বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৮
ইশরাত জাহান
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত।এখন ঘুমানোর সময়।জানালা দিয়ে বাতাস আসায় পর্দাগুলো নড়ছে।একটা শান্ত অথচ গুমট পরিবেশ।ঘরের ভেতর টেবিলের ল্যাম্পটা নিভে রেখেছে কিছুক্ষণ আগেই।দর্শন বিছানার এক পাশে হেলান দিয়ে আধা শোয়া মুখটা তীক্ষ্ণ ও চোখে বিরক্তির করে রেখেছে।ঠিক এমন সময় ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে দিলো শোভা।সাদা নরম সুতির কাপড়ের ঢিলাঢালা সালোয়ার কামিজ ও মুখে বড় হিজাব দিয়ে নিকাব পরা।শোভা ভেতরে পা রাখলো চোখেমুখে স্পষ্ট জেদ।বিয়ে মানিনা বলা অব্দি ঠিক কিন্তু তাকে কথায় কথায় বিনা কারণে অপমান করলে আজ সেও থেমে থাকবে না।পা টিপে টিপে এসে দাড়ালো বিছানার পাশে।দর্শন আড়চোখে দেখে ঠান্ডা গলায় বলল,“ফিরে যাও।এই বিছানায় তোমার কোনো জায়গা নেই।”
শোভা দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ চুপ করলো।তারপর সাহসিকতার সাথে নিশ্বাস নিয়ে গলা শক্ত করে বলল,“আপনি যাই বলেন আমি আজ এখানেই ঘুমাবো।পিঠে ব্যথা করছে আমার।কাল সারারাত ব্যালকনির মেঝেতে কাঁথা পেতে ঘুমিয়েছি।আজ আর না।”
দর্শন উঠে বসল।চোখে আগুন,চোয়াল শক্ত করে বলল,“আমার জীবনে জোর করে কিছু হয় না।আমি তোমাকে আমার জীবনের সাথে যুক্ত করবো না।সেই আশা রেখোনা মেয়ে।বের হয়ে যাও ঘর থেকে সাথে আমার জীবন থেকে।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
শোভা এবার আর সহ্য করতে পারলো না।সেও উত্তর দিলো,“আমি আপনার বিয়ে করা বউ।যেভাবেই হোক বউ।যদিও বিচ্ছেদের কথা উঠছে কিন্তু বিচ্ছেদ এখনও হয়নি।যতদিন না বিচ্ছেদ হয় আমাদের একসাথে এক ঘরে থাকার প্রতিশ্রুতি ধরে রাখতে হবে।আপনি চাইলে ওই কোণায় ঘুমাবেন আমিও এই কোণায় কিন্তু আমাকে বারবার আঘাত করে কষ্ট দিতে চাইলে ভালো কিছু হবেনা।এই ঘরে এই বিছানায় আমার এখন অধিকার আছে।চাইলেই সরিয়ে দিতে পারবেন না আমাকে।”
দর্শন চোখ রাঙিয়ে তাকালো শোভার দিকে।মেয়েটা মুখ চালাচ্ছে তার সাথে!ব্যাপারটা সাহসিকতার হলেও দর্শনের মগজে অপমান বাড়িয়ে দিলো।তার মুখে মুখে তর্ক মানতে নারাজ।তাই বলে,”আমি তোমার বয়সে বড়।বড়দের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না?”
“বড় হলে কি হবে?স্বামী তো স্বামীই হয়।বয়স দেখলে তো মানুষ সুগার ড্যাডি বিয়ে করে হানিমুন লাইভ দেখাতো না।”
দর্শন চোখ বড় বড় করে বলে,“তুমি ঐ থার্ডক্লাস ভিডিও ফলো কর!ছিঃ,এই জন্যই তো তোমাদের মত মেয়েরা ভালো কোনকিছু অনুসরণ করতে পারেনা।”
“এই আপনি রাতে ঘুমানোর ব্যাপারে কথা বলুন।আমি কি দেখি ওগুলো নিয়ে না।”
কথা-কাটাকাটির জোর বেড়েছে ক্ষণে ক্ষণে।ধীরে ধীরে তর্কের তীব্রতায় ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। হঠাৎই দর্শনের মাথায় চেপেছে রাগ।আর মুহূর্তেই সে বসিয়ে দিল ঠাস করে শোভার গালে।তীব্র ঝাঁকুনিতে শোভা দুপা পিছিয়ে গেল।তারপর আবার নিজেকে সামলে সামনে এসে চোখ রাঙিয়ে বলল,“আপনি আবারও আমাকে মারলেন?ঠিক আছে!এবার আপনাকেও বুঝিয়ে দেবো কিন্তু ঘর আমি ছাড়বো না!”
