প্রেমসুধা পর্ব ৫৮
সাইয়্যারা খান
নরম স্বভাব বজায় রেখে পৌষ’কে নিয়ে ঠান্ডার দেশে গরম গরম কফিতে ভালোবাসার আদান-প্রদান করছে তৌসিফ। তার আচার আচরণ ঠিক এক সদ্য প্রেমে পুরুষের মতো। পৌষ’র চঞ্চলতা এখনও বিদ্যমান। তারা দু’জন বিন্দুর দূরত্বও রাখতে যেন অপারগ। গায়ে গা ঘেঁষে দু’জন বসে আছে। তৌসিফ নিজের জ্যাকেটের চেইন খুলে তাতে টেনে নিলো পৌষ’কে। আদুরে বিড়াল বনে গেলো পৌষ। সে ওম খুঁজতে ব্যস্ত। কান টুপিটা টেনে ঠিক করে তৌসিফ। হালকা স্বরে বলে,
— ঠান্ডা লাগবে।
পৌষ বুকে আরেকটু সেটে যায়। তৌসিফ বাহু বন্ধনে আটকে নেয়। না চাইতেও চোখ ভিজে যায় পৌষ’র। তৌসিফ তখন আদর আদর কথা বলছে তাকে। দৃষ্টি তার বাইরে তুষারপাতে। তৌসিফ হ্যান্ড গ্লাভসগুলো পরাতে চাইলো পৌষ’কে কিন্তু ও পরবে না। হাত দুটো তৌসিফে’র কোমড় পেঁচিয়ে ধরে চাপা স্বরে পৌষ বলে,
— এই যে, গরম হয়ে যাবে।
— পৌষরাত?
পৌষ চমকালো। এখানে আসার পর থেকে পৌষরাত নামে ততটা ডাকছে না তৌসিফ। সে ভালোবাসার মধুর ডাকই ডাকছে। হঠাৎ নিশ্চিত পৌষ’র ভারী কণ্ঠ
শুনেই সে বুঝেছে। পৌষ ঝটপট গলা খেঁকিয়ে নিলো। বুকে আরেকটু ঢুকার চেষ্টা করে বললো,
— এখানে কত সুন্দর সবকিছু….
— ডাকছি আমি।
— হুঁ। বলুন।
— মন খারাপ? তোমার কণ্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন?
— কিছু ভাবছি।
— কি?
— এত সুখ কোথায় রাখব আমি?
— এই যে তোমার ছোট্ট বুকটায় ভেতর ছোট্ট একটা হৃদয়। ওখানে শুধু আমাকে রেখে দাও। আর কিছু রাখতে হবে না।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— আমার কাছে সব কল্পনা মনে হয় জানেন। মনে হয় সেদিনও আমি কক্সবাজার যেতে কত বায়না ধরলাম। কেউ নিলো না। বান্ধবীরা সবাই যাচ্ছিলো। তাদের সাথেও যেতে দিলো না। পাঁচ হাজার টাকা জমিয়েছিলাম তবুও দিলো না। সেবার আমার কত্ত মন খারাপ হলো। এত রাগ লাগলো কিন্তু আমি রাগ করি নি। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে হাবিজাবি অনেক কিছু কিনে রাতে ছাদে পার্টি করেছিলাম। জানেন, শ্রেয়া ভাবীও বলেছিলো কিন্তু তবুও যেতে দেয় নি৷ আমি আসলে কখনো ঢাকার বাইরে যাই নি। এবার একদম দেশ ছাড়া হয়ে গেলাম।
তৌসিফে’র ভেতরে বেহুদা সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হয়। নামহীনা যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার কোন কারণ নেই। মাঝেমধ্যে আমাদের খারাপ লাগে। সেই খারাপ লাগার তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকে না। তৌসিফে’র এবার তাই হলো। এমন মন খারাপ অবশ্য তার সহসা হয় না। আবার মনে হচ্ছে এই প্রথমই বুঝি এমন মন খারাপ হচ্ছে।
তৌসিফ পৌষ’কে তুললো বুক থেকে। প্রেমিকের মতো কপালে চুমু দিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ংকাল। পৌষ চোখ নামিয়ে নিলো। তৌসিফে’র গভীর চোখে বেশিক্ষণ তাকাতে সে অক্ষম।
তৌসিফ পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে বললো,
— উঠবে?
