের নির্ভীক সঙ্গী হয়ে উঠলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অন্যদিকে প্রিন্স জ্যাসপার, থারিনিয়াস আর আলবিরা এক গোপন স্থানে উপস্থিত ছিল। স্থানটি নির্জন, মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নীচে চারপাশ রহস্যের ছায়ায় ঢাকা। আলো-আঁধারিতে আবৃত এই পরিবেশে থারিনিয়াস কিছুটা উত্তেজিতভাবে বলল,
“প্রিন্স,একটা বিশেষ খবর আছে।”
জ্যাসপার গভীর দৃষ্টিতে তাকাল, তার কণ্ঠে সুপ্ত উৎকণ্ঠার সুর, “কি খবর?”
থারিনিয়াস কিছুটা গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, “আমি দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করছি, কিন্তু মিস্টার চেন শিং সম্পর্কে কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। এমনকি তাকে দেখাও যাচ্ছেনা কোথাও, অনেক দিন হয়ে গেল। ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক লাগছে আমার, উনি আবার নতুন কোনো পরিকল্পনা করেন নিতো এথিরিয়নকে নিয়ে?।”
এই কথায় জ্যাসপার চিন্তিত হয়ে গেল। চেন শিংয়ের আচমকা এই অন্তর্ধানকে সে সহজভাবে মেনে নিতে পারছিল না। তবুও পরক্ষনেই ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিলো।
জ্যাসপার কঠিন দৃষ্টি নিয়ে থারিনিয়াসের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়।আমাদের এখন পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে মিটিং এর বিষয়ে ফোকাস করতে হবে। প্রতিটা প্রস্তুতি নিখুঁত হতে হবে কোনো ভুল কর যাবেনা ।
ডঃ আর্থার যেদিন তারিখ নির্ধারণ করবেন, সেই দিনই আমি একটুখানি শান্তি পাবো। মিটিংয়ের আগ পর্যন্ত আমি আর কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না,থারিনিয়াস।”
তার কণ্ঠের অটলতায় থারিনিয়াস বুঝতে পারল, জ্যাসপারের মনের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই।
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ধরে মিস্টার চেন শিং বন্দি অবস্থায় রয়েছেন। প্রতিদিনের মতো তাকে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে, তিনি একটা বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্য জীবিত। কারণ তার কাছে এমন কিছু মূল্যবান তথ্য রয়েছে যা ওয়াং লি নিজেও জানেন না। এই তথ্যের আশায়ই তাকে বন্দি অবস্থায় রেখে যত্নসহকারে তার পরিচর্যা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, মিস ঝাং প্রায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন।তাকে জানানো হয়েছে যে মিস্টার চেন শিং আর ফিওনা গ্রিসে গেছেন বিশেষ কাজে। এই সংবাদ দিয়েছে ডক্টর লিউ ঝান। কিন্তু ফিওনার অনুপস্থিতি নিয়ে ডক্টর লিউ ঝান এখনও উদ্বিগ্ন। প্রায়শই সে ফিওনার খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করে। ফিওনার বান্ধবী লিন লিয়ার সাথেও সে দেখা করেছিলো, কিন্তু লিন লিয়াও তার বন্ধুর কোনো খবর জানে না। তারাও এই নিখোঁজের ঘটনায় গভীর উদ্বিগ্ন, যেখানে অদৃশ্য কোনো রহস্য তাদের তাড়া করছে।
