চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২৬

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২৬
Writer Asfiya Islam Jannat

“তোমার এখন মেডিসিন আছে। সুপ যে-টা খেতে দিয়ে গিয়েছিলাম খেয়েছিলে?”
গুরুগম্ভীর এক পুরুষালি কন্ঠ শুনে নিধি আর কেয়া দ্রুত পিছন ঘুরে তাকায়। মুহূর্তে নির্বাণকে দেখামাত্র ভূত দেখার মত চমকে উঠে দুইজনেই। নিজের বিস্ময় ভাব ধরে রাখতে না পেরে আচমকাই নিধি বলে, “স্যার আপনি এইখানে কি করছেন?”
নির্বাণ দৃষ্টি তুলে তাকায়। সামনে নিধি আর কেয়ার বিমূঢ় মুখশ্রী দেখে ভ্রু সংকুচিত হয়ে এলো তার। গভীর দৃষ্টিতে তাকালো নিধির পানে। ক্ষণেই নিধি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, আমতা আমতা সুরে বলল, “না মানে, আপনি হসপিটালে যে? কাউকে কি দেখতে এসেছেন?”

নির্বাণ একপলক তাকালো স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী এতক্ষণ নির্বাণের দিকেই তাকিয়ে ছিল, নির্বাণ তাকানো মাত্রই সে দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়৷ স্পর্শী জানে, নির্বাণ নিধি ও কেয়ার সামনে তাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিবে না। বিয়ের প্রথম রাতেই বলে নির্বাণ দিয়েছিল, সে তার প্রফেশনাল আর পার্সোনাল লাইফ আলাদা আলাদা রাখতে চায়। এখন সে যদি তাকে স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দেয় তাহলে হয়তো বিষয়টা কিছুটা হলেও ঘেটে যাবে। স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, আনমনে তাকায় নিজের পায়ের বৃদ্ধা আঙুলটির দিকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নির্বাণের দৃষ্টি সরালো, নিধির প্রশ্নের প্রেক্ষিতে উত্তর দিল, “হ্যাঁ! তোমরা এইখানে কেন?”
নিধি বলে, “স্পর্শী অসুস্থ, ওকেই দেখতে এসেছিলাম। আপনি চিনেন, আমাদের ডিপার্টমেন্টেই পড়ে, ইফাত আরা স্পর্শী।”
কথাটা বলে নিধি হাত দিয়ে স্পর্শীর দিকে ইশারা করে। তা দেখে স্পর্শী হকচকিয়ে উঠে, গোলগোল দৃষ্টিতে তাকায় নিধির দিকে। নির্বাণ মৌনব্রত থেকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায় স্পর্শীর পানে৷
কেয়া মনে কিঞ্চিৎ সাহস জুগিয়ে জিজ্ঞেস করে, “স্যার আপনি কাকে দেখতে এসেছেন এইখানে? কে এডমিট?”
নির্বাণ স্পর্শীর দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল, “আমার বউ!”

নিধি সে সময় স্পর্শীর কথায় বিশ্বাস করে নি যে নির্বাণ বিবাহিত, সে ভেবেছিল স্পর্শী এইভাবেই ফাজলামো করছে৷ যার দরুন নির্বাণের মুখ থেকে নিজের বউয়ের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলো না। অকস্মাৎ সে মুখ ফসকে বলে উঠে, “তার মানে আপনি সত্যি বিবাহিত?”
নির্বাণ স্পর্শীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিধির দিকে স্থাপন করে। ভ্রু দু’টি পুনরায় সংকুচিত করে রুক্ষ কন্ঠে বলে, “মিথ্যে বিবাহিত আবার কিভাবে হয়?”

