প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৫

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৫
সাইয়্যারা খান

সবার খাওয়া দাওয়া তখন শেষ দিকে। পৌষ নিজে বেড়ে খাওয়াচ্ছে। ওর পরিবেশনের হাত সুন্দর। তায়েফা মুগ্ধ চোখে দেখলো। তৌসিফের দিকে তাকাতেই তৌসিফও চোখে হাসলো। তিশার স্বামী চিংড়ি মালাই মুখে দেওয়ার পর থেকেই প্রশংসা করছে। তার বাচ্চা দুটোও বেশ প্রশংসা করে যাচ্ছে। বাচ্চাদেরটা কানে না লাগলেও তিশা নিজের স্বামীর উপর বেজায় ক্ষেপে যাচ্ছে। তিশা কি রেঁধে খাওয়ায় না? এত আদেখলাপনা করার মানেটা কি? এত বড় চিংড়ি পরপর দুটো গিলেছে। পৌষ এই প্রথম অদিতেকে কথা বলতে দেখলো। হাত ধুয়ে এসে ওর মায়ের সাথে কথা বলছে,

“তুমি এভাবে চিংড়ি রান্না করবে আম্মু৷ মজা লাগলো অনেক। মেঝ চাচ্চুকে বলে আমার জন্য একটা বাটিতে করে দিয়ে নিবে।”
মীরা মাথা নাড়লো। কথা সত্যি। মজা হয়েছে। শেষ সময়ে গিয়ে বাকি খাবারে সামান্য হাত লাগালেও চিংড়ি করেছে নিজ হাতে। তৌসিফকে হাজার বললেও ও খেতে বসে নি। পৌষরাতটা খায় নি। ওর সাথে খাবে। সবাই টেবিল ছেড়ে উঠছে একে একে। পৌষ গরুর ভুনা নিয়ে আদিত্যকে দিলো। ও জানে আদিত্য গরুর গোস্ত পছন্দ করে। তাদের কিছু বছরের খাপছাড়া বন্ধুত্বে টুকটাক জানাশোনা আছে। কেউ বিষয়টা আমলে না নিলেও নিলো তিশা। বাজপাখির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সন্দেহ হলো মনে। সেই সন্দেহ বাড়াতে পৌষ একটু ঝুঁকে আদিত্যকে কিছু একটা বললো। তিশা ফাটা চোখে তাকিয়ে রইলো। আজ হাতেনাতে ধরবে ও। তার ভাইয়ের সংসারে, তার ভাইয়ের খেয়ে এই মেয়ে লটরপটর করবে আরেকজনের সাথে, এটা তো চলবে না। তিশা রইলো তাকে তাকে। আজ যাওয়ার আগে ও দেখেই ছাড়বে কি এমন সম্পর্ক আদিত্য আর পৌষের।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তায়েফা বাদে বাকি সবাই চলে যাবে। এঁটো প্লেট বাটি বুয়াদের হাতে হাতে সরাচ্ছে পৌষ। সবাই গেলে একেবারে খেতে বসবে। পৌষ গ্লাস ভরে ঠান্ডা বরফ দেওয়া লেবু পুদিনার শরবত বানিয়ে বুয়া দিয়ে পাঠালো। ভারী খাবারের পর স্বস্তি পাবে। এই ছোট ছোট বিষয় গুলো সবাইকে ভীষণ মোহিত করছে তা বুঝাই যাচ্ছে। পৌষকে তখন খুঁজছিলো সালামি দিবে বলে। তিশা এসেই দেখলো বুয়াদের সাথে নেই। তিশা তারাতাড়ি এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলো বারান্দায় দুটো ছায়া দেখা যাচ্ছে। ছায়া দু’টো ছুঁইছুঁই অবস্থা। তিশা হঠাৎই চিৎকার করে সবাইকে ডেকে ওঠে। ওর বিকট চিৎকারে বারান্দা থেকে পৌষ আর আদিত্য বেরিয়ে আসতে আসতেই বাকি সবাই উপস্থিত সেখানে। বুয়ারা সহ একত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি হয়েছে কেউ জিজ্ঞেস করার আগেই তিশা মুখ বিকট করে বললো,

