চন্দ্রাস্ত পর্ব ১১
ফারহানা কবীর মানাল
ভোরের আলো ফোঁটার সময় হয়ে এসেছে। একটু পর সকাল হবে। সূর্য উঠবে। গাঢ় অন্ধকার ম’রে গেছে প্রায়। হাবিব মোনাজাত শেষ করল। নববীর দিকে তাকিয়ে বলল, “হাঁটতে যাবে?”
নববী বলল, “আর একটু সময় থাকি। এখানে থাকতে ভালো লাগে। মনে হয় ছেলেটা আমার কাছে আছে।”
“কষ্ট পেও না নববী। আমাদের ছেলে ভালো আছে। দুনিয়ার কুৎসিত পরিবেশ থেকে দূরে আছে। ওর গায়ে বি’ষা’ক্ত বাতাস লাগে না।”
সে আর কিছু বলল না। আঁচলে চোখের পানি মুছল। ফজরের নামাজ শেষে তারা দু-জনে ছেলের ক’ব’র জিয়ারত করতে এসেছিল। তাদের ছেলে মা’রা গেছে বেশ অনেকদিন। তবে ছেলে হারানোর শোক একটুও কমেনি। নতুন রয়ে গেছে। এখনো তাদের চোখে পানি আসে, বুক চি’রে দীর্ঘশ্বাস বের হয় না। বাড়ির উঠানে লাগানো বসরাই গোপালের ঝাড় ফুলে ছেয়ে গেছে। বিনা যত্নে এত ফুল উপহার দেয়াটা কি শোভনীয় দেখায়? হয়তো দেখায় নয়তো দেখায় না! হাবিব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। নববী বলল ,“এখন আর কোথাও যাব না। রান্না বসাতে হবে। আম্মার শরীর ভালো না। রাতে বলছিলেন–মাথা ব্যাথা করে, শরীরের বল পান না।”
“তোমার শরীর ভালো আছে?”
“ভালো আছে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ঠিক আছে। রান্নার ফাঁকে সুযোগ পেলে আমায় এক কাপ চা করে দেবে?”
নববী হেসে রান্নাঘরে চলে গেল। হাবিব তার মা’য়ের দরজায় কড়া নাড়ল। অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, “মা, শরীর কেমন আছে?”
শরিফা বেগম বললেন, “শরীর বেশি ভালো না। গায়ে বল পাই না। মাথাটাও কেমন ঘুরায় ঘুরায়।”
“শরীর খারাপ লাগা ভালো কথা না। আমি ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়ে দেব। সন্ধ্যায় ডাক্তার দেখাতে যাবে।”
শরিফা বেগম মাথা দোলালেন। হাবিব নিজের ঘরে চলে গেল। নাইমা রান্নাঘরে বসে সবজি কাটছিল। কাজ থামিয়ে বলল, “ভাবী, ভাইয়া কোথায়?”
“বোধহয় ঘরেই আছে। কিছু বলবে?”
“ঘরে গিয়েছিলাম। পাইনি।”
“ওহ আচ্ছা! তাহলে আম্মার কাছে গিয়েছিল। তুমি একটা কাজ করো নাইমা। এই চায়ের কাপটা তোমার ভাইকে দিয়ে এসো। এদিকটা আমি সামলে নেব।”
নাইমা হেসে কাপ হাতে নিলো। হাবিব তখন বিছানায় বসে চোখ বুঁজে আছে। সে তার কাছে গিয়ে বলল, “ভাইয়া, চা নিয়ে এসেছি।”
“তোকে একটা কাজ করতে হবে নাইমা।”
“কি কাজ করতে ভাইয়া? তদন্তের ব্যাপারে কিছু?”