নিধি এইবার থতমত খেয়ে যায়। কিছু বলার পূর্বেই কেয়া পাশ থেকে নিধির পেটে হালকা গুঁতো দিয়ে চাপা কন্ঠে বলল, “কার সামনে কি বলছিস তুই? একটু বুঝে শুনে তো কথা বলবি।”
নিধি অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় কেয়ার দিকে। কেয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে, “ওর কথা ধরবেন না স্যার। কখন কি বলে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। বাদ দিন! তা ম্যাম এর কি হয়েছে? এখন কেমন আছেন তিনি?”
‘ম্যাম’ সম্মোধন শুনে স্পর্শীর বিষম খাওয়া উপক্রম।
নিবার্ণ গম্ভীরমুখে বলে, “অপারেশন হয়েছিল কাল, ভালো আছে এখন।”

কেয়া বলে, “আলহামদুলিল্লাহ! তবে স্যার, আপনি বোধহয় ভুল কেবিনে চলে এসেছেন। এইটা স্পর্শীর কেবিন, ম্যাম হয়তো অন্য কেবিনে আছেন।”
নির্বাণ চোখ ঘুড়িয়ে তাকালো স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী ঠোঁট চিপে হাসছে৷ নির্বাণ শাণিত দৃষ্টিতে তাকাতেই স্পর্শী ঠোঁট দু’টো আরও চেপে ধরে, হাসি থামানোর অসাধ্য চেষ্টা। সেই সাথে অপেক্ষা, নির্বাণের উত্তর শোনার। কি বানোয়াট কাহিনী শুনাবে নির্বাণ এখন কে জানে?
নির্বাণ একবার কেয়ার দিকে তাকায়। শান্ত কন্ঠে বলে, “নাহ! আমি ভুল কেবিনে আসিনি। তোমাদের ম্যাম এই কেবিনেই আছে।”

নিধি আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বলে উঠে, “মানে? এই কেবিনে কোথায়?”
“এই কেবিনের রোগীই আমার বউ। সাথে তোমাদের ম্যাম।”
কথাটা শোনামাত্র কেয়া আর নিধি গোলগোল চোখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। বিষয়টা হজম করতে তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এইদিকে, ঘটনাক্রমে স্পর্শী নিজেও স্তম্ভিত। সে ভাবেনি নির্বাণ তাকে এইভাবে পরিচয় করিয়ে দিবে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নির্বাণের মুখ পানে। নিধির একবার স্পর্শীর দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার নির্বাণের দিকে। অকস্মাৎ নিধি স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “ঘটনা কি সত্য?”

স্পর্শী থতমত খেয়ে বলে, “কিসের ঘটনা, কিসের সত্য?”
“তুমি কি সত্যি স্যারের বউ?”
স্পর্শী এইবার নির্বাণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বলেন, আমি কি আপনার বউ?”
কথাটা বলে স্পর্শী দ্রুত গতিতে বাম হাত নাড়াতে নিলে খুব জোরে ক্যানোলাতে টান পড়ে, সাথে সাথে সে ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠে। আর্তনাদ শোনামাত্র নির্বাণ দ্রুত স্পর্শীর দিকে এগিয়ে আসে, হাতের ব্যাগগুলো বেডের পাশে মেঝেতে রেখে স্পর্শী ডান হাতটা সন্তপর্ণে নিজের হাতে নিয়ে শাণিত কন্ঠে বলে, “সাবধানে হাত নাড়াচাড়া করতে পারো না? এত কিসের তাড়া তোমার? পেলে তো ব্যথা এখন। সকালেও একই কান্ড করেছ।”

স্পর্শী মুখ ছোট করে বলে, “ঠিক আছি আমি।”
নির্বাণ প্রত্যুত্তর করলো না। খুব সতর্কতার সাথে স্পর্শীর হাত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো। সকালে টান খেয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়েছিল স্পর্শী, এখন আবার এমন হলে রগ ফুলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এইদিকে নিধি আর কেয়া দৃশ্যটা কোন রকম হজম করে যাচ্ছে, নিজের চোখকে যেন বিশ্বাসই করতে পাচ্ছে না তারা। সবকিছুই তাদের নিকট কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কেয়া চাপা কন্ঠে নিধিকে বলে উঠে, “তার মানে, স্পর্শী বিয়ে তখন নির্বাণ স্যারের সাথেই হয়েছিল? এই জন্যই স্পর্শী বলেছিল, আমরা তার বরকে চিনি।”

