পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৫৬

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৫৬
সাদিয়া আক্তার

আজকের সকালের নাস্তা হবে গরুর কলিজা দিয়ে খিচুড়ি তাই বাড়ির মহিলাদের রান্নার কোনো ভেজাল নেই। রেনু মিনুও আনন্দে উল্লাসে আছে পুরো বাড়ির সকলেই এখন মুক্তির হলুদ গোসলের আয়োজনে ব‍্যস্ত
গোসলে নেয়ার পর থেকেই মুক্তি সমানে কেদেঁ চলেছে তার কান্না দেখে চাদনী বেগমও আড়ালে কাদেন কামরুল সাহেবকেও দেখে মনে হচ্ছে অনেক কষ্টে সে কান্না আটকে রেখেছে।
গোসল করে দুই রাকাত নফল নামাজ পরেই মুক্তি বউ সাজার জন‍্য চলে গেলো । চন্দ্র এবারও বাসায় লোক আনিয়েছে সাজানোর জন‍্য। বিয়েটা বাড়ি থেকে হওয়ায় একটু বেশী কাজ ছেলেদের। পিছনে লনে প‍্যান্ডেল দিয়ে সাজানো হয়েছে।
যোহরের নামাজের পরপরই বরপক্ষ এসে হাজির গেট ধরেছে পুনম ঝিনুক রিমি ও চন্দ্রের মামাতো বোন।

— শালিকা গন কত চাই??
— লিমন ভাই সবাই কি দরদাম করার জন‍্য আপনারেই পায় নাকি??
— আর বলিও না শালিকা পূর্ণ,, সবার কথা আমি ম‍্যাজিস্ট্রেট মানুষ বাজার দর ভালোই জানা তাই সবাই আমাকেই পায়
বলেই লিমন দীর্ঘস্বাস ছাড়ল। রুপশা লিমনের পেটে গুতা দিয়ে বলল — হইছে তাড়াতাড়ি করো খবরদার বেশী বার্গেনিং করবা না
রুপশার থ্রেড শুনে লিমন ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল — ভাই তোর টাকার স্রাধ‍্য হচ্ছে আজ
ইহান মুচকি হেসে বলল — সমস্যা নাই ভাই আমার শালিকারাই তো নিবে
পিছন থেকে রেনু মিনু মাথা বের করে বলল
— আমরাও আছি দুলাভাই,,,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওদের কান্ড সবাই হেসে উঠল ইহান কোনো কথা ছাড়া ওদের দাবী পূরণ করল। সবাই হইহই করে কেচি দিলো ফিতা কাটতে।।
খাওয়া দাওয়া শেষে বিয়ের কার্যক্রম শুরু হলো।
বিয়ের কার্যক্রম শেষে সবাই হাসি ঠাট্টার মধ‍্যে আয়না দেখা ও মালা বদলের আয়োজন শেষ করল। মুক্তি কাদতে কাদতে কাহিল বাবার বুকে তার দেখাদেখি রূপশা ও পুনমও বাবা বুকে মুখ গুজে কাদছে দূর থেকে নিশা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার কাছে এইসব কেমন ন‍্যাকা লাগছে।। পারভেজ সাহেব হাজার ডেকেও মেয়েকে কাছে টানতে পারেনি।।
কন‍্যা বিদায় কতটা কষ্টের তা মেয়ের বাবাই জানে।।
কামরুল সাহেব ও চাদনী বেগম কেমন মুর্ছা গেছে তাদের সামলে রাত আটটায় ঘরে ঢুকল পুনম চন্দ্র কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে সারাদিনের ক্লান্তিতে সবাই নিজের ঘরে রেষ্ট নিচ্ছে। কাল আবার দুই জুটির রিসিপশন হবে কমিউনিটি সেন্টারে তাই সকলেই রাতের খাবার সেরে রেষ্ট নিতে চলে গেছেন।
পুনম চন্দ্রর মাথায় হাত বুলায় চন্দ্র পুনমের পেটে মুখ গুজে

