তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ৯

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ৯
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

ঝুমবৃষ্টি অনুর ভীষণ পছন্দ। কিন্তু এখন তার বৃষ্টি উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে না। রায়ান ভাইকে মন ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে। এত দেখে তবুও ওর মন ভরে না। রায়ান ভাই একেবারের জন্য গ্রামে ফিরে আসার পর থেকে অনুর ভালোবাসাও দিনকে দিন পাল্লা দিয়ে শুধু বেড়েই চলেছে। কিন্তু মুখ ফুটে এ কথা বলার সাহস নেই অনুর। কীসের যে এত ভয় তার সে বুঝে উঠতে পারে না। রায়ান ভাইটাও কেমন জানি! সবই বুঝে, বুঝে না শুধু অনুর অনিভূতিটুকু। এইযে অনু এখনো নির্নিমেষ দৃষ্টিতে রায়ান ভাইয়ের দিকেই তাকিয়ে আছে, অথচ রায়ান ভাই? সে সানগ্লাস খুলে চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটাবার কি অনুর দিকে তাকানো যায় না?
অনুর ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে রায়ান ভাই এবার সত্যি সত্যিই অনুর দিকে তাকাল। তখনো তার চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি। সে বিরক্তিতে মুখ তেতো করে বলল,

“এই বৃষ্টি মনে হয় না খুব সহজে থামবে। চল রিকশায় করে দিয়ে আসি।”
“আপনার বাইক?”
“রবিনকে কল করে বলব এসে নিয়ে যেতে।”
“আচ্ছা।”
রায়ান ভাই রবিনকে কল করে মিনিট দশেক আরো অপেক্ষা করল। এরপর রবিন এলে বাইকের চাবিটা দিয়ে অনুকে নিয়ে রিকশায় উঠল। এই প্রথম রায়ান ভাইয়ের সঙ্গে রিকশায় বসে বৃষ্টিবিলাস করছে অনু। না জেনেও রায়ান যে ওর কতশত ছোটো ছোটো ইচ্ছে পূরণ করে দিচ্ছে এসব ভেবেই আপ্লুত হচ্ছে অনু। ক্যাম্পাসের সামনে অনুকে নামিয়ে দিয়ে রায়ান অফিসে চলে গিয়েছে।
আজ অনুর ক্লাস নেই। নাচের ফাইনাল প্র্যাক্টিস করতে এসেছে। কয়েকদিন ধরে বাড়িতে দরজা আটকে দিয়ে নাচের প্র্যাক্টিস করছিল। আগামীকাল ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে। প্রতিবার শুধু গান দিলেও, এবার বান্ধবীদের অনুরোধে নাচও দেবে। নাচের কথা অবশ্য বাড়ির কেউ জানেও না। জানলে একদম জানে মে’রে ফেলবে। চৌধুরী বাড়ির মেয়ে এত মানুষের সামনে বাইরে নাচবে এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রোগ্রামের দিন অনু মেরুন রঙের জর্জেট একটা শাড়িটা পরল। শাড়িটা ছোটো চাচির। ভীষণ সুন্দর! দুই হাত ভরতি করে পরেছে মেরুন কালার রেশমি চুড়ি। পায়ে আলতা দিয়েছে, নূপুর পরেছে। খোঁপায় গুঁজেছে লাল টুকটুকে একটা জারবেরা ফুল। হালকা মেকাপের সঙ্গে ঠোঁটে মেরুন লিপস্টিক দিয়েছে। কানে সিলভারের ঝুমকা। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই কতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল অনু। এরপর বাহানা নিয়ে গেল রায়ান ভাইয়ের রুমে। এত সুন্দর করে সে সেজেছে আর রায়ান ভাইকে দেখাবে না তা কি হয় নাকি?
রুমে গিয়ে সে হতাশ হলো। রায়ান ভাই রুমে নেই। লিলি খালার কাছে জানতে পারল, রায়ান ভাই আরো অনেক আগেই কোথায় যেন গেছে। অনু মন খারাপ নিয়েই বাড়ির গাড়িতে করে ভার্সিটিতে চলে গেল।

