প্রেমসুধা পর্ব ৭৪
সাইয়্যারা খান
সমান তালে পায়চারি করছে তৌসিফ। রান্নাঘর থেকে সুঘ্রাণ আসছে। পৌষ নিজ হাতে রান্না করছে। তৌসিফ এত নিষেধ করলো ও মানলো না৷ সকাল থেকে যথেষ্ট ফুরফুরে মেজাজে আছে পৌষ। তার মন ভালো খারাপ হোক চায় নি তৌসিফ তাই যা করতে চাইছে তাই করতে দিচ্ছে। তৌসিফ টাউজারের পকেটে হাত ভরে তো একবার টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করার এক অব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। অধৈর্য হয়ে এবার পৌষ’র পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো ও। কাচ্চি শেষ পথে। সেদ্ধ ডিমগুলো দিচ্ছে মাঝে। এর পরের চাল দিতে দিতে পৌষ বললো,
— এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কাজ নেই আপনার? আপা কতদূরে?
তৌসিফ থতমত খেলো। ও তো চুপ করে এসে দাঁড়িয়েছিলো। পৌষটা এখন চালাক হয়েছে। সে তৌসিফে’র উপস্থিতি খুব সহজেই টের পেয়ে যায়। পৌষ হাতের কাজ শেষ করতে করতে টের পেলো খুব ধীরে সযত্নে কেউ তার পেটটা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে। আফসোস পুরোপুরি ধরা যায় না। পেটের ভেতর দুটো হানি লুকিয়ে আছে। তাদেরই আজ শখ জেগেছে বাবা’কে কাচ্চি খাওয়াবে। তাদের কথাতেই তাদের একমাত্র ফুপিকেও ডাকা হয়েছে। তাদের আরো ইচ্ছে আছে যা পেটে থাকতে থাকতে তারা পূরণ করবে। তৌসিফ মাথা ঝুকিয়ে রাখে পৌষ’র কাঁধে। আস্তে করে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— আর কতক্ষণ?
— হয়ে গিয়েছে।
— তাহলে চলো।
— কি দরকার?
— পৌষরাত দরকার।
— ওমা! আমি তো শুনেছি বাচ্চাকাচ্চা হলে জামাই এর আদর নাকি খাটের নীচে লুকিয়ে থাকে যা শুধু রাতে উথলে ওঠে কিন্তু আপনি তো দেখি এখনও বউ বউ করেন।
বলেই চাপা হাসলো পৌষ। দুধ ঢাললো চালের উপর। তৌসিফ অসন্তুষ্ট গলায় বললো,
— বেশি বুঝো তুমি। ফালতু কথাবার্তা সব। যার যাকে ভালোলাগে তার তাকে সবসময়ই ভালোলাগে।
— শুনেছি মন উঠে যায়।
— ওমন মন রাখার কি দরকার?
— হ্যাঁ, আমিও তো এটাই বলি। ওমন মনকে এক শার্ট মে’রে বুড়িগঙ্গায় ফেলা দরকার।
পৌষ’র কাজ শেষ। তৌসিফ যত্ন করে ওকে নিয়ে চুলার সামনে থেকে সরলো। সোফায় বসিয়ে ফ্যান ছেড়ে দিলো। পরণের জামাটা গলার দিকে বড়। তৌসিফ টেনে ধরতেই পৌষ ঝট করে চোখ খুললো। তার গাল দুটো ফুলে উঠেছে। সেই ফুলা গাল লাল হয়ে উঠেছে। তৌসিফ টিস্যু দিয়ে গলা মুছে একটু নিচে নামতেই পৌষ হাত ধরে ফেললো। তৌসিফ কপাল কুঁচকে তাকালো। বললো,
— কিহ?
— কিছু না।
— হাত ছাড়ো।
— উহু।
— কি সমস্যা?
