চন্দ্রাস্ত পর্ব ১৩
ফারহানা কবীর মানাল
বাদশা বলল, “পানি। একটু পানি হবে? ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পানি খাব।”
দারোগা সাহেব হাতের ইশারায় পানি আনতে বললেন। বয়স্ক এক লোক গ্লাসে করে পানি নিয়ে আসলো। বাদশার কাঁপা হাতে গ্লাস ধরল। এক চুমুকে সবটুকু পানি পান করে বলল, “এসব মিথ্যে কথা। আমার সাথে কারোর কোন সম্পর্ক নেই। সবকিছু অপবাদ।”
দারোগা সাহেব তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, “স্বামী স্ত্রী দু’জনেরই একই সমস্যা। এক কথায় কিছু স্বীকার করতে চায় না। অবশ্য কোন অপরাধীই নিজের দোষ স্বীকার করতে চায় না। সে যাইহোক! মিলির সাথে বাদশা বাবুর অবৈধ সম্পর্ক ছিল এটাই সত্যি।”
“না, মিলি আপুর সাথে বাদশা ভাইয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল না।” সকলে চমকে নাইমার দিকে তাকাল। নাইমার চোখ-মুখ শান্ত। নিজের কথায় সে বিচলিত নয়। দারোগা সাহেব বললেন, “এ কথা কিভাবে বলছ?”
নাইমা শান্ত গলায় বলল, “ঠিক বলেছি। মিলি আপু ভাইয়াকে পছন্দ করত। এতটাই পছন্দ করত যে আর কাউকে বিয়ে করতে চাইত না। সে কিভাবে বাদশা ভাইয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়াবে? এটা সম্ভব না।”
“তাহলে কোনটা সম্ভব? বাদশা আর মিলি দু-জনে মিলে কোন ষড়যন্ত্র করেছে? তাহলে মিলিকে কে খু’ন করল? আর কেনই বা খু’ন করল?”
“তা আমি জানি না। হয়তো রাফিয়া আপু ভুল বুঝে এ কাজ করেছে।”
দারোগা সাহেব বিরক্তি নিঃশ্বাস ফেললেন। হাবিব বলল, “বাদশা ভাইয়ের মোবাইল নম্বরটা দেখতে পারি? যে নম্বর দিয়ে মিলির সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“দেখাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু তা দেখে আপনি কি করবেন?”
হাবিব দারোগা সাহেবের কথার জবাব দিলো না। বাদশার গায়ে হাত দিয়ে বলল, “আপনি কি কাউকে সীমকার্ড কিনে দিয়েছিলেন? বা আপনার কোন সীমকার্ড চুরি হয়েছে?”
বাদশা ডানে বামে মাথা দুলিয়ে বলল, “ঠিক মনে পড়ছে না। এমন কিছু করিনি।”
“কয়েকদিনের মধ্যে কি কোন সীমকার্ড কিনেছিলেন? একটু মনে করার চেষ্টা করেন।”
বাদশা দু-হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরল। তার কিছু মনে পড়ছে না। দারোগা সাহেব মিলির কললিস্ট দেখাল। বাদশার এনআইডি কার্ড দিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করা নম্বরটা লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। হাবিব খুব মনযোগ সহকারে নম্বরটা দেখল এবং তক্ষুনি বিদ্যুুৎ চমকের মতো তার কিছু মনে পড়ল। সে ব্যস্ত গলায় বলল, “নিশ্চিত না হলেও বুঝতে পারছি এর পিছনে কে আছে। এই নম্বরটা আমি একজনের কাছে দেখেছিলাম।”
দারোগা সাহেব ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। বললেন, “কার কাছে দেখেছেন?”
“আমাদের কলিগ সজীব ভাইয়ের কাছে। হ্যাঁ ঠিক! সেদিন উনি হোটেলেই ছিলেন। হাতে নতুন সীমকার্ডের প্যাকেট দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করতে আমায় দেখিয়ে বলল–একটা সীমকার্ড নিয়েছি। ভালো অফার আছে। বিশ টাকা রিচার্জে পাঁচ জিবি ইন্টারনেট, একশ মিনিট। ক’দিন চলে যাবে। ওই সীমকার্ডের শেষ চারটে অঙ্ক আমার খুব ভালো করে মনে আছে।”
দারোগা সাহেব বললেন, “আপনি ঠিক কথা বলছেন? সম্পূর্ণ নিশ্চিত?”