রায়ান এসেছে ওর বন্ধু আকাশের বাসায়। আকাশ ল্যাপটপে নিউজফিড স্ক্রল করছিল। রায়ান ওর বিছানায় শুয়ে আছে পাশেই। হঠাৎ করেই আকাশের ফ্রেন্ডলিস্টের একটা ছেলের লাইভ সামনে চলে আসে। ছেলেটা অনুর ভার্সিটির সিনিয়র। আকাশ লাইভে ক্লিক করে দেখে অনু ড্যান্স করছে ভার্সিটির প্রোগ্রামে। আকাশ তখন বিস্ময় নিয়ে রায়ানকে ডেকে বলল,
“এই রায়ান, দেখ তো এটা অনু না?”
রায়ান লাফিয়ে উঠল। অনুকে নাচতে দেখে ওর মাথায় আগুন ধরে গেছে। সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। আকাশ জিজ্ঞেস করল,

“কোথায় যাচ্ছিস?”
না থেমেই যেতে যেতে রায়ান বলল,
“অনুর ভার্সিটিতে।”
আকাশও আর কিছু না ভেবেই ওর পিছু নিল। আকাশের বাড়ি থেকে অনুর ভার্সিটির দূরত্ব মাত্র পাঁচ মিনিটের। বাইক দিয়ে গিয়েছে বলে দুই মিনিটও লাগল না। ভার্সিটির সিকিউরিটি গার্ড রায়ানকে খুব ভালো করেই চেনে এবং এটাও জানে যে সে অনুর চাচাতো ভাই হয়। এর আগেও অনুর সাথে এসেছিল। এছাড়া আকাশও এই ভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র। তাই ভেতরে প্রবেশ করতে রায়ানকে কিংবা আকাশকে কোনো বেগ পেতে হয়নি। রায়ান হাঁটতে হাঁটতে অনুর বড়ো ভাই তমালকে ফোন দিল। তমাল ফোন রিসিভ করে বলল,

“হ্যাঁ, রায়ান ভাই বলো।”
“কোথায় আছিস তুই?”
“একটু কাজে বের হয়েছি। কেন?”
“অনু যে ভার্সিটিতে নাচছে, তোদের পারমিশন নিয়েছে?”
তমাল বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“অনু নাচছে মানে?”
“ভার্সিটির প্রোগ্রামে নাচছে। অনুমতি দিয়েছিস তোরা?”
“কীসের অনুমতি দেবো? ও তো কিছু বলেইনি এই বিষয়ে।”
“এখন ওর কী বিহিত করা উচিত?”
“মে’রে ওর হাত-পা ভেঙে দাও।”
“ভেবে বলছিস তো? পরে আবার বলিস না, তোদের আদরের বোনের গায়ে কেন হাত তুলেছি!”
“শোনো রায়ান ভাই, আমি যদি এখন আসতে পারতাম তাহলে নিজে গিয়েই ওর হাত-পা ভে’ঙে কোলে করে নিয়ে আসতাম।”

“আয়ানের কী মত?”
“ওর কোনো মতামত নেওয়া লাগবে না। আমি যা বলেছি তা-ই করো।”
“ঠিক আছে, এখন রাখছি।”
রায়ান ফোন পকেটে রেখে একটা গাছের ডাল ভেঙে নিল। আকাশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“গাছের ডাল ভাঙলি কেন?”
রায়ান কোনো জবাব দিল না। প্রোগ্রাম হচ্ছিল অডিটোরিয়ামে। সে সরাসরি ওখানেই চলে গেল। ততক্ষণে অনুর নাচ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সে নাচতে নাচতেই খেয়াল করল রায়ান ভাই লাঠি নিয়ে স্টেজে উঠছে। এক পলকেই অনু বুঝতে পারল রায়ান ভাই ভীষণ ক্ষেপে আছে। সে কাছে আসতেই অনু নাচ বাদ দিয়েই উলটো পথে দৌঁড় দিল। পিছু পিছু রায়ানও দৌঁড়াচ্ছে আর বলতে লাগল,
“থাম, থাম বলছি। তোর নাচের শখ মেটাচ্ছি আমি।”