— লজ্জা লাগছে।
তৌসিফ ফিক করে হেসে ফেললো। পৌষ’র হাত ছাড়িয়ে নিজের কাজ করলো। পৌষ চুপ করে রইলো। তৌসিফ ওর গালে দাবিয়ে এক চুমু খেলো। বললো,
— হয়েছে তো। আর লজ্জা পেতে হবে না।
পৌষ ঠোঁট ফুলাতেই তৌসিফ ঠোঁটে চুমু খেলো। পৌষ মুখ সরিয়ে বললো,
— খালারা ওখানে।
— আচ্ছা।
বলেই গলার স্বর উঁচু করে তাদের সরতে বললো। পৌষ হতভম্ব। এভাবে বলার কি হলো? ওর ভাবনার মাঝেই তৌসিফ আচমকা এক কান্ড ঘটালো। পৌষ ওর পিঠ আঁকড়ে ধরে। তৌসিফ যেন পেয়ে বসলো। তার হাত দুটো অবাধ্য হয়। পৌষ’র দম ফুরায়। তৌসিফে’র বুকে মৃদু ধাক্কা দিতেই ও একটু ছাড়লো পরক্ষণেই চেপে ধরলো।
তৌসিফে’র বুকে মুখ গুজে চুপ করে আছে পৌষ। তৌসিফ ওর মাথায় চুমু খায়। আদুরে হাত বুলায়। খেয়াল করে পৌষ ঘুমিয়ে গিয়েছে। এতটুকু সময়ে মেয়েটা ঘুমে কাদা। তৌসিফ জাগালো না বুকে নিয়েই বসে রইলো। পা তুলে সোফার উপরে রাখা। মিনুকে ডেকে পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে রাখলো। পায়ে পানি চলে এসেছে পৌষ’র।
কলিং বেল বাজতেই বুয়া এসে খুললো। তার মুখটা হাসি হাসি। তায়েফার থেকে ব্যাগ নিতেই ভেতর থেকে তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,
— কে এসেছে বুয়া?
— আপা এসেছে মামা।
তৌসিফ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তায়েফা ঢুকছে। বোরকা খুলে ভাইয়ের পাশে বসে ঘুমন্ত পৌষ’র গালে হাত রাখলো। তৌসিফ পাশ থেকে ওরনা দিয়ে পৌষ’র বুক ঢেকে দিলো। এই পোশাকের গলাটা বড়। তায়েফা ভাইয়ের সতর্কতা দেখে সন্তুষ্ট হলো। জিজ্ঞেস করলো,
— কি অবস্থা ওর? কাল রাতে নাকি কাঁদছিলো?
তৌসিফ ক্লান্ত হয়ে উত্তর করলো,
— হুটহাট কাঁদে আবার ঠিক হয়ে যায়। ওর বাবা নাকি স্বপ্নে এসেছিলো অথচ চেহারা ঠিকমতো মনে নেই। আল্লাহ জানে, কাকে দেখেছে। সকালে আবার মন ভালো দেখলাম। তুমি আসবে বলে কাচ্চি রেঁধেছে নিজ হাতে।
তায়েফা অবশ্য হাসলো। বললো,
— আমার জন্য নাকি তোর জন্য।
— মজা নিচ্ছো।
— নিতেই পারি। বউয়ের আদর খাচ্ছিস। মোটা হয়ে যাবি।
— মজা নিও না আপা। আমার চিন্তা হচ্ছে।
— আচ্ছা রে বাবা। ও ঘুমালো কখন? উঠবে এখন?
— ডেকো না আপা। ঘুমাক। বাচ্চা দুটো বেশি নড়ে তো তাই ব্যথায় কাঁদে মাঝমধ্যে।
— কি ভাবলি ঐ বিষয়ে?
তৌসিফ ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। সে তো আজকাল ভাবতে পারে না শুধু মন আর মস্তিষ্কের মাঝে যু’দ্ধ চলে। কেউ জিতে না আবার কেউ হারেও না। তৌসিফ ঝুলে যেন শুলের উপর।
তায়েফা ভাইয়ের চিন্তা বুঝে। পিঠে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলে,
— তুসু সোনা আমার, এত ভাবিস না। সব ঠিক হবে।
— চিন্তা এসে পরে আপা। ওর কিছু হলে?