অবশেষে ফিওনা ছাদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলো। আজকের সাজে তার মৃদু, স্বচ্ছন্দ্য স্পর্শ। সে বেছে নিয়েছে একটি সাদা, হালকা,মিহি কাপড়ের লম্বা কোটি, কোটির নিচে ছিলো এক টুকরো গোলাপি ছোঁয়া—একটা ছোট্ট, পাতলা ক্রপ টি-শার্ট যা তার কোমরের সূক্ষ্মতা প্রকাশ করেছে। তার সাথে ছিল একটা জিন্সের শর্ট প্যান্ট যা হাঁটুর অনেক উপরে এসে থেমেছে, চীনের ঐতিহ্যের ছোঁয়া থাকা সত্ত্বেও এতে আধুনিকতা স্পষ্ট।
চুল আঁচড়ে সাজাতে খুব বেশি সময় লাগেনি, কিন্তু তার অবিন্যস্ত চুলগুলোও একরকম নান্দনিকতার ছোঁয়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও কোনো মেকাপ ছিল না তার কাছে, তার মুখের স্নিগ্ধতায় অভিব্যক্তির কোনো অভাব ছিল না। তবে এই বন্দি জীবনে সাজগোজের কোনো আগ্রহও নেই তার। একঘেয়েমি আর অবরুদ্ধতার ভার তার মনের উপর চাপিয়ে রেখেছে এক অদৃশ্য শৃঙ্খল। তার সাজতে ইচ্ছে করে না, এমনকি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার রুচিটুকুও হারিয়ে গেছে। এই সীমাবদ্ধ জীবনের প্রতিটি দিন একই রকম বিষণ্ণতায় ঢাকা, সাজানোর মতো কোনো স্বপ্ন কিংবা খুশি আর অবশিষ্ট নেই ফিওনার মনে।
অ্যাকুয়ারা ফ্লোরা-স্টাইলের একটি ফ্রক পরেছে, যার কোমল ডিজাইনে তাকে এক স্বপ্নিল, অন্য গ্রহের পরির মতো লাগছে। তার নীল রঙের চুলের সাথে ফ্রকের নকশা এমনভাবে মিশেছে যে, তাকে দেখে মনে হয় কল্পনার কোনো রাজকুমারী।
ফিওনাকে দেখে অ্যাকুয়ারা মৃদু হাসি দিয়ে বললো
“বাহ আজকে তোমাকে অন্যরকম লাগছে, ফিও।”
ফিওনা একটু লজ্জা পেয়ে উত্তর দিলো, “বেশি খারাপ লাগছে? আসলে আমার এই ড্রেসটা চীনে বেশ জনপ্রিয়, এরকমই পোশাক পড়ে ওখানকার মেয়েরা। তবে থারিনিয়াস মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধরনের ড্রেস নিয়ে আসে।”
অ্যাকুয়ারা মাথা নাড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ,বারবার একই শহর থেকে পোশাক আনতে গেলে একটু ঝুঁকি আছে। তাই ও বিভিন্ন শহর থেকে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের জামাকাপড় কিনে আনে ।”
কথার ফাঁকে তারা ছাদের দিকে যেতে শুরু করলো।
কাঠের সিঁড়িগুলো বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে ফিওনা আর অ্যাকুয়ারার মধ্যে হালকা কথা চলতেই থাকলো, এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো তাদের বন্দি জীবনের একঘেয়েমি কিছুটা হলেও দূর করে।
অবশেষে ফিওনা ছাদের ভেতরে পা রেখেই কিছুটা থমকে দাঁড়ালো। ছাদটি ছিল এক বিস্ময়কর স্থান, যেখানে প্রতিটা কোণা প্রতিটা বক্রতা এক অজানা রহস্য লুকিয়ে ছিল। চারপাশে নির্মিত ছিল গ্লাস রেলিং, যার মাধ্যমে ছাদের অপর প্রান্তের দৃশ্য স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। গ্লাসের উপর সূর্যের আলো যখন পড়ছিল তখন সেটার এক অদ্ভুত ঝলকানি সৃষ্টি হচ্ছিলো। পায়ের নিচের ফ্লোরও ছিল অন্যরকম এক ধরনের পাথরের ওপর সূক্ষ্ম রঙিন কারুকাজ করা হয়েছে।
ফিওনা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো, চোখের সামনে ছাদের চারিপাশে টবে ফুটে থাকা ফুলগুলো তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করছিল। প্রতিটা ফুলের আকার,রঙ,গন্ধ এক ভিন্ন দুনিয়ার কথা বলছিল।তার চোখে কিছুক্ষণ হারিয়ে গিয়েছিল—এত সব ফুল, এত নতুন রূপের সমাহার, যা সে আগে কখনোই দেখেনি।
