প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২০

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২০
রাজিয়া রহমান

শারমিন অপেক্ষা করলো না।ইরার মত পাল্টাতে আবার সময় লাগবে না।
ইশতিয়াককে দেখে ড্রাইভার দরজা খুলে দিলো।
শারমিন বিশাল কালো রঙের গাড়িটা দেখে শারমিনের চোখ চকচক করে উঠে।
এতো সুন্দর গাড়ি!

তার মেয়েদের স্বামী ভাগ্য ভালো। গর্দভগুলো নিজের দোষে স্বামীর ঘরে সুখের ভাত খেতে পারে না।
শারমিন ও গাড়িতে উঠে বসলো।এতো আরামদায়ক গদিতে বসে আরামে শারমিনের ঘুম এসে গেলো প্রায়।
তন্দ্রায় থেকে শারমিন স্বপ্ন দেখে বিশাল একটা গরুর পিঠে সে বসে আছে।গরুটা এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে ভীষণ জোরা।তারপর হুট করে থেকে বিকট শব্দে হাম্বা হাম্বা করে ডাকতে শুরু করে।
শারমিনের ঘুম ভেঙে যায় হুট করে। চোখ মেলে দেখে ড্রাইভার বসে বসে হর্ণ দিচ্ছে।
ইশতিয়াক বললো, “নামুন,কাজী অফিসে এসেছি।”
শারমিন নামলো।ইরা নামলো না।ইরা শক্ত হয়ে বসে রইলো।ইশতিয়াক ইরার দিকে তাকিয়ে বললো, “আসো ইরা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“না।”
“কেনো ইরা?”
“কিছুতেই আমি বিয়ে করবো না।আমি সবকিছু ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবো।”
“তোমার যেখানে ইচ্ছে তুমি সেখানে যেতে পারবে।ইশতিয়াক নামক বিশাল আকাশে তুমি মুক্ত,স্বাধীন পাখি ইরা।তোমাকে কেউ শিকলে আটকাবে না।”
“আমার কারো আকাশ চাই না।আমার নিজের যে এক খন্ড আকাশ আছে তাতেই আমার চলবে।”
“এক খন্ড আকাশে ওড়তে গেলে তুমি বারবার জায়গার সংকীর্ণতায় মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে ইরা।আমি চাই ইরাবতী ওড়ুক।”

“আমি কোথাও যাবো না।আমার ভাইয়া কোথায়?আমার ভাইয়ের কথা ছাড়া আমি এক পা ও নড়বো না।”
শারমিনের বিরক্ত লাগছে।এই মেয়ে এতো নাটকবাজ হইছে কেনো?
শারমিন এগিয়ে এসে ইরার হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে ইরাকে গাড়ি থেকে নামালো।ইশতিয়াক চুপচাপ তাকিয়ে রইলো শারমিনের দিকে।
শারমিন ইশতিয়াককে বললো, “চলো,ভেতরে চলো।”
“না,সাগর ভাই আসছে।উনি আসুক তারপর।”
ইরা চমকায়।এই লোক ভাইয়াকে কখন ডেকেছে আবার?
ইরার চোখের দিকে তাকিয়ে ইশতিয়াক ইরার মনের কথা বুঝতে পারলো।হেসে বললো, “গাড়িতে বসেই আম ওনাকে কল করেছি।তুমি ব্যাক সীটে ছিলে তাই শোনো নি।”
ইরা দাঁড়িয়ে আছে। তার অবশ্য সব অনুভূতি মরে গেছে প্রায়।যা-ই হবে হোক।শুধু শারমিনের থেকে ইরা নিষ্কৃতি পেতে চায়।

