ডার্কসাইড পর্ব ২১

ডার্কসাইড পর্ব ২১
জাবিন ফোরকান

অমানিশায় আচ্ছন্ন আবদ্ধ পাতালঘরের বায়ু কেমন গুমোট হয়ে আছে।বহুদূর থেকে জল গড়ানোর মৃদু শব্দ ভেসে আসছে।
টপ। টপ।
চুঁইয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু।আদতেই জল?নাকি র*ক্ত?বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরী চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা থাকা মানুষটি ঠিক ঠাওর করতে পারলোনা।মৃদু গোঙানি নির্গত হচ্ছে তার কন্ঠনালী বেয়ে।দৃষ্টিতে ঝাপসা দেখছে।যেন সমস্ত শরীর অজানা এক অশুভ আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।বিপরীত পাশের চেয়ারে হেলান দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে নিহাদ।অসহনীয় এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে মানুষটিকে।তার বাম হাতে ঝুলছে একটি বই,যার মলাটজুড়ে মুদ্রিত রয়েছে “মিডল এজ”।

– মাথা গরম করিস না। আগামীকাল পরীক্ষা, এমনিতেও ব্রেইন সার্কিট ৪২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উত্তেজিত হয়ে আছে। ভালোয় ভালোয় মুখ খোল নাহলে….
কচাৎ!
টেবিলের উপর রাখা মানুষটার হাতের আঙুলের ফাঁকে কাঠের মাঝে গেঁ*থে গেলো ধা*রালো ছু*রি।কেঁপে উঠল ভুক্তভোগী।নিজের হাত সরিয়ে নিতে চাইলো প্রতিক্রিয়াস্বরুপ।কিন্তু উভয় হাত টেবিলের উপর যুক্ত হাতকড়ার মতন যন্ত্রাংশে আটকানো।চাইলেও সরানোর উপায় নেই।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিহাদ আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডদের ইশারা করলো।তিনজন এগিয়ে এলো।মানুষটিকে ঘিরে ধরলো চারিদিক থেকে।একজনের হাতে রয়েছে জ্বলন্ত কয়লাভর্তি পাত্র। তাতে একটি ধাতব দণ্ড চুবানো হলো।অপরজন মানুষটির মুখ চেপে ধরলো যেন সামান্যতম চিৎকার কিংবা নড়চড় সম্ভব না হয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– উম… মম!
নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বইয়ে মুখ গুজলো নিহাদ, পরোয়া করলোনা কোনকিছুর।এ যেন তার কানে শান্তিসুধা।গোঙানি প্রতিধ্বনিত হতে আরম্ভ করলো সমস্ত দেয়ালজুড়ে।ঝটকা দিতে থাকলো অবাধ্য শরীর।নরকের শাস্তি যেন পৃথিবীতেই অনুভূত হচ্ছে।লোকে তাহলে ঠিকই বলে…..
নরকের অপর নাম কে বি গ্রুপ।
– হুম, জ্ব*লন্ত মাং*সের ঘ্রাণ পাচ্ছি, দারুণ!
কণ্ঠস্বরটি কর্ণগোচর হতেই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বই থেকে মুখ তুলে চাইলো নিহাদ।পাতাল ঘরটিতে প্রবেশ করতে লক্ষ্য করলো বাদশাহ কায়সারের অতি আদরের সন্তান নাবিল কায়সারকে।শুধুমাত্র নাবিল থাকলে সে কোনোপ্রকার পরোয়া করতোনা অবশ্যই, কিন্তু তার পিছনে ধীরপায়ে এগিয়ে আসা অবয়বটি সহসাই সম্মানে তাকে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করলো।

– আসমান ভাই…
এক ঝলক নিষ্পাপ হাসি উপহার দিলো নিহাদ।হাতের বইটা বুকে জড়িয়ে রাখলো,যেন আসমান দেখতে পায় যে সে আর যাই করুক না কেনো পড়ালেখা ঠিকই জারি রেখেছে।নিজেকে ছাড়িয়ে পিছনের আসমানকে সম্বোধন করায় নাবিল কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও চেহারায় প্রদর্শিত হতে দিলোনা।হনহন করে এগোলো চেয়ারে বাঁধা মানুষটির দিকে।

– মুখ খুলেছে?
– এখনো না।
পো*ড়া চাম*ড়ার উপর থেকে উত্তপ্ত লোহার দণ্ড সরিয়ে জবাব দিলো গার্ড।তাতে তেঁতে উঠলো নাবিল। দণ্ডটি এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে মানুষটির পেট বরাবর আ*ঘাত করে বসলো।তবে মুহূর্তেই তার নিজের হাত থেকেই সেটি মেঝেতে পরে ধাতব ঝনঝন শব্দ তুললো।মুখ বিকৃত হয়ে এলো, হাত ঝাড়া দিতে থাকলো।

– ওমা কি গরম!
– ভ্যাক… ছেঁকা লেগেছে নাবিল ভাই?
বহু কষ্টে হাসি দমন করে মুখ টিপে প্রশ্ন ছুড়লো নিহাদ।তাতে কটমট করে তার দিকে চেয়ে নিজের সেক লাগা আঙুল চুষতে আরম্ভ করলো নাবিল।অপরদিকে এগোলো আসমান, মেঝে থেকে দণ্ডটি তুলে নিলো গ্লাভস পরিহিত হাতে রেখে দিলো কয়লায়।সে আসতেই বাকি সকলে জায়গা ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো।সবার মাঝেই এক প্রকার সম্মানিত দৃষ্টি।যেন ময়দানে পদার্পণ করেছেন স্বয়ং মহারাজ।