অ্যকুয়ারা তার পাশ দিয়ে আসতে আসতে এক এক করে ফুলগুলোর পরিচয় দিতে শুরু করল। ফিওনা অ্যকুয়ারার পিছে পিছে হাঁটছে আর মন দিয়ে ফুলের বর্ননা শুনছে।
একটা ফুলের সামনে যেয়ে অ্যকুয়ারা বললো “স্ফটিক মণি (Crystal Gem)” এটি দেখো ফিওনা এই ফুলটা স্ফটিকের মতো উজ্জ্বল তার প্রতিটি পাপড়ি রূপালি রশ্মির মতো আলো বিকিরণ করে।
“আর এইটা,” অ্যকুয়ারা বলল, “ধূসর পাতা ফুল, যেটার পাপড়ির রঙ সাদা আর ধূসস ছিলো, মেঘের মধ্যে সূর্য ওঠার দৃশ্য।
এই ফুলটা হচ্ছে অগ্নিপথ (Path of Fire) নাম অ্যকুয়ারা বললো। এই ফুলের পাপড়ি লাল আর সোনালী ছিলো। অগ্নিময় আভার মতো
এই ফুলটা (কসমিক ব্লসম (মহাকাশী) এটার পাপড়িগুলি নীলাভ আর সোনালী আভার ছিলো।
অ্যকুয়ারা আবার ও বললো “আলোর মুকুট (Crown of Light): “এই ফুলটির সৌন্দর্য দেখো, এটার পাপড়িগুলি সাদা আর হলুদ ছিলো
চাঁদনী ঝর্ণা (Moonfall): “এটি চাঁদনী ঝর্ণা,” অ্যকুয়ারা আরও এক পা এগিয়ে বলল, “এই ফলের পাপড়ি সাদা আর নীলাভ।
ধ্বংস ফুল (Doomflower): “এটি হলো ধ্বংস ফুল। এটার পাপড়ি ছিলো ডার্ক মেজেন্ডা আর নীলের মধ্যে।
ফিওনা এক এক করে প্রতিটি ফুলের সৌন্দর্য আর রহস্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল। তার চোখে নতুন পৃথিবী উন্মোচিত হচ্ছিল—অ্যকুয়ারার কথাগুলি তার মনের গভীরে নুয়ে যাচ্ছিল,তার অনুভূতি একে একে ফুটে উঠছিল ছাদের প্রতিটি কোণে।
একপাশের ফুল দেখা শেষে অ্যকুয়ারা ফিওনাকে আরেক পাশে নিয়ে গেলো সেখানকার ফুল দেখাতে।
অ্যকুয়ারা ফিওনাকে আরেক পাশের
কিছু ফুলের বর্ণনা দিতে শুরু করল, আর ফিওনা একে একে প্রতিটি ফুলের সৌন্দর্য মুগ্ধ চোখে দেখছিল। তার সামনে ফুলগুলি ছিলো একেকটি জীবন্ত কবিতা।
হিমবাহ গোলাপ (Glacier Rose): “এটি হিমবাহ গোলাপ,” অ্যকুয়ারা বলল, “এটার পাপড়ি ছিলো বরফের মতো সাদা, তবে মাঝে মাঝে একটু নীলাভ আভা আছে।
নীল কমল (Blue Lotus) “আর এই নীল কমল,” অ্যকুয়ারা বলে, “এটা এমন এক ফুল,যা জলের মধ্য থেকে উঠে আসা। এটার পাপড়ি নীলাভ রঙের ছিলো।
লাভলেস ফুল (Lovelorn Flower)” এই ফুলটি খুবই বিশেষ,”অ্যকুয়ারা জানাল, “এটা এতটাই সুন্দর আর দুঃখময়, এটার পাপড়ির মধ্যে মিষ্টি রঙের সঙ্গে একটা র*ক্তচোখের ছাপ আছে।
ফিওনা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা,অ্যকুয়ারা, এই ফুলগুলো কি কখনো যত্ন নিতে হয় না? পানি দিতে হয় না?”
অ্যাকুয়ারা হাসতে হাসতে বলল, “না, সবসময় নয়, শুধু গ্রীষ্মকালীন সময় পানি দরকার হয়, তবে সেটা খুব কম। ওই যে,ছাদের ফ্লোরের নিচে একটা সিস্টেম আছে। “অটো-স্প্রিং ওয়াটারিং সিস্টেম”। অ্যকুয়ারা পুনরায় বললো।
“এটা এমন একটা সিস্টেম যা প্রাকৃতিকভাবে বা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে গাছগুলোর স্বয়ংক্রিয় পানি সরবরাহ করে, যেখানে পাইপের ছিদ্র দিয়ে পানি ছড়িয়ে পড়ে একাধিক বাটন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
অনেকগুলো মোটা লোহার পাইপ পাতা আছে, আর সেই পাইপগুলোর মধ্যে ছিদ্র রয়েছে।একে একে,পানি দেওয়ার সময় ওই ছিদ্রগুলো দিয়ে পানি ছড়িয়ে পড়ে পুরো ছাদে।”
ফিওনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে,এভাবেই পানি দিতে হয়, কোনো সমস্যা তো হলোনা ফ্লোরে হাঁটার সময়?”
ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে, ফিওনা অ্যকুয়ারা থেকে গাছগুলোর পরিচর্যার এক অদ্ভুত সিস্টেমের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল।
অ্যকুয়ারা গর্বিত ভাবে উওর দিলো “এটা হচ্ছে অত্যাধুনিক পানি সিস্টেম,যা ফ্লোরের নিচে থাকা লোহার পাইপের মাধ্যমে কাজ করবে। এগুলোতে ছোট ছোট ছিদ্র আছে যেগুলো থেকে পানি বের হয়ে সোজা গাছের গোড়ায় পৌঁছাবে।
“তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়,” অ্যকুয়ারা ফিওনাকে বলল, “এখানে কোনো রকমের জলদূষণ বা সমস্যা হয় না। শুধু এই বাটনগুলো প্রেস করতে হবে।” সে একটি সাদা গোলাকার বাটনের দিকে নির্দেশ করল, যেটি ছাদের ফ্লোরে এক কোণে স্থাপন করা ছিল।
ফিওনা কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করল, “এই সিস্টেমটা কি খুবই জটিল?”
“না, খুবই সহজ,” অ্যকুয়ারা হাসতে হাসতে বলল,”ফ্লোরের নিচে পাইপগুলো তৈরি করা হয়েছে এমনভাবে যেন, যখন তুমি বাটনটি চাপবে, সিস্টেম অটোমেটিক্যালি সক্রিয় হবে আর পানির প্রবাহ শুরু হবে যা বাটনগুলো এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে হাঁটার সময় কোনো অসুবিধা না হয়, তারা সূক্ষ্ম আর মসৃণ অবস্থায় আছে।”
ফিওনা আরও অবাক হয়ে বলল, “এটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং সিস্টেমটি তো একদম নিখুঁত!”
অ্যাকুয়ারা মৃদু হেসে ফিওনাকে বলল, “তুমি একটু থাকো, আমি আসছি। একটা জিনিস ভুলে গেছি, দাঁড়াও, আসছি একটু সময় লাগবে।”
ফিওনা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, “ঠিক আছে, অ্যকু, তাড়াতাড়ি আসো।”
অ্যাকুয়ারা দ্রুত পা চালিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেল। তার চলে যাওয়ার মুহূর্তে, ফিওনার চারপাশে শান্তি ভর করল। ছাদের ফুলগাছগুলো, সেই অদ্ভুত ফুলের সুগন্ধ, আর হালকা বতাসের মৃদু নিঃশ্বাস তাকে অদ্ভ প্রশান্তির মধ্যে ডুবিয়ে দিল। ফিওনা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকলো, তার চোখে কিছুটা চিন্তা, কিছুটা বিরক্তি। এত সুন্দর এই জায়গা, তবুও কিছু একটা ছিল, যা তার মনকে অস্থির করে তুললো।
ছাদের কিনারায় এসে দাঁড়ালো ফিওনা। চারপাশে তাকালেই শুধু পাহাড়, পাহাড় আর পাহাড়। সবুজে আচ্ছাদিত প্রকৃতি অশেষ,আর একেবারে আকাশের সীমানায় মিশে গেছে। মেঘগুলো এত কাছের, হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেয়া যাবে। এই দৃশ্য ছিল কোনো স্বপ্নের মতো।
ফিওনা চোখ বন্ধ করে কিছুটা অবাক হয়ে হাত বাড়াল। মেঘের নরম গাঁথনে প্রথমে হাতটি ছুঁইয়ে গেল। ঠাণ্ডা অনুভূতি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল।
হঠাৎ ফিওনার মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি এলো। “আচ্ছা, অ্যাকুয়ারা যে পানি দেওয়ার সিস্টেমের কথা বলছিল, যদি আমি সেটা চালু করি,তাহলে তো দেখতে পারব কিভাবে গাছগুলোকে পানি দেওয়া হয়!” এই চিন্তা মনে আসতেই, ফিওনা ফ্লোরের কাছে থাকা একটি বাটান প্রেস করলো।