নিধি বলে, ” কিন্তু কেমনে কি? স্পর্শী কিভাবে নির্বাণ স্যারের বউ হয়? যেখানে স্পর্শী স্যারকে দুই চোক্ষে দেখতে পারে না, সেখানে তারা বিয়ে করে সংসার করতাছে? কেমনে সম্ভব ভাই?”
“সেটা বাদ দে, আগে ভাব স্যারের সাথে আমাদের সম্পর্কটা কি? আমরা তার স্টুডেন্ট নাকি শালিকা? আর তাকে এখন কি ডাকবো আমরা? দুলাভাই নাকি ভাইয়া নাকি স্যার? স্যারকে স্যার ডাকলে স্পর্শীকে আবার ম্যাম ডাকতে হবে। আবার স্পর্শীকে ওর নাম ধরে ডাকলে স্যারকে দুলাভাই বা ভাইয়া ডাকতে হবে৷ কিন্তু কথা হচ্ছে, স্যারকে ভাইয়া কিভাবে ডাকি? আবার স্পর্শীকে ম্যাম কিভাবে ডাকি?”

“বইন তুই থাম। মাথা ঘুরাইতাসে আমার, জ্ঞান হারাবো আমি। ধর আমায়!”
কেয়া নিধির কথার তোয়াক্কা না করে নির্বাণ ও স্পর্শীর দিকে তাকায়। নির্বাণ স্পর্শীর হাত ভালো মত দেখে সরে আসে। মন্থর কন্ঠে বলে, “আমি নার্সকে ডেকে নিয়ে আসছি, সে একবার চেক করলে বুঝা যাবে সব ঠিক আছে কি-না। তুমি বেশি হাত নাড়াচাড়া করবে না।”
স্পর্শী আপত্তিকর কন্ঠে বলে,”নার্সকে ডাকতে হবে না, আমি ঠিক আছি।”
“ঠিক আছো বলেই তো আজ এই অবস্থা। তাই না?”

নিবার্ণের খোঁচা শুনে স্পর্শী ঘুচে বসে রইল। প্রত্যুত্তর করলো না। নির্বাণ স্পর্শীর দিকে একপলক তাকিয়ে অতঃপর কেয়া এবং নিধির দিকে তাকালো, “তোমরা থাকো, আমি আসছি একটু পরে।”
কথাটা বলে নির্বাণ লম্বা লম্বা পা ফেলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। নির্বাণ বেরিয়ে যেতেই নিধি আর কেয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্পর্শীর উপর। নিধি অস্ফুট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি কি নির্বাণ স্যার তোর জামাই?”
স্পর্শী নির্বিকার কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ, আমারই জামাই।”

কেয়া বলে, “এত বড় কথা আমাদের একবার জানাইলিও না তুই? এমন মীরজাফরগিরি করলি?”
নিধি হতাশাজনক স্বরে বলে, “বইন আমাকে একটু বুঝাবি তুই হিটলারে বউ কিভাবে হলি? হাও?”
স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। ধীরে সুস্থে একদম শুরু থেকে সবই বলে গেল তাদের। সবটা শুনে কেয়া বলে উঠে, “তোর কাহিনীর সামনে বাংলা সিনেমাও ফেইল। এমন কাকতালীয় ঘটনা আদৌ জীবনে ঘটে?”
স্পর্শী নির্বিকার কন্ঠে বলে, “কে জানে?”
নিধি বলে, “আচ্ছা শুন না, আমার না একটা প্রশ্ন আছে।”

স্পর্শী ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে, “কি?”
“স্যার আর তোর বাচ্চা আমাকে কি ডাকবে?”
কেয়ে হাসতে হাসতে বলে, “গুড কুয়েশ্চন!”
স্পর্শী রাগান্বিত নয়নে নিধির দিকে তাকিয়ে বলে, “আগে বাচ্চা হোক তারপর ভাবিস তোকে সে কি ডাকবে। বাচ্চার হওয়ার খবর নাই সে আসছে তাকে আমার বাচ্চা কি বলে ডাকবে জানতে।”
নিধি কিছু বলতে যাবে তার আগে নির্বাণ একজন নার্স নিয়ে ফিরে আসে৷ যার দরুন, নিধি ভদ্র বাচ্চার মত চুপ হয়ে যায়।