কোনোপ্রকার কথা উচ্চারণ না করে আসমান নিজের পকেটে হাত ভরলো।বেরিয়ে এলো একটি কটকটে লাল বর্ণের ইলেকট্রিক তারের লম্বা টুকরো।সেটি দুই হাতে পাকাতে পাকাতে টেবিল ঘুরে এগোলো মানুষটির দিকে।আধখোলা দৃষ্টিতে হাঁপাতে হাঁপাতে তার উদ্দেশ্যে চেয়ে আছে রীতিমত মুষড়ে পড়া ব্যক্তিটি।কিছুক্ষণ আগেই নিহাদের মুখে “আসমান” নামটি উচ্চারিত হতেই তার সর্বাঙ্গে শিহরণ খেলে গিয়েছিল। অদেখা অজানা এই অস্তিত্ব তাদের পেশায় নিয়োজিত সকল ব্যক্তির জন্য একপ্রকার কিংবদন্তির নাম।যার রূপকথা প্রচলিত জনে জনে,কল্পনার আদর্শ হিসাবে সে বিচরণ করে প্রত্যেকের অন্তরে তবুও তার দর্শনলাভ অসম্ভব।
চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে থামলো আসমান।উপস্থিত সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে অবলোকন করে চলেছে তার প্রতিটি পদক্ষেপ। মুক্তোর হারের মতন চিকন তারটি ব্যক্তির কন্ঠে ঝোলালো আসমান,হালকা ঝুঁকে বিড়বিড় করলো,

– মানুষ কখন বাঁচতে চায়?
তার কণ্ঠস্বরের তীব্রতায় না চাইতেও সকলে শিউরে উঠলো।যেন অদ্ভুত এক অশরীরী প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।অন্ধকার দ্বিগুণ গাঢ়ত্ব ধারণ করেছে।প্রশ্নটির উত্তর কারো জানা নেই,থাকলেও এমন গভীর মুহূর্তে কেউ কিছু উচ্চারণ করবার দুঃসাহস করতোনা। একদম স্থির হয়ে থাকা ভুক্তভোগীর দৃষ্টিতে এক নজর দৃষ্টি মেলালো আসমান।উত্তর করলো,
– ঠিক মৃ*ত্যুর পূর্বমুহূর্তে।
তৎক্ষণাৎ আসমানের উভয় হাত তারের উভয় প্রান্তে জড়িয়ে একটি হ্যাঁচকা টান দিলো।তাতে চিকন তারটি ক্ষীপ্র গতিতে চেপে বসলো কন্ঠজুড়ে, ভে*দ করে গেলো সামান্য চামড়ার অংশ!চুঁইয়ে নামলো র*ক্ত।

– আক… আহ্হঃ!!
হাহাকার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো সম্পূর্ণ কক্ষ। মরমবেদনা এতটাই সুতীব্র যে কানে হাত পেতে নিজের অন্তরাত্মাকে রক্ষা করতে হলো।একজন গার্ড এগোলো দ্রুতই,উদ্দেশ্য কাপড় গুঁজে মুখ বন্ধ করে দেয়ার।কিন্তু আসমানের নিগূঢ় দৃষ্টিপাতে থমকালো মাঝপথেই।
– নো।অন্তরের ভিত্তি ভেঙে চুরমার করতে আপন আর্তনাদের তুলনায় সক্রিয় আর কোনো ওষুধ নেই। শুনুক নিজের চিৎকার,অনুভব করুক যন্ত্রণার আধিক্য।
– আআহ…!
কণ্ঠস্বরের আর্তনাদ বেদনাদায়ক উপাখ্যানে পরিপূর্ণ।গা শিরশির করে উঠলো স্বয়ং নিহাদেরও।অথচ নির্বিকার হিমালয়।তার নিকট অনুভূতি প্রত্যাশা করা কদর্য।তারের টানে কোটরের ভেতরের চোখ যেন ঠি*করে বেরিয়ে আসতে চাইছে,জিভ বেরিয়ে পড়েছে ইঞ্চি চারেক।গোলাকার দাগ হয়ে গড়িয়ে নামছে ধীর র*ক্তধারা।সামান্য একটু ঢিল দিলো আসমান,জানে এখনি হড়বড় করে বলতে আরম্ভ করবে কথা।

– ব..বলছি…! সও… ব… বল…. ছি!
কাজ হয়েছে। সরে দাঁড়ালো আসমান। র*ক্তমাখা তার ছুঁড়ে ফেললো, যা পড়লো বরাবর নাবিলের পায়ের নিকট।অজান্তেই এক পা দূরে সটকে পড়লো বাদশাহর আদরের পুত্র।ফ্যালফ্যাল করে তাকালো আসমানের দিকে,পরক্ষণে আবার ক্রমাগত ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ফেলতে থাকা ব্যক্তির দিকে।ঘেমে নেয়ে একসার সে।মৃ*ত্যুর খুব কাছ থেকে তাকে ঘুরিয়ে আনা হয়েছে মাত্রই।নাবিলের অধরে তীর্যক হাসি ফুটলো যন্ত্রণাদায়ক অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে।যে কাজ বাকি সকলে মিলে দুই দিনেই করতে পারেনি সে কাজটা করতে আসমান কত সময় নিলো?১ মিনিট বা তার চেয়েও কম।

– ইউ আর আ গ্রেট মনস্টার…
নাবিলের প্রশংসা কিংবা ভৎসর্নায় কর্ণপাত ঘটলোনা আসমানের।সে ব্যাস্ত নিজের গ্লাভস ঠিক করতে। হেঁটে চলে এলো,বাকি কাজ অন্যরা সামলে নেবে।নিহাদের উপর দৃষ্টি পড়তেই কিছু উচ্চারণ করতে যাচ্ছিল আসমান,কিন্তু তার আগেই পকেটে থাকা ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো।কলার আইডিতে নাম্বার প্রত্যক্ষ করে ভ্রু কুঁচকালো তার। কন্ট্যাক্ট লিস্টে সেভ করার প্রয়োজনবোধ করেনি,তবুও এতবার তাকে কল করা হয়েছে যে নাম্বার রীতিমত মুখস্থ হয়ে গিয়েছে।রিসিভ করে ফোন কানে চাপলো সে,নিজে থেকে কিছুই উচ্চারণ করলোনা।ওপাশ থেকে ভেসে এলো চাপা মেয়েলী কন্ঠস্বর,খানিকটা জড়ানো,যেন নেশার ঘোরে রয়েছে।

– পাতালে আছি, নিয়ে যাও…. প্লিইজ!
নিশ্চুপ আসমান।কণ্ঠের পাশাপাশি মিউজিকের ধুমধুম বিট ভেসে আসছে।নিশ্চয়ই “ পাতাল ” নামক ক্লাবটিতে গিয়েছে।
– অ্যাই?শুনতে পাচ্ছো না?জলদি আসো।
– না।
– কেনো?
– মিটিং আছে।
– রাখো তোমার মিটিং! এক্ষুণি এসো, রাফা কায়সারকে এই রাত্রিতে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেয়া অধিক জরুরী।
– আমি বডিগার্ড নই।
সাপের মতন হিসিয়ে ওঠার শব্দ শোনা গেলো।তারপরই জড়ানো কন্ঠটি জানালো,
– ঠিক আছে! লেটস্ সি টু হুম ইউ বিলং!