“হুম। তোকে নিয়ে বাদশা ভাইয়ের বাড়িতে যাব। যে কোন এক অযুহাতে ঘরে ঢুকে উনার বউয়ের ছবি তুলবি।”
“বুঝে গেছি ভাইয়া। তারপর ছবিটা মিলি আপুর মা’কে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করব এটাই সেই বান্ধবীটা কি-না।”
“একদম। এর বাইরেও কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে। যাবার পথে সবটা বুঝিয়ে বলব।”
“ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। এখন যা।”
নাইমা সোজা তার মায়ের ঘরে ঢুকল। মহিউদ্দিন সাহেব তখন ঘরে নেই। সে গিয়ে বিছানায় বসল। বলল, “মা, ভাইয়ার সাথে বাইরে যাচ্ছি। ভাইয়ার এক বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত আছে।”
শরিফা বেগম চোখ-মুখ শক্ত করে তাকালেন। কঠিন গলায় বললেন, “যেতে হবে না। দিন কাল ভালো না।”
নাইমা বিরক্ত গলায় বলল, “উফফ মা! তুমি কি শুরু করেছ? ভাইয়ার সাথে যেতে নিষেধ করছ কেন?”
“কতবার বলতে হবে? চারদিক থেকে ধ’র্ষ’ণের খবর আসছে। আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না। পুরুষ মানুষ সবাই সমান।”
“পুরুষ মানুষ সবাই সমান- কথাটা ঠিক। তার মানে এই নয় যে লোকজন নিজের পরিবারের ওপর থেকে বিশ্বাস তুলে নেবে। এক চোখে সবাইকে সন্দেহ করবে। দুই-এক খারাপ মানুষের জন্য সব সম্পর্ক নষ্ট করে দেবে। সবাই কখনোই এক রকম হয় না।”
শরিফা বেগম চুপ করে রইলেন। নাইমা নরম গলায় বলল, “মা, তোমার দুশ্চিন্তা বুঝতে পারছি। তাই বলে এমন দোষারোপ ঠিক না মা। ভাইয়া শুনলে কি মনে করবে? ভাইয়াকে তোমার এমন মনে হয়? দেখো, দুলাভাই আর ভাইয়া দুজনেই পুরুষ মানুষ। তাই বলে কি দুজনের চরিত্র সমান?”
শরিফা বেগম তবুও চুপ করে রইলেন। তিনি গতকালই একটা সংবাদ দেখেছেন– বাবা মেয়েকে ধ’র্ষ’ণ করেছে। তারপর থেকে তিনি আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। যাকে দেখছেন তাকেই সন্দেহ হচ্ছে। বুঝতে পারছেন এটা ঠিক নয়। সব পুরুষ খারাপ হয় না। কেউ কেউ অসম্ভব দায়িত্ববান হয়। নারীদের সম্মান করে। তবে তিনি এ কথা নিজেকে বোঝাতে পারছেন না।
সকালের নাস্তার পরপরই হাবিব নাইমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সে বাদশার বাড়ির ঠিকানা জানে। সোজা সে বাড়িতে গিয়েই উঠল। বাদশা তখন অফিসের জন্য তৈরি হয়ে আছে। হাবিব বলল, “শেষ পর্যন্ত আপনাদের বাড়িতে চলেই এলাম। বসতে বলবেন না?”
বাদশা জিভ কা’ম’ড়ে বলল, “একি কথা বলছেন! ভেতরে এসে বসুন। রাফিয়া দেখ, কারা এসেছে।”
হাবিব বারান্দায় চেয়ারে বসল। নাইমা ঘরে ঢুকে বলল, “ভেতরে কে আছেন?”
রাফিয়া এসে তাকে স্বাগত জানাল। বলল, “তোমার ভাইয়ের কথা অনেক শুনেছি। তোমার কথাও শুনেছি। তুমি খুব বুদ্ধিমতী। তা তোমার ভাবীকে নিয়ে আসলে না কেন?”
“ভাবীর শরীর বেশি ভালো নেই। পরে কখনো আসব। আমায় এক গ্লাস পানি দিবেন?”
