ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৬
তাজরীন ফাতিহা
চারপাশ নিস্তব্ধ। শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে আশেপাশে। শহরের নিরিবিলি এক স্থান। পরিত্যক্ত গোডাউনের চারদিকে বিরাট গাছগাছালি। কোনো শব্দ নেই আশেপাশে তবুও নিঃশব্দ এক কম্পন হেঁটে আসছে অদূর থেকে। কালো কাপড়ে আবৃত দুটো ছায়ার আবির্ভাব হলো গোডাউনের সামনে। চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করে ধূর্ত নজরে গোডাউনে প্রবেশ করলো তারা। প্রথম ব্যক্তিটি নিজের সাথের ব্যক্তিটিকে ইশারা করে চাপাতি হাতে একটি রুমে প্রবেশ করলো। তারপর ধীর কদমে হেঁটে দড়ি দিয়ে বাঁধা লোকটার সামনে দাড়ালো।
“ধর্ষণ করেছিস?”
হিমশীতল ও ভারিক্কি কণ্ঠটি বলে উঠলো। দড়ি দিয়ে বাঁধা লোকটি ছটফটিয়ে উঠলো। তার সামনে মানুষ নয় স্বয়ং মৃত্যু দাঁড়িয়ে। কালো কাপড় দিয়ে মোড়ানো মুখটা। চোখ দুটো ভয়ংকর দেখাচ্ছে। ব্যক্তিটির হাতে চাপাতি। আস্তে আস্তে হেঁটে লোকটার সামনে বসলো। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললো,
“খুব মজা ছিল, তাই না?”
লোকটা অনবরত মাথা নাড়াচ্ছে। কালো কাপড়ে আবৃত ব্যক্তিটি চাপাতি লোকটার গ্রীবাদেশে ঠেকিয়ে বললো,
“কথা বলছিস না কেন? মাথা ঠিক থাকে না মেয়ে মানুষ দেখলে?”
লোকটা হাত জোর করে বললো,
“আমাকে মাফ করুন স্যার। আমার হুঁশ ছিলো না।”
কৃষ্ণবস্ত্রে আবৃত মুখটি হেঁসে উঠে ভয়ংকর চাহনি নিক্ষেপ করলো। হাসি থামিয়ে ফ্লোরে বারি দিয়ে বললো,
“হুঁশ ছিল না? আজকের পর থেকে হুঁশ আসবে। Burn in hell, you beast’s spawn!”
বলেই এক কোপ বসালো পুরুষাঙ্গে। লোকটা ভয়ংকর চিৎকার করতে লাগলো। সামনের ব্যক্তিটির এতে সামান্যতম মায়া কাজ করলো না। আরও তিনবার একই জায়গায় কোপ দিয়ে পুরুষাঙ্গ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। তারপর এক কোপে হাত দুটো কেটে ফেললো। লোকটা চোখ উল্টে গলা কাটা মুরগির মতো কাতরাতে কাতরাতে একসময় স্থির হয়ে গেলো। চাপাতি চালানো ব্যক্তিটি লাশের পাশে বসে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আল্লাহর কসম, মায়ের জাতির দিকে যে কুলাঙ্গার হাত বাড়াবে তাদের শাস্তি শুধুমাত্র যন্ত্রণাদায়ক বিভৎস মৃত্যু। এবার জাহান্নামে গিয়ে আজন্ম শাস্তি ভোগ কর।”
বলেই ব্যক্তিটি পিছনের ব্যক্তির দিকে চাইলো। চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনের। তারপর কোড ল্যাংগুয়েজে পরস্পরের কথা বিনিময়। দুজনেই মুচকি হাসলো।
পরদিন খবরের পাতায় দুটো নিউজ প্রকাশ পেলো।
” গোডাউনে বিশিষ্ট শিল্পপতির বিভৎস মরদেহ উদ্ধার।”
“বাস চালক ও হেলপার উভয়ের অঙ্গবিহীন ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার।”
সারাদেশে খবরটি তোলপাড় হয়ে গেলো। খবরটিতে কেউ কেউ খুশি হলেও আতঙ্কিত হয়েছে কিছু কিছু মানুষ। কারো কারো ধারণা খারাপদের দমন করতে মহান ব্যক্তির আগমন ঘটেছে শহরে আবার কারো ধারণা শহরে মারাত্মক খুনির আগমণ ঘটেছে। সময় বলে দিবে কারা এই মর্মান্তিক খুনের পিছনে দায়ী। কি তাদের উদ্দেশ্য আর কিই বা তাদের লক্ষ্য?