ফোনের লাইন কেটে গেলো।একটি নিঃশ্বাস ফেলে তা পকেটস্থ করলো আসমান।মেজাজ তার বিষিয়ে উঠেছে।নিহাদকে আগামীকাল পরীক্ষার জন্য গুড লাক জানাবে ভেবেছিল।কিন্তু তার আর ইচ্ছা রইলোনা।পিছন ফেরা ছাড়াই সোজা বেরিয়ে গেলো সেল থেকে।নাবিল এখন যা ইচ্ছা করুক,নিজের খায়েশ মেটাক।তার চলে যাওয়া পথের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে অতঃপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো নিহাদ।নাবিল বর্তমানে তার চেয়ারটিতে আসন গ্রহণ করেছে।তার হাতে উঠে এসেছে সাঁড়াশি।যা দিয়ে একটা একটা করে ন*খ উঠানোর পাঁয়তারা করছে বাদশাহপুত্র।
সেল থেকে বেরিয়ে করিডোর ধরে সিঁড়ির নিকট পৌঁছতেই আসমানের ফোন পুনরায় বেজে উঠলো।বিরক্ত হলেও যথারীতি চেহারায় তা প্রদর্শিত হলোনা।কলার আইডিতে ভাসছে “ মাস্টার ”।চুপচাপ ফোন কানে তুললো,যদিও আন্দাজ করতে পারছে কি আদেশ দেয়া হবে। ভারিক্কী গাম্ভীর্যপূর্ণ আওয়াজ ধ্বনিত হলো কর্ণকুঠরে।

– রাফা ক্লাবে আছে।ওকে বাড়ি পৌঁছে দাও।মিটিং এক ঘণ্টা পরে হবে।
এটুকুই।ফোন কেটে গেলো।না কিছু জিজ্ঞেস করা হয়েছে,না জানতে চাওয়া হয়েছে।একপ্রকার নীরব আদেশ,পালন করতে বাধ্য পালিত কুকুর।ফোন এবার আর পকেটে না ভরে ধীর পদক্ষেপে এগোলো আসমান। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে পাতালের বাইরে উন্মুক্ত পৃথিবীতে পদার্পণ করলো।কিন্তু….সে কি আদও উন্মুক্ত?

“পাতাল” নামক ক্লাবটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা একইসাথে কঠোর আবার দূর্বলও বটে।
দূর্বলতা সম্পর্কে অবশ্য অন্যান্য মানুষদের অতটা ভাবান্তর নেই।আসমান নিজ বুদ্ধি খাটিয়ে নিরাপত্তা চাদরের ফাঁকফোকর বের করেছে। ক্লাবটি প্রাইভেট, ধনীর দুলাল এবং বিদেশী নাগরিকদের আমোদ স্ফূর্তির অবাধ সুযোগ সৃষ্টির আস্তানা হিসাবে কুখ্যাত।দিনের বেলায় সূর্যরশ্মিতে ভদ্রতার পোশাক গায়ে জড়িয়ে যারা ঘুরে বেড়ায় তারাই হৃদয়ের নিষিদ্ধ এবং অবাঞ্ছিত সকল বাসনা মেটাতে ভিড় জমায় এই স্থানে। কোটি কোটি টাকার লেনদেন, ক্যাসিনোগিরি, বিকৃত মানসিকতার প্রস্টি*টিউশন হয় এখানে প্রতি রাতে।

ভদ্র ধনীদের কুকর্ম লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে বেশকিছু স্থানে সিসিটিভি কিংবা লেজার অ্যালার্ট সিকিউরিটি সিস্টেমের অভাব রয়েছে।তেমনি সাউন্ডপ্রুফ প্রত্যেকটি প্রাইভেট এবং ভি ভি আই পি চেম্বার।মানুষ খু*ন হ*য়ে গেলেও টের পেতে দেরী হওয়া অস্বাভাবিক নয়।এই ব্যাপারটা ধনীর দুলাল দুলালীদের জন্য বিরাট ভালো ব্যাপার হলেও আসমানের জন্য এটি বিশাল একটি ফাঁক বাদে ভিন্ন কিছু নয়।অনায়াসে এখান থেকে সে যে কাউকে তুলে নিয়ে যেতে পারবে,কেউ টেরটুকুও পাবেনা।

ভেতরে ঢুকতে আসমানকে বেগ পেতে হলোনা।কে বি গ্রুপের অধীনস্থ কার্ডটি দেখাতেই তাকে সসম্মানে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলো।দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করে ঢুকে পড়ল আসমান,হাতের ব্রিগেট ওয়াচে সময় বলছে রাত ১২ টা ২৫। ভদ্র ঘরের মেয়ে বলতেই এই সময় বাইরে থাকার কথা নয়,পাতালের মতন ক্লাবে তো নয়ই।কিন্তু অভিজাতদের ব্যাপারই আলাদা।অভিজাত না বলে বলা উচিত কায়সার পরিবার।সর্বকনিষ্ঠ জন্য রাফা কায়সার পিতার অতি আদরের দুলালী বটে।