পৌষ শান্ত ভাবে মাথা নাড়ে যদিও এখানে বসে থাকতে তার ভালো লাগছিলো৷ তৌসিফ পৌষ’র হাত টেনে গ্লাভস পরিয়ে দিলো। উঠতে নিবে তখনই ফোনটা বেজে উঠে। তৌসিফ দেখলো দেশ থেকে কল তাই পৌষ’কে বসিয়ে বললো,
— একটু বসো। এখানে নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না৷
পৌষ বসে। এদিক ওদিক এলোমেলো দৃষ্টি দিতেই দেখা মিলে অপ্রীতিকর দৃশ্য। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরায় পৌষ। ঠিক সেই মুহুর্তে ওর টেবিলে দুটো টোকা দিয়ে এক নারীকণ্ঠ বলে উঠে,
— হেই ডিয়ার, ক্যান আই নো ইউর নেইম?
পৌষ চোখ তুলে তাকায়। নারীটির চোখ মুখ দেশীয় লাগলেও তার মুখের ভাষা এবং চুলের রং এখানকার মতো। ঘাড় পর্যন্ত চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে পুণরায় বললো,
— হোয়ার আর ইউ লস্ট?
— নাথিং। আই ডোন্ট নো ইউ।
— ওকে ফাইন। আমি বলছি..
পৌষ বুঝলো সে ঠিক। এই মহিলা দেশী কিন্তু এখানে এসে বেশ ধরেছে। এসব পৌষ’র খুবই বিরক্ত লাগে। তবুও ঠোঁটে হাসি ফুটাতে চাইলো ও। বললো,
— আমার হাসবেন্ড আছেন সাথে। ওখানে আছেন।
আঙুল দিয়ে দেখাতেই নারীটি হাসলেন। বললেন,
— আই আস্কড এবাউট ইউ ডারলিং।
পৌষ’র হাসি বিস্তর হলো। বললো,
— আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে ওনাকেই জিজ্ঞেস করুন আন্টি।
বলেই পৌষ উঠে দাঁড়ালো। হেঁটে হেঁটে গেলো তৌসিফে’র কাছে। তারা হাত ধরে প্রস্থান করলো এখান থেকে। এদিকে নারীটি আন্টি ডাকে হতভম্ব হয়ে গেলো। তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মুহুর্তেই।
মেহেদী অস্থির হয়ে উপস্থিত হলো ঢাকার সনামধন্য এক হাসপাতালে। তখন সে চিৎকার করে ডাকলেও সোহা উত্তর করে নি৷ সে ছিলোই না বাড়ীতে। থাকার কথাও অবশ্য না কারণ মেহেদী’র ফোনে তখন সোহা’রই এক বার্তা উপস্থিত ছিলো। হয়তো খুবই বা খুশির বা অতি মর্মান্তিক। মেহেদী’র ডাকে ওর মা-বাবা উপস্থিত হয়। মেহেদী তখন অবিন্যস্ত দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে থাকে। তার বুকের অস্থির ভাব তার চোখেমুখে তখন ফুটে উঠে তখন কোনমতে শুধু মানিব্যাগটা পকেটে ভরে সে দৌড়ে বেরিয়ে আসে।