“তুমি আদির সাথে এই রাতে বারান্দায় কি করছিলে? আমি দেখেছি। আমার ভাতিজাকে ফুসলে ফাসলে…”
কেউ কিছু বুঝার সুযোগ পেলো না। পৌষ এগিয়ে এলো। তার হাতেও চারকোণাকার একটা কাঁচের গ্লাস। লেবু পুদিনার সেই শরবত তাতে ভরা। পৌষ সবাইকে বেয়াক্কেল করে দিয়ে তিশার মুখে ছুঁড়ে মারলো সেই শরবত। ঝাঁঝাঁলো কণ্ঠে বললো,
“কি করবেন? কি করবেন আপনি? দেখে না এনেছেন আমাকে? একবার ধরা খেয়েছি তাতে আপনার ভাইয়ের বউ হয়েছি। এখন কি করবেন? ভাতিজার সাথে আবার বিয়ে দিবেন নাকি…”
“পৌষরাত!”

তৌসিফের ধমক শোনা গেলো। তুরাগের সাথে অন্য পাশে কথা বলছিলো বিধায় শুনে নি। তিশার গলা এমনিতেই চওড়া। চিল্লাচিল্লি করতেই থাকে। একটু পাঁজিও বটে। ওর চিৎকার শুনেও দুই ভাই এসেছে আস্তেধীরে কিন্তু পৌষের কথাবার্তার স্বর একটু জোরে শুনেই তৌসিফ দ্রুত এসেছে। অপ্রীতিকর কথা শুনে ধমকটা দিয়েছে। পৌষ দমলো না। যেই পরিস্থিতিতে কয়েকদিন আগেও পরেছিলো সেই একই পরিস্থিতিতে পরেছে আজ আবার। সেদিন পরিচিত, অপরিচিত সবাই ছিলো। আজ সবাই পরিচিত কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন না। পৌষ দমলো না। রাগে হিসহিসিয়ে উঠলো,
“কি পৌষরাত? কিসের পৌষরাত? আপনার বোনকে ডাকুক। তার মুখের জোর কমাতে বলুন। আপনার সাথে ধরা খেলাম এখন আদির সাথে খেয়েছি। প্রথমবার ধরায় বিয়ে হলো এবার শাস্তি কি হবে আমার?”
তৌসিফ কিছু বলার আগেই তায়েফা তিশার গালে জোরে একটা থাপ্পড় দিলো। তিশা ‘আপা’ বলে ডেকে উঠতেই তায়েফা আরেকটা চর দিয়ে বললো,

“আপা ডাকবি না। তোর এই আচার-আচরণ আমার কোন কালেই পছন্দ না। যেদিন এসব ছাড়বি সেদিন আপা ডাকবি। তোর সাহস কি করে হয় এরকম কথা বলার? তোর বড় ভাইয়ের বউ হয় পৌষ।”
তিশা বুঝলো আপা শুনবে না। তৌসিফের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মেঝ ভাইয়া আমি নিজে দেখেছি…”
ওর কথা শেষ করার আগেই তৌসিফ বাম হাত তুলে থামতে ইশারা করলো। তিশার চোখ ভরে উঠলো পানিতে। তুরাগ সামলে নিলো সবটা। জানালো গাড়ি বের হয়েছে। তিশার স্বামী লজ্জিত ভঙ্গিতে তৌসিফকে বললো,
“ভাইয়া একটু শুনে যেতেন।”

তৌসিফ খুব স্বভাবিক ভাবে জানালো সে আসছে। একে একে সবাই সরে যেতেই তৌসিফ টিস্যু বক্স থেকে দুটো টিস্যু টেনে নিলো। তিশার মুখটা সুন্দর করে চেপে চেপে মুছে বললো অতিশয় ঠান্ডা স্বরে,
“আমার বউ তোমার বড় ভাবী হয় তিশা। তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবে। তোমার থেকে নিতান্তই বয়সটা কম। রাগ একটু বেশি। তাই মুখে শরবত ছুঁড়েছে। আমি হলে কিন্তু আপার মতো দুটো না বরং তোমার বলা প্রতিটা তাচ্ছিল্য করা শব্দের বিপরীতে চর দিতাম। আমার বউকে কিছু বলা মানেই আমাকে বলা। পর থেকে খেয়াল রাখবে। এখন মাফ চেয়ে যাও।”
মুখটা মুছা শেষ। তৌসিফ ছোট বোনের কপালে চুমু খেলো। তিশা টলমল চোখে পৌষের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি দুঃখীত পৌষ।”

