তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২৬

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২৬
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

পাখিদের কলরবে বাড়ি আজ মুখরিত। সচরাচর পাখিদের এত কিচিরমিচির শোনা যায় না। আজ পাখিগুলো খুব ডাকছে। মনে বসন্তের হাওয়া লেগেছে কিনা কে জানে। সবাই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে অনুর জন্য। সবাই রেডি, খাবার রেডি, শুধু অনুরই এখনো আসার নাম নেই। রায়ানের মুখ চুপসে আমশি হয়ে গেছে। গতকাল রাতে কোনো প্রত্যুত্তর না করেই অনু রুম থেকে চলে গিয়েছিল। তাই ভয়টা একটু বেশিই হচ্ছে। যদি সবার সামনেই প্রত্যাখ্যান করে দেয় তাহলে মান-সম্মান তো যাবেই, সাথে মনটাও ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
অপেক্ষা করতে করতে দাদা নিজেও অস্থির হয়ে গেছেন। তিনি লিলি খালাকে ডেকে বললেন,

“লিলি, গিয়ে দেখ তো অনুটা কী করছে? এখনো আসছে না কেন?”
লিলি খালা মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“যাইতাছি।”
দুটো সিঁড়ি পার হতেই দেখা গেল, অনু রুম থেকে বের হয়েছে। মুখ থমথমে ও গম্ভীর। কিন্তু লিলি খালা উল্লাসিত কণ্ঠে বললেন,
“ঐতো অনু আইতাছে।”
অনু কোনো কথা বলল না। বাকিরাও নিরব রইল। নিঃশব্দে এসে আলমগীর চৌধুরীর পাশে বসল অনু। জোবেদা বেগম, তাহমিনা বেগম খাবার সার্ভ করতে শুরু করলেন। দাদা গলা খাঁকারি দিয়ে অনুর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন প্রথমে। অনু চোখ তুলে তাকানোর পর দাদা জিজ্ঞেস করলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“রাতে ঘুম ভালো হয়েছে?”
অনু ছোটো করে জবাব দিল,
“হু।”
“তারপর? কী সিদ্ধান্ত নিলে?”
“কোন বিষয়ে?”
বাড়ির সবার চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। তাহমিনা বেগম বললেন,
“কোন বিষয়ে মানে? গতকাল না তোমার দাদু বিয়ের সিদ্ধান্ত জানাতে বলল?”
এই পর্যায়েও অনুর সংক্ষিপ্ত জবাব,
“ওহ।”
সে ভাবলেশহীনভাবে পরোটা দিয়ে ডিম পোজ খাচ্ছে। আলমগীর চৌধুরী কিছু বলতে গেলে দাদু তাকে থামিয়ে দিলেন। নিজেই বললেন,

“তুমি কি আমার কথা সিরিয়াসলি নিচ্ছ না?”
“না নেওয়ার কী আছে?”
“তাহলে হেঁয়ালি করছ কেন?”
“হেঁয়ালি করছি না তো।”
“তাহলে তোমার সিদ্ধান্ত কী?”
অনু গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি পান করল। হাতের উল্টোপিঠে ঠোঁট মুছে বলল,
“সিদ্ধান্ত নতুন করে বলার কী আছে? সারাজীবন তোমরা যা চেয়েছ সেটাই তো হয়েছে। আমি এই বিয়েতে রাজি। এখন ক্লাসে যাব। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
এরপর রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চলুন, আমাকে দিয়ে আসবেন।”
সবকিছু রায়ানের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। অনু বিয়েতে রাজি! সত্যিই রাজি? তার বিশ্বাস হচ্ছে না। অনু যে এত সহজেই রাজি হয়ে যাবে কল্পনাতীত ছিল। আনন্দে, উল্লাসে রায়ানের খাওয়াও হলো না। সে অনুর আগেই গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। অনু এলো কিছুক্ষণ পর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে। দাদু বললেন,

“আজ ক্লাসে না গেলে হয় না? বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা বলতাম।”
“আমি থেকে কী করব? তোমরা কথা বলো, আয়োজন করো। আমি আসছি।”
অনু গাড়িতে উঠে বলল,
“চলুন।”
রায়ান ভাই তাকিয়ে আছে নিষ্পলক।
“কী হলো?” জিজ্ঞেস করল অনু।
“আর ইউ ওকে?”
“অফকোর্স।”
“তোকে অন্যরকম লাগছে। এই অনুকে তো আমি চিনতে পারছি না।”
“সেটা তো আপনার সমস্যা। আমাকে বলছেন কেন?”
“তুই ভেবে-চিন্তে বিয়েতে রাজি হয়েছিস?”
অনু এবার রায়ান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“না। না ভেবে-চিন্তেই রাজি হয়েছি। এখন কী করবেন? বিয়ে করবেন না?”
রায়ান ভাই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,
“অসম্ভব! পাগল নাকি? একবার হ্যাঁ বলেছিস মানে বলেছিস। দেখি কে বিয়ে আটকায় এবার।”
অনু অন্যদিকে তাকিয়ে হাসছে।

