পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৫৮
সাদিয়া আক্তার
বেলা আর নাওয়াজ শেখ দুজন দুদিকে চলে গেলো। তাদের যাওয়ার দিকে শাণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একজন সেটা কেউ টের পেলো না।
নাওয়াজ শেখ বাসায় ফুরফুরে মেজাজে ঢুকল। মায়ের ঘরে উকি দিলো নায়লা বেগম আসরের নামাজ পরতেছিল সালাম ফিরাতেই ছেলের উকি দেখতে পায়
— ভেতরে আয় খোকা
মায়ের কাছে ধরা পড়ে নাওয়াজ শেখ মাথা চুলকে ঘরে ঢুকে। জায়নামাজ বসা অবস্থায় মায়ের কোলে শুয়ে পড়ে ইস্তত করে বলে — আম্মা তুমি না আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলে অনেক আগে,,,
— হ্যা খোকা তবে তুমিই তো মাষ্টার্স শেষ না করে বিয়ে করতে চাওনি।
— এখন চাইছি
ছেলের কথায় অবাক হয় নায়লা শেখ বুঝতে পারে নিশ্চয়ই কোনো ঘাবলা আছে তবে শান্ত স্বরে বলল — মেয়েটা কে আব্বা??
মায়ের কথা শুনে বিস্তর হাসল নাওয়াজ মায়ের হাতে চুমু খেয়ে বলল — দ্যাটস হোয়াই আই লাভ ইয়্যু সো মাচ,, মেয়েটার নাম বেলা!! আমি এখন যেই স্কুলে পড়াই সেখানে পড়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী।
নায়লা চুপচাপ ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ছেলের কথা শুনছে আর ক্লাসে করা বেলার পাগলামির কথা শুনে হাসছে। সে মনে মনে ভেবেও নিয়েছে পাখিকে নিয়ে মেয়েটার বাড়িতে যাবে সব ঠিক থাকলে মেয়ের মেট্রিক পরীক্ষার পরেই বিয়ে দিয়ে দিবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সকাল সকাল পাখি গরুদের নিয়ে বের হতেই পিছন থেকে ডাকল নায়লা শেখ — পাখি শোন
পাখি গরুদের বাশের আড়ার সাথে বেধে নায়লার সামনে আসল — জে খালাম্মা
— এই গ্রামে বেলা নামের মেয়ে আছে কোন বাড়ির মেয়ে সে
— খালাম্মা বেলা নামের মাইয়া আছে দুই তিনজন তয় আপনে কারে খুজেন
— খোকার স্কুলে পড়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে মেয়েটা মেয়েটার ভাইরা মনে হয় বড় বাজারে কাপড়ের দোকানে চাকরী করে,,,??
পাখি এবার বুঝল কার কথা বলছে নায়লা শেখ সে ঢোক গিলে বলল — সেদিক যেই মাইয়াডার লগে আপনের ঝগড়া হইল এই সেই
থমকে গেলেন নায়লা শেখ সেই বেয়াদব মেয়েটাকে সে কোনো মতেই নিজের ছেলের বউ করতে পারবেন না। নায়লা শেখ চতুর বুদ্ধিমতি মহিলা সে কোথাও না যেয়ে পাশেই দেওরের ঘরে গেলেন দেওরের বড় মেয়ে নাজমার সাথে বিয়ে ঠিক করে আসলেন যার ঘুর্ণাক্ষরেও কেউ টের পেলো না সাথে বলে দিলেন একথা যেনো নাওয়াজ শেখ না জানে।
আজ ফুরফুরে মেজাজেই স্কুলে এসেছে নাওয়াজ শেখ। আজও বেলার পাগলামি দেখেছে তবে অন্যান্য দিনের মতো চোখ না রাঙিয়ে মুচকি হেসে প্রশ্রয় দিলো। ইশারায় বলল স্কুল শেষে অপেক্ষা করতে কালকের সেই জায়গায়।
প্রেমিকে সাড়া পেয়ে বেলার প্রেমিকা সত্তা ছটফটিয়ে ওঠে গুনতে শুরু করে কখন ক্লাস ও কোচিং শেষ হবে।
— আজ মাষ্টার মহাশয়ের এই অধমার প্রতি এতো দরদ
বেলার কথা শুনে মুচকি হাসে নাওয়াজ শেখ। বেলার দিকে ঝুকে বেলার চোখে চোখ রেখে বলল
— যতই হোক পুরুষ মানুষ তো একজন পাগলাটে রমনীর আকাঙ্খা ফিরিয়ে দিতে পারিনি,,,
বেলা নাওয়াজ শেখের ঐ চোখে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না নজর ঝুকাতে বাধ্য হয়। তা দেখে দুষ্টু হাসে নাওয়াজ শেখ ফিসফিসিয়ে বলে — কেনো বেলারানি এতোদিনের সাহস কোথায় গেলো??