কোনো আগাম ঘোষণা ছাড়াই সে পাশে রাখা একটা বালিশ তুলে সজোরে ছুঁড়ে মারল দর্শনের গায়ে।আরেকটা আঘাত করতে নিয়ে বলে,“এই নিন! এখন বুঝুন মার একা দিতে নেই মার পালটাও খেতে হয় !”
দর্শন প্রথমে থমকে গেলেও পরমুহূর্তেই শোভার হাত থেকে বালিশ নিয়ে শোভার দিকেই পাল্টা আঘাত করে বলে,“তুমি পাগল হয়ে গেছো বুঝি?এই নাও, এটাও খাও!”
শুরু হয়ে গেলো এক ভয়ানক অথচ হাস্যকর বালিশ-যুদ্ধ।একজন আরেকজনকে বালিশ দিয়ে মারতে থাকে।কেউ কারো সিদ্ধান্ত বদলাবে না।দর্শন মানবে না শোভাকে নিজের বিছানায় আর শোভা জানে খুব ভালো করে এই ঘর ছাড়া তার কোথাও জায়গা নেই তাই এই বিছানায় তাকে ঘুমানোর অধিকার করে নিতে হবে।আচমকা বালিশ যুদ্ধের মধ্যে তুলা বেরিয়ে বিছানার চারদিকে ভেসে উঠেছে। তুলার ঝাঁপি যেন একেকটা সাদা পাখির মতো ওড়াউড়ি করছে বাতাসে।শোভা একবার দর্শনের মাথায় বালিশ ঠেসে ধরে।দর্শন পাল্টা শোভার কোমরে বাড়ি দেয় বালিশ দিয়ে।
দর্শন ক্ষোভ দেখিয়ে বলে,“এই নাও তোমার অধিকার!”
শোভাও পাল্টা আঘাত দিয়ে বলে,“আর এটা আপনার অহংকার!”
“এই যে কষ্টের পিঠের বদলা!”
“আর এইটা ঘরের শান্তির কফিন!”
রাগ আর তুলোর ঝড় মিলেমিশে ঘরটা যেন এক নাট্যমঞ্চ হয়ে উঠলো।শেষে দুজনেই হাঁপাতে হাঁপাতে বিছানায় বসে পড়লো।শোভা চোখ বন্ধ করে বলল,“এখন অন্তত একটা বালিশ দিন।একটু শান্তিতে ঘুমাবো।”
দর্শন ক্লান্ত গলায় বলল,“সব বালিশ তো মরেই গেল!”
শোভা চোখ খুলে হেসে ফেলল।মনে মনে বলে,“তাহলে আপনার বুকেই মাথা রাখবো।”
দর্শন তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।শোভার মুখ দেখতে পায়না।শোভার মনের কথাও শুনতে পায়না।শোভা দেখেছে দর্শনকে অল্পসল্প।অন্ধকার ঘরটিতে চাঁদের আলোয় যতটুকু সম্ভব আর কি।তাও তো স্বামীর দেহের গড়ন ও মুখের কিছু আকৃতি বুঝতে পারছে।দর্শন একটু ভেবে ধীরে বলে,“আরে না!এক মিনিট!একটা অর্ধমরা বালিশ আছে।এই নাও।”
শোভা বালিশ দেখে বলে,“ছোট ছোট দু টুকরো তুলা এটা মাথায় দিলে তো ঘুম আসবেই না।”
দর্শন ভ্রু কুঁচকে বলে,“তুমি আমার ঘরে এসে আমার একেকটা জিনিস নষ্ট করে দিচ্ছ।”
“আমি না ওগুলো আপনি নষ্ট করেছেন।”
“হ্যাঁ কিন্তু কারণটা তুমি।”
আবারও কথাকাটাকাটি করে শেষে দুজনেই হাঁপিয়ে পড়ে।শোভা কাতর গলায় বলে,“এখন তো বালিশে তুলা নেই।এবার বিছানায় ঘুমাতে দিন।ব্যালকনিতে পিঠের সাথে মাথটাও এবার যাবে।”
দর্শন চোখ শান্ত করে বলে,“শুধু ঘুমাতে সুযোগ পাবে।বেশি কিছু চাইবে না তো?”
