প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৬

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৬
সাইয়্যারা খান

বিয়ে বাড়ীটা মূহুর্তের মাঝে এক মৃত বাড়ীতে পরিণত হলো। হেমন্ত বাড়ী থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। তৌসিফের সাথে তার কথা হয়েছে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় অতঃপর আলোচনার শেষে ডাকা হয় তার তিন চাচাকে। তৌসিফ আকুতি না বরং আদেশের স্বরে শুধু জানায়,
“আগামী কাল দেখতে আসবে ওকে।”
চাচা তিনজনই বোধহয় বোধ হারা হলেন। ছোট চাচা শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। বড় চাচা মাথাটা নিচু করে রেখেছিলেন কিন্তু কিয়ংকাল বাদই বলেন,

” হঠাৎ এভাবে আমরা কিভাবে কি করব?”
তৌসিফ যেন শুনেও শুনলো না৷ বড়ই হেয়ালি তার কণ্ঠে। সে গম্ভীর মুখেই বললো,
“চোখ পড়ার ক্ষমতা আছে আমার। বাহির দেখে ভেতর পড়তে পারি। যথেষ্ট নাটক হলো আজ আর দেখার ইচ্ছে নেই। রাজনীতির মানুষ আমি। নাটক আর বাস্তবতা খুব ভালো করে জানি। আর হ্যাঁ, বিষয়টা আজ মোটেই ভালো হয় নি। আমার সম্মান জড়িয়ে এই ঘটনার সাথে সুতরাং ফলাফল বিশেষ ভালো হবে বলে আপনাকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না৷”
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ায় তৌসিফ। তুহিন গা ঝেড়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আগামী কাল দেখতে আসবো মেয়ে। মেয়েকে সাজিয়ে গুজিয়ে রাখবেন। তালুকদার বাড়ী থেকে লোক আসবে।”
আদিত্য ঠাই দাঁড়িয়ে। বারংবার তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। পৌষর সাথে তার দেখা করতে মন চাইছে। মেয়েটা একটু ভিন্ন। ছন্নছাড়া ধরণের। না জানি এতবড় এক অপবাদ কিভাবে মেনে নিচ্ছে? তার চাইতে বড় প্রশ্ন এখনও রয়ে যাচ্ছে। পৌষ সম্রাট বলতে অজ্ঞান সেখানে একই বাড়ীর, একই রক্তের ভাইকে বিয়ে কিভাবে করবে সে? কতটা মেনে নিবে? আদিত্য এতটুকু তো জানে যে পৌষ কতটা সিরিয়াস বিষয়টা নিয়ে।

তৌসিফরা আর অপেক্ষা করে না। বেরিয়ে যায় হক বাড়ী থেকে। এলাকা ততক্ষণে গমগমে। এই প্রথম তারা নারীঘটিত কেলেঙ্কারির সাক্ষী হয়েছে তালুকদার বাড়ীর মেঝ ছেলের। তুহিন নিয়ে নানান কথাবার্তা উঠলেও তৌসিফ নিয়ে এই প্রথম। ঘটনা রঙচঙয়ে তখন রঙিন৷ কেউ কেউ বিষদ বর্ণনা করছে। কেউ ঘটনা টেনেছে বিছানা পর্যন্ত। অবাক করা বিষয় তৌসিফে’র নাম মুখে ততটা ছিঃ ছিঃ হচ্ছে না যতটা হচ্ছে পৌষ’র। নিয়মানুযায়ী অবশ্য ঠিকই আছে। মেয়েদের দোষ বেশি। সেই যদি পৌষ হয় দোষটা বুঝি একটু বেশিই তার হয়। এই এলাকায় ভাড়াটিয়া কম বাড়ীওয়ালা বেশি। স্থানীয় মানুষজন সকলে। সেই সুবাদে বাড়ীতে ফোন আসছে। তাহমিনার কানে ঘটনা এসেছে ঘন্টাখানেক হলো। ও থম মে’রে বসে ছিলো। কথা বলে নি। মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছে,
“তৌসিফ একাজ করবে না।”