— আআপনি তো এতোদিন এমন দৃষ্টিতে তাকাননি তাই নজর সরানোর প্রয়োজন পরেনি,,
— কেমন দৃষ্টি??
— অন্তরে ঝড় তুলার মতো দৃষ্টি হৃদয় সত্তা কাপিয়ে তোলার দৃষ্টি
বলেই বেলার সাইকেল নিয়ে দৌড়ে চলে যায়। নাওয়াজ শেখ সেদিকে তাকিয়ে বিস্তর হাসে এই মেয়েটাকে যত দ্রুত সম্ভব নিজের কাছে নিয়ে আসা দরকার।
মায়ের হাতে তেল মালিশে আরামে চোখ মুদে আসছে নাওয়াজ শেখের নায়লা বুঝল ছেলে ঘুমের ঘোরে তাই কথাটা উঠালো।
— মেয়ে তারা মেট্রিক পাশের আগে দিবে না খোকা তুমি কি বলো??
— মেট্রিক পাশের পরই সই
— তাহলে বিয়ের কথা পাকা করে মেট্রিকের পড়ে একটা ডেট দেই কি বলো খোকা
— দাও বলেই ঘুমের ঘোরে টলতে টলতে নিজের ঘরে চলে গেলো। নায়লা বেগম জানে ছেলের মুখ থেকে যখন একবার কথা বের করেছে তখন ছেলে কখনও কথার বরখেলাপ করবে না।
একমাস পর
কিছুদিন পরে বেলার মেট্রিক পরীক্ষা তাই সে খুব ব্যস্ত তবে এই ব্যস্ততার মাঝেও প্রণয় পুরুষের দিকে তাকাতে ভুলে না নাওয়াজ শেখও তাই। দুইজনের মধ্যে বেশ ভালো একটা বন্ধন তৈরী হয়েছে নাওয়াজ শেখ আছে পরীক্ষা শেষ হওয়ার আশায়।
আজ বেলার প্রথম পরীক্ষা ভাগ্যগুনে নাওয়াজ শেখের আজ বেলাদের সাথে যাবার কথা উঠেছে। প্রথম পরীক্ষায় স্যাররা হল পযর্ন্ত পৌঁছে দেয় সেটাই নাওয়াজ শেখের ভাগ্যে পড়েছে। নাওয়াজ শেখও খুশী মনে পালন করেছে । বেলাকে হলে পৌঁছে দিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই সামনে একটা লোককে দাড়ানো দেখে ভরকে যায় নাওয়াজ শেখ।
মাথা উঠিয়ে দেখে লোকটাকে — কিছু বলবেন
লোকটা বলল না করল মুঠো শক্ত করে নাওয়াজ শেখের নাক বরাবর মারল এক ঘুষি। নাওয়াজ শেখ নাকে হাত দিয়ে দুই কদম পিছনে চলে গেলো।
— হোয়াট দ্য হেক,,, মারলেন কেনো??
— আমার বোনকে আপনি ডিস্টার্ব করছেন কেন??
— হোয়াট কে আপনার বোন??
