ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৭

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৭
তাজরীন ফাতিহা

উঠোনে তিনভাই চেয়ারে বসে আলাপ আলোচনা করছে। মারওয়ান মাঝের চেয়ারে গম্ভীর হয়ে ছোট দুই ভাইয়ের কথা শুনছে এবং মাঝেমাঝে প্রতিউত্তর করছে। মাহদী মানহার বিয়ের সমস্ত ঘটনা বিশদভাবে বর্ণনা করে থিতু হলো। মারওয়ান সমস্ত ঘটনা শুনে নিশ্চুপ রইলো। মাহফুজ বললো,
“ভাইয়া, বাবার কার্যকলাপ আমার ভালো ঠেকছে না। মানহাকে কি বলে রাজি করিয়েছে আমরা কেউ জানি না। মানহার বিয়েতে মত আছে শুনে আমি আর মেঝো ভাইয়া টাস্কি খেয়ে তাকিয়ে ছিলাম। কত বাধা দিতে চাইলাম আব্বাকে কিন্তু তিনি একটা কথাও শোনেন নি। আমাদের কোনো কথার কোনো গুরুত্বই নেই যেন।”
মাহদী বললো,

“ওই লোককে আমার সুবিধার লাগে না ভাইয়া। নির্ঘাত কোনো খিচুড়ি পাকাচ্ছে। আর আব্বাই বা কেমন তোমার সাথে ওই চেয়ারম্যানের পুতের ঝামেলা আছে সেটা জেনেও কি করে মানহাকে ওই বিপদের মুখে ঠেলে দেয়?”
মারওয়ান ছোট দুই ভাইয়ের কথা শুনছে আর হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করছে। বোঝাই যাচ্ছে রাগ কন্ট্রোল করছে। এখন হাতের কাছে কিছু পেলে খুনাখুনি বাঁধিয়ে ফেলতো এটা নিশ্চিত। মাহফুজ আচমকা বললো,
“তোমাকে বাড়িতে আনার একটা চাল নয়তো আবার ভাইয়া?”.
মারওয়ান স্বাভাবিক হয়ে বললো,
“যেই চালই দিক সফল কোনোটাতেই হবে না।”
মাহদী বললো,
“ভাইয়া শোনো নাহওয়ান বড় হচ্ছে, তুমি কি কোনো কাজবাজ এখনো করবে না?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মারওয়ান কথাটা শুনলো বলেই মনে হলো না। যথাসম্ভব পাশ কাটিয়ে গেলো। উঠে ঘরের ভিতরে চলে গেলো। মাহদী, মাহফুজ উভয়ই হতাশ হলো। এই বড় ভাইয়ের মতিগতি এখন পর্যন্ত তারা বুঝলো না। কাজের কথা বললেই এমনভাবে ইগনোর করে যেন এরকম কথা জীবনেও শোনে নি।
মারওয়ান ঘরে ঢুকে দেখলো নিশাত নাহওয়ানকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে। মারওয়ান দরজা আটকে বিছানার দিকে অগ্রসর হলো। নিশাতের পাশে শুতে শুতে বললো,
“ফাইয়াজ ঘুমিয়ে পড়েছে?”
নিশাত চোখ বন্ধ করেই উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ।”
মারওয়ান নিজেও পাশে শুয়ে চোখ বুজলো। দুপুরের পর সবাই এখন একটু বিশ্রাম নেয়। গতরাতের নির্ঘুম রাত ও সারাদিনের জার্নির ফলে মারওয়ান চোখের পাতা এক করতে না করতেই নিদ্রার অতল সাগরে তলিয়ে গেলো।