ঠিক তখনই সিস্টেমের ভেতর থেকে একটা নড়াচড়া শুরু হলো। এক মুহূর্তের মধ্যে চারপাশে থাকা ফ্লোরের সব পাইপ থেকে পানি বের হতে শুরু করলো,মনে হচ্ছে কোন ঝর্ণা থেকে তারিফের মত স্রোত বেরিয়ে আসছে।প্রথমে অল্প কিছু, তারপর আরো দ্রুত গতিতে পানি ছড়িয়ে পড়লো, সবগুলো পাইপ থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে আসছিলো।
ফিওনা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো, পুরো ছাদ এক নিমিষে পানিতে ভিজে গেলো। তার শরীরের জামাকাপড় একেবারে ভিজে গেলো, স্যাঁতসেঁতে হয়ে গিয়েছে।
সে চিৎকার করে করে ডাকতে থাকলো , “অ্যাকুয়ারা!” তবে কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। ফিওনা হতভম্ব হয়ে আবার একাধিক বার বাটন প্রেস করতে লাগলো, কিন্তু কোনো কাজ হল না। পানির প্রবাহ থামলো না, বরং আরো জোরে বের হতে লাগলো।
এদিকে, ছাদে প্রবেশ করা আর বের হওয়ার সিস্টেম ফিওনা জানেনা। একদম নিজেই তার ভুল বুঝতে পারলো। সে যে সিস্টেম চালু করেছিল, তা কাজ করছে, কিন্তু বন্ধ করার উপায় সে জানে না। সেখান থেকে বের হওয়া পানি থামানো সম্ভব ছিল না—অ্যাকুয়ারাই জানতো এই সিস্টেমের সঠিক কৌশল।
ফিওনা একাধিক বার বাটন প্রেস করার ফলে জলপ্রবাহ এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে,ফিওনার শরীরে পড়া প্রতিটি ফোঁটা মনে হচ্ছে ধারালো কাঁটার মতো। পানি শক্ত হয়ে গা’য়ে আঁচড়ে পড়ছিল। সে সরে যেতে চেষ্টা করলো, কিন্তু চারিদিক থেকে আসা পানি তাকে এক জায়গায় আটকে রেখেছে।
প্রথমে সামান্য অস্বস্তি, তারপর ধীরে ধীরে ব্যথার অনুভূতি হতে লাগলো। ফিওনা ভিজে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পুরো শরীর তীক্ষ্ণ ঠাণ্ডায় কাঁপতে শুরু করল।পানি এতটাই প্রবল ছিল যে,তার শরীরের ওপর আছড়ে পড়তে পড়তে এক ধরনের ভারী অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছিল।
হঠাৎ করেই ফিওনার কনুই ধরে একটা শক্ত হাতে টান দিয়ে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিল। প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না ফিওনা। চোখের সামনে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে একটি অবয়ব স্পষ্ট হতে লাগলো। তার হৃদস্পন্দন কিছুটা দ্রুত হয়ে উঠলো কিন্তু ঠিক কী অনুভব করছে—আশ্বস্ত হবে নাকি ভয় পাবে, সে মুহূর্তেই ঠিক করতে পারছিল না।
তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি এক চমকানো দৃষ্টিতে তাকে দেখে যাচ্ছিল। সেই সবুজ চোখ দুটি গভীর কোনো রহস্যে মোড়া ছিল। সেই চোখগুলো সরাসরি ফিওনার দিকে তাকিয়ে তার আত্মাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। তার দৃষ্টিতে ছিল তীক্ষ্ণ।
জ্যাসপার কঠোর কণ্ঠে বললো, “এই মেয়ে,তুমি ছাদে কি করছো? কার অনুমতি নিয়ে এখানে এসেছো? আর এসব কি করেছো তুমি?”
