চন্দ্রাস্ত পর্ব ১০
ফারহানা কবীর মানাল
আকাশের অবস্থা ভালো। চাঁদ আছে, অসংখ্য তারা আছে, জায়গায় জায়গায় কালচে মেঘ দেখা যাচ্ছে। থেমে থেমে ঠান্ডা বাতাস বইছে। সে ক’ব’রে পাশে বসে পড়ল। চোখে-মুখে লেপ্টে থাকা অশ্রুকণা শুকিয়ে এসেছে। তার ঠোঁটের চাপা হাসি আর একটু চওড়া হলো। তরল গলায় বলল, “জীবনে খুব সুন্দর সুখের একটা সংসার চেয়েছি। সব কষ্ট দূরে সরিয়ে আনন্দে বাঁচতে চেয়েছি। অথচ সে-সবের কিছুই পেলাম না। না পাওয়ার একটা বড় অংশ শুধু তোমার কারণে। সন্তানকে ছাড়া কি কোন পিতা ভালো থাকতে পারে? পারে না। কাজের ব্যস্ততা অথবা পৃথিবীর কোন সুখ পিতার মন থেকে সন্তানের কথা মুছে দিতে পারে না। জানো বাবা? যে তোমাকে হ’ত্যা করেছিল সে অনেক আগেই নিজের কৃতকর্মের শা’ন্তি পেয়েছে। আর যে তোমাকে হ’ত্যা করতে চেয়েছিল সে-ও শা’স্তি পাবে। আগামী শুক্রবার তার ফাঁ’সি হবে।”
হাবিব কথা শেষ করতে পারল না। ডুকরে কেঁদে উঠল। যারা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে তাদের কাউকেই সে হারাতে চায়নি। বোন, সন্তান, দুলাভাই কাউকে না। আর মিলি? সে তার জীবনের কোন অংশ ছিল না। শুধুমাত্র পরিচিত একজন। যার মৃ’ত্যুতে শোক প্রকাশ করলেও খুব বেশি কষ্ট হয় না। চোখে পানি আসে না। সে দীর্ঘ সময় ক’ব’রের পাশে বসে রইল। দোয়া-কালাম পড়ে মোনাজাত ধরল। কান্নাভেজা গলায় বলল, “আল্লাহ তোমাকে ভালো রাখুক। ম’রার পর আর একবার তোমার সাথে আমার দেখা করার সুযোগ দিক।”
বাতাসের কারণে মাঝেমাঝে মেঘের স্থান পরিবর্তন হচ্ছে। চাঁদ একরাশ কালো মেঘের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে। চাঁদের গা গলে জোছনা গড়িয়ে পড়ছে না। সবকিছু কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। কাছে কোথাও একটা পাখি ডাকছে। তার ডাক অপরিচিত।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নববীর ঘুম ভাঙল দেরিতে। সে আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসল। হাবিব পায়ের কাছে বসে মনযোগ সহকারে কিছু দেখছে। নববী বলল, “কি দেখছ?”
“হুম! তেমন কিছু না। তোমার শরীর কেমন আছে?”
“ভালো আছে। তুমি কেমন আছ?”
“ঠিকঠাক। শরীর ভালো থাকলে আমায় এক কাপ চা করে দেবে? অনেকদিন তোমার হাতের চা পান করা হয় না।”
নববী খাট থেকে নামল। ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগাতে লাগতে বাথরুমে ঢুকে গেল। হাবিব সেদিকে খেয়াল দিলো না। সে দুই জোড়া কানের দুল হাতে নিয়ে বসে আছে। একই রকমের কানের দুল দু-জনের কাছে থাকা কাকতালীয় হতে পারে না। এখানে কিছু রহস্য আছে। সে একটু সময় নিয়ে চিন্তা করল তারপর দুল দু’টো সরিয়ে রাখল। খাবার টেবিলে নাইমা বলল, “ভাইয়া কিছু জানতে পারলে?”