তিশা যেতে চাইলেই তৌসিফ থামালো। বোনের হাত ধরে রেখেই বললো,
“পৌষরাত আমার বউ হওয়ার আগেই আদিত্যর বন্ধু। ওরা কথা বলতেই পারে।”
“জি, মেঝ ভাই।”
“সাবধানে যেও।”
তিশা মাথা নাড়ে। তাহিয়া পৌষকে আদর করে বিদায় জানিয়ে চলে যেতেই আদিত্য তৌসিফের সামনে দাঁড়িয়ে মাথাটা নিচু করে বললো,
“স্যরি চাচ্চু।”
তৌসিফ ওর পিঠ চাপড়ে বিষয়টা হালকা করে। মীরা যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলো তখনই পৌষ ডাকলো,
“বড় ভাবী।”
মীরা দাঁড়াতেই পৌষ বললো,

“একটু দাঁড়ান।”
তৌসিফ গেলো তৌসিফের কাছে। ও তখন নিচে যাচ্ছে সবাইকে গাড়িতে তুলতে। পৌষকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ। চিংড়ি মালাই খেয়ে অদিতি বড় ভাবীকে বলছিলো যাতে বাসায় নিয়ে যায়। আমি কি দিয়ে দিব?”
তৌসিফ পৌষের দিকে তাকিয়ে রইলো একটু। মাত্রই না রেগে ছিলো? এত মাতৃ সুলভ পৌষরাতটা? এই নরম তো এই শক্ত। শুধু মাথা নেড়ে বললো,
“দাও। আর অনুমতির প্রয়োজন নেই।”

পৌষ হেসে চলে গেলো। দিতে পেরে ও খুশি। তৌসিফ একটু শ্বাস ফেললো। বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।
পৌষ যখন হাসিমুখে মীরার হাতে বাটিটা দিলো তখন মীরা মনে মনে চমকালো। এমন একটা পরিস্থিতিতে পৌষের এত সুন্দর আচরণে মীরা একদমই আশা করে নি৷ শুধু ছোট একটা ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। সবাই চলে যেতেই পৌষ ঝাড়ু নিয়ে সোফা ঝাড়ছে। বুয়া ছুটে আসতেই পৌষ বললো,
“খালা আপনি নাহয় হাঁড়ি-পাতিল গুলো ধুয়ে ফেলুন।”
বুয়া কিছু বলতে পারলো না। পৌষ পুরো ঘর ঝাড়ু দিয়ে যখন ময়লা তুলছে তখনই এসেছে তায়েফা। পৌষের দিকে তাকিয়ে ডেকে বললো,

“পৌষ সোনা আপার কাছে আয় তো।”
“আসছি আপা।”
পৌষের মনটা বেশ ফুরফুরা৷ আজ পর্যন্ত হেমন্ত বাদে কেউ ওর জন্য প্রতিবাদ করে নি৷ আজ করেছে। তায়েফা আপা করেছে। তৌসিফ করেছে। বাকিদের কারো মুখেও পৌষ সন্দেহ দেখে নি। সাদা মনটায় তায়েফার জন্য কাদাটাও নেই এখন৷ হাত ধুয়ে পৌষ বসলো তায়েফার কাছে। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
“চা আনি আপা? রাতে চা খান?”