ইহাব নিজের রুমে বসে ল্যাপটপে কি যেন টাইপ করছে। কাগজে খচখচ করে কিসব যেন লিখে রাখছে। ইনাবা ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বললো,
“ভাইয়া আসবো?”
ইহাব দ্রুত ল্যাপটপ বন্ধ করে কাগজের উপর চাপা দিয়ে রাখলো। তারপর আসার অনুমতি দিলো। ইনাবা ভাইকে দেখে হাস্যোজ্বল মুখে এগিয়ে গেলো। বললো,
“কি অবস্থা ব্রো, বিয়ে নাকি করে ফেলছো? আমি অবশ্য গুজবে কান দেই নি। আমার ভাই আমাকে ছাড়া বিয়ে করতেই পারে না, কাভি নেহি।”
ইহাব কৃত্রিম হেঁসে বললো,
“যা শুনেছিস সেটা সত্য নাবা।”
ইনাবা অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে চাইলো। বললো,
“সিরিয়াসলি?”
“ইয়েস।”

“কি এমন জরুরি কাজে বিয়েটা এতো দ্রুত আর চুপিচুপি সেরে ফেললে? আম্মু, বোনকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করলে না?”
“দরকার ছিল।”
“কি দরকার সেটাই জানতে চাইছি।”
“সময় হলেই জানতে পারবি। ওসব কথা বাদ দে। তোর পড়াশোনার কি খবর?”
“আলহামদুলিল্লাহ চলছে। প্রচুর প্যারা, কুলিয়ে উঠতে হিমশিম খেয়ে যাই। মিড টার্ম, ফাইনাল এক্সাম, ল্যাব, ভাইভা ব্লা ব্লা। I’m fed up, bro.”
“পড়শোনা সবার কাছেই বিরক্তিকর ও তিতা বাট এটার ফল কিন্তু মিষ্টি। So, you should do your best.”
“ওকে ব্রাদার। আচ্ছা ভাবিকে কবে দেখাবে?”
“দেখবি দেখবি, সবুর কর।”
ইনাবা ভাইয়ের কোলে মাথা দিয়ে বললো,
“ভাইয়া মাথা ম্যাসেজ করে দাও। তোমার ম্যাসেজ দুর্দান্ত। আরামে ঘুম এসে যায় বুঝলে। আর শোনো ঘুমিয়ে পড়লে ডোন্ট ডিস্টার্ব। আরেকটা কথা, ভাবিকে শীগ্রই দেখতে চাই। নাহলে কিন্তু আমিই চলে যাবো ভাবির বাড়িতে তাকে দেখতে। শত হলেও একটা মাত্র ভাবি আমার।”
বলে হামি দিয়ে চোখ বুঝলো ইনাবা। ইহাব মুচকি হেঁসে বোনের মাথা মালিশ করে দিতে লাগলো। এই বোনটা তার ভীষণ আদরের। একমাত্র বোন বলে কথা আদরের তো হবেই।

রাত আটটা বাজে। নিশাত চুলোর পাশে বসে আছে। পাশেই মায়মুনা বেগম রাতের রান্না করছেন আর নিশাতের সাথে গল্পগুজব করছেন। মায়মুনা বেগম ইলিশ মাছে নুন, হলুদ, মরিচ মাখিয়ে তেলের উপর ছেড়ে দিলেন। খুন্তি দিয়ে মাছের ওপর পিঠে তেল ছিটিয়ে বললেন,
“আজাদ এখনো ওঠেনি নিশু?”
“না, আম্মা। কালকে সারা রাত ঘুমায়নি তাই আজকে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নিচ্ছে।”
“তোমার স্কুলের চাকরি কেমন চলে?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে ভালোই।”
“শোনো মা, আজাদরে একটু কাজ কাম করতে বইলো। নাতিটা বড় হচ্ছে। আমাদের পুরো পরিবার শিক্ষিত, কাজবাজে পারদর্শী শুধু ও এরকম কেন যে হইলো! তোমার প্রতি আমরা অনেক জুলুম করছি মা, আমাদের মাফ কইরো।”

নিশাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কি বলবে সে? লোকটার এই খামখেয়ালী আচরণ তারও যে বিরক্তির কারণ। তবুও বললো,
“আম্মা, আপনারা একটু তাকে বইলেন প্লিজ। সে আমার একটা কথাও শোনে না। এখন আপনাদের কথা যদি শোনে আরকি।”
মায়মুনা বেগম মাছ নামিয়ে পিঁয়াজ, মশলা কষাতে লেগে গেলেন। তারপর বললেন,
“বলবো। এবারও কথার গুরুত্ব না দিলে পিঠের ছাল তুলবো। যত বড়ই হোক ওদের মায়ের এখনো শক্তি ক্ষয়ে পড়েনি যে মারতে পারবে না। আস্ত রাখবো না এবার।”
বলে মশলা কষানোতে মনোযোগ দিলেন। নিশাত একটা নিঃশ্বাস ফেলে বসে রইলো শাশুড়ির পাশে। খানিক পর বললো,
“আম্মা, মাহদী বা মাহফুজকে একটা ফোন দেন। নাহওয়ানকে নিয়ে সেই কখন বেড়িয়েছে এখনো ফেরার কোনো নাম গন্ধ নেই। চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। ওর বাবা উঠে ওকে না পেলে চিৎকার চেঁচামেচি করবে। তার উপর নয়টা বেজে গেছে এখনো ফিরছে না।”

মায়মুনা বেগম চিল্লিয়ে মানহাকে ডেকে উঠলেন,
“মানহা আমার ফোনটা দিয়ে যা, নইলে তুই তোর মেঝো নয়তো সেঝো ভাইকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস কর বাড়িতে আসবে কখন? নাতিটাকে নিয়ে এতক্ষণ বাইরে কি করে ওরা?”
মায়ের হাঁক শুনে মানহা পড়ার টেবিল থেকে উঠে মায়ের রুমে গিয়ে ফোন নিয়ে মেঝো ভাইয়ের নম্বরে ডায়েল করলো। ফোন বেজে কেটে গেলো। এরকম কয়বার রিং বাজলেও কেউ ফোন তুললো না। সেঝো ভাইকে কল দিয়েও একই রেজাল্ট পেলো। মানহা রুম থেকে বেরিয়ে উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরে এসে বললো,
“আম্মু, ফোন তো ধরে না কোনো ভাইয়া।”
মায়মুনা বেগম দুপুরের পোলাও, রোস্ট গরম করতে করতে বললেন,
“কি বলিস, ফোন ধরছে না কেন?”
“কি জানি?”
নিশাতের বুকে কামড় দিয়ে উঠলো। নিজের মানিকের জন্য বুকটা ভীষণ পুড়ছে। সে উঠে নিজেদের বরাদ্দকৃত ঘরে গিয়ে দেখলো মারওয়ান উঠে পড়েছে। নিশাতকে ঘরে আসতে দেখে মারওয়ান বললো,
“কোথায় ছিলে? আমার ছাও কই?”
নিশাত আতঙ্ক নিয়ে বললো,
“মাহদী, মাহফুজ সেই সন্ধ্যার সময় নাহওয়ানকে নিয়ে বেড়িয়েছে এখনো ফেরেনি। ফোনও ধরছে না। একটু দেখুন না আপনি?”

মারওয়ান ভ্রু কুঁচকে ঘড়িতে সময় দেখলো নয়টার ঘরে ঘড়ির কাঁটা। এতক্ষণ বাইরে কি করছে ওরা? সে বিছানা থেকে দ্রুত উঠে কলপাড়ে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বের হতে নিলো এরমধ্যেই মাহদী, মাহফুজ গেট দিয়ে ঢুকলো। নাহওয়ান মাহদীর কোলে। হাতে চিপস, চকলেট, খেলনা। মাহফুজের হাতে কতগুলো ব্যাগ। মারওয়ান ওদেরকে দেখে বললো,
“কিরে এতক্ষণ কোথায় ছিলি আর তোদের ফোন কই?”
মাহদী বললো,
“আর বলো না ভাইয়া, বাজারে কিসের যেন দাঙ্গা লেগেছিল আজ। অনেকক্ষণ চলেছে। নাহওয়ান সাথে ছিল নয়তো আগেই বাসায় চলে আসতাম। ওকে নিয়ে রিস্ক নেইনি। একটা সেইফ জায়গায় ছিলাম। তাই আসতে দেরি হয়েছে।”
মারওয়ান ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,