— যাওয়া মানেই আমাদের মেয়েদের জীবন আমি এসেছি রুপশা আপু গেছে মুক্তি আপুও গেছে এটাই আমাদের নারীদের জীবন তাদের নিজস্ব স্থায়ী কোনো বাড়ি নেই।
— আমি যদি আমার জোহরার জন‍্য তার নিজস্ব ছোট্ট একটা বাড়ি করি কোনো সমস্যা হবে
— সত্যিই!! আচ্ছা আমরাদের বাড়ির নাম আলীহরা
— এটা আবার কেমন নাম,,??
— আপনি আমাকে কি নামে ডাকেন
— কেনো জোহরা,,
— আমি ডাকি শের “এ আলী। আলীর আলী”” আর জোহরার “” হরা তাহলে হলো না আলীহরা!!
— তবে জোহরা বিবি আমিতো ঐ বাড়িটা তোমার জন‍্য দিতে চাই
— উহু দুইজনের নামেই থাকবে আমরা একে অপরের পরিপূরক না,,,
পুনমের কথায় চন্দ্রর ঠোটে বিতৃত হাসি ছড়িয়ে পড়ল। সে যেনো জানতো এরকম একটা উত্তরই পাবে সে তার জোহরার থেকে। এভাবেই চলতে থাকে তাদের কথোপকথন কখন পড়াশোনা কখনও ভবিষ্যতের অপার স্বপ্ন।।

রিসিপশনটা রাতে হওয়ার জন‍্য সকাল সকাল কোনো ভেজাল হয়নি ঘরের মেয়েরা মিলে আজ নাশতা বানায় চাদনী বেগম অসুস্থ হয়ে গেছে রোজিনা বেগম পূর্বকে নিয়ে খুব একটা করতে পারবে না তাই আজ ঝিনুক শিলা বেলা রিমি ও পুনম মিলে সবার জন‍্য নাশতা বানায়।
আগের দিনের গরুর গোশত গরম করে রাখে সাথে ভিমের অমলেট আর গরম গরম পরোটা।
নাশতা সেরে চন্দ্ররা মিলে যায় কমিউনিটি সেন্টারের দিকে দুইটা রিসিপশন একসাথে হওয়ায় বেশ লোকজনের দাওয়াত পরেছে।। আবার চন্দ্রর ইউনিভার্সিটির থেকে বেশ কয়েকজন টিচারকে দাওয়াত করা হয়েছে তাদের আপ‍্যায়নে যাতে কমতি না থাকে তাই চন্দ্র শিহাব ও রিশানকে দায়িত্ব দিয়েছে যাতে তাদের কোনো সমস্যা না হয়।
রয়েল ব্লু ব্লেজার ও নীল শার্ট রয়েল ব্লু প‍্যান্ট সব মিলিয়ে ধবধবে ফর্সা চন্দ্রকে বেশ ভালোই মানিয়েছে। চন্দ্রর সাথে মিশিয়ে পুনম শাড়ি পরেছে রয়েল ব্লু সিল্কের কাজ করা ভাড়ি শাড়ি।।
চন্দ্ররা সেন্টারে পৌঁছে দেখে ইহানরা অলরেডি পৌঁছে গেছে অনেক গেষ্টদের সাথেও পরিচিতি হচ্ছে। ইহানের কলিগদের সাথে মুক্তি কথা বলছে।