হাবিব গম্ভীর গলায় বলল, “ না এখনও কিছু জানতে পারিনি। তবে মন বলছে খুব তাড়াতাড়ি কিছু না কিছু জানতে পারব।”
“ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
“এখনই কিছু বলা যাবে না। কাজ হবার পর বলব। তবে এ কাজের জন্য তোর সাহায্য লাগবে।”
“ঠিক সময়ে বলব। মা ডাকছে। গিয়ে দেখ কি বলে।”
নাইমা খাবার রেখে উঠে পড়ল। হাত ধুয়ে মা’য়ের ঘরে ঢুকল। শরিফা বেগম বললেন, “তোকে কতবার বলব হাবিবের থেকে দূরে দূরে থাকবি?”
নাইমা শক্ত মুখে বলল, “তুমি কি বলতে চাইছ তা বুঝতে পারছি। এসব চিন্তা মাথা থেকে ছেড়ে ফেলে দাও। নিজের স্বামী সন্তানের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছ না? মা তোমার কি হয়েছে? কেন এমন করছ?”
“আগে-পরে কখনো কিছু বলেছি? যখন খুশি সেখানে খুশি বাপ ভাইয়ের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছিস। এখন আর আগের অবস্থা নেই। পৃথিবীতে শ’য়তান নেমেছে।”
“মানুষের সাথেই শ’য়তানের জন্ম। সে আজন্ম কাল ধরে মানুষের সাথেই থাকবে।”
শরিফা বেগম মেয়ের গায়ে হাত রাখলেন। কোমল গলায় বললেন, এই সমাজ খুব খারাপ রে মা। এখানে ধ’র্ষ’কের থেকে ধ’র্ষি’তার দিকে মানুষের নজর বেশি থাকে। নিষ্পাপ মেয়েগুলোর ছবি খবরের কাগজ থেকে শুরু সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচার হয়। কিছু হলুুদ সাংবাদিক কার ঘরে কি হচ্ছে তার খোঁজ নিয়ে বেড়ায়। তোদের কাউকে নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। শুধু ভয় হয়। এক মেয়েকে হারিয়েছি। আমার নিজের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এমন হয়েছে। আর কাউকে হারাতে চাই না।”
নাইমা তার মায়ের গায়ে হাত রেখে হাসল। বাচ্চাদের প্রশ্রয় দিতে বড়রা যেমন করে হাসে তেমন হাসি৷ সত্যিই এ সমাজের মানুষ ভালো না। এরা মুখে মুখে প্রতিবাদ করে, বিচার চায় ঠিক। অথচ সামান্য লাইক কমেন্ট ফলোয়ার এসবের জন্য ধ’র্ষি’ত মেয়েদের ছবি পোস্ট করে। সাথে আবেগি দু – লাইন ক্যাপশন জুড়ে দেয়। অথচ তাদের উচিত ছিল মেয়েটাকে লুকিয়ে রেখে ধ’র্ষ’কের ছবি প্রচার করা। ধ’র্ষ’নের শা’স্তি চাইবার জন্য ধ’র্ষি’তার ছবির প্রয়োজন কি?
বেলা পড়ে এসেছে। তার অফিসের কাজ প্রায় শেষ। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। বাদশা নিজের বসে কিসব লেখালেখির কাজ করছে। সে ইশারায় বাদশাকে কাছে ডাকল। বাদশা উঠে গিয়ে বলল, “কি হয়েছে? কোন সমস্যা?”
হাবিব বলল, “ডান পা অবশ হয়ে গেছে। উঠতে পারছি না।”
সে হাবিবের হাত ধরল। নরম গলায় বলল, “মাঝেমধ্যে এমন হয়। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।”
“ধন্যবাদ বাদশা ভাই। অফিস শেষে আপনার সাথে বসে এক কাপ কফি খেতে চাই। অসুবিধা নেই তো?”
“না না, অসুবিধা কিসের?”