“কিসের দাঙ্গা?”
“সেটা তো জানি না তবে অনেক মারপিট হয়েছে শুনেছি। যেহেতু ওখানে ছিলাম না তাই সঠিক জানা নেই তবে কালকে বাজারে গেলে খবর পাওয়া যাবে।”
নাহওয়ান বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মারওয়ান ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। নাহওয়ান বাবার কোলে গিয়ে দুই চাচার দিকে হাত নাড়িয়ে বললো,
“টাটা।”
মাহদী হেঁসে বললো,

“টাটা। আপনি বড্ড চালাক। এতক্ষণ কি ঠান্ডা ছিলেন যেই বাবাকে দেখেছেন অমনি চাচ্চুদের ভুলে গেলেন?”
“বুলি নাই।”
মাহফুজ ভাতিজাকে ঠেসে ধরে চুমু খেয়ে বললো,
“খুব ভালো ভুলেন নাই।”
মারওয়ান বললো,
“তোরা হাত, মুখ ধুয়ে নে।”
“আচ্ছা।”
মারওয়ান ছেলেকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে করতে বললো,
“ওই তুই আমাকে রেখে একা একা বাইরে চলে গেলি?”
নাহওয়ান বাবার দিকে নিষ্পাপ চাহুনি দিয়ে বললো,
“বাবা গুমে চিলো।”

“যতই ঘুমে থাকি তুই আমায় ডাকবি না আন্ডার ছাও?”
নাহওয়ান ফিচফিচ করে হেঁসে ফেললো। নিশাত ছেলেকে দেখেই কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। নাহওয়ান মায়ের কোলে গিয়ে একদম মিশে রইলো। নিশাত আদর করতে করতে বললো,
“আমার বাচ্চা। আব্বা এতক্ষণ কোথায় ছিলেন মাকে ছেড়ে?”
“ইট্টু বাইলে চিলাম চাচুদের সাতে।”
“তাই?”
“হ্যাঁ।”
“আর থাকবেন না কেমন? মায়ের মন পুড়ে?”
“মন পুলে?”
“হ্যাঁ।”
মারওয়ান মা, ছেলের ভালোবাসায় বাগড়া দিয়ে বললো,
“ওই জাম্বুরা আমার কোলে আয়।”
“ইননা, মায়েল কুলে তাকি।”
“আসবি না?”
নাহওয়ান মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে বললো,
“না, না।”
মারওয়ান হতাশ হয়ে বললো,
“না আসলে কি আর করার। যাই গা।”

বলেই চলে গেলো। নাহওয়ান বাবার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মুখ তুলে দেখলো বাবা নেই। নিশাতের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,
“বাবা চলি গেচে?”
নিশাত ফিক করে হেঁসে দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, আপনি তো গেলেন না, এখন চোখে পানি কেন?”
নাহওয়ান মন খারাপ করে বললো,
“বাবা পুঁচা।”
নিশাত ছেলের অভিমান দেখে হেঁসে উঠে ফুলো ফুলো গালে চুমু খেলো। এই বাপ, বেটার কাহিনী তাকে অতিমাত্রায় আনন্দ দেয়।