সাহারার বুকটা কেমন ধরফরিয়ে ওঠে। তৌসিফ সেদিন বাড়ীতে এসে শাহরিয়ারের বিয়ের বিষয়ে কথা বলে গিয়েছে একথা তিনি পরে জেনেছেন। খুশি বা অখুশি কোনটাই হন নি। তবে আজ তিনি সামান্য চিন্তিত কারণ তৌসিফ বলেছে বিয়ে করবে। ঘটনার সত্যতা এখনো ঝাপসা তাদের নিকট। ভাবনার মাঝেই বুয়া ছুটে এলো। জানালো,
“ভাইজানরা আসছে খালাম্মা।”
সাহারা তারাতাড়ি উঠলেন। সাথে উঠেছে তাহমিনা। পায়ে স্যান্ডেল দিয়েই কিছুটা দ্রুত পদচারণ করে এগিয়ে আসে ভাইদের কাছে। গেট দিয়ে তখন তিনভাই সিনা টানটান করে ধুকছে। তাহমিনা অপলক তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে। এই চাচাতো ভাই গুলোকে বেশ আদরে পেলেছে তারা কিন্তু কিছু একটা মাঝে এলো অতঃপর ধীরে ধীরে কিছুটা বদলে গেলো পরিস্থিতি। সালাম বিনিময় হতেই তৌসিফ বলে ওঠে,

“আপা কি স্বাগতম করতে দাঁড়িয়ে আছো?”
তাহমিনা গম্ভীর কণ্ঠে শুধু বললো,
“ভেতরে আয়।”
টিনসেডের এই বাড়ীটার মাঝখানে ড্রয়িং রুম। সাহারাকে তৌসিফ বুকে জড়িয়ে বসেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে,
“চাচিম্মা, তুমি কাঁদলে তো তুহিনও কাঁদবে। ছোট মানুষ না ও?”
সাহারা তৌসিফে’র বুকেই হাসলেন সামান্য। তুহিনের মুখে তখন চামচ দিয়ে ফিরনী তুলে দিচ্ছে তাহমিনা। সেধেছে থেকে খাবে বলে আর খাচ্ছিলো না, অগত্যা তাহমিনার খায়িয়ে দিতে হচ্ছে। এই তিন ভাই, বিশেষ করে ছোট দুটো মা ভক্ত ছিলো। মা নেই বলে যখন সুযোগ পায় তখনই চাচি আর চাচাতো বোন থেকে আদর লুফে নেয়। তুহিন তুরাগের গায়ে সামান্য হেলে খাচ্ছে। আরেক চমচ তার মুখে দিতেই বললো,

“পানি দাও আপা।”
পানিটুকু সে হাত দিয়ে পান করলো না। তাহমিনা ওর মুখের সামনে নিলো তো ও পান করলো। জানালো,
“আর খাব না।”
“কেন? বউ না করেছে?”
“নাহ। বউ রান্না করেছে না বাসায়? বারোটা বাজলো বলে। ওর সাথে একটু খাব।”
তাহমিনা কথা বাড়ালো না। কথায় কথা উঠবে তার চাইতে চুপ থাকা ভালো। তুরাগ নিজ হাতেই খেয়ে টেবিলে পিরিচ রাখলো। তৌসিফের দিকে তাকিয়ে তাহমিনা জিজ্ঞেস করলো,
” তায়েফা আসবে না?”
তৌসিফ ছোট্ট করে উত্তর করলো,
“হুট করে কি টিকিট পাওয়া যায় আপা?”
তায়েফা স্বামী, সন্তান নিয়ে আমেরিকা থাকে। বাকি দু’বোন স্বামী নিয়ে দেশেই আছে তবে এখানে না। তাহমিনা তৌসিফে’র হাতে ফিরনী দিতে দিতে বললো,
” তাহিয়া আর তিশা? ওদের জানিয়েছিস?”
তুরাগ উত্তর দিলো,