গানের শব্দে রায়ানের কথাগুলো অনুর কান পর্যন্ত পৌঁছাল না। অনু দৌঁড়ে অডিটোরিয়ামে দ্বিতীয় গেইট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে সে। পেছনে তাকিয়ে দেখল রায়ান ভাই তখনো লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসছে। অনু আর এগুতে পারল না। শাড়িতে পা পেঁচিয়ে ধপাস করে মাঠে ঘাসের ওপর পড়ে গেল। আকাশও তখন দৌঁড়ে এসে পেছন থেকে রায়ানকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কী করছিস? পাগল হয়ে গেছিস? এটা ওর ভার্সিটি। এখানে কোনো সিনক্রিয়েট করিস না।”
আশেপাশে তাকাল রায়ান। অনেকেই উৎসুক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। বুক উঠানামা করছে তার। রাগে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ঘেমে গিয়েছে অনেকখানি। কর্কশকণ্ঠে অনুকে বলল,
“ওঠ।”

অনু ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রায়ান এবার ধমক দিয়ে বলল,
“আমি উঠতে বলেছি!”
ধমক খেয়ে কাঠের পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াল অনু। রায়ান হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“বাড়িতে চল।”
অনু কাঁদোকাঁদো দৃষ্টিতে তাকাল আকাশের দিকে। আকাশ চোখের ইশারায় বুঝাল ভয় না পাওয়ার জন্য।
অনুর ভয় তবুও কমল না। সে ভয় পাচ্ছে এবং হাঁটতে গিয়ে বুঝতে পারল পড়ে গিয়ে আঘাতটা সে বেশ ভালোভাবেই পেয়েছে। ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। হাঁটুর কাছটায় ভীষণ জ্বলছে এবং ব্যথা করছে। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গুটিগুটি পা ফেলে হাঁটতে লাগল। আকাশ পেছন অনুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ব্যথা পেয়েছ?”

অনুর চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে। চোখ লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে ব্যথায় সে এক্ষুনী কেঁদে ফেলবে। ওদের এত পেছনে দেখে রায়ান পেছনে এলো। জিজ্ঞেস করল,
“হাঁটিস না কেন তোরা?”
আকাশ বলল,
“দোস্ত, অনু মনে হয় পায়ে ব্যথা পেয়েছে।”
“ঘাসের ওপর পড়ে কেউ ব্যথা পায়?”
“তো ঘাস কি তুলার বিছানা? নিচে তো শক্ত মাটি নাকি? যেভাবে দৌঁড়ানি দিয়েছিস মেয়েটাকে! পড়েছে তো মুখ থুবড়ে। ব্যথা পাবে এটাই তো স্বাভাবিক।”

“এখন কী করব?”
“কী করবি আর? ওকে ধরে ধরে নিয়ে চল। আমি আগে গিয়ে একটা রিকশা ঠিক করি।”
“ঠিক আছে।”
আকাশ চলে যাওয়ার পর রায়ান ভাই অনুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমার হাত ধর।”

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ৮

অনু রায়ান ভাইয়ের হাত ধরে আগের মতো করেই হাঁটতে লাগল। রায়ানের রাগ হচ্ছিল।খুব। এর থেকে তো পিঁপড়াও জোরে হাঁটে। এরকম গুটিগুটি পায়ে হাঁটার মতো ধৈর্য রায়ান ভাইয়ের নেই। সে অনুর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল,
“এভাবে হাঁটলে বছর পার হয়ে যাবে।”
এরপর আচমকা অনুকে কোলে তুলে নিল। অনু এতটাই অবাক হয়েছে যে, রিয়াকশন দিতেই ভুলে গেছে।

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ১০