ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২
তাজরীন ফাতিহা

স্কুলে পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে আজকে বেশ খানিকটা সময় চলে গেছে নিশাতের। আগামীকাল পরীক্ষার রেজাল্ট শীট জমা দিতে হবে। তাই এতো তাড়াহুড়ো করে খাতা দেখতে হচ্ছে। পেটে দানাপানিও পড়িনি আজ। ঘড়ির কাটায় সাড়ে তিনটা বাজে। স্কুলে এখন বিদ্যমান সে আর রুবি ম্যাডাম। পেট জানান দিচ্ছে তার মারাত্মক খিদে পেয়েছে। প্রতিদিন বাসায় এই সময় বাচ্চাকে খাইয়ে নিজের খাওয়াও হয়ে যেতো। আজকে প্রেশার গিয়েছে অনেক। শরীরটা আর টানছে না যেন। একটু বিশ্রাম খুঁজছে ক্লান্ত ভঙ্গুর শরীরটা। রুবি ম্যাডাম বললেন,
“ম্যাডাম চলুন বাসায় যাওয়া যাক। বাসায় গিয়ে খাতা কাটবেন। অনেকক্ষণ হলো ছেলেমেয়েদের স্কুল ছুটি হয়েছে আরও বসে থাকলে আমরা খিদের চোটে মারাই পড়বো।
নিশাত ভেবে পেলোনা কি বলবে। বাসায় তার খাতা কাটার মতো পরিবেশই নেই। বিড়ি’খোরটা হাউকাউ লাগিয়েই রাখে। এতে তার মেজাজ থাকে উত্তপ্ত কিন্তু রুবি ম্যাডামকে তো তা জানানো যাবে না। শত হলেও ঘরের খবর পরকে জানানো উচিত নয়। সে মনে মনে ভাবলো, যেভাবেই হোক সময় বের করে খাতাগুলো দেখে ফেলবে। বাসায় তার ছানাটা তার অপেক্ষায় অপেক্ষারত। কোনরকম পরীক্ষার খাতা গুছিয়ে সে আর রুবি ম্যাডাম বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো।

নিশাত ক্লান্তি নিয়ে বাসার দরজায় কড়া নাড়লো। জানে দরজা দেরিতে খুলবে তাই দরজায় বারি দিতেই থাকলো। খট করে দরজা খুলে গেলো। দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে মানুষরুপী এক জিরাফ। নিশাত দেখেই নিকাবের আড়ালে মুখ কুঁচকে ফেললো। এর সাথে তার দিনের মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টাই ঝগড়া লাগে। মারওয়ান দরজা খুলেই বললো,
“দরজা এতবার বারি দেয়ার কি আছে? স্কুলে পড়াও এখনো ম্যানার’স শেখো নি? ফাইয়াজের ঘুম ভাঙলে তোমার খবর করে ছাড়তাম লিলিপুট কোথাকার।”
শুরু হয়ে গেছে ভাঙা টেপ রেকর্ডার। এটা এখন বাজতেই থাকবে। যতক্ষণ নিশাত এই বাসায় থাকবে এই টেপ রেকর্ডারের কোনো থামাথামি হবে না। নিশাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে মারওয়ান নামক প্রাণীটিকে সরিয়ে ভিতরে ঢুকলো। জুতো ভিতরে ঢুকিয়ে রাখলো। মারওয়ান দরজা বন্ধ করে নিশাতের পিছু পিছু গেলো। এখন তার কাজ নিশাতকে খুঁচিয়ে ঝগড়া করা। নিশাত বোরকা খুলে ফ্যান ছেড়ে তার নিচে চুল খুলে বসলো। নামাজটা স্কুলেই পড়ে ফেলেছে আজ। নাহলে ওয়াক্ত থাকতো না। যেহেতু এখন শীতকাল একটু পরেই আসরের আযান পড়বে।
মারওয়ান ফ্যান ছাড়তে দেখে দাঁত কিরমিরিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এই শীতে ফ্যান ছেড়েছো কেন? বাচ্চাটার ঠান্ডা লাগবে না? আক্কেল বুদ্ধি কবে হবে তোমার? সাইজ যেমন লিলিপুটের মতো বুদ্ধিও তেমন লিলিপুট মার্কা।”
নিশাতের মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। এই লোকটা একটা যাচ্ছে তাই। সারাক্ষণ তার সাইজ নিয়ে খোটা দিতেই থাকবে। যেন এটা বলে পৈশাচিক আনন্দ পায়। নিশাত কোনো কথা না বলে ঘুমন্ত ছেলের কপালে চুমু খেয়ে কম্বল দিয়ে ভালো করে শরীর ঢেকে দিলো। তারপর মারওয়ানকে পাশ কাটিয়ে আলনা থেকে জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। এই খাম্বার সাথে অহেতুক তর্কে জড়ানোর মতো শক্তি তার আপাতত নেই।
মারওয়ান নিশাতের পাশ কাটিয়ে যাওয়ায় ফুসে উঠলো। তবে কিছু বললো না। নিশাত গোসল করে বের হয়ে ধোঁয়া জামা কাপড় বারান্দার দড়িতে মেলে দিলো। ফ্যান ছেড়ে ভিজে চুল ঝেড়ে শুকোতে লাগলো। মারওয়ান সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। নিশাত দেখেও যেন দেখলো না। আজকে শরীর এমনিতেই ক্লান্ত। ঝগড়া করার আপাতত মুড নেই। ভাত বেড়ে খেতে বসলো। মারওয়ান তা দেখে বললো,
“ঘরে স্বামী অভুক্ত আছে সেদিকে খেয়াল আছে?”