“না আপা। এখনো জানাই নি। আপনাকে আর চাচিম্মাকে আগে বলতে এলাম।”
তাহমিনা একটু ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো। বললো,
“তিশা যে বাড়ী মাথায় তুলবে সে খবর জানিস না? ওকে ফোন দে এখনই। রাত বারোটা বাজলো বলে। সকালে জানলে কান্ড ঘটাবে এখানে এসে।”
তুরাগ সম্মতি দিলো। সবার সামনেই আগে ছোট বোন তিশাকে ফোন দিলো। সংক্ষিপ্ত ভাবে জানাতেই ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলো তিশা। রেগেছে তা স্পষ্ট কিন্তু কাল যে ও আসবে সেটাও স্পষ্ট। তাহিয়া আবার শান্ত। একেবারেই শান্ত ধরণের। হালের শুরুতেও নেই শেষেও নেই। স্বামী নিয়ে শান্তিতেই থাকে। শুধু কমতি তার একটা বাচ্চার কিন্তু স্বামীটা খুবই ভালো এবং ভদ্র মানুষ। ওকে একবার বলাতেই হাসিমুখে জানালো, আসবে কাল। তৌসিফের দিকে তাকিয়ে তাহমিনা জিজ্ঞেস করলো,

“ঘটনা কি ঘটেছিলো বল তো? ঘটলেই বা কি? বিয়ে কেন করতেই হবে?”
তৌসিফ চোখে হাসলো। হালকা স্বরে উত্তর দিলো,
” মেয়েটার নামটা খুব বাজে ভাবে খারাপ হচ্ছিলো আপা। ভুল বললাম। হয়ে গিয়েছে। রাজার কালো ছেলে হয়েছে থেকে রাজার ছেলে কাক হয়েছে এই পর্যন্ত গড়িয়েছে ঘটনা৷ তুমি নিশ্চিত ঘটনা বিছানায় ধরা পড়া শুনেছো অথচ মেয়েটার সাথে আমার বেশ দূরত্ব ছিলো। কোনরূপ বিকৃত অবস্থায়ও ছিলাম না৷ তিনজন মহিলা খুললো অতঃপর যা ঘটে।”
তুহিন মাঝে ফোড়ন কেটে বললো,

“পুরাই নাটকীয় অবস্থা বুঝলে আপা। আমি, আদি তো নিচে। ভাই গেলো বাথরুমে এরপরই শোরগোল। গিয়ে দেখি কাহিনী ঘটে গিয়েছে। ভাই নাকি ধরা খেয়েছে তাও অতটুকু মেয়ে নিয়ে।”
তুহিন হাসছে। তৌসিফ তাকালো এক পলক ওর দিকে। তাহমিনা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো। বললো,
“কাল বিকেলে যাচ্ছিস?”
“জি, আপা।”
“আম্মা বাসায় থাকুক। তাহিয়া, তিশা চলবে সাথে। তোদের দু’টোর বউকে বলিস। তালুকদার বাড়ীতে অনেক বছর পর বিয়ে হচ্ছে। পুরো এলাকা জানুক, আমাদের তৌসিফকে বিয়ে করাচ্ছি।”
তুরাগের সাথে আরো কিছুক্ষণ আলাপ হলো। তৌসিফ সাহারার হাত ধরে তার হালহকিকত জিজ্ঞেস করলো। সাহারা বেশ অভিমান করে বললেন,

“ভুলেই তো যাস চাচিম্মার কথা।”
” ভুল বললে তো। তুমি কি ভুলার মতো কেউ। একটু ব্যাস্ত জানোই তো।”
“তোর সংসারটা দেখে যেতে পারলে খুব শান্তি পাব।”
“দেখবে, ইনশা আল্লাহ।”
“মেয়েটার ছবি নেই?”
তৌসিফ চাচির মাথায় দুইবার হাত বুলিয়ে বললো,
“আপাতত নেই।”

বাড়ীতে গমগমে অবস্থা। হেমন্ত সোজা উকিল নিয়ে বাড়ীতে ফিরেছিলো। ভীষণ কথা কাটাকাটির মাঝে হেমন্ত হুমকি দিয়েছে। নিজের সংসারও আলাদা করে নিবে ও। উকিল সামনে থাকায় ততটা কথা আগায় নি কিন্তু বাপ-চাচা সহ চাচিরা এটা বুঝে গিয়েছে পৌষ’র হক মা’রা যাবে না৷ হেমন্ত সবটা উসুল করবে।