প্রকৃতি আজ তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। ভীষণ ঝড় হয়েছে বিকেলে। চারপাশের প্রকৃতি গুমোট। দ্যুলোক আজ তিমিরে আচ্ছাদিত। নিশাত ফোন হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত কাঁপছে। একটু আগের শ্রবণকৃত ঘটনা তাকে নিশ্চল করে দিয়েছে। কানের পাশে বোলতার মতো খালি একটা কথা বেজে চলছে,
“মানহার বিয়ে হয়ে গেছে।”
একটু আগে নিশাত তার শ্বশুর মাহাবুব আলমকে কল দিয়েছিল। ফোনটা ঠিক করে এনেছে দুপুরে। তিনদিন ধরে আত্মীয় স্বজনদের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন প্রায়। তাই সাংসারিক সকল কাজ গুছিয়ে রাতের এই নিরিবিলি সময়টায় শ্বশুর আব্বাকে ফোন দেয় সে। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে ভালো মন্দ কথা বললো। তারপরই মাহাবুব আলমের বোমা ফাটানো সংবাদে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে সে।
“শোনো নিশাত মা, তোমাদের তো ফোন দিয়ে পাইনি কয়েকদিন। খবরটা শুনে হয়তবা অনেক কষ্ট পাবে, আমার সিদ্ধান্তে রুষ্ট হবে তবুও কিছু করার ছিল না। তোমাদের সাথে অসংখ্যবার যোগাযোগ করতে চেয়েছি কিন্তু সক্ষম হয়নি।”
নিশাত অল্প হেঁসে বলেছিল,
“কষ্ট পাবো কেন বাবা? আপনার উপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। আপনি বলুন।”
মাহাবুব আলম একটু ইতস্তত করে একনাগারে বললেন,
“মানহার বিয়ে হয়ে গেছে। চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে। দেখতে এসেই আকদ করিয়ে গেছে। খবরটা মারওয়ানকে জানিয়ে দিও। ওকে তো ফোন করলে পাই না। তোমরা কি বাড়িতে আসবে?”
নিশাতের মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছিল। এই সংবাদ শুনবে কল্পনাও করেনি। মানহার বিয়ে হয়ে গেছে শোনার পর আর কোনো সংবাদ তার মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে নি। মারওয়ানকে এই খবরটা কিভাবে দেবে সে? তার তো এখনই হাত, পা অনবরত কাঁপছে। কি ঘটবে সামনে?
মারওয়ান শান্ত ভঙ্গিতে ভাত খাচ্ছে। নাহওয়ান বাবার কোলে বসে আছে। ছেলেকে এক লোকমা খাইয়ে নিজে এক লোকমা মুখে পুরলো মারওয়ান। নিশাত অনবরত ঘামছে। লোকটা এখন যেমন শান্ত ভঙ্গিতে ভাত খাচ্ছে একটু পর এতো শান্ত থাকবে কি? আজকে ঘরে সুনামি না বয়ে গেলেই হয়। নাহওয়ান আলু হাতে নিয়ে খাচ্ছে। নিজে একটু খেয়ে বাবার দিকে বাড়িয়ে দিলো। মারওয়ান নাহওয়ানের ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুলে কামড় দিয়ে আলু খেলো। নাহওয়ান বাবাকে নিজের আঙ্গুল খেতে দেখে বললো,
“বেতা, বেতা আঙুল কাও কেনু? আলু কাও।”
“না তোকে খাবো। আমার আলু তেমন পছন্দ না, তোর আঙ্গুল গুলো জবরদাস্ত।”
“জবল ডাস্ট?” নাহওয়ান নিজের আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো।
মারওয়ান হো হো করে হেঁসে দিলো। নিশাতের দিকে চেয়ে বললো,
“এসব কথা কিভাবে বলে আমার ছাও?”