“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তুই নির্বাণ স্যারের বউ।”
দীর্ঘ আলাপের শেষ পর্যায়ে এসে আকস্মিক নিধি কথাটা বলে উঠলো। নিধির কথা শুনে কেয়াও সেই কথায় সাঁই জানিয়ে বলে, “সেম আমারও। সব স্বপ্ন লাগছে।”
নিধি ও কেয়ার কথা শুনে স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়, “তো এতে আমি কি করব?”
নিধি জিহ্বার ডগা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে, “এমন কিছু করে দেখা যাতে আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হই তুই স্যারের বউ। মানে তোকে আর স্যারকে পাশাপাশি দেখে যেন স্বামী-স্ত্রী ভাইবটা আসে।”

স্পর্শী ক্রুদ্ধ নয়নে নিধির দিকে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “চুমু খাই তাকে সবার সামনে? তখন নিশ্চয়ই পিউর স্বামী-স্ত্রী ভাইবটা পাবি। কি বল! ডাকব নাকি তোদের নির্বাণ স্যারকে?”
মুহূর্তেই নিধি মুখ বিকৃতি করে বলে, “আস্তাগফিরুল্লাহ দোস্ত! কিসব নাউজুবিল্লাহ মার্কা কথা বলোস তুই? বেডরুমের কার্যকলাপ পাবলিকে ফাঁস করতে চাস। ছিহ! তোকে আমার ফ্রেন্ড বলতেও লজ্জা করছে।”
স্পর্শীর লেগ পুল করার উদ্দেশ্যে কেয়াও নিধির সঙ্গ দিয়ে বলল, “আজ তুই বিবাহিত বলে আমাদের মত সিঙ্গেলদের এইভাবে হেনেস্তা করছিস? ভুলে যাস না একদা তুইও সিঙ্গেলই ছিলি।”

নিধি সুক্ষ্ম কন্ঠে বলে, “বিয়ে হতে না হতেই তোর মধ্যে বিবাহিত মহিলাদের ভাবসাব এসে পড়েছে ভাই। তোর সাথে এখন আর মিশা যাবে না, নাহলে দেখা যাবে তোর সঙ্গ দোষে আমরা নষ্ট হয়ে গিয়েছি।”
কেয়া নিধির কথায় তাল মিলিয়ে বলেই, “একদম খাঁটি কথা বলেছিস। স্পর্শীর সাথে আসলেই মিশা যাবে না এখন।”
স্পর্শী রোষানল দৃষ্টিতে তাকায়। তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, “মিশবি না, তাই না? যা এখনই বের হো এইখান থেকে। যাহ!”
নিধি বিদ্রুপের সুরে বলে, “না গেলে কি করবি? আমাদের বায়োলজির মূল বিষয়বস্তু প্রেকটিক্যালি দেখাবি?”
কথাটা বলে শেষ করতে না করতে নিধি আর কেয়া উচ্চস্বরে হেসে উঠে। ওদের হাসি দেখে স্পর্শীর নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করলো।এমন হারামি বন্ধুদের সামনে টু আওয়াজ করাই যেখানে দায় সমান সেখানে সে তো তাদের এলাহি কান্ড করার সুযোগ দিয়ে দিয়েছে৷ এরা কি এখন আর মৌন থাকবে? স্পর্শী নিজের রাগ সংযত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “নিধির বাচ্চা তোকে তো আমি…”