নিশাত অবাক হলো যেন। এই লোক না খেয়ে বসে আছে কেন? ঘটনা কি? তাকে নিয়ে খাওয়ার পাবলিক এই বিড়ি’খোর তো না? তাহলে এর অভুক্ত থাকার কারণ কি? নিশাত প্লেটে হাত রেখেই সন্দেহের নজরে বললো,
“অভুক্ত থাকার কারণ কি? বাইরে হাবিজাবি কিছু খেয়েছেন? আপনি আমার ছেলেকেও অভুক্ত রেখেছেন নাকি?”
মারওয়ান আজাদ সিগারেট ফেলে নিশাতের পাশে বসলো। নিশাত মুখ কুঁচকে বললো,
“ছিঃ কি বাজে গন্ধ! একদিন বলেছি সিগারেট খেয়ে আমার আসে পাশের ত্রিসীমানায়ও আসবেন না। এটার গন্ধে বমি এসে পড়ে আমার, কথা কানে ঢুকে না আপনার?”
মারওয়ান কথা না বাড়িয়ে মুখ ধুয়ে এসে নিশাতের পাশে আবারও বসলো। বললো,
“হাতে ব্যথা পেয়েছি। ছেলেকে খাইয়ে হাত আরও টনটন করে ব্যথা করছিল। তাই হাত উঁচিয়ে ভাত খাওয়ার মুড ছিল না।”