মাহদী, মাহফুজের নিকট সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষ হলো চেয়ারম্যান বাড়ির সদস্যরা। সকাল সকাল তাদের দুজনের মুডের বারোটা বাজাতে ইহাব ভুঁইয়ার আগমন ঘটে গেছে। রাগে দুই ভাইয়ের রক্তের হিমোগ্লোবিন পর্যন্ত টগবগ করে ফুঁটছে। তাদের বড় ভাই এখনো ঘুমে নাহলে এতক্ষণ যুদ্ধ একটা বেঁধে যেতো এতে কোনো সন্দেহ নাই। মাহদী, মাহফুজ খুব করে চাচ্ছে বড় ভাই উঠুক আর উঠোনের মাঝখানে বাবার সাথে বসা হাস্যরত বেহায়া ইহাব ভুঁইয়ার চাপাচোপা নাড়িয়ে দিক। মাহফুজ মেঝো ভাইকে গুতো দিয়ে বললো,
“মেঝো ভাই, বড় ভাইয়াকে হাঁক ছেড়ে ডাকবো নাকি?”
“ইচ্ছে তো আমারও করছে কিন্তু বাবা রেগে যাবেন।”
“কেমন বেহায়ার বেহায়া একবার ভাবো, এতো সকালে আমাদের বাড়িতে এসেছে জামাই আদর খেতে। আমার বয়সে বড় নাহলে আজকে দেখিয়ে দিতাম আমার কেরামতি।”
বলেই মাহফুজ দাঁত খিটমিট করতে লাগলো। মাহদী বললো,

“ঠান্ডা হ। ভাইয়ার ঘুমটা খালি ভাঙতে দে। তার কপালে আজকে এমনিতেও খারাপি আছে।”
তাদের কথা বলার মধ্যেই মারওয়ান কলপাড়ের দিকে গেলো ঘুমঘুম চোখে। আশেপাশের কোথাও খেয়াল নেই আপাতত। উঠোনে বসা উভয় চক্ষু তার গমনের দিকে চাইলো। একজনের চোখ হাস্যোজ্বল আরেজনের চোখ রহস্যময়। মাহদী, মাহফুজ বড় ভাইয়ের পিছে পিছে যেতে নিলে বাবার দিকে তাকিয়ে আগের স্থানে দাঁড়িয়ে পড়লো।
স্বল্প সময় পর মারওয়ান মুখ ধুয়ে উঠোনের দিকে অগ্রসর হলে উঠোনের মাঝখানে বসা একজনের দিকে তাকিয়ে তার চক্ষু বাজের মতো হিংস্র হয়ে উঠলো। ইহাব মারওয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপাত্মক হাসলো। মারওয়ানের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেলো। ইহাব উঠে এসে মারওয়ানের সামনে দাঁড়ালো। মুখোমুখি দুটি আগ্রাসী দৃষ্টি। যেন চোখে চোখে অনেক বছরের হিসেব চুকিয়ে নিচ্ছে দুজন। আচানক ইহাব মারওয়ানের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বললো,

“কি অবস্থা শালা?”
মারওয়ান ইহাবের কলার ধরে বললো,
“মুখ সামলে, নয়তো মুখ ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিবো স্টুপিড কোথাকার। শালা বলিস কাকে?”
মাহাবুব আলম দ্রুত উঠে ছেলের হাত থেকে ইহাবের কলার ছাড়িয়ে নিলেন। বললেন,
“এটা কেমন বেয়াদবি আজাদ? আমাদের জামাই হয়।”
মারওয়ান ঝাড়া মেরে বললো,
“এর মুখও যেন আমার আশেপাশে না দেখি। আপনার পেয়ারের জামাইকে কোলে তুলে নাচুন তবুও আমার চোখের সামনে যেন একে না দেখি। ইডিয়েট!”
বলেই প্রস্থান করলো। মাহদী, মাহফুজ মনে মনে ভীষণ খুশি। মাহাবুব আলম ইহাবকে বললেন,
“কিছু মনে কোরো না বাবা, হুট করে বোনের বিয়ে হওয়াতে মাথা গরম হয়ে আছে। তুমি বসো।”
ইহাব কুটিল হেঁসে বললো,
“জ্বি বসবো, কিন্তু মানহা কোথায়?”
কথাটা শুনে মাহদী, মাহফুজ উভয়ই মাহাবুব আলমের দিকে চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো। এখানে থাকলে যেকোনো মুহূর্তে মেজাজ হারিয়ে ফেলতে পারে তারা। মেয়ের যেমন বিয়ে দিয়েছে এখন নিজেই বলুক কোথায় তার মেয়ে? যত্তসব!

