প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৬
রাজিয়া রহমান
ইশতিয়াক রুমে এসে স্বস্তি পেলো না।অস্থির হয়ে কিছুক্ষণ পায়চারী করলো।পৃথিবীতে পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক কতো সুন্দর হয়,স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কতো মধুর হয়, ভাই বোনের সম্পর্ক কতো দৃঢ় হয়!
অথচ ইশতিয়াক সেসবের কিছুই দেখে নি।
না তো বাবার সাথে মা’য়ের ভালো সম্পর্ক দেখেছে, না নিজের সাথে, না ভাই বোনের সাথে তার।
সবাই আছে অথচ যেনো কেউ-ই নেই।
রক্তের সম্পর্ক, আত্মার সম্পর্ক সবকিছুই ভীষণ আর্টিফিশিয়াল হয়ে গেছে।
সবখানে শুধু স্বার্থের খেলা।
অস্থির হয়ে ইশতিয়াক ড্রয়ারে হাত দিলো।চাবি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে গেলো।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে লাইট অন করতেই ইশতিয়াক চমকে উঠে।
হাত, পা, মুখ বেঁধে শুধু ব্লাউজ আর পেটিকোট পরা অবস্থায় একটা মেয়েটা বসে আছে ফ্লোরে। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে মেয়েটা।চোখ বন্ধ।
ইশতিয়াকের হার্টবিট বেড়ে যায়।
কী হচ্ছে এসব?
এই মেয়েটা কে?
দ্রুত মেয়েটার সামনে গিয়ে মুখের বাঁধন খোলে ইশতিয়াক। খুলতেই চমকে উঠে।
আরে,এটা তো ওই মেয়েটা!
এর এই অবস্থা কেনো?
ইশতিয়াক হতাশ হয়ে বসে পড়ে মেয়েটার সামনে। ইশতিয়াকের মাথায় চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে।এই কাজটা কে করেছে?
ইরার জ্ঞান ফিরে এলো।
চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পায় বেবি হাল্কটা ইরার মুখের উপর ঝুঁকে তাকিয়ে আছে।
ইরার চেহারা মুহুর্তেই রক্তবর্ণ হয়ে যায় নিজের গায়ের উপর চোখ পড়তেই।
অর্ধ নগ্ন অবস্থায় ইরা বসে আছে!
ইরার দুই চোখ মুহূর্তেই টলমল করতে লাগলো। এই লোকটা তাকে এভাবে ধরে এনেছে?
ইরাকে অবাক করে দিয়ে ইশতিয়াক বললো, “তুমি এখানে কেনো?”
ইরা হতভম্ব হয়ে বললো, “আপনি আমাকে এখানে এনে বেঁধে রেখে আবার জিজ্ঞেস করছেন আমি এখানে কেনো?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমি!”
“আপনি নন?”
“কি আশ্চর্য! আমি কেনো এমন করতে যাবো?তুমি কে?তোমাকে আমি চিনি? অযথা কেনো এই কাজ করবো?”
“আমার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিন,আমাকে আমার শাড়ি দিন।লজ্জা করছে না আপনার একটা মেয়েকে এভাবে বেঁধে রাখতে?
বেঁধে রেখে তার পরনের বস্ত্র ছিনিয়ে নিতে আপনার লজ্জা করে নি?”
“প্রথম কথা তোমার এই অবস্থা আমি করি নি।তাই আমার লজ্জার কোনো কারণ নেই।দ্বিতীয়ত, আমি টি-শার্ট, প্যান্ট পরে আছি।তাই আমার লজ্জিত হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই।”
ইরার দুই চোখ টলমল করতে লাগলো।
এতো লজ্জা,এতো অপমান!
এতো অপদস্থ হওয়া কেনো ওর কপালে ছিলো!
ইরা কান্নাভেজা গলায় বললো, “কেনো করলেন এমন? আমার তো নিজের বলতে এইটুকুই ছিলো, সম্ভ্রম। সেটুকু ও আপনি!”