পৌষর ঘরে ঢুকে হেমন্ত ওকে বাথরুমে গোসলরত অবস্থায় পেয়েছে। পিহা কোনমতে কাঁদতে কাঁদতে জানিয়েছে হেমন্ত যাওয়ার পর থেকেই পৌষ বাথরুমে। শ্রেয়া সহ হেমন্ত মিলে ওকে বের করেছে। এই যে এত কষ্ট করে ওকে বের করলো। হেমন্ত নিজ চোখে দেখলো পৌষ’র পানিতে ভিজতে ভিজতে লাল হওয়া দুটো চোখ। এই মেয়ে এখন ফাইজলামি করছে। ইনি, মিনি যদিও ঘটনা জানে বা বুঝে না কিন্তু এতক্ষণ বেশ কেঁদেছে কারণ ও দেখেছে পিহা সহ জৈষ্ঠ্য, চৈত্র কেঁদেছে। ফলাফলস্বরূপ দু’বোনও কাঁদলো কিন্তু এখন পৌষ’র সাথে মিলে বেশ দুষ্টামি করছে। হেমন্ত ওকে দেখে নিজের ঘরে গেলো। শ্রেয়া গোসল করেছে। হেমন্তও ক্লান্ত শরীরে গোসলে ঢুকলো। ওর অবস্থা দেখে শ্রেয়ার বুক ভেঙে কান্না পেলো। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হেমন্তের ভেতরের অবস্থা ভালো না৷ এতকিছুর মাঝে ও শ্রেয়াকে বলেছে বাবার বাড়ী যেতে। হেমন্ত আসবে দেখা করতে। শ্রেয়া যেতে পারে নি৷ যেই মানুষ গুলো ওকে এতটা ভালেবেসে আগলে রেখেছে তাদের ছেড়ে শ্রেয়া কিছুতেই যেতে পারে নি।
হেমন্ত বের হতেই শ্রেয়া ওকে খাটে বসালো। নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কি ভবলেন?”
ঠোঁট কামড়ে ধরে হেমন্ত। কি ভাববে সে? তার ভাবার মতো তো অবশিষ্ট কিছুই নেই। আগুনে পুড়ে ছাড়খাড় সব। ছাই গুলো এখন শুধু বাতাস পেলেই উড়বার পালা। শ্রেয়া ওর হাতটা শক্ত করে ধরতেই হেমন্ত বললো,
“তুমি কি রাগ করবে যদি এখন পৌষ’র কাছে যাই?”
“যদি বলি না?”
“তাহলে নিজেকে এই মূহুর্তে খুব ভাগ্যবান মনে হবে।”
“তাহলে আপনি ভাগ্যবান হেমন্ত।”

এক টানে শ্রেয়াকে বুকে জড়ায় হেমন্ত। শক্ত করে জড়িয়েই রাখে। শ্রেয়া টের পায় হেমন্তর বুক কাঁপছে। একটু বেশিই কাঁপছে। শ্রেয়া ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। হেমন্ত ধীরে ধীরে বললো,
“তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে শ্রেয়া। আমার আজ সারাটা দিন তোমাকে দেওয়ার কথা ছিলো। আমি বর হিসেবে ব্যার্থ হয়ে গেলাম।”
“সারা দিন আপনি আমার সাথেই ছিলেন হেমন্ত। ব্যার্থ হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।”
“তুমি আমাকে মাফ করে দিও। আমি জানি এই সময়গুলো খুব প্রিসিয়াস।”
“ঠিক কিন্তু আপনি আমার কাছে তার চাইতেও প্রিসিয়াস হেমন্ত, সাথে আপনার জড়িয়ে সকলে।”
হেমন্ত আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শ্রেয়াকে। আস্তে আস্তে বলে,
“ওর সাথে আজ কি হলো এটা শ্রেয়ু?”
প্রশ্নটা যেন শ্রেয়ার চোখে পানি আনলো। ও শুধু অপারগ হাতে হেমন্তের পিঠ বুলিয়ে দিলো।