“হ্যাঁ আমি নিশ্চিত। আমার খুব ভালো করে মনে আছে।”
“এই সজীবকে কোথায় পাওয়া যাবে?”
“অফিসে থাকার কথা। এক মিনিট! কল দিয়ে জিজ্ঞেস করছি।”
হাবিব সজীবের নম্বরে কল দিলো। রিং হলো তবে কল রিসিভ করল না। সে আবারও কল দিলো। তবুও ধরল না। দারোগা সাহেব বললেন, “নম্বরটা আমাকে দেন। লোকেশন দেখতে বলছি।”
সে নম্বর দেবার পরপরই সজীব কল ব্যাক করল। স্বাভাবিক গলায় বলল, “অফিসে আসলেন না? সব ঠিক আছে?”
হাবিব বলল, “হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। আপনি কোথায়? অফিসে?”
“না, অফিসে গিয়েছিলাম। ফিরে এসেছি। আপনাদের ভাবীকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছি। দু-চার দিন পরে ফিরব।”
“কোথায় যাবেন?”
সজীব জবাব না দিয়ে কল কেটে দিলো। দারোগা সাহেব বললেন, “সজীবের বাড়ির ঠিকানা বলুন। ফোর্স পাঠাচ্ছি। তাকে এখানে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”
বাদশা সজীবের বাড়ির ঠিকানা বলল। দারোগা সাহেব চারজন চারজন করে দু’টো ফোর্স পাঠালেন। একদল সজীবের বাড়িতে গেল, অন্যটা বাসস্ট্যান্ডের দিকে। প্রায় ঘন্টা খানেক পর সজীবকে সাথে নিয়ে ফিরল তারা। অল্প বয়সী ছেলেটা বলল, “বাড়িতে ছিল। প্রথমে আসতে চায়নি। পরে অবশ্য এসেছে।”
দারোগা সাহেব সজীবকে বসতে বললেন। সজীব চেয়ারে বসল। চারপাশ দেখে নিয়ে বলল, “আমাকে এখানে ডেকে এনেছেন? কি হয়েছে?”
দারোগা সাহেব বললেন, “মিলিকে চেনেন?”
সজীব বিস্মিত গলায় বলল, “মিলি কে? আমি এই নামের কাউকে চিনি না।”
“ওহ আচ্ছা! এই যে দেখুন এটা মিলির ছবি। এবার চিনতে পারছেন?”
“এই মেয়েটা! হ্যাঁ কোথায় যেন দেখেছি। ওহ মনে পড়েছে! হাবিব ভাইয়ের সাথে দেখেছিলাম। দু’জনে এক টেবিলে বসে ছিল। কেন এর কি হয়েছে?”
“মিলি খু’ন হয়েছে।”
সজীব আৎকে হাবিবের দিকে তাকালো। হাবিব বলল, “এমন ভাব করছেন যেন কিছুই জানেন না।”
সজীব বিস্মিত গলায় বলল, “সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না।”
“চমৎকার অভিনয় করতে পারেন। মিলির সাথে আপনার সম্পর্ক আছে। সেদিন হোটেলে আপনি আমাকে যে সীমকার্ড দেখিয়েছিলেন সেই নম্বর থেকে বহুবার মিলির সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। দারোগা সাহেবের কাছে সব প্রমাণ আছে।”
“হাবিব ভাই! আপনার সাথে আমার কিসের শত্রুতা জানা নেই। তবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে আমার কাঁধেই দোষ চাপালেন?”
দারোগা সাহেব বললেন, “তার মানে?”
সজীব পকেট থেকে মোবাইল বের করল। একটা নম্বর দেখিয়ে বলল, “স্যার, হাবিব ভাই সে সীমকার্ডের কথা বলছে সেটা এখনো আমার কাছেই আছে। এই যে তার নম্বর।”
দারোগা সাহেব নম্বর মিলিয়ে দেখলেন। দুটো নম্বরের শেষ চারটে অঙ্ক হুবহু এক। তিনি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। সজীব বলল, “হাবিব ভাই, কেমন এমন করলেন? আপনার সাথে ওই মিলি মেয়েটার ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল। আর আমাকে খু’নি বানিয়ে দিলেন?”