ইশতিয়াক ব্যস্ত হয়ে বললো, “নো,প্লিজ।আমাকে অন্তত আর যা-ই ভাবো এরকম ভেবো না।আমার অনেক দোষ থাকতে পারে কিন্তু আমি কখনো কোনো নারীকে দুই আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখি নি।তোমার সাথে আমি এরকম কিছুই করি নি,না তো করার জন্য তোমাকে এনে রেখেছি।আমি নিজেই তো ভেবে পাচ্ছি না আমার এই রুমে তোমাকে কে এনে…?
ইশতিয়াক থেমে গেলো। এক মুহূর্ত থেমে বললো, “বুঝেছি।”
ইরার চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ইশতিয়াক ইরার হাতের বাঁধন খুলে দেয়।
ইরার উন্মুক্ত পেট নজরে আসতেই ইশতিয়াক উঠে যায়। আলমারি থেকে একটা টি-শার্ট বের করে ইরাকে পরতে দেয়।
সময় নষ্ট না করে দ্রুত পরে নেয় ইরা।
পরতে পরতে ইরার ভীষণ কান্না পায়।এতো অসহায় কেনো সে!
এতো সস্তা ভাবে কেনো সবাই!
নিজেকে সামলাতে পারে না ইরা।হুহু করে কেঁদে উঠে।
ইশতিয়াক অপ্রস্তুত হয়ে বললো, “কি হয়েছে?”
“আপনাদের কাছে মানুষের ইজ্জত কতটা সস্তা বলুন তো!একটা মানুষকে চাইলেই বিবস্ত্র করে দেওয়া যায়?আপনাদের টাকা পয়সা আছে বলে কি ভাবেন যা চান তা-ই পেয়ে যাবেন?যার কাছে তার সম্ভ্রমই একমাত্র সম্পদ তাকে এমন করে দেউলিয়া করে দেওয়া কী খুব প্রয়োজন ছিলো?”
“দেখো ডিয়ার,আমি তোমার সাথে কিছুই করি নি।তবে আমি বুঝতে পারছি এই কাজটা আমার বড় ভাই করেছে।সম্ভবত তুমি তার নজরে পড়েছো।সে তোমাকে কৌশলে যখন পায় নি তাই সে এই পথে এগিয়েছে।ফর গড’স সেক,বিলিভ মি।”
ইরার নিজেকে ভীষণ নোংরা মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। তাকে যেনো চাইলেই সবাই যা ইচ্ছে তা করতে পারে।নয়তো পরপর কেনো একই ঘটনা ঘটবে?
ইশতিয়াক ইরার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ স্বেচ্ছায় নিজেকে বিলিয়ে দেয় অন্যের সামনে আর কেউ নিজেকে রক্ষা করতে চায়।
ইকবাল যে চুপ করে থাকবে না ইশতিয়াক জানে।
ইরা আকুল হয়ে বললো, “আমাকে একটু সাহায্য করুন,আমাকে একটু আমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসুন।আমি এক মুহূর্ত ও এখানে থাকতে চাই না।সবসময় জেনেছি নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু নারীরাই হয়।আর প্রমাণ ও পেয়ে গেলাম।তবে কখনো ভাবি নি লিনা ও এমন হবে। অন্ধ বিশ্বাসের ফলাফল হাতেনাতে পেয়ে গেলাম আমি।”
ইশতিয়াক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইরার দিকে।
“তুমি এখন এই অবস্থায় বাড়িতে যাবে?তোমাকে দেখলে তোমার বাড়ির মানুষ ভুল ভাববে।”
ইরা চিৎকার করে বললো, “তাহলে আমাকে বি ষ এনে দিন প্লিজ।এটুকু তো করতে পারবেন?আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।”
ইশতিয়াক কপাল কুঁচকে তাকালো ইরার দিকে। মেয়েটাকে কেমন এলোমেলো লাগছে।
ইরা নিস্তেজ হয়ে ফ্লোরে বসে রইলো। ইশতিয়াক কথা না বলে বের হয়ে গেলো বাহিরে।ইরাকে দরজা ভেতর থেকে আটকে রাখতে বলে ছাদের দরজায় ভেতর থেকে নতুন একটা তালা এনে লাগিয়ে দিয়ে রুমে চলে এলো।
ইরার মাথা কাজ করে না। টলমল পায়ে ইরা এগিয়ে এসে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়।অ্যাটাচ ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দেয় ইরা।
নিজেকে সামলাতে হবে নিজেরই।ইরা হিসেব কষতে বসে।এই লোকটার কথা কতটা সত্যি?