স্পর্শী নিজের শেষ করার পূর্বেই দরজার দিকে তার নজর গেল। সেখানে নির্বাণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে আপনা-আপনি নীরব হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য মাথায় চিন্তা এলো, “নির্বাণ কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে, সে সব শুনে ফেললো না তো?” পরমুহূর্তে ভাবলো, “নাহ! সে হয়তো মাত্রই এসেছে।” কথাটা ভেবেই ক্ষান্ত হলো সে।
স্পর্শীকে চুপ হতে দেখে কেয়া আর নিধির পিছন ঘুরে তাকালো। নির্বাণকে দেখামাত্র তারাও দ্রুত ভদ্রভাবে বসে, ঠোঁটের কোণে সরু হাসি ফুটালো। নির্বাণ একমুহূর্ত অপেক্ষা করে ধীর পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসলো, নিঃশব্দে স্পর্শী কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা ফ্রুটসের প্লেটটা এগিয়ে দিল, “এইগুলো খেয়ে নাও। মেডিসিন খেয়েছ অনেক সময় হয়ে গিয়েছে।”
কথাটা বলে বিচক্ষণ দৃষ্টির সহিতে স্পর্শীর মাথার উপর ঝুলতে থাকা স্যালাইনটা পর্যবেক্ষণ করে নিল। আর কতটুকু বাকি। এমন সময় চারদিকে মিষ্টি এক কলধ্বনি গুঞ্জিত হলো। আছরের আযান দিচ্ছে। মুহূর্তেই কেয়া কিছুটা আশঙ্কা নিয়ে ঘড়ি দেখলো। তারা এইখানে এসেছে প্রায় তিন ঘন্টা হতে চললো। তৎক্ষনাৎ কেয়া চাপা স্বরে বলে উঠলো, “আয় হায়! এত দেরি হয়ে গিয়েছে, খেয়ালই তো করিনি।”

কেয়ার চাপা আর্তনাদ শুনে নিধিও একবার ঘড়ির দিকে চোখ বুলালো। আসলেই দেরি হয়ে গিয়েছে দেখে সেও তাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ইফতারের আগে বাসায় ঢুকতে হবে তাদের। এমনেই এখন বের হলেও জ্যামে পড়তে হবে নির্ঘাত। সব বিবেচনা করে নিধি ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো, “স্পর্শী, আজ যাই৷ পরে বাসায় এসে দেখা করে যাব নে একদিন।”
স্পর্শী মাথা দুলিয়ে বলল, “আচ্ছা, সাবধানে যাস।”
নিধি স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে ছোট করে “হুম” বলল, অতঃপর নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ তাহলে আসি স্যার ভাইয়া।”
অদ্ভুত এক নামে নিজের সম্মোধন শুনে নির্বাণ কপালে তিনটি সুক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়লো। সে গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলো, “স্যার ভাইয়া মানে?”

নির্বাণের গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠ শুনে নিধি কিছুটা চুপসে গেল। সে কেন ভুলে গেল এইটা তাদের হিটলার স্যার। তার ফাজলামো করার দুঃসাহসিকতা দেখানো মানেই বাঘের মুখে হাত দেওয়া। নিধি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বকা খাওয়ার ভয়ে মাথা নুইয়ে বলে, “না মানে, আপনি তো এখন আমাদের দুলাভাই প্লাস স্যারও। আপনাকে ঠিক কি বলে ডাকব বুঝতে না পেরে ভাবলাম, স্যার ভাইয়া ডাকি। সরি স্যার! আর এমন হবে না।”
নিধির সহজ-সরল স্বীকার নির্বাণের অভিব্যক্তি নম্র হলো, “ভার্সিটি এরিয়াতে আমি সবার জন্যই স্যার। এর বাইরে তোমরা ভাইয়া বলে সম্মোধন করতে পারো, সমস্যা নেই।”

কথাটা নিধির কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হওয়া মাত্র সে মাথা তুলে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে নির্বাণের পানে তাকালো৷ কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে ঢুকার পর থেকেই সে এবং সবাই সর্বদা নির্বাণকে গম্ভীর অথবা কর্কশ কন্ঠেই কথা বলতে দেখেছে, তাকে নম কন্ঠে কথা বলতে দেখেছে এমন সংখ্যক মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা যাবে। যার দরুন, নির্বাণের কোমল কন্ঠে বলা কথাটি হজম করতে নিধির বেশ বেগ পেতে হলো। বিষয়টা এমন ঠেকলো, এ যেন বাঘের মুখে মধুচ্ছন্দা। কেয়ার অবস্থাও বিপরীতমুখী নয়। নিধি কোনরকম নিজের ডানে-বামে হ্যাঁ সূচক মাথা দুলালো।