“কেন দেব না? বসো বসো। আমি নিয়ে আসছি।”
সে দ্রুত পায়ে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেল। ফিরল একটু দেরিতে। দু-হাতে দিয়ে ট্রে ধরে রেখেছে। ট্রে-তে নানান খাবার সাজানো। নাইমা পানির গ্লাস নিলো। বাদশা এসে ট্রে নিয়ে হাবিবের সামনে রাখল। আনন্দিত গলায় বলল, “আপনাকে কল দিতাম। খুশির সংবাদ আছে। সেই কানের দুল পাওয়া গেছে। খাটের নিচে পড়ে গিয়েছিল। সকালে খুঁজে পেয়েছি।”
সে পকেট থেকে দুল জোড়া বের করল। বলল, “এই নেন। পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। পাছে ভুলে গেলে। আরে শুকনো মুখে বসে আছেন কেন? কিছু নিন। লজ্জা করবেন না।”
হাবিব এক টুকরো আপেল হাতে তুুলে নিলো। দীর্ঘ সময় ধরে তারা দু-জনে কথাবার্তা চালিয়ে গেল। অহেতুক অনর্থক কথাবার্তা। একটা সময় পর নাইমা ঘর থেকে বের হলো। ব্যস্ত গলায় বলল, “ভাইয়া চলো। দেরি হয়ে গেছে। এখন না গেলে খুব দেরি হয়ে যাবে। আপু খুব ভালো, গল্প করতে করতে সময় পেরিয়ে গেছে।”
হাবিব বলল, “চল।”
বাদশাও তাদের সাথে বেরিয়ে এলো। বউয়ের প্রশংসা শুনে তার খুব খুশি লাগছে। মেয়েটা যেমনই হোক লোকজন আসলে খুব যত্ন-আত্তি করে। সে অফিসের পথে গাড়ি ধরল। হাবিব নাইমাকে কোথাও এগিয়ে দিতে গেছে। অফিসে যেতে একটু দেরি হবে। তাকে বলেছে– বসকে বুঝিয়ে বলতে। সে-ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে এসেছে।
তারা যখন মিলিদের বাড়িতে ঢুকল তখন প্রায় দুপুর। সূর্য মাথার ওপরে। মানিক মিয়া বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের দেখে বললেন, “তোমরা হঠাৎ কি মনে করে? কিছু কি হয়েছে?”
হাবিব বলল, “বিশেষ কিছু হয়নি। কয়েকটা কথা জানতে এসেছি।”
তিনি ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। বিস্মিত গলায় বললেন, “কি কথা জানতে এসেছ?”
“আপনি সেদিন বললেন– মিলি পাঁচদিন পর বাড়িতে ফিরেছে। এ কথা কি ঠিক?”
মানিক মিয়া আঙুল গুনতে শুরু করলেন। হাবিব নাইমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। নাইমা ঘরে ঢুকে গেল। মিলির মা তখন রান্নাঘরে বসে বাঁধাকপি কুঁচি করছে। সে তার পাশে গিয়ে বসল। নরম গলায় বলল, “কেমন আছেন? শরীর ভালো আছে?”
সে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আর শরীর! বেঁচে আছি। কি মনে করে এসেছ?”
“আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে এসেছি।”
“কি দেখাবে আমাকে?”
নাইমা মোবাইল বের করে বাদশার বউয়ের ছবি দেখাল। বলল, “এই মেয়েটাই কি মিলি আপুর বান্ধবী পরিচয় দিয়েছিল?”
“হ্যাঁ, এ-ই তো সে। ওইদিন একটু সাজগোছ করে ছিল। তবে চেহারা এমনই। একে তুমি কোথায় পেলে? তোমার সাথে ছবি তুলল কখন?”
“ভাইয়ার সাথে তার কলিগের বাড়িতে গিয়েছিলাম। মেয়েটা সেই কলিগের বউ। নাম রাফিয়া।”
“এই মেয়ে আমার মিলিকে খু’ন করেছে? পুলিশ বলেছে?”