রায়ানের সাথে অনুর বিয়ের খবর বড়ো ফুপি এবং ছোটো ফুপিকে ফোন করে জানানো হয়েছে। সবাই এই বিয়েতে খুশি। শুধু একজন দুঃখী। সূর্য। সে মানতেই পারছে না, অনুর বিয়ে হয়ে যাবে। তাও রায়ান ভাইয়ের সাথে। তার এমনই এক দুঃখ এটা যে, কাউকে বলার মতোও না। খবর পেয়ে বড়ো ফুপি সূর্যকে তৈরি হয়ে নিতে বললেন ঐ বাড়িতে যাওয়ার জন্য। সূর্যর মোটেও ইচ্ছে নেই আসার। কিন্তু তার আবার উপায়ও নেই। দুঃখ-কষ্ট লুকিয়ে সে মায়ের সাথে নানাবাড়িতে এসেছে।
বাড়ি পৌঁছে দেখে উঠানে সবার মধ্যমণি হয়ে অনু মাঝখানে বসে আছে। কাজিনরা সবাই আছে এখানে। কীসব বলে যেন হাসাহাসি করছে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে চেয়ারে বসে আছে রায়ান ভাই। তার কোলে ল্যাপটপ। আড়চোখে একটু পরপর অনুকে দেখছে। সূর্যর মন বিতৃষ্ণায় ভরে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এক দৌঁড়ে চলে যেতে। ওকে মনমরা দেখে রায়ান ভাই ইশারায় ডাকল। সূর্য উদাস মনে এগিয়ে গিয়ে রায়ান ভাইয়ের পাশে বসে বলল,

“বলো।”
রায়ান ভাই জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে? মন খারাপ?”
সূর্য দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“না তো!”
“তাহলে এরকম মনমরা হয়ে আছিস কেন?”
“এমনি।”
রায়ান ভাই সূর্যর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“মুখে না বললেও তোর কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি না। এটা ঠিক কষ্টও নয়, তোর আবেগ। বয়স কম তো! আরো বড়ো হ , তখন এসব ভেবে হাসি পাবে দেখিস। এখন আনন্দ কর। মুখ গোমড়া করে থাকিস না তো।”
বিয়ের দিন-তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। তবুও বাড়িতে এখন থেকেই বিয়ে বিয়ে একটা আমেজ। রিয়াদের বিয়ে অনেক বড়ো অনুষ্ঠান করে দিয়েছেন সবাই, রায়ানের বিয়েতেও কোনো ত্রুটি রাখা যাবে না। সবাই এসব বন্দোবস্ত নিয়েই ব্যস্ত।
অনু পড়ছিল। বিয়ের আনন্দে পড়ায় ফাঁকিবাজি তো আর করা যাবে না। স্নিগ্ধা এলো তখন রুমে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ফোনটা সামনে ধরে বলল,

“ভাইয়া কথা বলবে তোমার সাথে।”
অনু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ফোনের দিকে তাকাল। স্নিগ্ধ সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছেন বেয়াইন?”
অনু মৃদু হেসে সালামের জবাব নিয়ে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। আপনি?”
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো আছি। স্নিগ্ধার কাছে শুনলাম, আপনার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
অনু লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে মাথা নাড়াল। স্নিগ্ধও হেসে বলল,
“কংরাচুলেশন। দেশে আসা সম্ভব হলে চলে আসতাম। কিন্তু সম্ভব নয়। বিয়ে মিস করে গেলাম। আমার তরফ থেকে উপহার পেয়ে যাবেন। নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।”
“অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। বিয়েতে উপস্থিত থাকলে ভালো লাগতো।”
“সমস্যা নেই। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। ভালো থাকবেন।”
“আপনিও।”

কথা শেষ হলে স্নিগ্ধা আবার চলে গেল। তখনই অনুর ফোনে রায়ান ভাইয়ের টেক্সট এসেছে।
“ছাদে আয়।”
রাত আটটা বাজে। একটুপরই তো খাওয়ার জন্য ডাকবে। এখন ছাদে যাওয়ার মানে কী? কোনো মানেই হয়তো নেই। কিন্তু অনু তবুও ছাদে গেল।
ছাদে আসার পরই মনে হলো যে, ভাগ্যিস এসেছিল! নতুবা এত সুন্দর চাঁদ দেখাটা মিস হয়ে যেত। কী সুন্দর মন শীতল করার মতোন বাতাস। রায়ান ভাই ছাদের মাঝখানে একটা চেয়ারে বসে আছে। অনু তার কাছে না গিয়ে ছাদে উড়াউড়ি করছে। একটা নয়নতারা ফুল ছিঁড়ে কানেও গুঁজল। রায়ান ভাই গম্ভীরকণ্ঠে বলল,
“কাছে আয়।”
অনু দূর থেকেই বলল,

“কাছে যাব কেন? এখনো তো বিয়ে হয়নি আমাদের।”
“কথার ডাবল মিনিং বের করছিস কেন?”
“এমনি। ডেকেছেন কেন?”
“খুব তো হাসাহাসি হচ্ছিল ফোনে। দেখি তো সব।”
অনু হাসল। কাছে গিয়ে রায়ান ভাইয়ের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,
“আপনি অনেক বেশি হিংসুটে। দেখুন, আজকের রাতটা কত সুন্দর। আজ আর আমরা ঝগড়া করব না।”
“ঝগড়া করলে কী হবে?”
“কী হবে তা তো জানি না। বিয়েতে না-ও করে দিতে পারি আবার।”
“ভয় দেখাচ্ছিস?”
“হুম দেখাচ্ছি। এখন দেখি, এখানে বসুন তো।”
“আরে কী করছিস?”
“বসুন না।”

রায়ান ভাইকে জোর করে ছাদের ফ্লোরে বসিয়ে দিল অনু। এরপর পা গুটিয়ে শুয়ে সে রায়ানের ভাইয়ের কোলে মাথা রাখল। চোখ বন্ধ করে বলল,
“শান্তি!”
রায়ান ভাই চাঁদের রূপালী আলোতে ঝলমল করা অনুর মুখটা দেখছে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে! অনু চোখ মেলে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“কী দেখেন?”
“তোকে।”

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২৫

“আমাকে দেখতে হবে না। আকাশের দিকে তাকান। দেখুন কী সুন্দর চাঁদ!”
“তুই পৃথিবীর চাঁদ দেখ, আমি আমার চাঁদকে দেখি।”
অনু লজ্জা পেয়ে হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২৭