মাহাবুব আলম ইতস্তত করতে করতে বললেন,
“ওর ঘরেই আছে।”
“ওর ঘরটা কোনটা?”
মাহাবুব আলম জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন “কি জন্য?” কিন্তু মেয়ে জামাইকে এই প্রশ্নটা করা কত বড় মূর্খামি হবে সেটা জেনে আর করলেন না। শুধু বললেন,
“কিছু মনে কোরো না, উঠিয়ে না নেয়া পর্যন্ত মানহার ঘরে যাওয়ার পারমিশন তোমায় দিতে পারবো না।”
ইহাব হেঁসে দিয়ে বললো,
“সিরিয়াসলি আংকেল? বউয়ের রুমে যেতে পারমিশন লাগবে?”
“পারমিশন লাগবে না আমিও জানি কিন্তু আমরা মেয়েকে একেবারে তোমার হাতে তুলে না দেয়া পর্যন্ত ওর ঘরে যাওয়ার পারমিশন তোমাকে দিতে পারছি না। দুঃখিত।”
“আচ্ছা সমস্যা নেই। উঠিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই নিয়ে যাবো তখন নিশ্চয়ই আর পারমিশন লাগবে না?”
মাহাবুব আলম মাথা নাড়লেন অর্থাৎ লাগবে না। ইহাব মাহাবুব আলমের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

অনেকদিন পর গ্রামের বাজারে মারওয়ানের পা পড়লো। প্রায় চার বছর পর। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাজারে। কত হাসি ঠাট্টা করতো করিম চাচার চায়ের দোকানে এখন সবই স্মৃতি। মারওয়ান ছেলেকে নিয়ে এসেছে। নাহওয়ান বাবার কোলে বসে আশপাশ দেখছে। পথিমধ্যে কর্ণকুহরে বিশ্রী একটা শব্দ বারি খেলে চোখ তুলে চাইলো সেদিকে। ইহাব ও তার দলবল হুন্ডা নিয়ে তার দিকে হেঁসে তাকিয়ে আছে। ইহাব আবারও ডাক দিলো,
” হাই শালা।”
সাব্বির, পল্লব, আসিম, হাসান, মুহিব কোনো কথা না বলে মারওয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। মারওয়ান রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে হেঁটে চলে যেতে লাগলো। ইহাব দ্রুত পথ আটকে বললো,
“উফস সরি সরি আপনি তো শ্লা শুনতে পারেন না। ঠিক আছে শালা ব্রো ডাকবো নি।”
“চোখের সামনে থেকে সরবি নাকি ফুটবলের মতো কিক দিয়ে রাস্তায় শুইয়ে ফেলবো?”
“এটা তো ঠিক না শ্লা ব্রো, আপনাকে সম্মান করছি আর আপনি তুই তুকারি করছেন?”
মারওয়ান তাচ্ছিল্যের হেঁসে বললো,

“যে যেমন ব্যবহার প্রাপ্য।”
ইহাব মারওয়ানের কোলে নাহওয়ানকে দেখে বললো,
“ব্রো, আপনি তো এগিয়ে গেলেন। শহরে গেলেন রিক্ত হস্তে ফিরে আসলেন ভরপুর ইনপুট নিয়ে। সাথে আউটপুট ফ্রী। বাহ্ বাহ্! আর আমরা এখনো বিয়েশাদী করতে পারলাম না। যদিও বিয়ে হলো দুদিন হয় তবুও জীবন যুদ্ধে অনেক পিছিয়ে গেলাম শ্লা ব্রো।”
মারওয়ান হাত মুঠো করে ছেলেকে আগলে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে থাকলে মারামারি হয়ে যাবে। নাহওয়ানকে নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে ইহাব তার দলবলের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করলো। সবাই ইশারা বুঝে মারওয়ানের পথ আগলে দাঁড়ালো। সাব্বির বললো,
“কতদিন পর দোস্ত!”
মারওয়ান শক্ত কণ্ঠে বললো,
“পথ ছাড়, বিরক্ত করছিস কেন?”
পল্লব বললো,
“আমাদের সাথে তোর রুড আচরণের কারণ কি?”