বলে আবার হাসলো। নিশাত হালকা হাসার চেষ্টা করলো। আজকে বাপ, বেটার খুনসুটিতে তার হাসি আসছে না। ঘেমে উঠছে একটু পর পর। মারওয়ানের এদিকে খেয়াল নেই। সে ছেলের সাথে খুনসুটিতে মত্ত। নাহওয়ান গেঞ্জিতে ঝোল ভরিয়ে ফেলেছে। এটা দেখে মারওয়ান বললো,
“ঝোল মাখিয়ে ফেললি দেখি। মার দিবো।”
নাহওয়ান গোল গোল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“না।”
“তাহলে শান্ত বাচ্চার মতো ভাত খা।”
“কাই।”
বলেই ফিচ করে হেঁসে দিলো। একটা আলুর টুকরোতে কামড় দিয়ে আবার আয়েশ করে খেতে লাগলো। ভাত খাচ্ছে কম আলু খাচ্ছে বেশি। বাচ্চাটার আলু অনেক পছন্দের। মারওয়ান নিশাতকে ভাত হাতে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলো?”
নিশাতের মস্তিষ্কে কথাটা পৌঁছুলো না। সে একমনে ভাতের দিকে তাকিয়ে আছে। মারওয়ান আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“ভাত খাচ্ছো না কেন?”
নিশাতের ভাবনা চ্যুতি ঘটলো। সে মারওয়ানের দিকে চাইলো। মারওয়ান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নিশাত ঘাড় নাড়িয়ে বললো,
“নাহ, খাচ্ছি তো।”
মারওয়ান আর কিছু বললো না। ছেলেকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে উঠলো। নিশাত খাবার খেয়ে অনেকক্ষণ পর রুমে গেলো। দেখলো মারওয়ান ছেলেকে বুকের উপর নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে। বাচ্চাটা বাবাকে আঁকড়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে। ছেলে যখন গভীর ঘুমে মগ্ন সেসময় নিশাত মারওয়ানের উদ্দেশ্যে আস্তে করে বললো,
“আপনার সাথে একটু কথা ছিল?”
মারওয়ান চোখের পাতা খুলে তাকালো। বললো,
“এতো রাতে কিসের কথা? ঘুমাও।
নিশাত ইতস্তত করতে করতে বললো,
“কথাটা গুরুত্বপূর্ণ।”
মারওয়ান বিরক্তসূচক শব্দ করলো। ছেলেকে বুক থেকে সাবধানে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। ফুলো ফুলো ঠোঁটের গোড়ায় চুমু খেয়ে উঠে দুই পাশে কোলবালিশ দিয়ে বর্ডার করে দিলো। তারপর বসে বললো,
“কি বলবে বলো। শুনি তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথা।”
নিশাত ঢোঁক গিলতে লাগলো। তার মুখ দিয়ে কথা বেড়োতে চাচ্ছে না। মিনমিন করে বললো,
“অন্যরুমে চলুন।”
মারওয়ান এবার সাংঘাতিক বিরক্ত হলো। আশ্চর্য একটা কথা বলতে এখন অন্যরুমে যেতে হবে কেন? তার মাথায় হঠাৎ কিছু খেলে গেলো। তাই নিশাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি কি আমার সাথে সময় কাটাতে চাচ্ছো নাকি?”
নিশাত চোখ মুখ গম্ভীর করে মারওয়ানের দিকে চাইলো। বললো,
“আজাইরা, ফালতু কথা বলবেন না। কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই অন্যরুমে যেতে বলেছি। আপনি অন্য মিনিং বের করছেন কেন? আপনার সাথে সময় কাটাতে চাইবো কোন দুঃখে? আপনি যাবেন কি যাবেন না?”
মারওয়ান আড়মোড়া ভেঙে বললো,
“চলো যাই। যদি গুরুত্বপূর্ণ কথার সাথে কিছুমিছু আদর, আপ্যায়ন পাই মন্দ হয়না।”
নিশাত আবারও শক্ত চোখে চাইলো। মারওয়ান কুটিল হেঁসে অন্যরুমে যেতে লাগলো। পিছন পিছন নিশাতও চললো। ছেলেকে আরেকবার দেখে পাশের রুমে গেলো। মারওয়ান শীষ বাজিয়ে বিছানায় বসলো। নিশাত পাশে বসে বললো,
“মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনবেন। দয়া করে এই রাতের বেলা রিয়েক্ট করবেন না। মাথা ঠাণ্ডা রাখবেন। ওয়াদা করুন।”
মারওয়ান ভ্রুকুটি করে বললো,
“কি এমন কথা যে ওয়াদা করতে হবে?”