— আপু
পুনমের ডাকে মুক্তি ফিরলে পুনম দৌড়ে তাকে ঝাপটে ধরে। — এই আস্তে পরে যাবি তো
চন্দ্র মুক্তি একসাথেই বলল। ইহান পুনম হেসে ফেলল
— আই মিসড ইয়‍্যু আপু
মুক্তি আড়চোখে ইহানের দিকে তাকায় কাল এই ব‍্যাটার সাথে এই নিয়ে একদফা ঝগড়াও করেছে সে। সেই ঝগড়ার সরি স্বরুপ মুক্তির কপালে জুটেছে লোকটার পাগল করা ভালোবাসা আদর।
এর মধ‍্যে ঝিনুক রিমি আসে চারজন একসাথে কথা বলতে থাকে যেনো কতদিন পর দেখা হয়েছে তাদের। কিছুক্ষণ পরে রুপশাও এসে যোগ দেয়। লিমন ইহান গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে চন্দ্রর সেদিকে খেয়াল নেই সে জোহরার পাশে বসে আশে পাশে সবার দিকে নজর রাখতে ব‍্যস্ত।
— ইহান মন খারাপ করিস না এরা বোনেরা একটা আরেকটাকে পেলে আমাদের ভুলে যায়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইহান। চন্দ্রর হঠাৎই নজর যায় কাইফির দিকে যে পুনমের দিকে একটু পরপর তাকাচ্ছে। বিরক্ত লাগল চন্দ্রর তবে বিরক্তি চেপে পুনমের দিকে আরেকটু চেপে যায়। পুনম কথা বাদ দিয়ে চন্দ্রর দিকে তাকায় ফিসফিসিয়ে বলে

— আসেন বসেন একেবারে কোলেই বসেন,,
— সেটা তো বসবে তবে আমি না তুমি বসবে।। বলেই বাকা হাসল চন্দ্র পুনম চন্দ্রর কথার মানে বুঝে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আবার কথায় মন দেয়।
অন‍্যদিকে,,,,,,,,
নাওয়াজ শেখ এসেছে গেটে শিহাব তাকে অভ‍্যর্থনা জানায় পিছন থেকে মিহি উচ্ছসিত হয়ে বলে — স‍্যার আপনি এসেছেন,,,?? দাড়ান আমি এখনই পুনমকে ডেকে আনছি
মিহি পুনমের কানে কানে স‍্যারের কথা বললে পুনম খুশী হয় মিহিকে কানে কানে বলে তার ছোট ফুপী বেলাকে ডেকে দিতে বলে।
নাওয়াজ শেখ এসে চন্দ্র ও পুনমের সাথে কথা হয় বর্তমানে নাওয়াজ শেখ ও চন্দ্র কলিগ তাই সেই হিসেবে পুনমকে ট্রিট করে। স‍্যারের মতো অতটা গম্ভীর হয়। তাদের কথার মাঝখানে পিছন থেকে বেলা শাড়ি সামলাতে সামলাতে এসে বলল

— কিরে আম্মা ডেকেছিলি??
স্থির হয়ে গেলো নাওয়াজ শেখ আজ প্রায় বিশবছর পর সেই মধুর কন্ঠ শুনলো তবে ব‍্যক্তিটাকে চিনতে তার একটুও ভুল হয়নি। হবেই বা কেনো এই ব‍্যক্তির কন্ঠই তো তার নিত‍্যদিনের সঙ্গী ছিলো।
— হ‍্যা ফুপি একটু দরকার ছিলো দেখো আমাদের ইউনিভার্সিটির স‍্যার
পুনমের দেখানো ব‍্যক্তির দিকে তাকাতে থমকে গেলো বেলা চোখের পলক পড়তেও থেমে গেলো গুনে গুনে একুশ বছর চারমাস আটাশ দিন আঠারো ঘন্টা তেত্রিশ মিনিট পর দেখলো লোকটাকে। আগের মতো লোকটা আর নেই সেই তাগড়া লোকটা একটু শুকিয়ে গেছে দুই কানের পাশে সাদা কালো চুলও বেড়িয়েছে বয়স পয়তাল্লিশের লোকটা এখন সেই চব্বিশ বছরের যুবক নেই। বেলার ধ‍্যান ভাঙল পুনমের কথায় পুনম নাওয়াজ শেখকে জিজ্ঞাসা করল

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৫৫

— স‍্যার আপনার ফ‍্যামিলির কেউকে আনেননি
— এক বৃদ্ধ মা ছাড়া আর কেউ নেই আমার। আর বুঝোই তো বয়স হয়েছে কোথাও যেতে চায়না।।
নাওয়াজ শেখের কথা শুনে যারপরনাই অবাক বেলা কি বলছে লোকটা তবে যার জন‍্য তাকে ছেড়ে চলে গেলো যাকে চেয়ে তাকে ফেলে গেলো সে কই,???

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৫৭