এখন এই মুহুর্তে তার লজ্জা এবং সংশয় হয়। এমন ভাবে এই বেশে এত বড় হাসপাতালে ঢুকবে কিভাবে? যদি অপমান করে? মেহেদী সহ্য করতে পারে না। তার ভেতর তখন জ্বলছে। ভয়ে বুকটা কুঁকড়ে যাচ্ছে বারংবার। সোহা ফোন ও ধরছে না। মেহেদী ভেতরে ঢুকে। তার দিকে ওয়াচম্যানও কেমন ভাবে তাকায়। মেহেদী পাত্তা দেয় না। ও লিফট ধরে চার তলায় যায়। কাঁপা কাঁপা পা ফেলে কাউন্টারে জিজ্ঞেস করতেই তারা কম্পিউটারে সোহা নামটা টাইপ করে শুধু জানায় তার অবস্থান। মেহেদী’র শরীর হীম হয়ে আসে৷ ও দেয়াল ধরে সেদিকে পা বাড়ায়।
রুম নাম্বারটা আরেকবার দেখে নব ঘুরাতেই দরজা খুলে গেলো৷ মেহেদী দেখলো বেডে শুয়ে আছে সোহা। ধরাস করে উঠে ওর বুকটা। অজানা আশঙ্কায় ভেতর কাঁপে।
আস্তে করে দরজা লাগিয়ে ভেতরে ঢুকে হাত রাখে সোহা’র পেটে। বুঝার চেষ্টা করে কিছু। সোহা চোখ থেকে হাত সরায়। মেহেদী’র অবস্থান সে টের পেয়েছে। মেহেদী বুঝে না কিছু। সোহা তাকাতেই আচমকা ঝরঝরে কেঁদে ফেলে মেহেদী। হাঁটু গেড়ে বসে নিচে। সোহা তাকিয়ে রয়। মেহেদী’র কান্না সে দেখেনি কখনো। সোহা’র শান্তি লাগলো। তার ভেতরের রাগ হালকা হচ্ছে যেন মেহেদী’র চোখের পানি ছিটানো হচ্ছে ওর বুকে যা উপশম করছে তার দাবানো রাগ।
মেহেদী কাঁদতে কাঁদতে শুধু প্রশ্ন করে,
— আছে?
সোহা উঠে বসে। পা দুটো ভাজ করে আসাম করে বসে বলে,
— না থাকাটা আপনার জন্য সস্তির মেহেদী। খরচ হতো অনেক। কাঁদার কারণ?
মেহেদী তাজ্জব বনে উঠে এলো। সোহা’র বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বললো,
— কি বলছো? কি বলছো সোহা? আমার সন্তান বোঝা কেন হবে? এই তুমি কি করেছো? ওকে কি মে-রে ফেলেছো? কথা বলো দয়া করে…
— আমি কাল জানলাম। ভাবলাম আপনাকে জানাব। কিন্তু দেখলাম আপনার টাকা নেই। অতিরিক্ত এক পিঁপড়েও যদি আপনার চিনির দানা নিয়ে যায় তবে আপনার সংসারে চায়ে মিষ্টতা কমে যাবে। ছোট বাচ্চা, বুঝেন কত খরচ। এদের দুধ থেকে নিয়ে সবই খরচ। জামা-কাপড় অতিরিক্ত খরচ। ডায়াপার নাহয় কাঁথা দিয়ে সারিয়ে নিতাম। ছয় মাস যেতেই বাড়তি খরচ। তা বাদ দিন এই যে পেটে থাকতেই খরচ শুরু হতো। ভালো-মন্দ, ডাক্তার, খাওয়া কত খরচ! আবার বড় হলে একে স্কুল, সে আরেক খরচ। চিপস, চকলেট সহ কত আবদার থাকবে তার মেহেদী। সংসার চলে টানটান করে। বাচ্চার খরচ কোথা থেকে আসবে? কত টাকা খরচের থেকে এবর্শন এর টাকা খরচ বুদ্ধিমানের কাজ। কি ঠিক বলি নি?
আর ভাবলাম যেহেতু এবর্শন করাবই বড় হাসপাতালেই করাই। ওও আচ্ছা, আপনি কি টাকা নিয়ে ভয় পাচ্ছেন? কোন সমস্যা নেই। বিল পে করা সব। আমি দিয়ে দিয়েছি। আর হ্যাঁ, এটা আপনার খরচ না। পেটের সন্তান আপনার হলেও তাকে মা’রার খরচ তার মা ই দিবে…..