হতেও তো পারে সে নিজেই ইরাকে বন্দী করেছে!
ইরার সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ জন্মায় লিনার উপর। বন্ধু হয়ে বন্ধুর এরকম ক্ষতি করতে পারে কেউ!
নিজেকে ধাতস্থ করে ইরা।লিনাকে একটা কঠিন শিক্ষা সে দিবেই।আবারও সে লিনার মুখোমুখি হবে।
ইরার মনে হলো দরজা লক করেও সে নিরাপদ না।ঠেলে রুমে থাকা ডিভানটা এনে দরজায় ঠেস দেয়।
ইকবাল হাতে করে দুটো ওয়াইনের বোতল নিয়ে ধীর পায়ে ছাদের দিকে এগিয়ে গেলো। মনটা ভীষণ হালকা লাগছে।
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আগায় ইকবাল। মনটা ভীষণ খুশিখুশি। বিকেল বেলায় লিনা ছাদ থেকে নেমেই ইকবালকে জানিয়েছে ইরা এক্ষুনি চলে যেতে চাইছে।
ইকবাল বললো বুঝিয়ে সুঝিয়ে আজ রাতটা রেখে দিতে।
লিনা সেভাবেই কাজ করেছে।
রাত গভীর হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো ইকবাল।ছাদের দরজার ছিটকিনি খুলতে গিয়ে দেখলো তালা দেওয়া।
ইকবাল বিরক্ত হয়ে বুয়াকে ডাক দিয়ে বললো, “এখানে কে তালা মেরেছে?”
ইশতিয়াক বের হয়ে এসে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বললো, “আমি তালা লাগিয়েছি।তুমি ছাদে গিয়ে মাতলামি করতে পারবে না।ম দ খেতে হলে তোমার বেডরুমে যাও।”
ইশতিয়াকের গলার আওয়াজ শুনে সবাই বের হয়ে এসেছে, শায়লা এসে ইকবালের রুমের দরজার সামনের পর্দার আড়ালে দাঁড়ায়। লিনার গলা শুকিয়ে গেছে।
ইকবালের মাথা গরম হয়ে গেলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, “আমি কোথায় যাবো তোকে জিজ্ঞেস করবো আমি?তুই দরজা খোল বলছি।আমি যাবোই।
আমার ডিনার ছাদে।লিনাকে দিয়ে একেবারে রেডি টু কুক অবস্থায় রেখে এসেছি।শা লা,এখনো একবার ভালো করে দেখতেই পারি নি মালটাকে কেমন লাগে এরকম অবস্থায়।তুই আমাকে আটকানোর কে?
ইউ সন অব আ বিচ,গো টু হ্যেল।”
ইশতিয়াকের সহ্য হলো না।দুই লাফে সিঁড়ি ভেঙে ইকবালের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, “বিহেভ ইউরসেল্ফ,নয়তো আমি ভুলে যাবো তুমি আমার বড় ভাই।”
ইকবাল ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, “কী করবি তুই? কি করতে পারবি?
আগে পুরুষ হয়ে দেখা। হয়েছিস তো নপুংসক, যার জন্য না নিজে খেতে পারিস আর না অন্যের খাওয়া সহ্য করতে পারিস।বিয়ে ও তো করছিস না এ জন্য। পুরুষ হতে হয় আগে,পুরুষ।”
ইকবাল কথা শেষ করার আগেই ঝড়ের বেগে একটা ঘুষি এসে ওর নাকের উপর পড়লো। ইশতিয়াকের পুরুষত্ব নিয়ে কথা বলায় ভীষণ আঁতে ঘা লাগলো। মাথার ভেতরে বাজতে থাকে ইকবালের কথাগুলো।
পুরুষ হলে কী যেখানে সেখানে, যাকে পাবে তার সাথেই ইন্টিমেট হতে হবে!