সময়টা রাত দু’টো বেজে সাতাইশ মিনিট,
পৌষ’র ঘরে মেঝে জুড়ে বসেছে সকলে। কারো খাওয়া হয় নি। পৌষ একবার গলা উঁচু করে ডাকলো,
“হেমু ভাই, তুমি কি খাবে?”
ঘর দুটো পাশাপাশি কিছুটা। হেমন্ত ওখান থেকেই বললো,
“বউ আছে সাথে?”
“ছোঁচা মানুষ তুমি হেমু ভাই। বউ নিয়েই এসো।”
হেমন্ত আসলো মিনিট পাঁচ পরে। শ্রেয়া ওর পিছু পিছু ঢুকলো। বেশ অবাক হলো শ্রেয়া। পৌষ ইনি, মিনিকে খাওয়াচ্ছে। সবাই বড় এক বোল নিয়ে খেতে বসেছে। হেমন্ত বউ নিয়ে মাঝে ঢুকলো। খেতে বসে এদের খুনসুটি দেখে শ্রেয়া বেশ অবাক হয়। ওর ভাই-বোন নেই। এই ধরণের অভিজ্ঞতাও নেই। হেমন্তের বলা একটা কথা আজ মনে পরলো ওর। হেমন্ত বলেছিলো, “আমার পৌষটা ভিন্ন”। শ্রেয়া দেখলো। ভাবলো। আসলেই তো, পৌষ মেয়েটা ভিন্ন। একদমই ভিন্ন।

জৈষ্ঠ্য আর চৈত্র একদম চুপচাপ খাচ্ছে। পৌষ চৈত্র’কে খোঁচা দিতেই ও তাকালো। পৌষ ইশারায় কিছু বলতেই চৈত্র সামান্য হাসলো। মাথা নেড়ে সায় জানালো। পৌষ হাড় চিবুতে চিবুতে বললো,
” হেমু ভাই, তোমার বিয়ের খাবারটা কিন্তু একদম ঝাক্কাস হয়েছে।”
হেমন্ত নিজের হাতে গরুর গোস্ত থেকে গোস্ত ছুটিয়ে শ্রেয়াকে দিলো। সামান্য লজ্জা পেলো শ্রেয়া। হাড়টা পৌষ’র দিকে দিতেই পৌষ খুশি হলো। বোঝা গেলো সেটা। মেয়েটা হাড় বেশ পছন্দ করে।
খাওয়া শেষ হতেই আইসক্রিমের টাব নিয়ে ঢুকে চৈত্র। হেমন্ত দেখা মাত্রই ধমক দিলো,
“সবকটাকে চটকাব এখন? এত রাতে আইসক্রিম? যা রেখে আয়।”
পৌষ দাঁত বের করে হাসে। বলে,
“আজ তোমার বিয়ে সেই উপলক্ষে খাওয়া হচ্ছে। খেয়ে মোনাজাত ধরব। তোমার সংসারে আয় উন্নতি হবে।”
হেমন্ত চেনে ঢপবাজ পৌষ’কে। ও যেহেতু বলেছে খাবে এরমানে খাবেই। শুধু বললো,
“ইনি, মিনিকে এক চামচের বেশি দিস না।”
“কেন? এটা কি ঠান্ডার ঔষধ যে এক চামচের বেশি দেওয়া যাবে না?”
হেমন্ত চোখ গরম করে তাকালো। পৌষ তখনও একই ভঙ্গিতে হাসছে।
.
আকাশ পানে তাকিয়ে একটা সিগারেট শেষ করলো তৌসিফ। ভাবভঙ্গি বোঝা গেলো না ওর। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো খোলা মেঘে ঢাকা আকাশটার দিকে। বিষাক্ত ধোঁয়াও এখন আর নেই। স্পষ্ট দেখলো তৌসিফ বাড়ীর পেছন দিকে কেউ যাচ্ছে। ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আই মিস ইউ আম্মু।”