হাবিব মুচকি হাসল। অফিসের সামনে এই ক্যাফেটা নতুন হয়েছে। ছিমছাম পরিবেশ, সুন্দর করে গোছানো। তারা দুকাপ কফি অর্ডার করল। হাবিব বলল, “বুঝলেন ভাই, একটা সমস্যা হয়ে গেছে।”
বাদশা উৎসুক চোখে তাকাল। সরু গলায় বলল, “কি সমস্যা? সিরিয়াস কিছু?”
“মনে আছে- অফিসের কাজে যেখানে গিয়েছিলাম, সেই জায়গার এক দোকান থেকে কানের দুল কিনেছিলাম?”
“হ্যাঁ, খুব মনে আছে। আমিও তো আপনার ভাবীর জন্য একজোড়া নিয়েছিলাম। বেশ সুন্দর দেখতে ছিল।”
“হ্যাঁ, ওইটার কথাই বলছি। নববী সেই দুল জোড়া টিস্যু পেপারে মুড়ে টেবিলের ওপর রেখেছিল। আমি ময়লা টিস্যু ভেবে ফেলে দিয়েছি। এখন কান্নাকাটি শুরু করেছে।”
“মেয়ে মানুষের আর কি কাজ! আমার নিজের ঘরেরটাও এমন।”
“হ্যাঁ, এখন ওকে অমনই এক জোড়া কিনে দিতে হবে। কিন্তু আমার সে ডিজাইন মনে নেই। আপনি যদি ভাবীর দুল জোড়া নিয়ে আসতেন বা ছবি তুলে দিতেন, তাহলে খুব উপকার হতো।”
“আরে এ আর এমন কি! আমি বাড়ি গিয়েই পাঠিয়ে দেব অথবা কাল সকালে সাথে করে নিয়ে আসলাম।”
হাবিব হাসল। সন্ধ্যা নেমে গেছে। পাখিরা নিজেদের ঘরে ফিরতে ব্যস্ত। তারা দু-জনও দাঁড়িয়ে পড়ল। কফির বিল মিটিয়ে যে যার বাড়ির পথ ধরল।
নববী সন্ধ্যার নাস্তায় চায়ের সাথে পনিরের সমুচা ভেজেছে। এই খাদ্যবস্তু হাবিবের খুব পছন্দের খাবার। শরিফা বেগম থালায় করে মহিউদ্দিন সাহেবের জন্য নিয়ে গেছেন। সাথে নিজের ভাগেরটাও নিয়েছেন। নাইমার শরীরটা একটু খারাপ, সে এসব খাবে না। দু’টো খেজুর খেয়ে পড়তে বসেছে। তবে বইয়ের পাতায় মন লাগাতে পারছে না। মিলির ব্যাপারে আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত পুলিশ কোন পদক্ষেপ নিবে না। আর নিলেও তাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করবে না৷ মহিউদ্দিন সাহেব বিকেলে মিলিদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। বাড়ির অবস্থা ভালো। মানিক মিয়াকে দেখে মনে হলো- তিনি শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। মিলির মা অবশ্য তার সামনে আসেনি।
হাবিব সমুচার শেষ অংশটুকু মুখে পুরে দিলো। তৃপ্ত গলায় বলল, “দারুণ বানিয়েছ। খুব ভালো হয়েছে।”
নববী বলল, “আর খাবে? দুটো আলাদা করে তুলে রেখেছি।” তার মুখ হাসিহাসি। চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে। হাবিব বলল, “না, এখন আর খাব না৷ তুমি গিয়ে নাইমাকে একটু ডেকে নিয়ে এসো।”
নববী বেরিয়ে গেল। নাইমা তার খাতা নিয়ে এসে ভাইয়ের সামনে বসল। সরু গলায় বলল, “হোটেলে তোমার সাথে মিলি আপুর কতবার দেখা হয়েছে?”
“একবার। রেস্তোরাঁয় খেতে বসেছিলাম তখন এসেছিল। তারপর আর দেখা হয়নি।”
“অথচ সেদিন মানিক মিয়া বললেন – মিলি আপু পাঁচ দিন পর বাড়ি ফিরেছে।”
“তাতে কি হয়েছে?”