দারোগা সাহেব বললেন, “কি সমস্যা ছিল?”
“মিলি হাবিব ভাইয়ের বউকে মে’রে ফেলতে চেয়েছিল। উনার বউ অন্তঃসত্ত্বা। তাকে পুকুর ঘাটে আছাড় খাওয়ানোর জন্য সিঁড়িতে সাবান পানি ঢেলে রেখেছিল।”
“হাবিব সাহেব, এ কথা কি সত্যি? মিলি আপনার বউয়ের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিল?”
হাবিব বলল, “হ্যাঁ সত্যি।”
সজীব বলল, “হাবিব ভাই তার বউকে খুব ভালোবাসে। একদম চোখে হারায়। অফিসে এসে কতবার খোঁজ নেয় কি বলব!”
নাইমা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “আপনি এ কথা জানলেন কিভাবে? কে বলেছে?”
“হাবিব ভাই বলেছে।”
“মিথ্যে কথা। ভাইয়া কখনো এমন কথা বলতে পারে না। ভাইয়া কখনো পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে বাইরের মানুষের সাথে আলাপ করে না। সে যতই ঘনিষ্ঠ হোক না কেন।”
“এইতো আপনার ভাই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। অবশ্য সে এখন এ কথা স্বীকার করবে না।”
হাবিব শান্ত চোখে তাকাল। বরফ শীতল গলায় বলল, “সজীব ভাই, আমরা তিনজনে একই রকমের কানের দুল কিনেছিলাম মনে আছে? নিজেদের বউকে দেবার জন্য। আমি হলফ করে বলতে পারি সেই কানের দুল আপনি আপনার বউকে দেননি। মিলিকে দিয়েছেন।”
“মিথ্যে কথা। এমন কিছু নয়।”
“এমন কিছুই। আপনার বউকে এখানে এনে জিজ্ঞাস করলেই সে সত্যিটা বলে দেবে।”
“তাতে কি হলো? এতে কিছুই প্রমাণ হয় না।”
“অবশ্যই প্রমাণ হয়। আমার মন বলছে অফিসের ঝামেলার সাথেও আপনি জড়িত।”
দারোগা সাহেব বললেন, “অফিসের ঝামেলা মানে?”
বাদশা বলল, “আমাদের অফিসে গুরুতর একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। কিছু দরকারী কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। ওগুলো না পেলে কোম্পানি পথে এসে দাঁড়াবে।”
সজীব চিৎকার করে উঠল। শক্ত গলায় বলল, “তোমরা সবাই মিলে আমাকে অপবাদ দিয়েই যাচ্ছ। প্রথমে খু’ন আর এখন অফিসের ব্যাপার। আমি এসবের সাথে জড়িত নই।”
“তাহলে আপনার কপাল ঘামছে কেন? এখন তো গরম নেই। ঠান্ডা।”
সজীব তীক্ষ্ণ চোখে নাইমার দিকে তাকাল। মনে মনে বলল, “ইচ্ছে করছে ওকে শূন্য তুলে আছাড় মা’রি। অতিরিক্ত রকমের বেশি বোঝে মেয়েটা।”
দারোগা সাহেব অল্প হেসে সজীবের গালে হাত রাখলেন। বললেন, “কোনটা অপবাদ আর কোনটা সত্যি। তা আমরা তদন্ত করলেই বের করতে পারব। সিদ্ধান্ত আপনার। সত্যি বলবেন নাকি রি’মা’ন্ডে শরীরকে কষ্ট দেবেন। কারণ আমি আপনার বুকের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছি।”
সজীব পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। দারোগা সাহেব বললেন, “সজীব সাহেবের মোবাইলটা চেক করো। বাড়িতে তল্লাশি চালাও।”
“না এসব কিছু করতে হবে না। আমি বলছি। বলছি আমি।”
দারোগা সাহেব অবাক হবার ভান করে বললেন, “বাবাহ! এত তাড়াতাড়ি সব স্বীকার করে নেবেন। জলদি বলুন কি হয়েছে।”
সজীব জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। নরম গলায় বলল, “মিলির সাথে আমার প্রথম দেখা হোটেলে। সে হাবিবের সাথে বসে ছিল। ব্যাস ওই পর্যন্ত। আমার পরিকল্পনা ছিল অন্যকিছু। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র বিক্রি করে দেওয়া। সেই কারণে আমার অন্য একটা নম্বরের প্রয়োজন ছিল। বিক্রি করব এ কথা বলে পরিচিত এক ভাইয়ের থেকে কয়েকটা সীমকার্ড নিলাম। সেই সীমকার্ডের একটা বাদশা ভাইয়ের নামে তুললাম। উনার এনআইডি কার্ডের নম্বর আমি আগে থেকেই জানতাম। হোটেলে ঘুমের সুযোগ নিয়ে আঙ্গুলের ছাপ নিলাম।”
“এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু এখানে মিলি আসলো কিভাবে?”