— পা’গল কি হবে? বয়স, স্বাস্থ্য সবই ঠিক আছে।
— তবুও।
তৌসিফে’র চিন্তার যেন অন্ত নেই। সি সেকশন করাবে নাকি নরমাল তার সিদ্ধান্ত ও নিতে পারছে না। একদমই না।
বসন্ত আসাতে কৃষ্ণচূড়া গাছটায় কোকিল বসেছে। সেই যে ডাকাডাকি শুরু করলো থামার নাম নেই। পৌষ হাপিয়ে উঠেছে তবুও থামছে না। তৌসিফে’র হতভম্ব ভাব যেন কাটে না। কোকিল পাখিটা কু কু শব্দে ডাকছে। পৌষ শোনার পর থেকে পাখিটাকে বিরক্ত করতে মুখে কু কু শব্দ করছে। পাখিটা এতে ক্ষেপে গিয়ে আরো জোরে ডাকা ধরেছে। তৌসিফ এত থামাচ্ছে পৌষ থামে না।
বিকেলে পৌষ’র জোড়াজুড়িতে নিচে এসেছে ওরা। পুকুর পাড়ে বসেছিলো মাত্র। চারপাশে সুন্দর এক বাতাস। মিঠা অনুভূতি জোগানো এক বাতাস। তৌসিফ ভাবলো এতে বউটার মন ভালো হবে কিন্তু সে ভুলেই গিয়েছিলো তার বউ একটা ইতর-ভদ্র। তার রগে রগে ইতরামি। এখনও থামছে না। তৌসিফ এবার ধমক দিলো। পৌষ দাঁত বের করে হাসতেই তৌসিফ তাকিয়ে রয়। মেয়েটাকে এত সুন্দর দেখায় যা বলার বাইরে।
পৌষ জিজ্ঞেস করলো,
— এখানে মাছ নেই আর?
— আছে তো।
— ঐ দিন তুললো অনেক। আমি দেখেছি।
— হ্যাঁ বড় ভাই তুলেছেন।
— আমাদের দিলো না?
— চাষের মাছ আমার বউ-বাচ্চাকে খাওয়াব।
— একশত বার খাব।
— তাই? কে জানি মাছ দেখে আমার গায়ে বমি করেছিলো?
পৌষ তৌসিফে’র হাতে নাক ঘষে। বলে,
— একটু বমিই তো করেছি তুসু ভাই। বাবুরাতো হিসু করবে আবার পটিও করবে।
তৌসিফ হাসে শব্দহীনা। বুকে কেমন চিনচিন ব্যথা হয়। সুখ-দুঃখের মিশ্রিত ব্যথা। শব্দহীনা কান্না যাতে পানি দেখা যায় না আবার শব্দও হয় না।
পৌষ তৌসিফে’র এক হাত টেনে পেটে ধরে। তৌসিফ বলে,
— ভেতরে চলি?
— আরেকটু থাকি?
আবদার ফেলতে পারে না তৌসিফ। থাকে একটু। পৌষ ওর কাঁধে মাথা রাখে। নজর টলটলে পানিতে। আচমকা পৌষ জিজ্ঞেস করে,
— আপনি কি আমার উপর রেগে?
— পা’গল হলে? রাগব কেন?
— এই কয় মাস কত জ্বালালাম। হাত সরালেন কেন? পেটে রাখুন। ওরা বাবা’কে চাইছে।
— আমাকে রাগিও না পৌষ।
— শুনুন না?
— শুনছি।
— মীরা ভাবি থেকে মাফ চান। আমার কেমন ভয় লাগে। উনি যদি অভিশাপ দেয়? আমার বাবুর যদি কিছু হয়?
— ঠাটিয়ে চটকানা খাবে পৌষরাত? দিব? খাবে?
পৌষ চুপ করে যায়। মাথা তুলে কাঁধ থেকে। পেট থেকে হাত সরায় তৌসিফে’র। উঠতে নিলেই তৌসিফ শক্ত হাতে আটকায়। দেহটা জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে। নরম কণ্ঠে বলে,
— উল্টো পাল্টা কথা বলবে না হানি।
— বলব না।
— মুড ঠিক করো।
— করেছি।
তায়েফা আজ রাতে বিদায় নিলো। তৌসিফ ঘরে নেই। পৌষ ফোনে কথা বলছে শ্রেয়া’র সাথে। কথার মাঝে সে হাসছে বেশি। শ্রেয়া খুশি হলো। পরিকল্পনা কাল সবাই আসবে। ভিডিও কলের ওপাশে সবগুলো ঝুট ধরে আছে। শ্রেয়া মাঝেমধ্যে জ্ঞানবানী শোনাচ্ছে।
তৌসিফ দোতলায় আছে। তৌহিদ অবাক হয়ে দেখলো তৌসিফ মীরার কাছে মাফ চাইছে। মীরা’র চরিত্র বুঝা মুশকিল। ভালো তো ভালো আবার দুনিয়ার খারাপ।