তার কথায় অসন্তুষ্টির গম্ভীরতা ছিল,কিন্তু সেই মুহূর্তে ফিওনা শুধু এক মুহূর্তের জন্য তীব্র শীতলতা অনুভব করলো। জ্যাসপারও পুরোপুরি ভিজে গেছে, তার কালো ব্লেজারের উপর পানি কাঁপছে।
ফিওনাকে শক্তভাবে ছেড়ে দিয়ে, জ্যাসপার দ্রুত সেই বাটন প্রেস করতে শুরু করল। তবে,বাটনগুলো একাধিক বার প্রেস করার কারণে কান্ট্রোল সিস্টেম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাটান কাজ না করায় জ্যাসপার হতাশ হয়ে, একেবারে সিস্টেমটা ঠিক করতে চেষ্টা করছিল, তার চোখে চাপের ছাপ স্পষ্ট।
হঠাৎ করেই জ্যাসপারের চোখ চলে গেলো ফিওনার দিকে। ফিওনা যে পোশাকটি পরেছিল, তার হালকা গোলাপী আর সাদা রঙের জামা ভিজে যাওয়ার পর একে একে তার শরীরের প্রতিটি ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। জামার কাপড়টি এতোটুকু পাতলা হয়ে গিয়েছিল যে,পানি চলতে চলতে তা দেহের সঙ্গে আঁটসাঁট হয়ে ছিল,ফিওনার কোমর, বুকের রেখা, শারীরিক গঠন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।
এমন দৃশ্যের কারণে জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।জামাটি ভিজে গিয়ে তার ত্বকের সঙ্গে লেগে থাকা অনেক কিছু একে একে উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিল,যা চোখে পড়ার মতো।
জ্যাসপার দ্রুত উঠে এসে ফিওনার সামনে দাঁড়ালো, তার চোখে তীব্র অস্থিরতা। তার হাত তড়িঘড়ি করে নিজের কালো ব্লেজারটি খুলে ফিওনার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ফিওনার বুকের দিকে ব্লেজারটি ধরার সাথে সাথেই,ফিওনার ভিজে পোশাকের কিছুটা আড়াল হয়ে গেলো। ফিওনা অবাক হয়ে তাকালো, কিছু বুঝতে পারলো না, তার মুখে অজ্ঞতা ফুটে উঠলো।
জ্যাসপার আবার ফিরে যায় নিজের জায়গায় সিস্টেমের কাছে, বাটানটি ঠিক করার প্রচেষ্টা চালায়, তার চোখে গভীর তৎপরতা। কিছুটা পানি কমছে, তবে পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ছাদের ভেজা পটভূমিতে,পানি ছড়িয়ে পড়ছিল,পুরো ছাদটাই ঢেকে যাচ্ছে।
ফিওনার মাথা ঘুরে যাচ্ছিলো, তবে কোনো উত্তর ছিল না, সঠিক পরিস্থিতি সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছিল না।
পানি হঠাৎ আরও কয়েকটি ছিদ্র দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে আসতে শুরু করলো, আর তার ঝাপটায় জ্যাসপার পুরো ভিজে গেলো। তার পরনে ছিলো সাদা শার্ট আর কালো টাই, যা দ্রুত পানিতে ভিজে গাঢ় হয়ে গায়ে লেগে আছে। বিরক্তির সঙ্গে, কিন্তু অভ্যস্ত দক্ষতায়, সে একটানে টাই খুলে ফেললো, আর যখন ঝাপটানো পানি শার্টের ওপর এসে পড়ল, তাতে কয়েকটি বোতামও ঢিলে হয়ে খুলে গেলো। তার শক্তপোক্ত বুক স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
তার চুলগুলোও ভিজে গিয়ে কপালে এসে লেপ্টে যাচ্ছিলো, তাই ভেজা আঙুলের সাহায্যে সেগুলো পিছনের দিকে ঠেলে সরাতে লাগলো, দূরে দাঁড়িয়ে ফিওনা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল—ফিওনার হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে উঠেছে, বুকে ঢেউ তুলছে প্রতিটি ধুকপুক।
তার চোখের সামনে এক হাঁটু ভেঙ্গে বসে থাকা জ্যাসপার, ভেজা শার্ট গায়ে লেপ্টে গেছে, তার মসৃণ ত্বক আর মজবুত পেশীগুলো স্পষ্ট। ।
ফিওনা নিজেকে সামলাতে পারছে না, তার চোখ পলকহীন, জ্যাসপারকে ঠিক এই মুহূর্তে গিলে খাচ্ছে।এমন অস্বাভাবিক,আবেগে ভরা দৃশ্যে ফিওনার সমস্ত জগৎ থেমে গেছে, তার দৃষ্টি নির্লজ্জের মতো আটকে আছে এই অপরূপ মুহূর্তে।
জ্যাসপার ফিওনার দিকে আবার তাকাল, তার দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা ফুটে উঠল। ভ্রু দুটি কুঁচকে গেল কিছু অনুমান করতে চেষ্টা করলো। ফিওনা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তখন ও তার চারপাশের সবকিছু থেকে সে বিচ্ছিন্ন, এতটাই গভীরভাবে ডুবে ছিল যে, কখন যে জ্যাসপারের জড়িয়ে দেওয়া ব্লেজারটি তার বুক থেকে পড়ে গেছে, তার কোনো হুঁশই ছিল না।
ফিওনার নজর ছিল কেবল জ্যাসপারের দিকে,তার চারপাশের বাস্তবতা তখন অর্থহীন। আর সে তো বুঝতেও পারেনি কেনো জ্যাসপার তার গায়ে ব্লেজার জড়িয়ে দিয়েছিলো।
পানি একবারে বন্ধ হয়ে গেলেও, ঝিড়ি ঝিড়ি করে একটু একটু করে ছড়াতে থাকল। জ্যাসপার ধীর পায়ে উঠে এসে আবার ফিওনার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো।
কিন্তু ঠিক তখনই ফিওনার ধ্যান ভেঙে গেল। এক পলকেই,ফিওনা নিজেকে সামলে নিলো কিন্তু তার মনে এক ধরনের অস্থিরতা চলছিল।
“উফ,ফিওনা!” মনে মনে নিজেকে আবার গালি দিতে লাগলো,”আবারও তুই এইভাবে তাকে দেখছিলি। এই ফায়ার মনস্টারটা বোধহয় বুঝে ফেলেছে তুই তাকে চোখ দিয়েই…সর্বনাশ করছিলি। এখন কি করবি?কিভাবে সামলাবি এই পরিস্থিতি?”