নাওয়াজ শেখের কথা শেষ হতে না হতে পরপর আরো কয়েকটা ঘুষি পড়ল নাওয়াজ শেখের নাকে এবার নাওয়াজও হাত চালালো দুইপক্ষই সমানে সমানে দিয়ে চলেছে। তখনই কামরুল সাহেব কোথা থেকে এসে পারভেজ সাহেবকে টেনে নিয়ে গেলো পারভেজ যাওয়ার আগে নাওয়াজ শেখকে শাষিয়ে গেলো তার বোন থেকে দূরে থাকে যেনো নাহলে জবাই করে ফেলবে।।
নাওয়াজ শেখ লোকটার কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে সে কার বোনের সাথে এমন কথা বলল সে শুধু বেলা ছাড়া আর কারো সাথে কথা বলে না তাহলে এই লোকটা কি বলে গেলো। ভাবনায় পড়ে গেলো
তবে পাখির কারণে তা স্থগিত রাখা হলো।
— আহহ মা জ্বলছে
নায়লা শেখ গম্ভীর চোখে একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে ফের তুলায় ডেটল ভরে ক্ষত পরিষ্কার করতে লাগলেন।। মাঝে মাঝে ফু দিথে ভুললেন না
ছেলেকে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে পাখিকে ডেকে পাঠালেন।
পাখি আসলে তার কাছে গম্ভীর স্বরে আজকের ঘটনা জানতে চাইলেন।
পাখি নিজের জানাটুকুই বলল সাথে বলল পারভেজ বেলার ভাই। সব শুনে নায়লা শেখ চুপ থাকলেন বুঝতে পারলেন ছেলে বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে মেয়েটার সাথে একটু বেশী ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
বলতে বলতে পরীক্ষা শেষ হয়েছে বেলার। পরীক্ষা দিয়ে বেলা হাফ ছেড়ে বাচল তবে খেয়াল করল কয়েকদিন ধরে বাড়ির পরিবেশ গুমোট থাকলেও আজ নেই। বেশী চিন্তা না করে দিলো এক লম্বা ঘুম।
হইচইয়ের শব্দে ঘুম ভাঙে বেলার উঠোনে আসতেই বড় বুবুকে দেখে দৌড়ে তার কাছে যায়। কতশত কথা হয় দুই বোনের মধ্যে।
— এই বেলা যা তো শিমুলের কাছে যেয়ে ব্লাউজের মাপ দিয়ে আয়।
— কেনো ভাবী??
চাদনী বেগমের কথায় বেলা জিজ্ঞাসা করল। তখনই রোজিনা বেগম বলল — ও কি ননদীনি শাড়ি পড়তে হলে ব্লাউজ তো লাগবেই।। শাড়ি ছাড়া বিয়ে হবে নাকি??
মেঝো ভাবীর কথায় অবাক হয় বেলা — বিয়ে কার বিয়ে
— তোর বিয়ে কেনরে বেলা হবি না আমার ভাইয়ের বউ??
চাদনী বেগমের কথায় অবাক হয়। হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ভাবীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
প্রতিদিনের দেখা করার স্থানে দাড়িয়ে আছে নাওয়াজ শেখ তবে আজ বেলা আসেনি ছটফটায় নাওয়াজ শেখ। মাগরিবের আজান দিতেই আর না পেরে বেলার বাড়ির দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মোটর বাইক চালিয়ে দশ মিনিটের মাথায় বেলাদের বাড়িতে পৌঁছে যায়। সেখানের পরিস্থিতি দেখে তার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে।
কোনো রকম টলতে টলতে বাইকে বসে বাইক টান দেয়। বাড়ির সামনে এসে হনহন করে মায়ের যায়
— আম্মা আজ আমার বেলার বিয়ে তুমি যদি বিয়ে ঠিক করে থাকো তাহলে আমাদের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন নেই কেনো??