তৌসিফ শুধু শেষে বললো,
— আমার সন্তান আর বউকে অভিশাপ দিও না মীরা।
তৌহিদ ভাইকে জড়িয়ে ধরে। পিঠ চাপড়ে ভরসা দেয়। তৌসিফ ফিরে আসতে দেখে পৌষ ফোন রাখছে। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে এসে পৌষ’র পাশে বসতেই পৌষ মুখ বাকিয়ে বলে,
— চটকানা মা’রবেন আবার তো ঠিকই গেলেন।
তৌসিফ বুঝলো মিনু সাংবাদিক জানিয়েছে পৌষ’কে। ও সামান্য হাসলো। পৌষ’কে ঠিকমতো বসিয়ে বুকে মাথা রেখে বললো,
— পুরো দুনিয়া থেকে হেরে তোমার কাছে এসেছি আমি পৌষরাত। আমাকে যত্ন করে রেখে দাও।
পৌষ তৌসিফে’র কপালে চুমু খেলো। চুলগুলো টেনে দিলো কিছুক্ষণ। তৌসিফ উঠে একটু পর। পানি আনতে বাইরে যেতেই হঠাৎ পৌষ জোরে ডেকে উঠলো। তৌসিফে’র কলিজা কাঁমড়ে উঠে। দৌড়ে যেতেই দেখলো মেঝের মাঝখানে পৌষ দাঁড়িয়ে। তৌসিফ’কে দেখেই চিল্লিয়ে উঠলো। বাজখাঁই কণ্ঠে বলে উঠলো,
— ওখানে কি করেন? তারাতাড়ি ধরুন আমাকে। হাসপাতালে যেতে হবে।
তৌসিফে’র দুনিয়া দুটো চক্কর মা’রলো। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পৌষ একাই ব্যাগে হাবিজাবি তুলছে। তৌসিফ দৌড়ে এসে ওকে ধরতে নিলেই পৌষ খেঁকিয়ে উঠলো,
— ছাড়ুন৷ ধরুন এসব। গাড়ি বের করান৷
— পেইন উঠেছে?
— না বিলাই, কুত্তা উঠেছে। এখনও ঠিক আছি, ঠিক থাকতে থাকতে আমাকে নিয়ে চলুন।
তৌসিফ ধ্যানে ছিলো। তার ধ্যান যেন ভাঙলো৷ না এটা স্বপ্ন না। সত্যিই হচ্ছে। তৌসিফ তারাতাড়ি বুয়া বলে জোরে ডাকলো৷ সারা বাড়ীর মানুষ উঠে পরেছে। তৌসিফে’র দুই ভাইও উঠে এসেছে। পৌষ’কে গাড়িতে তুলে তৌসিফ ওর সাথে বসলো। পৌষ যথেষ্ট স্বাভাবিক। হাসপাতালে সব রেডি।
পৌষ তৌসিফ’কে বুঝ দিতে নিলেই তৌসিফ ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। ফিসফিস করে কানে বললো,
— যেভাবেই হোক ভোমরা যাতে ফুলে আসে। ফুল অপেক্ষায় থাকবে।
পৌষ মৃদু হাসলো। তার ব্যথা বাড়ছে। মুখটা বিবর্ণ হয়ে আসতেই তৌসিফ ড্রাইভারকে ধমকে উঠলো। গাড়ি চলছে দ্রুত বেগে সেই সাথে দ্রুত বেগে ছুটছে তৌসিফে’র হৃদপিণ্ড। সময় কাটছে না অথচ পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে পৌষ’র চিৎকার। তৌসিফ দিশাহারা হয়। তার অবস্থা শোচনীয়।
প্রেমসুধা পর্ব ৭৩
হাসপাতালে পৌঁছানো মাত্র ডাক্তার পৌষ’কে নিয়ে চলে গেলো। পৌষ ওখান থেকেই চিৎকার জুড়ে তৌসিফ’কে ডাকছে। তৌসিফ’কে নার্স ডাকলেও তৌসিফ যেতে চায় না। তার সাহসে কুলায় না। হক বাড়ীর সকলে উপস্থিত হয়েছে।
তৌসিফ ভেতরে ঢুকতেই ওর হাত-পা ঝিম ধরে গেলো। দৌড়ে বেরিয়ে এলো। তৌফিক তালুকদার ভাইকে ধরে বসায়। সাহস জোগায়। তৌসিফ মানে না৷ দূর থেকে দেখে তায়েফা দৌড়ে আসছে। তৌসিফ মিনমিন করে “আপা” ডাকে। তায়েফা আসতেই ভাইকে জড়িয়ে ধরে। তৌসিফ চুপ করে যায়। কথা বলে না। ভেতরে থেকে তখনও কান্নার শব্দ আসছে। পৌষ কাঁদছে।