“পুলিশ এসবের কিছু জানে না। তবে তাদের জানাব।”
“ওহ আচ্ছা! আমি ভাবলাম।”
“আর একটা কথা, আগেরদিন আব্বা আপনাদের বাড়িতে এসেছিল। উনাকে পোলাও গোশত খেতে দিয়েছিলেন। মনে আছে?”
“এ কথা কেন জিজ্ঞেস করছ?”
“শোকের বাড়িতে পোলাও গোশত খুব একটা মানানসই না। দু’দিন আগে যাদের মেয়ে মা’রা গেছে তারা নিশ্চয়ই ভালো মন্দ রান্না করে খাবে না।”
“তুমি কি বলতে চাইছ? মিলির মৃ’ত্যুতে আমরা কষ্ট পাইনি? খুশি হয়েছি? সেজন্য পোলাও গোশত রান্না করেছি?”
“সে-কথা কখন বললাম? আমি তো শুধু জানতে চেয়েছি।”
“শোনো নাইমা, তোমার শখের গোয়েন্দাগিরির জন্য আমাদের কষ্ট নিয়ে সন্দেহ করো না। মিলি আমাদের নিজের মেয়ে। পাশের বাড়ির ভাবী পোলাও গোশত দিয়ে গিয়েছিল। আমরা দু’জন খাইনি তাই তোমার আব্বাকে দিয়েছিলাম।”
নাইমা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মিলির মা তার হাত ধরল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না হলে এসো আমার সাথে। ভাবীর মুুখ থেকেই না হয় শুনে আসবে।”
কথাগুলো বলেই সে ক্ষান্ত হলো না। নাইমাকে হাত ধরে সে-ই বাড়িতে নিয়ে গেল। ভাবীর মুখ থেকে স্বীকারোক্তি শুনিয়ে নিয়ে তবেই ফিরল। হাবিব তখনও চেয়ারে বসে আছে। মানিক মিয়া বললেন, “দু’জনে এসেছ যখন দুুপুরে খেয়ে যাও। তোমরা আমার মেয়ের হ’ত্যাকারীকে ধরতে চাইছ। এতে আমার আপত্তি করা বা কষ্ট পাওয়া সাজে না। পুলিশ পুলিশের কাজ করুক। তোমরাও চেষ্টা করো। সমস্যার কিছু নেই।”
হাবিব তার কথা শুনল না। নাইমাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। যেতে যেতে নাইমা তাকে সবটা খুলে বলল। সবকিছু শোনার পর হাবিব বলল, “ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে গড়াবে বুঝতে পারছি না। মহিউদ্দিন সাহেব বলেছেন– শোকের মাথায় নাকি তার দিন তারিখের হিসাব ছিল না। এর বাইরে আর কিছু বলেননি। দারোগা সাহেবও কোন খবরাখবর দিচ্ছেন না। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসেনি।”
“যা-ই হোক, রাফিয়া মিলি আপুদের বাড়িতে গিয়েছিল এটা নিশ্চিত। এখন উনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন এসেছিল। আর কিভাবে তার সাথে মিলি আপুর পরিচয় হয়েছে।”
“ঠিক বলেছিস। আজকে রাতেই আবার ওদের বাড়িতে যাব।”
“তাহলে আমি এখন বাড়ি ফিরে যাই। তুমি অফিস থেকে ফেরার পর সন্ধ্যায় আবার যাব।”
হাবিব মাথা কাত করল। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। দিন প্রায় শেষ। তবুও তাকে একবার অফিসে যেতে হবে। সে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
চন্দ্রাস্ত পর্ব ১০
সন্ধ্যা নেমে গেছে অনেকক্ষণ। হাবিব এখনও বাড়িতে ফেরেনি। নাইমা অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। বারবার করে ঘড়ির দিকে দেখছে। নববী বলল, “কি হয়েছে? এমন করছ কেন?”
“ভাইয়া এখনও ফিরছে না কেন? কল দাও তো।”
নববী হাবিবের নম্বরে কল দিলো। তার মোবাইল বন্ধ।