নিশাত মুখ গম্ভীর করে বললো,
“ব্যথা পেলেন কি করে?”
“সেটা তোর না জানলেও চলবে। ভাত খাইয়ে দিলে দে নাহলে উপোস থাকবো।”
“আপনার চাকরানী আমি? তুই তুকারি করে চকরানীকে অর্ডার দিচ্ছেন বুঝি? এই ব্যবহার করে আবার আশা করেন আপনাকে ভাত খাইয়ে দিবো?”
মারওয়ান যথেষ্ট বিরক্ত হলো। এই মহিলা জাতের কাজ খালি ঘ্যানর ঘ্যানর করা। সে মেজাজ কন্ট্রোল করে বললো,
“হাতে ব্যথা দেখে তোকে বললাম নাহলে তোর মতো লিলিপুটের হাতে খেতাম নাকি?”
“আপনাকে খাওয়ানোর জন্য তো আমি এক পায়ে খাড়া হয়ে আছি, আহা! বিড়ি খাওয়ার সময় হাতে ব্যথা করেনি বুঝি? দেখলাম তো মনের সুখে বিড়ি টানছিলেন, তখন ব্যথা কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিল?”
মারওয়ান তর্কে না গিয়ে উঠে চলে গেলো। নিশাত কিছুই বললো না। নিজে ভাত, তরকারি বেড়ে খেতে লাগলো। মারওয়ান বারান্দায় মেজাজ খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মুখের সামনে ভাতের লোকমা দেখে হাতের মালিকের দিকে চাইলো। নিশাত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। মারওয়ান না খেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নিশাত বললো,
“সারাদিন উপোস থাকবেন নাকি খাবারটুকু গিলবেন? আপনার মতো সারাদিন আজাইরা বসে থাকার সময় নেই। অনেক কাজ আছে আমার। আপনার মতো ভাদাইম্মাকে যে ভাত খাইয়ে দিচ্ছি আপনার সাত কপালের ভাগ্য। চুপচাপ মুখে খাবার নিন। লুতুপুতু করার সময় নেই।”

শেষের কথাটা একটু জোরেই বললো। মারওয়ান উপায় না পেয়ে খাবার খেয়ে নিলো। পরে আবার অভুক্ত থাকতে হবে। এর থেকে খেয়ে ফেলাই যৌক্তিক। নিশাতও একসাথে খেয়ে নিলো। খাবার খেতে খেতে আসরের আজান দিয়ে দিয়েছে। খাওয়া শেষে নিশাত নামাজ পড়ে নিলো। ঐ লোক জীবনেও নামাজ পড়ে না। আগে বলতো নামাজের কথা এখন বলা ছেড়ে দিয়েছে। তার কোনো কথাই শোনার পাবলিক এই বিড়ি’খোর না। তবুও নামাজের তাগাদা মাঝে মাঝেই দেয় নিশাত। না শুনলে নাই। নিশাতের বলার কাজ নিশাত বলে। আল্লাহ তার মতো নগণ্য বান্দির সকল গুনাহ মাফ করুক। তার স্বামীকেও হেদায়েত দিক।

নাহওয়ানকে কোলে নিয়েই রাতের রান্না করছে নিশাত। কড়াইয়ে তেল দিয়ে ইলিশ ভাজা করছে সে। বিড়ি’খোরটার আবার ইলিশ মাছ ভাজা পছন্দ। নাহওয়ানকেও ইলিশপ্রেমী বানিয়ে ফেলেছে বদ টা। অতটুকু বাচ্চাকে মারওয়ান আজাদ ইলিশ মাছ বেছে দিলে মজা করে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে খায়। পুরো বাপের কার্বন কপি তার মাসুম ছানাটা।
শ্বশুর আব্বা গতবার আসার সময় চাঁদপুরের বিখ্যাত ইলিশ নিয়ে এসেছিলেন। পদ্মার টাটকা টাটকা ইলিশ। বড় বড় সাইজের তিনটে। ভাজলে যে সুঘ্রাণ আসে। জিভে পানি চলে আসার মতো সেই সুঘ্রাণ। ছেলের পছন্দ বলে কথা। মারওয়ান ইলিশের কাঁটা বেছে খেতে পারে না দেখে শ্বশুর আব্বা ডিমওয়ালা বড় বড় ইলিশ নিয়ে আসেন প্রত্যেকবার। বড় বড় ইলিশে কাঁটা থাকে না তেমন। থাকলেও বেছে খাওয়া যায়। নাতিও ইলিশ মাছ মজা করে খায় শুনে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন শ্বশুর আব্বা। নাহওয়ান বললো,
“মা, ইলিত রানো?”
নিশাত গালে টুপটাপ আদর করে বললো,
“জ্বি আব্বা। আপনি ইলিশ ভাঁজা খাবেন?”
নাওয়ান মাথা নাড়লো। অর্থাৎ সে খাবে। নিশাত তা দেখে বললো,
“আমার আব্বাটা। আজকে কতটুকু ভাত খাবেন?”
নাহওয়ান ছোট্ট হাত প্রসারিত করে অনেকখানি দেখালো। নিশাত হেঁসে গালে চুমু খেলো। ইলিশ মাছ ভাজা হলে ডাল রান্না করলো। গরম গরম ভাতের সাথে ইলিশ ভাঁজা আর ডাল। খুবই মজাদার লাগে খেতে।