ঢুকতেই পরিধানের মাস্কের অভ্যন্তর থেকেও কড়া অ্যালকোহলের গন্ধ নাকে এসে ঠেকলো।ভ্রু এবং নাক উভয় কুঁচকে এলো।তীব্র মিউজিকের শব্দে বক্ষগহ্বরের হৃদযন্ত্র বানর নাচন আরম্ভ করেছে।আসমানের নিকট মানুষ সর্বদাই একটি অপছন্দের প্রাণী।শুধুমাত্র হাতে গোণা দুই তিনজন বাদে, যার মাঝে নিহাদ একজন।ছেলেটিকে নিজের হাতে গড়ে তুলেছে সে।পড়ালেখা থেকে আরম্ভ করে মানুষ খু*ন।কে বি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হওয়া তার হাত ধরেই।চাইলে কি সবটা ভিন্ন হতে পারতো?হয়ত।নিহাদকে এই কালো জগৎ থেকে দূরে রাখতে পারতো সে।তাতে অচিরেই ছেলেটিকে গ্রাস করতো জাগতিক চক্রধারা।আসমানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অর্থ তার জীবনধারায় যুক্ত হওয়া।তাই কোনোদিন এই জীবনে কাউকে যুক্ত করার বাসনা তার জাগেনি।কিন্তু নিহাদ… বছর সাতেক পূর্বে চট্টগ্রামের গলিতে নিজের অধিকার আদায়ে তাকে রংবাজি করতে দেখে আসমানের কি হয়েছিল বলতে পারবেনা।শুধু একটি চিন্তাই এসেছিল মস্তিষ্কে,রংবাজি যখন করবেই তখন ভালোমতই করুক, খেয়ে পরে বেঁচে থাকুক।আজকাল নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে কিঞ্চিৎ আফসোস হয় তার,কিন্তু নিহাদের মায়াকাড়া হাসিমুখ চোখে পড়লে অবাধ্য হৃদয় বলে উঠে—ভালোই আছে ছেলেটা।

মানুষ এড়িয়ে ভি আই পি এরিয়ায় প্রাইভেট চেম্বারের সামনে এসে থামলো আসমান।ভেতরে কি অপেক্ষা করছে তার জানা রয়েছে,তবুও বুকে জেঁকে বসা চাপা অস্বস্তি দূরীভূত করা সম্ভব হলোনা।দরজা চাপানো, হয়ত সার্ভিস কল করেছিল। ঠেলে প্রবেশ করলো, অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমটির দরজার পথেই দাঁড়িয়ে রইলো স্থির হয়ে।
সুঘ্রান ছড়ানো মোমবাতিকে ছাপিয়ে গিয়েছে সিগারেটের তামাটে ধোঁয়ার বাষ্প। ভারী পর্দায় আবৃত চারপাশ।মৃদু হলদে আভায় কিঞ্চিৎ দীপ্তিতে ভাসছে চারিপাশ।তাতে ধোঁয়াটে স্বপ্নের ন্যায় দেখাচ্ছে দৃশ্যপট।বিছানার উপর শুয়ে রয়েছে দুজন পুরুষ, একজন চিৎ হয়ে এবং অপরজন উপুড় হয়ে। আরো একজনের স্থান পাশের কাউচে।প্রত্যেকেই উদাম।নেই বস্ত্রের একটি সুতোও।তাতে শরীরে দাগ নজরে পড়ছে। কামড়ের চিহ্ন, মা*রা*র চিহ্ন, বেঁধে রাখার ফলে সৃষ্ট ক্ষ*ত।কিছু কিছু স্থানে গাঢ় নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে তা, কিংবা আস্তরণ ফেলেছে কালশিটে।বিছানায় চিৎ হয়ে থাকা একজনের হাতে এখনো হ্যান্ডকাফ রয়েছে, কাউচের পুরুষের দৃষ্টি আবৃত ব্লাইন্ডফোল্ডে।
পুরুষ পতিত।

এহেন দৃশ্যপট তৈরির কারিগর রাফা কায়সার বর্তমানে বিছানার মাঝখানে হাঁটুর উপর পা তুলে বসে একমনে সিগারেটে সুখটান দিয়ে চলেছে।শরীর আবৃত তার,যতটুকু; সেটাকে শুধুমাত্র যৎসামান্যই বলা চলে।আসমানকে দেখেই তার ঘোলাটে দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক প্রজ্জ্বলন প্রস্ফুটিত হলো।
নিজের চোখ বুজে নিলো আসমান এক সেকেন্ডের জন্য।পরমুহুর্তে পুনরায় দৃষ্টি মেলে চাইলো, নির্বিকারভাবে।ঠোঁট থেকে সিগারেট সরিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে হাসলো রাফা,অদ্ভুত এক হাসি।তার গভীর অনুভূতিসম্পন্ন দৃষ্টি আসমানকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো। ডান হাতের তর্জনী কুচকে নিকটে ডাকলো হিমালয়কে,কিন্তু টললোনা সেই হিমালয়।তাই নিজেই উঠলো রাফা, অ্যাশট্রেতে সিগারেট রেখে দিয়ে হেলেদুলে হেঁটে আসমানের সামনে দাঁড়ালো।হিমালয়ের দৃষ্টি বরাবর তার নয়নজুড়ে।একবারের জন্যও এদিক ওদিক নড়েনি।

– কেমন পুরুষ গো তুমি?চোখ বাদে অন্যদিকে নজর যায়না?
নীরবতা এবং প্রশান্তি ব্যাতিত কোনো প্রতিক্রিয়া আদায় সম্ভব হলোনা।তাতে দুহাত মেলে গলা জড়িয়ে ধরলো রাফা। গ্রীবাদেশে মুখ ঘষে প্রানভরে গ্রহণ করলো গায়ে মেখে থাকা অনন্য এক সুঘ্রাণ।মৃদু কম্পন খেললো শক্তিশালী পুরুষালী দেহে।রাফাকে সরিয়ে হনহন করে এগোলো,মেঝেতে গুটিয়ে থাকা কালো বডিকোন ড্রেসটি তুলে নিয়ে এলিয়ে দিলো মেয়েলী অবয়বে।দৃষ্টি যথারীতি নয়নে।
– মেইক ইট কুইক।

এটুকুই।চেম্বারের বাইরে চলে গেলো আসমান।অপরদিকে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনমনে হাসলো রাফা।আজ মন একটুও ভরেনি তার।আর ভরবেও না,যতদিন না ওই শুভ্রতাকে স্পর্শ করতে পারছে।একটি আফসোসের নিঃশ্বাস ফেলে পোশাক গায়ে চড়িয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়ল রাফা,পিছন ফিরে দেখলোও নিজের ধ্বংসযজ্ঞ।
রাতের সড়কপথ বেয়ে টেসলা মডেল এক্স রীতিমত বিপদজনক গতিতেই ছুটিয়ে চললো আসমান।তাতে প্যাসেঞ্জার সিটে থাকা রাফা বেশ উৎসাহী ভঙ্গিতে বলে গেলো,