নায়লা শেখ হাতে বইখানা বন্ধ করে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল — আমি কখন বললাম যে তোমার বিয়ে আমি বেলার সাথে ঠিক করেছি,,
— মানেহহ
— তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে নাজমার সাথে পাচঁ দিন পরেই তোমার বিয়ে প্রস্তুতি নাও,,
— আম্মাহ কি বলছো তুমি আমি নাজমাকে কোনো সময় ছোট বোন ছাড়া অন্য নজরে দেখিনি,,
— বিয়ের পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
নাওয়াজ শেখ মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ল। পা ধরে আকুতি মিনতি করে বলল — এমন করো না আম্মা ঐ ষোড়শী মেয়েটা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে
চুপ থাকে নায়লা শেখ তারপর বলল — আমি নাজমার বাবা মাকে কথা দিয়ে ফেলেছি তুমি কি চাও আমার কথার বরখেলাপ হোক??,
— আম্মা এমন করোনা আম্মা
তাদের কথার মাঝে পাখি আসল দরজায় করাঘাত করে বলল — খালাম্মা বেলা এসেছে নাওয়াজ ভাইয়ের লগে কথা কইতে চায়,,
পাখির কথায় দুজনেই তার দিকে তাকায়। পাখি ইস্তত করে আবার বলল — মেয়েটা অনেক জোড় করেতাছিল আবার কনতাছিল তাইইই
নাওয়াজ শেখ দৌড়ে যেতে নিলে পিছন থেকে নায়লা শেখ গমগমে স্বরে বলল — মনে রেখো এই বাড়ির চৌকাঠ পেরোলে আমার মৃত মুখটাও দেখার ভাগ্য তোমার হবে না।
থেমে গেলো নাওয়াজ শেখ পিছিয়ে নায়লা শেখের পায়ের কথা বসে বলল — তুমি আমার মা তোমার বদদোয়া নিয়ে ওকে নিয়ে সুখে থাকতে পারব না তাই আজ ঐ ষোড়শীর উম্মাদনা তার আবেগ সবই তোমার পায়ে ঠেলে দিলাম আম্মা তবে একটা কথা মনে রেখো ঐ ষোড়শীর উম্মাদনা সচোখ্যে থাকলেও আমার উম্মাদনা অলক্ষ্যে
নাওয়াজ শেখের শেষের কথাটা বুঝতে পারল না নায়লা বেগম তবে খুব একটা চিন্তাও করল না নাওয়াজ মা পাগল ছেলে। পর সবই ঠিক হয়ে যাবে।
ক্রন্দন মুখে নাওয়াজ শেখের সামনে দাড়িয়ে বেলা নাওয়াজ শেখকে দেখে তাকে ঝাপটে ধরতেই ঝাড়া দিয়ে হাত ছুটায় নাওয়াজ শেখ গমগমে স্বরে বলল — এখানে কেনো এসেছো??
— মাষ্টার মহাশয় আজ আমার বিয়ে প্লিজ আমাকে আপনার সাথে নিয়ে চলুন আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি
বেলার কথা শুনে নাওয়াজ শেখ একপলক তাকায় তার দিকে শান্ত স্বরে বলল — আম সরি বেলা তোমার সাথে এতোদিন আমার যাই ছিলো সবটাই নিছক মজা ছিলো। আমি সিরিয়াস ছিলাম না আর আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে নাজমার সঙ্গে।
বলেই চিল্লিয়ে নাজমাকে ডাকল নাজমা আসতেই তার হাত ধরে বলল — নাজমা বংশীয় মেয়ে নম্র ভদ্র ওর সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে,,,
নাওয়াজ শেখের কথা শুনে বেলা দুই কদম পিছিয়ে যায়। ফের এগিয়ে নাওয়াজ শেখের হাত ধরতে গেলে নাওয়াজ শেখ এমন ভাবে ঝাড়া দেয় যেনো কোনো আর্বজনা।
— আআমাকে এতো বড় শাস্তি দিবেন না মাষ্টার মহাশয়। আমি বুঝতে পেরেছি সেদিন আমার মেঝো ভাই আপনাকে মেরেছে তাই অভিমানে এমন বলছেন তাই না আআমার ভাই আপনার কাছে মাফ চাইবে সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। বলছি মাফ চাইবে
— তোমাদের মাফ কে চায় ইডিয়েট। এমনিতেও ছোটলোকদের কাছে আর কি আশা করা যায়। যাই হোক পাচঁ দিন পরে বিয়ে অবশ্যই আসবে কিন্ত,,
বলেই নাজমার হাত ধরে ভিতরে চলে গেলো। ভিতরে গিয়েই নাজমার হাতটা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো। ঐ দিকে বেলা চিল্লিয়ে বলছে — আমাকে এতো বড় শাস্তি দিবেন না মাষ্টার মহাশয় আমি নিঃশেষ হয় যাব এতো বড় শাস্তি দিবেন না।
পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৫৭
বেলার কান্নায় পাখির ও খারাপ লাগে তবে কিছু বলার নাই সে এই বাড়ির কাজের লোক। বেলার মাথায় হাত বুলাতে বেলা মাথা তুলতেই বলল — এইখানে থাইকো না বইন চইলা যাও এরা বড়লোক দয়া মায়াহীন।
বেলা উঠে দাড়ায় এলোমেলো ভঙ্গিতে হাটতে হাটতে বলল — ধোকাবাজ সবাই ধোকাবাজ,,
হোচট খেয়ে ধান খেতের চিপায় গড়িয়ে পরল।।