মেহেদী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার ভাষা নেই। শব্দ ভান্ডার শূন্য। মেহেদী অবাক স্বরে শুধু বলে,
— আমি কি এত বড় শাস্তির যোগ্য সোহা?
সোহা ভাব শালীন। সে গুনগুন করে গান ধরেছে।
— হানিবানি, কি খাবে?
— মজা খাব।
তৌসিফ বউ’কে আজ হাঁটাচলা করতে দিচ্ছে না৷ সে জানে বউ অসুস্থ। ক্লান্ত তার বদন। তৌসিফ ওকে নিয়ে এলো সিডনির এক লোকাল রেস্টুরেন্টে। ওরা ঢুকা মাত্রই কয়েকজন লোক এগিয়ে এলো। এগুলো বিদেশি। অবাক করা বিষয় তৌসিফ সবাই’কে চিনে এবং তারা বন্ধু। তৌসিফ এসেছে শোনামাত্রই দাওয়াত দিয়েছে। তৌসিফ বউ সহ ভেতরে ঢুকে। সবার স্ত্রী ভেতর দিকেই। পৌষ’কে তারা নিজেদের কাছে টেনে নিলো। তৌসিফ চোখে ভরসা দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ডোন্ট বোদার হার মাচ।
উত্তরে মুচকি হাসি। ব্যাস।
পৌষ’কে ঘিরে তাদের বিস্তৃত আলোচনা। তারা পৌষ থেকে জানছে কিভাবে বিয়ে হলো। কিভাবে হলো প্রেম? পৌষ’র বলতে মন চাইলো অনেককিছু। তার মুখ নিশপিশ করছে কিন্তু আফসোস বলতে পারছে না। মনে মনে গান গাইলো পৌষ,
“পিরিত করছে যে জন জানে সেজন পিরিতের কি বেদনা”
তৌসিফ’কে বিয়ে করে প্রথম প্রথম এই বেদনাই পেয়েছে পৌষ। আহা! পৌষ শিহরিত হয়। পৌষ তাদের সাথে ভালোই আলোচনা চালায়। মিষ্টি মিষ্টি স্বভাবজাত কথা বলে। ওদের মাঝখান থেকে একজন বলে উঠলো,
— পিয়া’র সাথে দেখা হলো এখানে? ও তো সিডনিতেই থাকে।
পৌষ আসলে বুঝে না৷ “পিয়া” নামের কাউকে ও চিনে না। পৌষ’র মুখ দেখে মেয়েটা পুণরায় বললো,
— কি হলো পৌষ? বললে না?
— চিনি না তো।
আরেকজন ওকে থামিয়ে বললো,
— কেউ না। বাদ দাও।
প্রথম মেয়েটি থামলো না৷ সে জানতে উৎসুক। এই তৌসিফ’কে সে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো। তৌসিফ বাজেভাবে তাকে প্রত্যাখান করেছে। তাহলে এই হ্যাংলা-পাতলা মেয়ের মাঝে সে পেলোটা কি?
সে তাই বলে উঠলো,
প্রেমসুধা পর্ব ৫৭
— আরে, কেউ না কেন? পিয়াসী’কে তো পৌষই চিনেই৷ ও জানে যে তৌসিফ বিবাহিত ছিলো।
এতটুকু বলেই থামলো ওরা। পৌষ’র টনক নড়লো অল্প। তৌসিফে’র আগের বউয়ের নাম পিয়াসী এটা আদৌ পৌষ জানতো কি না এটা নিজেই বুঝতে পারছে না। তারা বলাতে শুধু বুঝলো কার কথা বলছে। পৌষ জানে তৌসিফে’র দ্বিতীয় বউ সে কিন্তু এই মুহুর্তে তার ভালো লাগে না কথাটা। একদমই না। সোজা উঠে যেতে নিলেই তার হাত ধরে বসিয়ে দিলো মেয়েটা। হাসতে হাসতে বিষয়টা হালকা করে চালিয়ে গেলো ভিন্ন আলাপ কিন্তু আশ্চর্য পৌষ’র ভালো লাগছে না। রাগে তার গা দপদপ করছে।