– আই লাইক ইট হোয়েন আ গাই ইয রেকলেস, জাস্ট লাইক ইউ!
শূন্য অভিব্যক্তি আসমানের,শুধুমাত্র স্টিয়ারিংয়ে চেপে বসলো তার ফিঙ্গারলেস গ্লাভসে আচ্ছাদিত আঙুলসমূহ।
– আই অলসো লাইক ইট হোয়েন আ গাই ড্রাইভস উইথ ওয়ান হ্যান্ড।
সঙ্গে সঙ্গে গিয়ারে রাখা নিজের বাম হাতটিও স্টিয়ারিংয়ে ছোঁয়ালো আসমান,ভ্রু কুঁচকে এলো তার কিঞ্চিৎ।হাসতে থাকলো রাফা,যেন কি এক মজার কাণ্ড ঘটিয়েছে সে।গতি আরো বাড়ানো হলো, যত দ্রুত সম্ভব এই রমণীর সঙ্গ হতে মুক্তি চায় অন্তর।

অবশেষে পথ ফুরিয়ে এলো প্রায়। “ কায়সার এম্পায়ার” নামক ছোট্ট শহরটিতে প্রবেশ করলো টেসলা এক্স।নিজেদের বাসভবন, অফিসভবন এবং প্রায় প্রত্যেক সন্তানদের জন্য আলাদা আলাদা আবাসনব্যবস্থা নিয়ে গড়ে তোলা স্থানটিকে একটি শহর বলাই শ্রেয়।তিনটি প্রসাদতুল্য ভবন, কর্মচারীদের কোয়ার্টার,সংগ্রহশালা, অফিসভবন, হেলিপ্যাড, মাঝারি আকৃতির লেক এবং বোট…. ফিরিস্তি দিয়ে কুলানো যাবেনা।আসমান গাড়ি থামালো সবচেয়ে বড় প্রাসাদের সামনে।দরজা খুলে নেমে পড়তেই অবাক হয়ে বের হলো রাফা।তার নিজস্ব আলাদা ভবন রয়েছে, কিছুটা সামনে, যার নাম লিলি।

– কি ব্যাপার?এখানে থামলে যে? লিলির সামনে নামানো দরকার ছিল না?
প্রাসাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়েও থমকালো আসমান।
– বলেছিলাম মিটিং আছে।
– তো?
– পা দুটো নিশ্চয়ই অকেজো নয়।কয়েক ফুট হাঁটলে পৃথিবীতে ভূকম্পন সৃষ্টি হবেনা।
– আমার হিল জুতোয় ব্যথা লাগছে।
– খুলে হাতে নিয়ে খালি পায়ে এগোন।
এটুকুই।কথোপকথনে সম্পূর্ণ ইচ্ছা হারিয়ে আসমান চুপচাপ উপরে উঠে গেলো,মুহূর্তেই অভ্যন্তরে আড়াল হলো তার অবয়ব।নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধু ভ্রুকুটি করলো রাফা।ছেলেটি তাকে যত দূরে সরিয়ে দিচ্ছে ততই এ হৃদয় তাকে কাছে পেতে চাইছে।

বিস্তৃত কক্ষ।কিন্তু উপস্থিত মানুষের সংখ্যা মাত্র তিন।সমগ্র কে বি সাম্রাজ্যের অধিপতি আধুনিক এবং রাজকীয় ডিজাইনের মিশেলে তৈরী সোফার গদিতে শরীর এলিয়ে তাকিয়ে আছেন ভৃত্যগণের দিকে।ঘড়ির কাঁটা সময় ঘোষণা করছে রাত ১ টা ১৫।তবুও নির্ঘুম প্রশান্ত সকলে।বিপরীত প্রান্তের সোফায় বসে আছে আকাশ।অন্যদিকে দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া টেবিলের গায়ে হেলান দিয়ে বুকে দুহাত ভাঁজ করে রেখে অনুভূতিশূণ্য দৃষ্টিপাত আসমানের।বাদশাহ একনজর তাকালেন তার দিকে,পরমুহুর্তে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে জানালেন।

– তোমার জন্য নতুন মিশন রয়েছে।
প্রতিক্রিয়াহীন আসমান।কোনো প্রশ্নে আগ্রহী নয়।তার এমন বৈশিষ্ট্য বেশ পছন্দের মালিকের।আকাশ নিঃশব্দে একটি ফাইল এগিয়ে দিলো।চুপচাপ অগ্রসর হয়ে ধবধবে সাদা চামড়ার মোড়ানো ফাইলটি তুলে খুললো আসমান।তার অভিজ্ঞ নজর বয়ে চলল পাতাজুড়ে।

– বিলাল রেমান। রেমান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক। ইতালিতে বসবাস করেন। সকল তথ্য দেয়া আছে। আরো কিছু প্রয়োজন হলে ইনফরমেশন টিম সহযোগীতা করবে। ইউ উইল ফ্লাই ইন ইতালি নেক্সট মান্থ।
যান্ত্রিক কন্ঠে আকাশের বক্তব্য শুনে কিছুই অনুভূত হলোনা আসমানের।তার দৃষ্টি যথারীতি আবদ্ধ ফাইলের পাতায় যেখানে বিলাল রেমানের একটি ছবি দেয়া আছে।সত্যি বলতে আরো প্রায় তিন মাস আগেই আসমান উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে অদূর ভবিষ্যতে তার উপর এই ব্যক্তিকে টপকে দেয়ার নির্দেশ জারি হবে। জাতশত্রু রেমান এবং কায়সার পরিবার।বাংলাদেশে রেমান সাম্রাজ্যের পুনঃব্যাপ্তি কে বি গ্রুপের জন্য হানিকারক।এবার কোনো আগাছা নয়, সোজাসুজি গোড়া উপড়ে ফেলার মাস্টারপ্ল্যান রচনা করছেন বাদশাহ কায়সার।
ফাইল বন্ধ করে মৃদু কন্ঠে আসমান জানালো,