“আপনি করুন। তারপর বলছি।”
মারওয়ান নিতান্ত দায়সারা ভাবে ওয়াদা করলো। তারপর পা দুটো নাড়াতে লাগলো। নিশাত গলা খাঁকারি দিয়ে ধীরে ধীরে বললো,
“আজকে বাবাকে ফোন করেছিলাম।”
মারওয়ান ঠ্যাং নাড়াতে নাড়াতে বললো,
“তো?”
“আরে শুনুন আগে। কথা বাড়তি বলবেন না।”
মারওয়ান কিছু বললো না। নিশাত এক নিঃশ্বাসে বললো,
“বাবা বলেছেন, মানহার বিয়ে হয়ে গেছে।”
মারওয়ান আগের মতোই ঠ্যাং নাড়িয়েই যাচ্ছে। নিশাত অবাক হলো। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই কেন? নিশাত বললো,
“আপনি আমার কথা শুনেছেন?”
“হ্যাঁ শুনলাম।”
“কি শুনলেন?”
“তোমার বাবা ফোন দিয়ে বলেছেন তোমার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে সেটাই শুনলাম।”
নিশাত ভারী আশ্চর্য হলো। এই লোক নিজের বোনের নামও কি ভুলে গেছে? এ কেমন ভাই? রাগ নিয়ে বললো,
“মানহা আমার বোন কবে থেকে হলো? আর আমার বাবাকে আমি বাবা কবে ডাকলাম? তাকে আমি আব্বু ডাকি। বিড়ি টানতে টানতে জ্ঞান বুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলেছেন?”
মারওয়ানের পা নাড়ানো বন্ধ হয়ে গেলো এক নিমেষের মধ্যে। এতক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ঠ্যাং নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা শুনছিল তাই অতটা গুরুত্ব দেয়নি কিন্তু যখন মস্তিষ্ক সিগন্যাল দিলো কোথাও ভুল হচ্ছে তখনই টনক নড়লো তার। মানহা? মানহা তো তার বোন। সে চোখ উঠিয়ে এমনভাবে চাইলো নিশাতের বুকে কাঁপুনি ধরে গেলো। মারওয়ান বললো,
“কার বিয়ে হয়েছে?”
নিশাত ঢোঁক গিলে বললো,
“মানহার।”
মারওয়ান কি রিয়েক্ট করবে সেটাই ভুলে গিয়েছে। রোবটের মতো বললো,
“কবে হয়েছে?”
“তিনদিন আগে।”
মারওয়ান এতো পরিমাণে বিস্মিত হলো যে কথা মুখ দিয়ে বেরোলো না। থম মেরে বসে রইলো। খানিকক্ষণ পর বললো,
“কার সাথে হয়েছে?”
“মানে?”
“বিয়েটা কার সাথে হয়েছে?”
বরফশীতল কণ্ঠের প্রতিউত্তর। নিশাত বিমূঢ় কণ্ঠে বললো,
“ইয়ে মানে কি যেন নাম আপনাদের চেয়ারম্যানের ছেলের? তার সাথে।”
মারওয়ান পাথরের মতো জমে শক্ত হয়ে আছে। না নড়ছে আর না কিছু বলছে। নিশাতের ভয় লাগছে। যেন ঝড় আসার আগের প্রকৃতির শান্ত, নিস্তব্ধ রূপ। মারওয়ান বেশ অনেক্ষণ বসে থেকে আস্তে করে উঠে চলে গেলো। নিশাত অবাক হলো মারওয়ানের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখানোতে। সেও পিছুপিছু গিয়ে দেখলো মারওয়ান কপালে হাত দিয়ে শুয়ে পড়েছে। ছেলেকেও আজ ধরেনি। নিশাত বুঝলো লোকটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। তাই আর ঘাটলো না। তাকে একা ছেড়ে ছেলেকে জড়িয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।
সকাল সকাল বাসে করে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে মারওয়ান, নিশাত ও তাদের ছানা। প্রায় চার বছর পর গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে তারা। নিশাতের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। নাহওয়ান মায়ের কোলে বসে পা দোলাচ্ছে। নাহওয়ান এই প্রথম দাদা বাড়ি, নানা বাড়ি দেখবে। বাসের দুটো সিট কাটা হয়েছে। নিশাত জানালার ধারে ছেলেকে নিয়ে বসা আর পাশে মারওয়ান গম্ভীর বদনে কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে। বোঝাই যাচ্ছে অনেক চিন্তিত সে।