সাগর এলো ২০ মিনিট পরে।সাগরকে রিকশা থেকে নামতে দেখে ইরার বুকের ভেতর কাঁপতে শুরু করে। ইরা এই দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কে জানে কেনো,ইরার ইচ্ছে করলো চিৎকার করে কাঁদতে। ইরা তাই করলো।
বহু বছরের জমানো সব যন্ত্রণা বের হয়ে এলো ইরার চোখের জলের সাথে।
সাগর এগিয়ে এসে বললো, “কী হয়েছে মা?কী শুরু করলে তুমি?”
“ওর বিয়ের বয়স হয়েছে। ভালো পাত্র পেয়েছি তাই বিয়ে দিচ্ছি।তোর কোনো সমস্যা আছে?”
ইশতিয়াক গিয়ে গাড়ির বনেটের উপর উঠে বসলো।ভাই বোনের এই আবেগময় দৃশ্য দেখে ইশতিয়াকের ভালো লেগেছে।
সাগর ক্রুদ্ধ হয়ে বললো, “লিরাকে মেরে তোমার শান্তি হয় নি?লিরার শোকে আব্বাও চলে গেলো স্ট্রোক করে। তুমি কী মানুষ মা?”

“আমি কী তা নিয়ে ভাবতে হবে না তোর।আমি আমার মেয়েদের ভালো চাই বলেই ভালো ঘরে বিয়ে দিতে চেয়েছি।তোর বোনদের স্বভাব ভালো দেখে ভাত খাইতে পারে নাই জামাইয়ের ঘরে। তোর বউ ও তো তার ভাইয়ের কাছে ভালো একেবারে, কিন্তু বউ হিসাবে কী ভালো ছিলো?
তোর বোনরা ও তেমন। নিজের পেটের দেখে অনেক কিছু বলা যায় না।”
ইশতিয়াক পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে ইরার দিকে বাড়িয়ে দিলো।ইরা তাকিয়ে রইলো।
“কেঁদে নাও।একবার কবুল বলে স্বাক্ষর করার পর এই দুই চোখ দিয়ে আমি দ্বিতীয় বার আর অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দিবো না ইরাবতী।এই কান্নাই তোমার জীবনের শেষ দুঃখের কান্না হোক।”

সাগর ইশতিয়াককে বললো, “আপনার প্রফেশন কী?”
“আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।”
“আমার বোন,আমাদের ফ্যামিলি সম্পর্কে জানেন কিছু?”
“না,আপনার ফ্যামিলিকে আমি বিয়ে করবো না।আমি যাকে বিয়ে করবো তার সম্পর্কে যতটুকু জানা দরকার ততটুকু জানি।আমার মনে হয় এর বেশি কিছু জানার প্রয়োজন নেই আমার। আমার ইরাকে দরকার, তার ফ্যামিলি হিস্ট্রি না।”
সাগর ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মুহূর্তে সাগরের মনে হলো এই ছেলেটা বোধহয় তার বোনকে ভালো রাখতে পারবে।
সাগর ইরার দিকে তাকিয়ে বললো, “কান্না বন্ধ কর।চোখ মুছে নে।নতুন জীবন হাসিমুখে শুরু করবি যাতে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মুখে হাসি থাকে তোর।”
ইরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
ভাইয়া কী বলছে?

“ভাগ্যে কী আছে সেটা আল্লাহ ভালো জানে।তবে আমার মনে হচ্ছে এই ছেলেটা তোকে ভালো রাখতে পারবে।আমি সবসময় চাই আমার বোনটা ভালো থাকুক।”
ইরা আর কথা বাড়ালো না।ভীষণ ক্লান্ত লাগছে ইরার।সারাদিনের অভুক্ত ইরা।
ইশতিয়াকের কয়েকজন বন্ধু মনে হয় আগে থেকেই আশেপাশে ছিলো। ইশতিয়াক কল দিতেই ৩-৪ জন এলো।১২ লক্ষ টাকা দেনমোহরে ইরার বিয়ে হয়ে গেলো ইশতিয়াকের সাথে।
কবুল বলার সময় ইরা সময় নিলো না,কান্না করলো না।শুধু স্বাক্ষর করার সময় ইরা টের পেলো বুকের ভেতর তুমুল ঝড় উঠেছে।
স্বাক্ষর করে ইরা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে।
কতটুকুই বা বয়স হয়েছে ইরার অথচ মনে হচ্ছে বেঁচে থাকতে থাকতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেছে সে।এই ক্লান্ত জীবন থেকে যদি ছুটি নেওয়া যেতো।কে জানে কোন সে রূপার কাঠি,সোনার কাঠি যার স্পর্শ পেলে এই জীবন থেকে মুক্তি পাবে।