– সময় লাগবে।জটিল মিশন।ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ ফেলতে হবে।পান থেকে চুন খসলে কায়সার পরিবারের নাম জড়িয়ে পড়বে।
অদ্ভুত এক হাসি ফুটলো বাদশাহর ঠোঁটে, সন্তুষ্ট তিনি।সোফায় বাহু ছড়িয়ে আসমানের নত মুখের পানে চেয়ে বিড়বিড় করলেন,
– হুম।সময়টা যত কম লাগে ততই শ্রেয়।রেমানকে আরেকটা সুযোগ দেয়ার অর্থ নিজের পতন নিজে ডেকে আনা।
নিঃশব্দ আসমান।বাদশাহ হাত তুলে দু আঙুলে ইশারা করলেন,

– গো,গেট টু ইওর ওয়ার্ক। আই ওয়ান্ট রেজাল্ট অ্যায সুন অ্যায পসিবল।
– জ্বি।
মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে আসমান উল্টো ঘুরলো। হেঁটে যেতে নিলেই পিছন থেকে আকাশ হঠাৎ বলে উঠলো,
– আগামীকাল গুলশানে যেও।পাবলিক রেস্টরুমের সামনে এক জাপানিজকে পাবে।ফিনিশ হিম। দ্যা নিউজ হেডলাইন শুড বি, জাপানিজ রিপোর্টার ফাউন্ড ডে*ড ইনসাইড পাবলিক রেস্টরুম।
– হুম।
ছোট্ট একটি শব্দ উচ্চারণ করেই বেরিয়ে পড়ল আসমান,হাতে মোটা ফাইল।
পরদিন।

গুলশানের বাইরের সড়ক।এখানেই রয়েছে পাবলিক রেস্টরুম।এতটা নিকটবর্তী হওয়ায় গুলশান বলেই চালিয়ে দিয়েছে আকাশ।সঙ্গে আনা ল্যাম্বরগিনির শরীরে হেলান দিয়ে ফোন ঘাটছে আসমান।যদিও সে আজকের এই ছোট্ট মিশনের কারণ জিজ্ঞেস করেনি তবুও কোনকিছুই তার অজানা নয়।
প্রতিদ্বন্দ্বী এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জাপানভিত্তিক এক চুক্তিকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকদিন ধরে জলঘোলা হয়ে আসছে দেশের ব্যবসায়িক অঙ্গনে।কাইতো হাকিমারু নামক এক জাপানিজ সাংবাদিক বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতি তুলে ধরার প্রক্রিয়ায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।এমন এক মুহূর্তে তার জীবননাশ নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠানটির উপর হুমকি এবং অবশেষে বিলুপ্তির কারণ হবে।কে বি গ্রুপের প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না বললেই চলবে।

কাজটি খুব বেশি কঠিন নয়।আসমানকে এমন মিশনে পাঠিয়ে নিজের সবথেকে বড়ো হাতিয়ার ব্যবহার করার ইচ্ছা ছিলোনা বাদশাহ কায়সারের।তথাপি তিনি ঝুঁকি নিতে নারাজ,গুলশানের মতন এলাকার আশেপাশে এমন একটি কাজ সূক্ষ্মভাবে সম্পন্ন করে অক্ষত বেরিয়ে আসা তার অন্য কোনো অ্যা*সাসিন নয় বরং শুধুমাত্র আসমানের পক্ষেই সম্ভব।
ফোনের দিকে চেয়ে রইলেও অভিজ্ঞ আসমানের দৃষ্টি চারিদিকে নজর বুলিয়ে চলেছে। দশ মিনিটের মাঝেই তার টার্গেট উপস্থিত হলো একটি বাইকে।সমস্ত পোশাকজুড়ে তার কাদা লেগে রয়েছে।বৃষ্টি হয়নি গতকাল, গুলশান এলাকায় কাদাপানি সৃষ্টির ঘটনা দূর্লভ।ব্যবস্থাটি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো।পকেটে ফোন ভরে আঙুল মটকে অগ্রসর হলো আসমান।সময় হয়েছে কাজে লাগার।

কাইতো প্রবেশের আগেই ভেতরে আসমান প্রবেশ করলো।পাবলিক রেস্টরুম সাধারণত এতটা ঝকঝকে তকতকে হয়না,অন্তত এদেশে তো নয়ই।নেহায়েত অভিজাত এলাকা বলে সমাজব্যবস্থা এথায় ভিন্ন। মেনস সেকশনে গিয়ে সম্পূর্ণ ফাঁকা জায়গায় একটি দরজার ভেতর ঢুকে পড়ল সে।কিছুক্ষণ পরেই টাইলসের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো জুতোর শব্দ, অতঃপর বেসিনের ট্যাপ থেকে গড়াতে থাকলো পানি। কাইতো এসেছে।হালকা একটু উকি দিলো আসমান।নিজের মাস্ক ঠিকঠাক করে চোখে পড়ল সানগ্লাস।সরাসরি গিয়ে কাইতোর কাঁধে হাত রাখলো,

– এক্সকিউজ মি?
– হুম?
পিছন ঘুরতেই কাইতোর মুখে চেপে বসলো আসমানের গ্লাভস পরিহিত হাত।আতঙ্কিত দৃষ্টিতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘাতকের হাতে উঠে এলো একটি টিজার।বৈদ্যুতিক শক প্রদানকারী যন্ত্রটি তার ঘাড় বরাবর ছুঁইয়ে দেয়ার আগেই অতর্কিত পদধ্বনি আসমানকে কিঞ্চিৎ হতচকিত করে তুললো।অভিজ্ঞ শ্রবণ ইন্দ্রিয় জানাচ্ছে পদক্ষেপ কোনো মেয়ের, কিন্তু পুরুষদের সেকশনে মেয়ে?চিন্তার সময় নেই।এক টানে কাইতোসমেত একটি টয়লেটে ঢুকে পড়ে দরজা আটকে দিল আসমান।রুদ্ধশ্বাস হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো। কাইতো তার বাহুডোরে ছটফট করছে ছাড়া পাবার উদ্দেশ্যে,তাতে যে শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে তা কিভাবে ধামাচাপা দেবে?