শোভা চোখ বড় বড় করে তাকায়,“হ্যাঁ চাইব।একটা আরামদায়ক বালিশ!”
“ওটা তুমিই নষ্ট করেছো।আরামদায়ক বালিশ খুঁজছে আরেকজন!আমার আরামদায়ক বালিশ পাচ্ছি না উনি আসছেন নিজের জন্য খুঁজতে।”
শোভা কথা বাড়ালো না।চুপ করে শুয়ে পড়ল এক কোণায়।দর্শনের চোখ গেলো সেদিকে।শোভা চোখ বন্ধ করতে করতে বলে,“আমাদের দুজনের এক হয়ে থাকাটা নসিবে লিখিত ছিলো।তাছাড়া যাকে চিনিনা যাকে দেখিনি তাকে আচমকা নিজের করে কেন পেলাম?যদিও আপনি মানেন না কিন্তু আপনি একদিন বুঝবেন ভাগ্য নির্ধারণ করা থাকে।সেখান থেকে পালানো যায়না মিস্টার দর্শন ফিরাজি।”
দর্শন চুপ করে শুনল।রাগ বাড়ছে না তার।মেয়েটার কথার মধ্যে আছে নমনীয় কিন্তু আত্মবিশ্বাস।মেয়েটার দুইটা গুণ দর্শন পেয়েছে।এক সে নামাজ পড়ে পর্দা করে আর দুই সে আত্মবিশ্বাসী।দর্শনের আচমকা মেয়েটার মুখ দেখতে ইচ্ছা হলো।ইচ্ছা করছে পাশে শুয়ে থাকা এই মেয়েটাকে নিজের চোখে দেখার।গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের চাওয়াকে দমিয়ে রাখে।শোভা চোখ খুললো দর্শনের গলা খাঁকারি শুনে।মুখ টিপে হেসে বলে,“আপনার বয়স নাকি সবে সাতাস?আমার তো আঠারো।নয় বছরের বড় হয়ে নিজেকে কি আমার কাকু বা দাদু ভাবছেন?যদি ভাবেন তাহলে কাল থেকে স্বামীকে কাকু বা দাদু বলে সম্বোধন করবো।”
দর্শন ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,“বাজে না বলে ঘুমাও।নাহলে এই রাতে পাঁজাকোলা করে বাইরে ছুঁড়ে মারবো।”
শোভার মুখটা শুকনো হয়ে গেলো।পাঁজাকোলা করে নিজের কাছে আনে,তা না করে বাইরে ছুঁড়ে ফেলবে।শোভা উঠে বসে বলে,“ধমকাচ্ছেন আমাকে!আপনি কে যে আপনাকে ভয় পাবো?”
“আমার জায়গায় পৌঁছাতে পারবে তুমি?”
“কেন পারবো না?কি করেছেন কি জীবনে?”
“অনেক স্ট্রাগল করেছি।অনার্স পড়াকালীন নিজের প্রতিষ্ঠান শুরু করার উদ্যোগ নেই।বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের পাশে নিজের প্রতিভা দেখিয়েছি বড় বড় বিজনেসম্যানদেরকে।এই চারটা বছর আমি বাইরে শুধু পড়াশোনা করে শেষে এসে ব্যবসা করার সুযোগ পাইনি কঠোর পরিশ্রমের ফল এগুলো।রাতে পড়াশোনা দিনে ব্যাবসা নিয়ে আলোচনা করে আমি নিজেকে আজ সাকসেসফুল করেছি।এমনি এমনি সফলতা আসেনা বুঝেছো মেয়ে?সফলতা আনতে গেলে কঠোর পরিশ্রম লাগে।আমার এই জায়গাটায় এসে তারপর বলবে আমি কে?”
শোভা আহম্বক হয়ে গেলো।এই লোক নিজের পরিশ্রমের ভাষণ শুরু করলো!শোভাও কম না।তাই সে বলে,“আমার একটা পরিচয় আছে।”
বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৭
“কি?”
“আমি এক রাগী গন্ডার বাজে লোকের বউ।যে আজ অব্দি নিজের বউকে বুঝে নি কিন্তু দুইবার থাপ্পড় দিয়েছে।”
কথাটুকু বলেই শোভা উল্টোদিক ফিরে শুয়ে কানে হাত রাখলো।কোনো কটুবাক্য শুনবে না সে।দর্শন বলেওনি কারণ সে কিছুই বুঝেনি।কিন্তু যেই বুঝলো চোখ বড় বড় করে তাকালো শোভার দিকে।