এক রাতের ব্যবধানে পৌষ’কে আজ দেখতে আসবে। কথাটা আবছা শুনেছে পৌষ। তাকে এসে বলার সাহস কেউ করে নি। আজ ভার্সিটি বন্ধ। শনিবার, ওর ক্লাস নেই। থাকলে একটু সুবিধা হতো। আদিত্য’র সাথে কিছু কথা আছে পৌষ’র। পিহা স্কুলে গিয়েছে। পৌষ রোজকার মতোই সব করলো। চাচিরা আজ একদম মুখে কুলুপ এঁটে আছেন৷ পৌষ’র ভালো লাগলো। মনে মনে বললো,
“এরা আজীবনকার জন্য বোবা হয়ে যেতো। আমি মসজিদের সামনে এক কেজি সাদা মিষ্টি বিলি করতাম। জানের উপর দিয়ে বালা টলতো আমার।”
নাস্তা শেষ করে বড় চাচা ডাকলেন পৌষ’কে। পৌষ নাস্তা খাচ্ছে তখনও। মাথা ঘুরিয়ে শুধু বললো,
“খেয়ে আসছি।”

বড় চাচা কথা বললেন না৷ সেঝ চাচার ভাবসাব বোঝা যায় না। ছোট চাচা মিনমিন করে বললেন,
“ভাই আরেকবার ভেবে দেখতেন।”
বড় চাচা কথা বললেন না। কাল তৌসিফের সাথে কথা হয়েছে। ভাবার মতো কিছু এখন পর্যন্ত তিনি পান নি।
দেখা গেলো পৌষ আর বড় চাচার সাথে দেখা করতেই গেলো না। ও জানে কি বলবে ওকে। হেমন্ত ভোরে বেরিয়েছে। তৌসিফদের বাসা থেকে মেহমনা আসছে। তাদের যত্নে তো আর ত্রুটি রাখা যায় না। বাড়ীতে ভরপুর আয়োজন। পৌষ একবার নেমে বাটিতে রোস্ট নিতে নিতে ছোট চাচিকে বললো,

“এভাবে যদি আমাকে খাওয়াতে ভীষণ সওয়াব হতো বুঝলে। এতিম খাওয়ালে সওয়াব বেশি।”
ছোট চাচি কিছু বললেন না। পৌষ রোস্ট নিজে নিলেও ছিড়ে ছিড়ে ভাই-বোনদের মুখে দিচ্ছে।
বিকেল পাঁচটার পর বাড়ীতে মেহমানের আগমন ঘটলো। যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করে তাদের বসানো হয়ছে। তাহমিনা সহ তাহিয়া আর তিশা বসেছে একদিকে। অপর পাশে মীরা। পলককে আনা হয় নি এখানে। তার সাথে উপস্থিত কারো সম্পর্কই ভালো না। তিন ভাই একসাথে বসেছে মাঝের সোফায়। তুরাগ প্রথমেই বললো,
“মেয়ে আনুন। সবাই দেখুক। কথা বলুক।”
হেমন্তর বুকটা একথায় ধক করে ওঠে। শ্রেয়ার দিকে তাকায় এক পলক। নিজেই যায় পৌষকে আনতে। অন্য কেউ আনতে পারবে বলে মনেও হচ্ছে না। হেমন্ত পৌষকে আনতে ঘরে ঢুকতেই দেখলো বিছানায় বসা সবগুলো একসাথে। পৌষ’র দিকে তাকিয়ে হেমন্ত ডাকলো,

“পৌষ?”
এক ভ্রুঁ উঁচু করে হাসলো পৌষ। বললো,
“আসতে হবে, তাই তো?”
“তুই আসবি?”
“আসছি।”
তেমন ভাবে সাজানো তো দূর পৌষ’কে কিছুই বলার সাহস হলো না হেমন্তর। শুধু এগিয়ে এসে বললো,
“মাথাটা ঢেকে চল। বড়রা আছে।”
পৌষ মাথা ঢাকলো। একসাথে ছয় ভাই-বোন ওর সাথে বেরিয়ে এলো ঘরটা থেকে। ওরা আসা মাত্রই সকলের নজর পড়লো। বেশ স্বাভাবিক ভাবে হেটে এলো পৌষ। নজরটাও নিচুতে নেই বরং এসে সবার দিকে তাকিয়ে দেখলো। তাহমিনা হাসলো চঞ্চল প্রকৃতির মেয়েটাকে দেখে। তাহিয়া নরম স্বরে বললো,