তায়েফা টেনে বুকে জড়ালো ওকে৷ মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“তিশার কথা মনে নিস না একদম। ওর মুখটা ছোট থেকেই বেশি চলে। কিছু মনে করিস না৷”
“করি নি। আমি তো উত্তর দিয়েছি।”
“বেশ করেছিস। আজ আপা চা করে দিচ্ছি।”
“আমাদের সাথেই থাকুন না আপা।”
“তুরাগটা বড় না? এত আবদার করছে। এসেছি তো তোর জন্য সোনা৷ থাকব আবার।”

পৌষের কথার ঝুলি খুললো। তায়েফা গিয়ে চা বানাচ্ছে। পৌষ ওর পিছুপিছু সেখানে গিয়ে কথা বলছে। তায়েফা হেমন্তের কথা জানতে চাইছিলো শুধু। সেখান থেকে শুরু হয়েছে পৌষের নানান কথা। দু’জনই খেয়াল করে নি তৌসিফও দাঁড়িয়ে পেছনে। পৌষের এই উচ্ছাস দেখে কিছুটা শান্তি পেয়েছে। নাহয় বউ তার আজ মাত্র রাগ ছাড়লো। আবার যদি রেগেই থাকে তাহলে তৌসিফের বেশ বেগ পেতে হতো।
দু’জন রান্না ঘরেই চায়ে আড্ডা দিচ্ছে। তৌসিফ ফ্রেশ হয়ে এসেই ডাকলো,
“পৌষরাত, খেতে এসো।”
পৌষ চায়ের কাপ হাতেই এসেছে। নিজের কাপটা টেবিলে রেখে গেলো খাবার আনতে। এসেই আশ্চর্য হয়ে তাকালো। ওর এঁটো চা তৌসিফ পান করছে। পৌষ কটমট করে বললো,
“কি ভাই, আপনি আমার চা নিলেন কেন?”
“মন চাইলো।”
“ফেরত দিন।”

তৌসিফ দিলো। পৌষ শেষ করে খাবার বেড়ে দিচ্ছে দেখে তৌসিফ ওর হাত ধরে পাশে বসালো। তায়েফাকে তুরাগ বারবার ফোন দিচ্ছে। তায়েফা বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। পৌষ ঠিক মতো খাচ্ছে না। তৌসিফ নিজের প্লেট থেকে খাবার নিয়ে লোকমা তুলে ওর মুখে দিচ্ছে। পৌষ না করে নি। তৌসিফ মনে মনে হাসলো। শুধু মাত্র ওর হয়ে কথা বলায় এতটা সহজ হবে তৌসিফ ভাবে নি৷ বউ পটাতে ততটাও বোধহয় বেগ পোহাতে হবে না৷ পৌষের মনটা একটু খারাপও বটে। তার ভাই-বোন গুলো যদি থাকতো। ওদের যদি একটু খাওয়াতে পারতো। এমন না ওরা না খেয়ে থাকে কিন্তু হাজার হোক বোনের মন। পৌষ মানাতে পারছে না। খাবার গুলোর স্বাদ পাচ্ছে না।

রাত তখন দুইটা বেজে একত্রিশ মিনিট,
তালুকদার পেছন থেকে বামে গেলেই বাঁশঝাড়। সেই বাঁশঝাড় বরাবর চারদিকে চারটা রাস্তা। সেই ঝাড়ের মাঝে সাদা কাপড় পরিহিত এক নারী নামাজ পড়ছে। টানা কতক্ষণ নামাজ চললো তার অতঃপর হাতে থাকা দুটো তাবিজ গেড়ে দিলো সেখানে। ধবধবে সাদা জমিদারি ভাবপূর্ণ নারীটি হেঁটে হেঁটে এগিয়ে এলো সম্রাটের বাগান বাড়ীর দিকে। প্যানেল দরজা খুলে পেঁচানো সিঁড়ি দিয়ে গেলো তার নিদিষ্ট গন্তব্যে। সেখানে থাকা পুরুষটাকে ডাকলো,
“ভাইজান?”

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৪

শুয়ে থাকা ব্যাক্তির চোখ খুলতে চায় না৷ বহু কষ্টে চোখ খুলে বোনকে দেখে মাথাটা তার কোলে তুললো। তাহমিনা ভাইয়ের পিঠ হাতড়ে দিলো। নরম স্বরে বললো,
“ভাইজান, খাবেন না?”
“না।”
“আম্মা আপনার কথা বলছে বারবার। দেখতে চায়।”
কথাটা শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না পুরুষটি। তাহমিনা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাহমিনা এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো বন্ধ ঘরটার অন্ধকার দেয়ালে। মনে মনে বললো,
“A small mistake can change the whole game. Also a small piece can rebuilt it.”

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here