মারওয়ান পার্ট টাইম কাজ করে দোকান দেখে বের হলো। একটা শপিং মলে পার্ট টাইম কাজ করে সে। টাকা যা পায় এতে বিড়ি আর বাচ্চার খেলনাপাতি, চিপস, চকলেটের খরচ হয়ে যায়। সে বাচ্চার জন্য চকলেট, চিপস কিনে নিলো। সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে ব্যস্ত রাস্তায় হেঁটে চলেছে সে। শহরের চারপাশ এই রাতেও ভীষণ কোলাহলপূর্ণ অথচ গ্রামের বাড়ি রাত এগারোটায় একেবারে নিস্তেজ হয়ে থাকে।
মারওয়ান আজাদ হেঁটে চলেছে বাসার উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে বেলি ফুলের নেতিয়ে পড়া মালা হাতে এক বাচ্চা মেয়েকে আশেপাশে ছুটতে দেখে মারওয়ান দাঁড়িয়ে পড়লো। মেয়েটার চোখমুখ ভারী উদ্বিগ্ন। যেন মাথায় রাজ্যের চিন্তা নিয়ে ছুটে চলছে চারপাশে। কেউ যেন তার থেকে মালা কিনে কিছু টাকা দেয় এই আশায় রাত এগারোটায়ও এতটুকু বাচ্চা মেয়ে ক্লান্তিহীনভাবে ছুটছে। তার হঠাৎ ফাইয়াজের কথা মনে পড়লো। এই মেয়েটাও তো কারো না কারো বাচ্চা। আদরের ধন। আহারে কতটা অসহায় হলে এতটুকু দশ বছরের বাচ্চাকে বাবা, মা ছেড়ে দেয় এই রাতের বেলায়ও। জগৎসংসারের প্রতি মারওয়ান আজাদের করুণা, মায়া, মহব্বত যদিও কম তবুও আজকে এই বাচ্চাটার মুখে হাসি ফুটাতে তার কেন যেন খুব ইচ্ছে করছে।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১

নিশাত দরজা খুলে দেখলো মারওয়ান দাঁড়িয়ে। নাহওয়ান বাবাকে দেখেই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মারওয়ান ছেলেকে আদর করতে করতেই ঘরে ঢুকলো। ছেলেকে চিপস, চকলেট দিলো। তারপর বাচ্চাটাকে আদর করে মুখ হাত পা ধুয়ে খেতে বসলো সে। মারওয়ানের কোলের উপর বসে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছে নাহওয়ান। মারওয়ান ছেলের সাথে মজা করতে করতে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে ছেলেকে। নিশাত পাশে বসে ওদের কাণ্ড দেখছে আর ভাত খাচ্ছে। বাবা ছেলের এই হাসি মজা তার ভীষণ প্রিয়। তার মুখ দেখলে মনে হবে যে এসবে তার কোনো ভাবাবেগ নেই অথচ মনে মনে সে ভীষণ প্রফুল্ল।
নিশাত রাতের খাওয়া শেষে সবকিছু গুছিয়ে রুমে এসে দেখলো দুই বাপ ছেলে গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে লাইট বন্ধ করে ঘুমাতে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো ওয়ার্ডরোবের উপরে নেতানো বেলি ফুলের মালা পড়ে আছে। ঠোঁটের কোণায় হাসি খেলে গেলো কি তার!

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