“এখানে এসো। তোমার নামতো পৌষ, তাই না?”
“জি।”
দ্বিধা ছাড়া উত্তর করে পৌষ। তুরাগ চোখের ইশারায় তাহমিনাকে মেয়ে দেখতে বলে। তাহমিনা পৌষ’র বড় চাচার দিকে তাকিয়ে সরাসরি বললো,
“মেয়েকে একাকী একটু দেখতে চাই। আমার বংশের রীতি এটা।”
“জি, জি আপা। দেখুন। জিজ্ঞেস করার কিছু নেই।”
পৌষ কপাল কুঁচকে তাকালো। সবার সামনেই বললো,
“যা দেখার তা তো দেখাই হলো আর কিছু তো বাকি নেই।”
পৌষ যথেষ্ট চঞ্চল একটা মেয়ে। তার এই প্রশ্ন শুনে কেউ ততটা অবাক হলো না বরং মীরা উঠে এসে পৌষ’র হাত ধরে হাসিমুখে বললো,

“মেয়েদের বিষয়ই তো। এসো।”
পৌষ ততটা পাত্তা দিলো না। তাহিয়া, তিশা সহ তাহমিনা উঠে দাঁড়ালো। বড় চাচি পৌষ’র ঘর পর্যন্ত দিয়ে এলেন তাদের। পৌষ আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে রইলো যখন দেখলো দরজাটার ছিটকিনি তুলে জানালা বন্ধ করা হচ্ছে।
পৌষর গা ঘিনঘিন করে উঠলো। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই মীরা চেপে ধরলো ওকে। কানে কানে শুধু বললো,
“আমাকেও দেখেছে। কোন ব্যাপার না।”

তাদের পাঁচ মিনিটও লাগলো না মেয়ে দেখতে। দরজার ছিটকিনি খুলে সবাই বেরিয়ে গেলেও ভেতরে বসে রইলো পৌষ। বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ, প্রতিক্রিয়াহীন। মাড়ি শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো ও। ওর বিধ্বস্ত মুখটা এক পলক দেখলো তৌসিফ। পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে মেয়েটার চোখ মুখ পরিবর্তন হয়েছে। পৌষ পেছন থেকে হেমন্তকে ডাক দিলো। হেমন্ত দেখলো লাল চোখ করে দাঁড়িয়ে আছে পৌষ। কপাল কুঁচকে দ্রুত যেতেই পৌষ চাপা স্বরে বললো,
“এখনই বলো কোন ভাবেই বিয়েটা হবে না।”

হেমন্তের ভেতরে অস্থির লাগে। সে নিজেও ততটা ইচ্ছুক না কিন্তু…? অনেকগুলো বিষয় তাকে নড়চড় করে দিয়েছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই পৌষ দাঁত চেপে বললো,
“আমাকে আলাদা করে কেন দেখবে? কোন সাহসে? আমি কি গরু? কুরবানী দিবে আমাকে?”
“আস্তে। সবাই দেখে এভাবে বাচ্চা। এমন করে না। তুই তো..”
“তুমি বুঝতে পারছো না হেমু ভাই।”

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৫

পৌষ’র গলার স্বর চওড়া হচ্ছে। ওপাশ থেকে সবাই তাকালো এদিকে। হেমন্ত এবার ধমক দিলো,
“চুপচাপ গিয়ে বসবি ওখানে। যা বলার পরে শুনব। দেখেছো তো কি হয়েছে?”
“আমাকে বিবস্ত্র করে দেখেছে হেমু ভাই।”
হেমন্ত থমকে দাঁড়ালো। গায়ের লোমগুলো কাটা দিলো যেন। অদ্ভুত এক চোখে তাকালো পৌষ’র দিকে। পৌষ তখনও শক্ত চোখে তাকিয়ে।

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৬ (২)