ভাবতে ভাবতেই শক্ত সোলের শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো দেয়ালে দেয়ালে।এগিয়ে এলো এক নারীমূর্তি। দরজার নিচ থেকে তার কালো তিন ইঞ্চি হিল স্পষ্ট নজরে এলো। ট্যাপ ছাড়লো সে।পানির কলকল ধ্বনিকে ছাপিয়ে গেলো কাইতোর মৃদু গোঙানি।অশ্রু ঝরছে বেচারার নয়ন থেকে।সহসাই ফিরে তাকালো তরুণী।এক মুহুর্ত সময়ও ব্যয় করলোনা আসমান। শক দেয়া সম্ভব নয়,ধস্তাধস্তি হতে পারে।তাই সজোরে আ*ঘা*ত হানলো ঘাড় বরাবর।পুনরায় গোঙানি তুলে তার আলিঙ্গনে নিথর হয়ে পড়ল সাংবাদিক কাইতো।

অতঃপর কয়েক সেকেন্ড প্রগাঢ় নীরবতা।আসমানের মনে হলো যেন নিজের নিশ্বাসের শব্দও সে শুনতে পাচ্ছে।কোনো মিশনে এতটা বিচলিত হয়ে পড়েনি সে এর আগে।এই রমণী যদি কিছু আন্দাজ না করে তবেই শ্রেয়,যদি করে থাকে তাহলে তার জীবনে আজরাইলের ভূমিকায় পদার্পণ করা ছাড়া আসমানের করার আর কিছুই থাকবেনা।

– আপনি কি কাদঁছেন?
কণ্ঠস্বরটি যেন অমৃতমিশ্রিত, কর্ণগহ্বরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সুধাবর্ষণ করে।প্রশান্তির প্রস্রবণ ছড়িয়ে দেয় অঙ্গ প্রত্যঙ্গজুড়ে।তবু নিটল আসমান।ভালো, মেয়েটি ভাবছে সে একা একা লুকিয়ে কাদঁছে।মৃদু কন্ঠে ফোপানির মতন আওয়াজ তুললো আসমান।ধীরে ধীরে কাইতোকে ঠেকিয়ে রাখলো টয়লেট সিটের উপরে।ওপাশ থেকে নীরবতা।নিশ্চয়ই মেয়েটি চলে যাবে।একজন পুরুষ কাদঁছে এমন স্থানে অবস্থান করে নিজের সময় অপচয় করার অর্থ হয়না।কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে কিছুক্ষণ বাদেই কন্ঠস্বরটি পুনরায় ধ্বনিত হলো।
– দরজার নিচে তাকান।টিস্যু দিয়েছি।
সত্যি সত্যি একটি টিস্যুর প্যাকেট লক্ষ্য করলো আসমান।নিঃশব্দে তা হাতে তুলে নিলো।চেয়ে থাকল ফ্যালফ্যাল করে।

– চোখ মুছুন। কাদঁবেন না।আপনার চোখের পানির মূল্য অনেক।অপচয়ের আগে ভেবে দেখবেন যা ঘটেছে তা আপনার চোখের পানি লাভ করার উপযুক্ত কিনা।
মেয়েটি কি বদ্ধ উন্মাদ?পাবলিক রেস্টরুমে দাঁড়িয়ে অচেনা অজানা এক পুরুষের সঙ্গে খেজুরে আলাপ জুড়েছে?
মৃদু হাসির শব্দ ভেসে এলো ওপাশ থেকে।যা মুহূর্তেই আসমানের পর্বতসমান নিটল অবয়বে মায়াবী আচ্ছাদনের জাল বিছিয়ে দিলো।
– কি ভাবছেন?আমি পাগল?আপনার সঙ্গে খেজুরে আলাপ জুড়েছি?
এতক্ষন টিস্যু স্পর্শ না করলেও এই কথাগুলো শ্রবণ করেই আসমান একটি টিস্যু তুলে কপালে ছোঁয়ালো।মুছে নিলো জমাকৃত দুফোঁটা ঘাম।

– উত্থান পতনের নামই জীবন।আজ যে রাজা কাল সে ফকির।আবার আজ যে গোলাম, কাল সে মালিক।আপনি আজ নাহয় ফকির হয়েছেন।কিন্তু তাই বলে কাল রাজা হওয়ার আগেই যদি কেঁদেকেটে সব একসা করে ফেলেন তাহলে কিছু হলো?রূপকথার গল্পে কোনোদিন শুনিনি কোনো রাণী কোনো ছিঁচকাদুনে রাজাকে বিয়ে করেছে।রাজাদের অধিকাংশই হয় দুঃসাহসী নাহয় লড়াকু সৈনিক ছিল।
নিজের অজান্তেই কণ্ঠনালী বেয়ে হাসির উদগীরণ ঘটলো আসমানের, তা সে দমন করলো জোরপূর্বক কাশির শব্দ দিয়ে।তাতে ওপাশ থেকে পুনরায় হাসির প্রবাহ ভেসে এলো।

– আপনি হাসছেন।
– উহুম।
– হাহা।হাসুন হাসুন।লজ্জা কিসের?হাসতে কোনো ক্ষতি নেই।নিজের অশ্রু যেমন সংবরণ করে রাখতে হয়, তেমন হাসির ধারা সর্বদা বজায় রাখতে হয়।একজন মহামনিষী বলেছেন। দয়া করে কোন মহামনীষী জিজ্ঞেস করবেন না।নাহলে থ্রি ইডিয়টস মুভির মতন বলবো বাবা রাঞ্চারদাস চাঁছাড়!
হাসলো আসমান।কোনপ্রকার লুকোচুরির চেষ্টা নেই।ওপাশের মানুষটি অনুধাবন করছে নিশ্চয়ই,যে সে নিজের কথার জাদুতে কাউকে হাসাতে পারছে।বাস্তব জীবনের মতনই যেন রং বদলালো মেয়েটি।

– মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী।আমরা কখনোই নিজের যন্ত্রণাটুকু কাউকে অনুধাবন করতে দিতে চাইনা।জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে মনে হয় যে আর পারছি না, আর সম্ভব নয়,নিজেকে লুকিয়ে রাখতে রাখতে আমি ক্লান্ত।তখনি আমরা ভেঙে পরি।স্থান, কাল, পাত্রভেদে।সেটা হোক কোনো পাবলিক রেস্টরুম।একান্তে কেঁদে নিজেকে উজাড় করতে চাই, ভৎসর্ণা করতে চাই আপন সত্তাকে।
আসমান অনুভব করলো মেয়েটি দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। দূর থেকেও অদ্ভুত এক অনুভূতির উষ্ণতা ছেয়ে গেলো তাকে।একমনে শুনে যাচ্ছে সে অচেনা অজানা কোনো এক রমণীর বক্তব্য,যা তার চরিত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান।তবুও,ভালো লাগছে তার।মেয়েটির সম্মোহনী কন্ঠে অদ্ভুত এক জাদু রয়েছে।যা প্রশান্তি ছড়ায় হৃদয়ে।

– কষ্ট পেয়ে লাভ নেই কোনো।জীবন চলবে নিজের আপন গতিতে।আমি জানিনা আপনার সঙ্গে কি হয়েছে, কেনই বা হয়েছে।শুধু এটুকু বলতে পারি যে যা হয়েছে তা কোনোদিন ভুলবেন না।
হতচকিত হয়ে পড়ল আসমান।এই রমণী পুনরায় তাকে ধাঁধাঁয় ফেলে দিয়েছে।
– হাহা, কি ভেবেছিলেন?বলবো সব ভুলে যান?উহু, তা কোনোদিন সম্ভব নয় আমি জানি।মানুষ যদি নিজের যন্ত্রণা ভুলে যেতে পারতো তাহলে এই পৃথিবীতে কোনো মানুষ কখনো দুঃখী থাকতোনা।চারিদিকে থাকতো শুধু সুখ এবং শান্তি।

মনোযোগ সহকারে শুনতে শুনতে আনমনে দরজায় হেলান দিলো আসমান।এক দরজার দুপাশে অবস্থানরত দুটি সত্তা। একে অপরের নিকট অদৃশ্য।অদেখা,অজানা,অচেনা অস্তিত্ব।তবুও পুরু দরজা ভেদ করে নিদারুণ এক প্রশান্তিদায়ক উষ্ণতা ছেয়ে যাচ্ছে শরীরকে।শরীর ছাড়িয়ে চলেছে অন্তর পর্যন্ত।
– তাই বলছি।যা হয়েছে তা মনে রাখুন,স্মরণে রাখুন।অতঃপর মোকাবেলা করুন।কখনো ভুলে যাবেন না নিজের চোখের অশ্রুর কারণ।ঘুরে দাঁড়ান পুনরায়।একবার মুখ থুবড়ে পড়বেন?দশবার উঠে দাঁড়াবেন।জীবনে আমরা অনেক সময় এমন এক প্রান্তে পৌঁছাই যখন মনে হয় সামনে বুঝি আর কোনো পথ অবশিষ্ট নেই;অথচ সেখানে স্রষ্টার তৈরি ভিন্ন পথ আপনার জন্য প্রস্তুত।বিকল্প খুঁজে বের করুন।নিজেকে সুখী করুন।পাবলিক রেস্টরুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনাকে জীবনজ্ঞানের বাণী শুনাচ্ছি,রাস্তার পাগলী ভাববেন না।হতে পারে আমি হিমালয়ফেরত কোনো বহুরূপী সন্ন্যাসী,আপনাকে নিজের জীবনদর্শনের আশীর্বাদ দান করছি।

– জ্বি মাতা হরহরিণী হিমালয়া দেবী…..
উপলব্ধি করার আগেই আসমানের কন্ঠ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্গত হলো শব্দগুচ্ছ।স্তব্ধ হয়ে থাকলো নিজেই। ঢোক গিললো আপনমনে।এটা কি হলো?মেয়েটির হাসিতে তার অন্তরের অস্বস্তি নিমিষেই উধাও হলো।
– একদম ঠিক।
মেয়েটি সরে দাঁড়িয়েছে।না দেখেও স্পষ্ট অনুভব করলো আসমান।নিজেকে কেমন শীতল শীতল অনুভূত হচ্ছে।
– যাক গে।আমার জ্ঞান বিলানো শেষ।বিদায় জানানোর পালা।
জুতোর শব্দ, হেঁটে চলে যাচ্ছে সে।আসমান স্থির হয়ে থাকলো।দরজা খুলে অপরদিকে দৃষ্টিপাত করার অদম্য বাসনা দমন করলো নিজের সর্বশক্তি দিয়ে।মেয়েটি হঠাৎ থমকালো।

– বায় দা ওয়ে, মেনস সেকশনে এসে বকবক করে গিয়েছি বলে উল্টোপাল্টা ভাববেন না।লেডিস সেকশনে কি যেন সমস্যা হয়েছে,মেরামতের কাজ চলছে।আমার জামায় কফি পড়ে গিয়েছিল,তাই ভাবলাম টুপ করে ঢুকে ঢুপ করে পানি ছিটিয়ে পগারপার হয়ে যাবো।ডোন্ট জাজ মি!আমি তো আর ভাবিনি আপনার মতন একজন ব্রোকেন হার্ট পাবলিক টয়লেটে বসে ছেঁকা খেয়ে বেকা হয়ে ফ্যাচফ্যাচ করে কাদবে!
বিদায়বেলায়ও হাসির ফোয়ারা বিলিয়ে গেলো, মনজুড়ে চেয়ে দিলো সুখের আবাহন।

ডার্কসাইড পর্ব ২০

– টিস্যুর দাম পঞ্চাশ টাকা।কোনো মসজিদে দান করে নিজের জীবনের জন্য প্রার্থনা করবেন।ওটা ফ্রি বিলাইনি।
– কি নিষ্ঠুর!
– হাহা…আরেকটা জিনিস বলতে ভুলে গিয়েছি।আপনার কন্ঠস্বর চমৎকার!রেডিও জকি হওয়ার চেষ্টা করবেন,ফ্রি তে টিস্যু না দিলেও একটা উপদেশ দিলাম।
জুতোর শব্দ ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেলো।অপরদিকে আসমান ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়।তার সামনে নিথর পরে রয়েছে মিশন,কিন্তু কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।অযাচিত হৃদয় অজানা এক আবেশে ধকধক করছে।নয়ন একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে হাতে ধরা টিস্যুর প্যাকেটের দিকে।

ডার্কসাইড পর্ব ২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here