“যে রেস্তোরাঁয় বসে কাগজপত্র আদান-প্রদান করছিলাম। দুভার্গ্যবশতঃ মিলি সেখানেই ছিল। আমার সব কাজকর্ম ভিডিও করে আমাকে ব্লাকমেল করতে শুরু করল।”
“কি চাইত মিলি?”
“টাকার ভাগ চেয়েছিল আর বলেছিল হাবিবকে তার করতে সাহায্য করতে হবে।”
“আপনি রাজি হয়ে গেলেন?”
“অন্য কোন উপায় ছিল না। ব্যাপারটা জানাজানি হলে আমার জে’ল-জরিমানা হতো। আমি মিলির কথায় রাজি হলাম। হোটেলে হাবিব যে রুমে থাকত, তাকে সেই রুমে ঢোকার সুযোগ করে দিলাম। দুই লাখ টাকাও দিয়েছি।”
“তারপর? মিলিকে হ’ত্যা করতে হলো কেন?”
“এতকিছুর পরেও ও আমাকে ব্লাকমেল করে যেতে লাগল। আরও টাকা চাইল। পরে আরও ষাট হাজার টাকা দিয়েছি। তবুও তার মন ভরেনি। আমি এসব আর নিতে পারছিলাম না। পরিকল্পনা করলাম ওকে সরিয়ে ফেলব। আমি জানতাম মিলি হাবিবের ওপর অনেক বেশি দূর্বল। তার হাবিবকে নিজের করে পাবার ইচ্ছে এতটাই তীব্র যে তা মানসিক রোগের পর্যায়ে চলে গেছে। হাবিবের জন্য ও যে কোন কিছু করতে পারে।”
রাফিয়া এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিল। সে এবার কথা বলে উঠল। বলল, “আপনি মিলিকে কিভাবে বি’ষ দিয়েছেন?”
“মিলিকে আমার সাথে দেখা করতে বললাম। বললাম, ‘আমার এক বন্ধু একজন তান্ত্রিকের সন্ধান জানে। যে কালো জাদুতে ভীষণ পারদর্শী। তার সাথে কথা বলে হাবিবের ব্যাপারটা সমাধান করা যেতে পারে। মিলি রাজি হলো। আমার এক বন্ধুকে তান্ত্রিক সাজিয়ে ওকে তার কাছে নিয়ে গেলাম। তান্ত্রিক কয়েকটা তাবিজ-কবচ আর বি’ষ দিলো। বলল– এটা মন্ত্রপুত গাছের গুড়ো। ঠিক সুবহে সাদিকের দুই ঘন্টা পর যদি কেউ কাউকে পাবার নিয়তে এটা খায় তবে তা সত্যি হয়। কিন্তু তার আগে এই তাবিজ পানিতে চুবিয়ে রাখতে হবে। আর হ্যাঁ যে কাগজে জড়িবুটি থাকবে সেই কাগজ মোমের আগুনে পু’ড়ি’য়ে ফেলতে হবে।
চন্দ্রাস্ত পর্ব ১২
আমি ভেবেছিলাম মিলি সব বুঝে ফেলবে। রাজি হবে না। কিন্তু সে রাজি হলো। বলল– এসব সত্যি হয়। মিলির ভাই নাকি তার শাশুড়িকে চিনি পড়া খাইয়েছিল। তারপর থেকে সেই মহিলা সবসময় তাদের পক্ষে থাকে। তাদের হয়ে কথা বলে।”
হাবিব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নাইমা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। দারোগা সাহেব বললেন, “আপনি এসব স্বীকার করে নিলেন কেন?”
সজীব তার দিকে তাকিয়ে হাসল। সেই হাসি দেখতে ভালো লাগল না।