নিজের নাকে হাত দিয়ে ইকবাল বসে পড়লো সিঁড়িতে।
“পুরুষ সে হয় যে নারীকে সম্মান দিতে জানে।তোর মতো মানুষকে পুরুষ বললেও তার আগে কা যুক্ত করতে হয়।
আর একটা নোংরা শব্দ তোর মুখ দিয়ে বের হলে তোর জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।”
ইরা সবটা শুনতে পেলো ভেতরে থেকে।
ইকবাল উটে ইশতিয়াকের কলার চেপে ধরলো। ইশতিয়াক ইকবালের গলা টিপে ধরলো। মুহুর্তেই হুটোপুটি শুরু হয়ে যাওয়ায় শায়লা ছুটে এলো দুজনকে ছাড়াতে।
হাত বাড়িয়ে দিতেই ইশতিয়াক চিৎকার করে বললো, “খবরদার, তোমার ওই নোংরা হাত দিয়ে আমাকে স্পর্শ করবে না।তোমার স্পর্শ আমার শরীরের যেখানে লাগবে,আমি সেখানটাই পু ড়ি য়ে ফেলবো।আল্লাহর কসম!তোমার ছেলে ও ঠিক তোমারই মতো। তোমরা দু’জনেই ভীষণ নোংরা, দুশ্চরিত্রের মানুষ।”
শায়লা ইকবালের হাত ধরে বললো, “ছেড়ে দে ইকবাল, ছেড়ে দে।ঝামেলা করিস না।একটা থার্ডক্লাশ মেয়ের জন্য তোরা দুজন ঝামেলা করছিস!”
ইশতিয়াক একদলা থুতু ফেলে বললো, “ওই মেয়েটার ক্লাস তোমাদের চাইতে অনেক উপরে।ওর কাছে নিজের সম্ভ্রমের মূল্য আছে,যা তোমাদের নেই।তোমরা ওর নখেরও যোগ্য না।”
ইকবাল হাত ঝাড়া দিতেই শায়লা গিয়ে দেয়ালের সাথে কপালে আঘাত পায়।
ইকবাল ইশতিয়াকের নাকে ঘুষি মারতে যায়, ইশতিয়াক মুহুর্তেই মাথা সরিয়ে ফেলে।ঘুষি গিয়ে লাগে দেয়ালে।
ইকবাল হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
“ওর যদি এক চুল পরিমাণ ক্ষতি করার চেষ্টা করো তুমি, মনে রেখো আমি নিজেই তোমার আজরাইল হবো।তুমি দেশে আসার পর থেকে ক’টা মেয়েকে টিস্যুর মতো ব্যবহার করে ফেলে দিয়েছো আমি জানি।আমি কখনো কিছু বলি নি,কারণ সেখানে একা তুমি দোষী না।মেয়েগুলোর ও সায় ছিলো।
কিন্তু যেখানে কোনো মেয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চাইবে, তুমি তাকে জোর করে তোমার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চাইবে সেখানে আমাকে বাঁধা হিসেবে পাবেই পাবে।”
সিঁড়ির গোড়ায় ইশতিয়াক বসে পড়লো। আজ সারা রাত সে এখানে বসে থাকবে।ইকবাল তালা ভেঙে ফেলতে পারে চাবি না পেলে।
“এই বসলাম আমি এখানে, কার এতো বড় বুকের পাটা আমাকে ডিঙিয়ে আজ ওখানে যায়, আমি দেখতে চাই।”
‘“আমি যখন বলেছি তো মনে রাখিস,ওই মেয়েটাকে আমার বিছানায় আমি টেনে নিবোই।পারলে ঠেকাইস।কয়দিন তুই ঠেকাতে পারবি আমি ও দেখবো।আজকে না হয় বাঁচাতে পারলি,এরপর ও সময় আছে।”
ইশতিয়াক মুচকি হেসে বললো, “ওকে,দেখা যাবে।”
প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৫
ইশতিয়াকের চোখের সামনে মেয়েটার টলমল চোখদুটো ভেসে উঠে।
ইশতিয়াকের চোখ জ্বলে। সে এই মেয়েটাকে হারতে দিবে না।এতো এতো চরিত্রহীনার ভীড়ে যখন শুদ্ধ কাউকে পেয়েছে তাকে ইশতিয়াক কিছুতেই হারতে দিবে না।