কালকে সারা রাত এক ফোঁটাও ঘুমায়নি লোকটা। রাত তিনটের সময় তাকে ডেকে বলে জামা কাপড় গুছিয়ে নিতে। সকালের বাসে নাকি গ্রামে যাবে। নিশাতের চোখে মুখে ঘুমের রেশ তখনও কাটে নি। তাই মারওয়ানের কথা তার কানে ঠিক করে ঢোকে নি। পরে মারওয়ানের ধমকে ঘুম ছেড়ে জামা, কাপড় গোছাতে লেগে গিয়েছিল সে। সব কিছু গুছিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে জিকির করতে করতে ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছিল। নামাজ পড়ে ছেলেকে উঠিয়ে রেডি করিয়েই খালি পেটে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। পরে বাস কাউন্টারে পাউরুটি আর কলা খেয়েছে তারা। নিশাত স্কুলে ফোন করে এক সপ্তাহের ছুটি চেয়ে নিয়েছে। বাস চলছে। নিশাতের মাথা ভার ভার হয়ে আসতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ পর মারওয়ানকে বললো,
“শুনুন, আমার বমি আসছে। একটা পলিথিনের ব্যবস্থা করে দিন আর ছেলেকে ধরুন।”
মারওয়ান ঝটপট বাসের সামনে থেকে পলিথিন নিয়ে এসে নিশাতকে দিলো। ছেলেকে কোলে নিয়ে নিশাতের মাথা চেপে ধরলো। নিশাত বমি করে হেলান দিয়ে মাথা ফেলে বসলো। মারওয়ান আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
“টক জাতীয় কিছু খাবে?”
“না এখন কিচ্ছু খাবো না। ভালো লাগছে না। একটু ঘুমাবো।”
“আচ্ছা, ঘুমাও।”
বলে নিশাতের মাথা টেনে তার ঘাড়ে এনে রাখলো। নাহওয়ান মাকে ঘুমোতে দেখে বাবার দিকে চাইলো। মারওয়ান ওর চাহুনি দেখে বললো,
“তুই ঘুমাবি লিলিপুটের ছাও?”
“হু।”
“তাহলে ঘুমা। ডিস্টার্ব করবি না খবরদার নাহলে আছাড় দিয়ে ভুঁড়ি বের করে ফেলবো। মাথা বহুত গরম আছে। ঘুমা।”
নাহওয়ান বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“বুলি বেল কলে পেলবে?
“হ্যাঁ।”
“বুলি নাই।”
“আছে।”
“কুতায়?
“বললাম না আছে পটলের বাচ্চা। এতো কথা বলিস কেন?
“আচ্চা গুমাই।”
বলেই বাবার বুকের উপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। মারওয়ান স্ত্রী, সন্তানকে আগলে রেখে পুরোটা জার্নিতে সামনে তাকিয়ে রইলো।
মাহাবুব আলম টিউবওয়েল চেপে গোসল করছিলেন। মানহা কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে বাবাকে সরিয়ে কোনো কথা না বলে কল চাপতে লাগলো। মাহাবুব আলম মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বাবার উপর রেগে আছো মামণি?”
মানহা কল চাপতে চাপতে বললো,
“না।”
মাহাবুব আলম হাত, পা ডলতে ডলতে বললেন,
“তোমার মা, দুই ভাই রেগে ফায়ার হয়ে আছে। আমার সাথে কোনো কথা বলছে না। এখন তোমার বড় ভাইয়ের আপডেট জানতে পারলে ষোলো কলা পূর্ণ হবে।”
মানহা কিছু বললো না। বালতি পানিতে ভরে বাবার পিঠ সাবান দিয়ে ডলে বললো,
“আব্বু, আপনি ওই কথাটা না বললে আমি জিন্দেগিতেও এই বিয়েতে রাজি হতাম না। লোকটাকে আমার কেন যেন পছন্দ না। কথাবার্তাও ভালো লাগে না। বিয়ে হয়েছে ঠিক আছে কিন্তু ওই লোক যেন ত্রিসীমানায় না আসে।”
মাহাবুব আলম হেঁসে দিলেন মেয়ের কথায়। মাহদী, মাহফুজ তাদের বাপ বেটির হাসি মজায় চরম বিরক্ত হলো। দুই বাপ মেয়ে ভিতরে ভিতরে কি পাকাচ্ছে কে জানে?