“দেখো ভাইয়া, তুমি অফিসের কাজের জন্য মোট ছয়দিন বাইরে ছিলে। মিলি আপু তোমার সাথে যায়নি। আমাদের বাড়িতে এসে একদিন থেকেছে তার পরেরদিন নিজের বাড়ি গিয়েছে। অর্থাৎ এখানেই দু’দিন শেষ। আবার তুমি যেদিন ফিরে এসেছ সেদিনই সে রোহানকে নিতে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। এর মানে কিছুতেই সে পাঁচ দিন বাড়ির বাইরে থাকতে পারে না।”
“মানিক মিয়া মিথ্যা বলছেন?”
“একদম। আমি মিলি আপুর মা’য়ের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম- রোহানকে নিয়ে সে ওইদিন সোজা বাড়িতে গিয়েছে। অন্য কোথাও থাকেনি।”
নববী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। বলল, “আল্লাহ! এখানে কি হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।”
নাইমা বলল, “আরও একটা ব্যাপার। আব্বা আজ ওদের বাড়িতে গিয়েছিল। পোলাও গোশত খেতে দিয়েছে। যে বাড়িতে একদিন আগে একজন মানুষ মা’রা গেল, সেই বাড়িতে পোলাও গোশত? ব্যাপারটা যেন কেমন কেমন।”
হাবিব কিছু বলতে যাবে তক্ষুনি তার মোবাইলটা বেজে উঠল। বাদশা কল দিয়েছে। হাবিব কল রিসিভ করে বলল, “আসসালামু আলাইকুম, বাদশা ভাই। বলেন।”
বাদশা করুণ গলায় বলল, “আপনি কানের দুলের কথা বলেছিলেন না?”
“হ্যাঁ, বলেছিলাম। ছবি পাঠিয়ে দিয়েছেন?”
“না ভাই, আপনার ভাবীও সে কানের দুুল হারিয়ে ফেলেছে। সন্ধ্যা থেকে অনেক খোঁজা খুঁজি করলাম। পেলাম না।”
“ঠিক আছে। সমস্যা নেই। নববীকে আমি বুঝিয়ে বলব।”
বাদশা কল কেটে দিলো। হাবিব বলল, “আমার সন্দেহ ঠিক। ওই মহিলার কাছে কানের দুল পাওয়া যায়নি।”
নাইমা বলল, “কিসের সন্দেহ ভাই? কি হয়েছে?”
“আমার কলিগ বাদশা। তার বউ ভীষণ সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত। আমার মন বলছে বাদশার বউ আমাদের কাজের জায়গায় গিয়েছিল। ভদ্রমহিলা সব সময় ভিডিও কলে কথা বলে। দিনের বেশিরভাগ সময় বাদশা ফোন হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অথচ ছয়দিনের মাঝে দু’দিন সে ভিডিও কল দেয়নি। বাদশা দিতে চাইলেও এড়িয়ে গেছে। এর মানে সে এমন জায়গায় ছিল সেখানে ভিডিও কল দেয়া যাবে না, দিলে সমস্যা হবে। অর্থাৎ সে নিজের চোখে দেখতে এসেছিল বাদশা কি করছে।”
চন্দ্রাস্ত পর্ব ৯
নাইমা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এটা খুবই অযৌক্তিক সন্দেহ। তবুও তার মনে দানা বাঁধল। অতিরিক্ত সন্দেহ প্রবণ মহিলারা যে কোন কিছু করতে পারে। মনে সন্দেহ মেটাতে যেখানে খুশি যেতে পারে। কিন্তু গেলেই বা কি? সে আর ভাবতে পারল না। বলল, “নাইমা, তুই এখন যা। এসব নিয়ে পরে কথা বলব।”
নাইমা বেরিয়ে গেল। যাবার সময় দরজা ভেজিয়ে দিয়ে গেল।