ভাবতে ভাবতে দুই চোখ ভিজে উঠে ইরার।শক্ত হতে গিয়ে ভেতরে ভেতরে ইরা যে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
শারমিন ইরাকে বললো, “এসব নাটক এবার বন্ধ কর।”
ইশতিয়াক শারমিনকে বললো, “অনেকক্ষণ ধরে আপনার অনেক কথা শুনেছি ইরাকে বলতে।একবার ও আমি নিষেধ করি নি,বাঁধা দিই নি।ইরা আপনার মেয়ে।আজ এই মুহূর্ত থেকে ইরা আমার স্ত্রী। আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলবেন ভেবেচিন্তে, হিসেব করে। সে আপনার মেয়ে বলে আপনার যা ইচ্ছে তা বলার অধিকার নেই।ভালোবেসে কথা যদি বলতে না পারেন তাহলে কথা বলবেন না আর কখনো।”
শারমিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ইশতিয়াকের দিকে। ইশতিয়াক ড্রাইভারকে কল দিলো।ড্রাইভার এসে বললো, “সব রেডি করা আছে স্যার।”

ইশতিয়াক গাড়িতে করে সবাইকে ইরাদের বাসায় দিয়ে আসলো।ইরা গাড়ি থেকে নামার সময় ইশতিয়াক বললো, “খুব শীঘ্রই তোমাকে এই পাষাণপুরী থেকে নিয়ে যাবো অলকানন্দা।আজ থেকে তোমার সবকিছুর দায়িত্ব আমার।
এই শপিং ব্যাগটা নাও।ভেতরে গিয়ে খুলবে।”
সাগরের ভীষণ নির্ভার লাগছে।ইরার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এবার আর সাগরের কোনো পিছুটান নেই।নিশ্চিন্তে সাগর নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারবে।এই জগতের সব বন্ধন থেকে সাগর মুক্ত হতে চায়।পিছুটান ছিলো ইরা।আজ আর কেউ নেই।”

ইরা টলমল পায়ে ভেতরে গেলো।শরীরে এক ফোঁটা শক্তি ও অবশিষ্ট নেই।শরীর নির্জীব লাগছে।
কোনো মতে নিজেকে টেনে নিয়ে গেলো ইরা।
চেয়ারে বসে ইরা উপরে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ইরার পেছন পেছন ইশতিয়াকের ড্রাইভার ঢুকলো দুই হাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে।
শারমিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।ড্রাইভার আসছে আর যাচ্ছে। ব্যাগ দিয়ে ডাইনিং টেবিল ভরিয়ে ফেলেছে।
সাগর এসে দাঁড়িয়ে রইলো।
শারমিনের দুই চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগলো আনন্দে।

মেয়ের জামাই জিনিসপত্র পাঠাতে আর আলসেমি করে নি।বাজারে যতো রকম ফল,মিষ্টি আছে তার কিছুই বাদ দেয় নি মনে হয়। সেই সাথে রেস্টুরেন্টের খাবার তো আছেই।
শারমিনের লোভাতুর দুই চোখের দিকে তাকিয়ে ইরার ঘেন্না লাগে।
একটা রসগোল্লা তুলে নেয় শারমিন। নরম,তুলোর মতো রসগোল্লা।
মুখে পুরার আগেই ইরা শারমিনের হাত ধরে বললো, “এগুলো আমার হাজব্যান্ড পাঠিয়েছে। আমি ঠিক করবো এগুলো কে খাবে।”

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৯

শারমিন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায় ইরার দিকে। সবগুলো ব্যাগ ইরা টেবিল থেকে নিচে নামায় এক এক করে। তারপর সাগরের দিকে তাকিয়ে ইরা বললো, “ভাইয়া,এগুলো সব দুইটা রিকশা করে নিয়ে বের হও।রাস্তায় যাকে পাবে তাকেই বিলিয়ে দিবে।বলবে যাতে আমার জন্য দোয়া করে।”
এতো কষ্টের মধ্যে ও সাগরের হাসি পেলো।ভীষণ হাসি।যেই হাসিতে যন্ত্রণারা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে যায়।

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২১