অতঃপর কেয়া,নিধি সৌজন্যতার খাতিরে নির্বাণকে নিজের বাসায় দাওয়াত দিয়ে বেরিয়ে গেল নিজ গন্তব্যের উদ্দেশে৷
নিধি, কেয়া চলে যেতেই নির্বাণ স্পর্শীর কাছে টুল টেনে বসলো। নিজ হাতেই স্পর্শীকে ফল খায়িয়ে দিয়ে, পানি খায়িয়ে দিল। অকস্মাৎ স্পর্শী বলে উঠে, “এই গরমের মধ্যে মাস্ক পড়ে থাকতে সমস্যা হয় না আপনার?”
নির্বাণ মাস্কের আড়ালে কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “না! অভ্যাস আছে।”
স্পর্শী নিচু স্বরে বলল, “আপনি বাসায় চলে যান, আজ থাকার প্রয়োজন নেই।”

“কেন?”
“হসপিটালে থাকতে আপনার অসুবিধা হচ্ছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বাসায় যান, বিশ্রাম নিন। গতকাল থেকে হসপিটালেই পড়ে আছেন। এমনেও আজকের রাতটাই ব্যাপার, কালকে তো বোধহয় ডিসচার্জ হয়েই যাব আমি। মা থাকবে নে আমার সাথে।”
নির্বাণ নিজের পকেট থেকে নিজের রুমালটা বের করে সপ্তপর্ণে স্পর্শীর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা পানির বিন্দুগুলো মুছে দিল। ধীর কন্ঠে বলল, “তোমাকে বেশি বুঝতে বলেনি কেউ। আমি ঠিক আছি, বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন নেই আমার।”
স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, কথা বাড়ালো না। নির্বাণ স্মিথ হেসে হঠাৎ স্পর্শীর খুব নিকটে এসে কানের কাছে মুখ স্থির করে বলে, “এমনেও, তোমার মনের নিষিদ্ধ ইচ্ছাটা পূরণ করতে হলে তো আমার থাকা লাগবেই।”

নির্বাণের ঠান্ডা,শীতল কন্ঠের ফিসফিসানিতে স্পর্শী কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে। অস্ফুটস্বরে বলে, “মানে? কিসের ইচ্ছে? কিসের কি?”
“মানে এইটাই রোজা আছি বলে বেঁচে গিয়েছ, অন্যথায় বায়োলজির প্রেকটিক্যাল ক্লাসটা এখনই নিয়ে নিতাম।”
নির্বাণের কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে স্পর্শীর কান গরম হয়ে আসে, মেদুর গালে ছড়ায় এক মুঠো রক্তিমা। তার মানে অসভ্য লোকটা তখন তাদের সব কথাই শুনেছে। কি লজ্জার বিষয়! স্পর্শী এক হাত দিয়ে আলতো করে নির্বাণের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলে, “কথার কি শ্রী! ছিহ!”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২৫

নির্বাণ স্পর্শীর নিকট থেকে সরে এসে ভ্রু কুঁচকে বলে, “তুমি বললে ঠিক আর আমি বললেই ছিহ?”
স্পর্শী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বলল, “ঘুম পাচ্ছে আমার, ঘুমাবো আমি। আপনি নামাযে যান, ওয়াক্ত পেড়িয়ে যাচ্ছে।”
কথাটা বলেই স্পর্শী ধীর গতিতে বিছানায় শুয়ে পড়লো, নির্বাণ দ্বিরুক্তি করলো না। সে জানে মেয়েটা লজ্জায় সংকীর্ণ হয়ে আছে। তাকে এখন কিছু বলা মানেই রক্তজবার আবরণে গভীরভাবে আবৃত করা।

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২৭