এরমধ্যে বাড়ির গেটে জোরে বারি পড়লো। মাহদী, মাহফুজের টনক নড়লো। মাহফুজ মুখ বিকৃত করে বললো,
“ওই চেয়ারম্যানের পোলায় আসছে মনে হয়। মন চায় টানা পিটাইয়া বাড়ির নাম, ঠিকানা ভুলাইয়া দেই। দেখেলেই রাগ উঠে।”
মাহদী বললো,
“মাথা ঠাণ্ডা কর। ওর মতিগতি বুঝে কঠিন একটা বাটনা বাটতে হবে। বহুত চালাক ভাবে নিজেরে। বুদ্ধি খাটিয়ে ওর এই বিয়ের পিছনের মতলব বের করতে হবে। যা গেট খুলে দিয়ে আয়। ওর জামাই আদর খাওয়াচ্ছি।”
মাহফুজ মাথা নাড়িয়ে হেলে দুলে গেট খুলে দিলো। খুলেই ঝটকা খেলো যেন। সামনে মারওয়ান দাঁড়িয়ে। মাহফুজ অবাক স্বরে বললো,
“বড় ভাইয়া!”
মারওয়ান বললো,
“এমন রিয়েকশন দিয়েছিস কেন? সামনে থেকে সর। তোর ভাবি পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। তোদের দেখলে অস্বস্তি বোধ করবে।”
মাহফুজ যন্ত্রের মতো সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো। মারওয়ান ভিতরে ঢুকে দেখলো মাহদী উল্টো দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। সে ডাক দিলো,
“মাহদী!”
মাহদী পরিচিত কণ্ঠে নিজের নাম শুনে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো মারওয়ান দাঁড়িয়ে আছে। বেশ অবাক হয়েছে। মারওয়ান বললো,
“হা করে ক্যাবলার মতো তাকিয়ে আছিস কেন দুইজন? ব্যাগ গুলো ধর। বাচ্চাটাকে ধর। এমন ভাব করছিস মনে হচ্ছে জীবনেও আমাকে দেখিস নি।”
মাহদী হুঁশে ফিরে মাকে ডেকে উঠলো। মায়মুনা বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নিজের বড় ছেলেকে দেখে ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসলেন। ছেলেকে মন ভরে আদর করে বললেন,
“আমার মানিক। আমার বুকের মানিক গ্রামে আসছে? ও আল্লাহ আমার সন্তান আমার বুকে ফিরে এসেছে। তোমার কাছে লক্ষ কোটি শুকরিয়া মাবুদ।”
বলে মারওয়ানের চোখে, মুখে, কপালে চুমু খেলেন তিনি। মাহদী ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মাহফুজ ভাইয়ের কোল থেকে নাহওয়ানকে নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। বাচ্চাটা বাবার গলা শক্ত করে জড়িয়ে আছে। বেশ ভয় পাচ্ছে বাচ্চাটা। একসাথে এতো মানুষ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছে সে। নিশাত পিছনে দাঁড়িয়ে মা, ছেলের ভালবাসা দেখছে। ইতোমধ্যে এতো শোরগোলে মানহা, মাহাবুব আলম হাজির হয়েছেন। মানহা বড় ভাই, ভাবিকে দেখে দৌঁড়ে গেলো। ভাবির অস্বস্তি হচ্ছে বুঝতে পেরে ঘরে নিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে মাহাবুব আলমের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে গেছে নিশাত। মারওয়ান ছেলেকে মায়ের কোলে দিয়ে বাবার কাছে গিয়ে বললো,
“ভালো আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ ভালো রেখেছেন। তুমি কেমন? এই অধম বাবা, মায়ের কথা এতদিনে মনে পড়লো তাহলে?”
“ভালো তো থাকবেনই। মানহার ব্যাপারে আপনার এই সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ কি?”
“তুমি আমার কাছ থেকে জবাব নিতে ঢাকা থেকে গ্রামে এসেছো?”