“যার সাথে তোদের জানে জিগারী সম্পর্ক তার সাথে আমার জনমের শত্রুতা তাই ওই কীটের আশেপাশের সবকিছুকে আমি ঘৃণা করি।”
বলেই মারওয়ান চলে যেতে নিলে একটা কথায় পা থেমে গেলো।
“তোর সাথেও কিন্তু আমাদের জানে জিগারী সম্পর্ক মারওয়ান।”
মারওয়ান সামনে তাকিয়েই বললো,
“মিথ্যা কথা, তোদের সাথে আমার সম্পর্ক আরও পাঁচ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। আমার কোনো জানে জিগার ছিল না।”
ইহাব হাসতে হাসতে বললো,
“সেদিন এই শত্রুকে বাঁচিয়েছিলি কেন?”
মারওয়ান থমকে দাঁড়িয়ে বললো,
“কোনদিন?”

“নাটক আমার সাথে করবি না মারওয়ান, তুই ছিলি ওটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর আমি। তোকে আমি চিনতে ভুল করবো সেটা কোনোদিনও পসিবল না।”
মারওয়ান ঘুরে তাকিয়ে হেঁসে বললো,
“কাকে না কাকে দেখে বলে আমি নাকি তাকে কবে বাঁচিয়েছি। হাস্যকর! তোকে বাঁচাবো আমি? উল্টো তোকে মেরে আসতাম। আমার তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই তোর মতো বিষাক্ত কীটকে বাঁচাবো। ওসব স্বপ্ন দেখেই দিন পার কর পূরণ হবে বলে মনে হয়না। তুই মরলেও আমার কিছু যায় আসে না বাঁচলেও না।”
বলেই জোর কদমে হেঁটে চলে গেলো। ইহাব কিছু বললো না। বলতে পারলো না। তার গলায় কিছু আটকে গেছে মনে হলো।

“বাবা, মুক লাল কেনু?”
“কোথায় মুখ লাল?”
নাহওয়ান বাবার মুখে হাত বুলিয়ে বললো,
“উইতো।”
“লাল না, এমনিতেই রোদে এমন হয়েছে। তুই কি খাবি বল?”
“কিচু কাবো না।”
“তাহলে বাসায় যাই চল।”
“ইননা। চুকলেট কাবো।”
মারওয়ান চকলেট কিনে ছেলেকে দিলো। ছেলেকে নিয়ে বাসায় যাওয়ার পথে নাহওয়ান বললো,
“হিস কব্বো।”
“ওরে জ্বালা, তোর হিস আসার আর সময় পেলো না জাম্বুরার ছাও।”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৬

নাহওয়ান ফ্যালফ্যাল করে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। মারওয়ান ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে রাস্তার পাশে ঝোপঝাড়ে হিসু করাতে লাগলো। ঠিক তখনই তার মাথার উপর দিয়ে পরপর দুটি বুলেট গাছকে ছিদ্র করে দিলো। মারওয়ান আঁতকে উঠে ছেলেকে কোলের মধ্যে ঢুকিয়ে প্রোটেক্ট করলো। নাহওয়ানের হিসু হয়ে গেলে তাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে দ্রুত মাথা নিচু করে স্থান ত্যাগ করতে লাগলো। খুব সাবধানে সেই জনশূন্য রাস্তা পাড়ি দিলো। নির্জন জায়গায় কে এই বুলেট দুটি ছুঁড়লো?

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৮