জ্যাসপার হঠাৎ করে ফিওনার একদম সামনে এসে দাঁড়ালো, তার ভাবভঙ্গি থেকে রাগ আর অবাক করা এক ধরনের ঠান্ডা তীব্রতা বের হয়ে আসছিল।
“আমাকে সিডিউস করতে চাইছো?”— তার কণ্ঠে চরম অবিশ্বাস আর কঠোরতা ছিল। “সিরিয়াসলি, একজন ড্রাগনকে তুমি নিজের প্রতি অ্যাট্রাক্ট ফিল করাতে চাইছো? নিজের বডি এভাবে শো করিয়ে কী প্রমাণ করছো? এভাবেই সব পুরুষকে বডি শো করিয়ে সিডিউস করো?”
ফিওনা হতভম্ব হয়ে একটুও নড়তে পারেনি। তার মনে একের পর এক প্রশ্ন উঠছিল কিছু বুঝতেই পারছিল না। এই লোকটা কী বলছে? তার চোখ ছলকে উঠল, অস্বস্তিতে গা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কি সব কথা? কেন সে এমন কথা বলছে?
ফিওনা এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে রইলো, সঠিক শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। জ্যাসপারের কথাগুলোর মধ্যে তীব্রতা ছিল, কিন্তু তার ওপর থেকে উনি এমনভাবে কথা বলছিলেন মনে হলো সে ফিওনার একান্ত জীবন সম্পর্কে সব জানে।
এই ব্যক্তির কঠোর বাক্য আর অবহেলা তাকে পুরোপুরি অপ্রস্তুত করে রেখেছিল, পৃথিবীটাও থমকে গেছে এক মুহূর্তে।
“আপনার কি মাথা খারাপ?”—ফিওনা বিরক্তি নিয়ে মুখের প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করলো,”কি সব বাজে কথা বলছেন? আমি কেনো আপনাকে সিডিউস করতে যাবো? আর আমি আজ পর্যন্ত কোনো ছেলের সামনে যাইনি, আমার কোনো ছেলে বন্ধুও ছিল না।”
জ্যাসপারের তীক্ষ্ণ চোখে এক মুহূর্তের জন্য কিছুটা বিরতি এলো,সে আরো অটল হয়ে বললো, “ও তাই? তাহলে ডক্টর লিউ ঝান? যার সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একদিন কথা বলছিলে?”
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৩
জ্যাসপার তার দিকে কিছুক্ষণ তাকাল, তারপর ফিওনা অবলীলায় উত্তর দিলো, “উনি মিস ঝাং এর ডক্টর আর আমার গ্র্যান্ডপার পার্টনারের নাতি তাই। আর মাত্র একদিন তার সাথে কিছু সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল।আর আপনাকে কেনো কৈফিয়ত দিচ্ছি, আপনার কি?”
ফিওনার কথা শেষ হতে না হতেই তার গলা কিছুটা কাঁপলো, কিন্তু সে নিজেকে ধরে রেখেছিল। সে জানতো, এখন এই মুহূর্তে, তার শুদ্ধতা আর নির্দোষতা স্পষ্ট হওয়া উচিত ছিল।