মারওয়ান কঠোর ভঙ্গিতে বললো,
“যখন সিদ্ধান্তটা আমাকে না জানিয়ে নেয়া হয় তখন আমি অবশ্যই আপনাকে তা জিজ্ঞেস করার অধিকার রাখি।”
“তা অবশ্যই রাখো। তবে এসেছো যখন আস্তে ধীরে সব জানতে পারবে। তবুও এই সিদ্ধান্তের জন্য যে গ্রাম মুখী হয়েছো এতেই আমি আনন্দিত। এবার হাত মুখ ধুয়ে বিশ্রাম নাও। জার্নি করে এতো প্রেশার মাথায় নিতে হবে না।”
কথাটা বলে মাহাবুব আলম মায়মুনা বেগমের থেকে নাতিকে কোলে নিলেন। নাহওয়ান দাদাকে দেখে কোলে গেলো। এতগুলো মানুষের মধ্যে দাদাকে সে ভালো করে চেনে। কারণ দাদাকে ঢাকায় প্রায়ই দেখেছে সে। বাকিদের সাথে তার অতটা ঘনিষ্ঠতা নেই। মাহাবুব আলম নাতির সাথে কথা বলতে বলতে ঘরে চলে গেলেন। মাহদী ব্যাগ নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। মাহফুজ বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“চলো ভাইয়া। ঘরে চলো।”
মায়মুনা বেগমও সায় জানালেন তাতে। ছেলেকে নিয়ে ঘরে চলে গেলেন।
পাটিতে বসে ভাত খাচ্ছে মাহবুব আলমের পুরো পরিবার। আজকে তাদের পরিবার স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিশাত একমাত্র এখানে নেই। সে ভিতরের ঘরে বসে ভাত খাচ্ছে। যেহেতু দেবররা গায়রে মাহরাম সেহেতু দেবরদেরকে সে কখনোই মুখ দেখায় না। মাহদী, মাহফুজও ভাবির সামনে যায়না। মাহফুজের কোলে নাহওয়ান বসে বসে পোলাও আর মাংস খাচ্ছে। মাহফুজ গোশত ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাচ্চাটার মুখে দিচ্ছে। বহুত কসরত করে ভাতিজাকে কোলে নিয়েছে মাহফুজ। তার কোলে আসবে না বলে কান্না করে দিয়েছিল বাচ্চাটা। তারপর রোস্টের হাড্ডির লোভ দেখিয়ে কোলে নিয়েছে সে। আজকের আইটেমের কোনো কমতি নেই। পোলাও, রোস্ট, গরুর গোশত ভুনা, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, শাক ভাজি, শিং মাছ দিয়ে মিষ্টি কুমড়ার ঝোল, রুই মাছের কালিয়া। বিরাট আয়োজন খানাপিনায় আজ। নাহওয়ান বাবার কোলে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলো। মাহফুজ বললো,
“আমার কাছে থাকেন আব্বা। বাবার কোলে তো সারাবছর আর সারাদিন থাকেন এবার একটু চাচ্চুদের কোলে থাকেন।”
নাহওয়ান মোচড়ামুচড়ি করতে করতে বললো,
“ইননা। বাবা…।”
বলে মারওয়ানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। মারওয়ান এক হাত দিয়ে ছেলেকে নিতে গেলে মায়মুনা বেগম চট করে নাতিকে কোলে তুলে নিলেন। নাতিকে আদর করতে করতে বললেন,
“বাবাকে খেতে দেন দাদুভাই। আমার মানিকটা কতদিন পর খাচ্ছে দাদি দেখে একটু মন জুড়াই। কতদিন দেখি না আমার মানিকটাকে। আপনি দাদুর কোলে থাকেন ভাই।”
নাহওয়ান বাবার কোলে যেতে না পেরে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো। মারওয়ান দ্রুত উঠে এক হাতে ছেলেকে কোলে নিলো। মায়মুনা বেগম বললেন,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৫
“মাগো মা! বাবার পাগল দেখি আমার দাদু ভাই।”
মাহদী তাল মিলিয়ে বললো,
“একদম।”
নাহওয়ান হাত উঁচিয়ে তাদেরকে দেখিয়ে বললো,
“মাইল দিবো।”
বাচ্চাটার পাকা পাকা কথা শুনে মাহাবুব আলমের পুরো পরিবার হেঁসে দিলেন।