ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২০

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২০
তাজরীন ফাতিহা

নিশাত ফজর পড়ে কুরআন তিলাওয়াত করলো বেশ খানিকক্ষণ। গ্রামে আসার পর থেকে কুরআন তিলাওয়াত ঠিকমতো করতে পারেনি সে। তাই আজকে অনেকক্ষণ মিহি স্বরে কুরআন পড়েছে। কুরআন তিলাওয়াত শেষ করে জায়নামাজ ভাঁজ করে রাখলো। কুরআন রেহালে উঠিয়ে আলমারিতে তুলে রাখলো। খাটের দিকে চোখ যেতেই দেখলো মিনি মারওয়ান আজাদ উঠে চোখ কচলাচ্ছে। মাকে দেখেই দু’ হাত বাড়িয়ে দিলো। নিশাত হেঁসে ছেলেকে কোলে নিয়ে ফুলো ফুলো গাল দুটোতে চটাস চটাস করে চুমু এঁকে দিলো। নাহওয়ান মায়ের কোলে বসে আদর উপভোগ করছে। ব্যাগ থেকে ছোট্ট ব্রাশ বের করে কল পাড়ে গেলো। ছেলের মুখ ধুইয়ে দিলো।

মায়মুনা বেগমকে বাসী বাসনকোসন নিয়ে কলপাড়ে আসতে দেখে নাহওয়ানকে কোল থেকে নামিয়ে দাঁড় করালো। শাশুড়ির হাত থেকে বাসন নিয়ে নিজেই মাজতে বসে গেলো। মায়মুনা বেগম ‘না না’ করে উঠলেন। নিশাত কোনো কথাই শুনলো না। মায়মুনা বেগম নাতিকে কোলে নিয়ে দাঁড়ালো পাশে। নাহওয়ান দাদির কোলে উঠতে চাইছিল না। নিশাত তা দেখে বললো,
“আব্বা দাদুমণির কোলে যান। দাদুমণি আদর করবেন।”
নাহওয়ান মায়ের কথা শুনে শান্ত বাচ্চার মতো মায়মুনা বেগমের কোলে উঠেছে। নিশাত বাসন ধুয়ে রান্নাঘরে নিয়ে রাখলো সব। মায়মুনা বেগম নাতিকে নামিয়ে চুলো ধরাতে বসে গেলেন। সিলিন্ডার থাকলেও মায়মুনা বেগম মাটির চুলাতে রান্না করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তার দুই ছেলে তাকে সিলিন্ডারে শর্টকাটে রান্না করতে কত যে জোরাজুরি করে তার ইয়োত্তা নেই কিন্তু তিনি তবুও মাটির চুলাই রাঁধবেন। তাই মাহদী, মাহফুজ বলা ছেড়ে দিয়েছে। মায়ের কষ্ট হয় দেখে মাহদী সিলিন্ডার কিনে দিয়েছে অথচ মা সেখানে শুধু রাতের খাবার গরম করেন। বাকি ভারী ভারী রান্নাগুলো মাটির চুলোতেই করেন। অবশ্য মাটির চুলোর রান্নার স্বাদ অতুলনীয়। তার উপর মায়ের হাতের ছোঁয়া থাকে এই রান্নায় অতুলনীয় তো হবেই। নিশাত শাশুড়িকে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কি নাস্তা বানাবেন আম্মা?”
মায়মুনা বেগম চুলোয় গরম পানি বসাতে বসাতে বললেন,
“পরোটা, চিকেন ভেজিটেবল, চা, সেমাই আর তোমার শ্বশুরের জন্য রুটি করবো।”
নিশাত শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবছে কত শিক্ষিত তার শাশুড়ি অথচ কোনো অহংকার নেই, একেবারে মাটির মানুষ। আব্বা, আম্মার মতো এমন শিক্ষিত, কর্মঠ মানুষের সন্তান এমন হয় কি করে? লোকটা তাকে একটুও শান্তি দিলো না। কথাটা ভেবেই নিশাত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর শাশুড়ির হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিলো। আটার খামির তৈরি করে রুটি, পরোটা বেলে দিলো। মায়মুনা বেগম হঠাৎ করে মুখে আঁচল চেপে কাঁদলেন। নিশাত বললো,
“কি হলো আম্মা?”

মায়মুনা বেগম চোখ মুছে বললেন,
“মানহাটা থাকলে তোমার মতো সবসময় হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিতো। মেয়েটার জন্য মন কেমন করছে। কালকেও তো সকালে আমাকে রুটি বেলে দিলো, একসাথে নাস্তা করলো অথচ আজ মেয়েটা পরের বাড়ি। নিয়তি এতো অদ্ভুত কেন?”
বলে আবারও চোখ মুছলেন। নিশাতের চোখও ছলছল করে উঠলো। মানহার কথা ভেবে মনটা খারাপ হলো। কালকেও ভাবি ভাবি করে মুখে ফেনা তুলে দিয়েছিল। নিশাত তার মাথায় তেল দিয়ে দিয়েছিল আর আজ সে স্বামীর ঘরে। হঠাৎ করেই বুকটা হু হু করে উঠলো তার। মা, বাবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। মারওয়ানকে বলে দেখবে বাবার বাড়ি যেতে রাজি হয় কিনা। লোকটা নিশ্চয়ই ঘাড়ত্যাড়ামি করবে। না যাওয়ার অজুহাত দেখাবে কিন্তু নিশাত এবার নাছোড়বান্দা। যেভাবেই হোক রাজি করাতেই হবে। কথাটা ভেবে উঠোনে চাইলো। নাহওয়ান দাদার কোলে উঠে দাড়ি ধরে খেলছে।

মাহবুব আলম নিজের মাথার টুপি নাতির মাথায় পড়িয়ে দিলেন। টুপিটা বাচ্চাটার মাথায় বেশ ঢোলা হয়েছে। মাহাবুব আলম তা দেখে হেঁসে উঠলেন।পিছনে মাহদী, মাহফুজও আছে। তাদের দেখে নিশাত মাথার ওড়না টেনে রান্নাঘরে চেপে বসলো যেন তাকে দেখা না যায়।
ওদিকে মাহদী, মাহফুজ নাহওয়ানকে আদর করে ঘরে চলে গেলো। নিশাত সেই সুযোগে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গেলো। দেখলো মারওয়ান উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। নিশাতের তা দেখে কেন যেন রাগ উঠলো ভীষণ। বাবা, ভাই ফজর পড়ে ঘরে আসে আর এই ভাদাইম্মাকে দেখো নাক ডেকে কিভাবে ভুস ভুস করে ঘুমাচ্ছে। নিশাত তাকে ঠেলে ঠেলে ডাকতে লাগলো,
“এই উঠুন। দ্রুত উঠুন।”
মারওয়ান বিরক্ত হয়ে অন্যপাশে ফিরে গেলো। নিশাত আবারও ডাকতে লাগলো। মারওয়ান বিরক্তিসূচক শব্দ করে বললো,

“মাথা খারাপ করবি না। ঘুমাচ্ছি দেখছিস না?”
“আবার তুই তুকারি করছেন?”
“হ্যাঁ তো? এখন তো মানুষ নেই। কারো সামনে তো আর বলছি না। ঘুম কেন ভাঙালি তাই বল?”
নিশাত মারওয়ানের পিঠে চিমটি দিয়ে বললো,
“শখে।”
মারওয়ান চিমটি খেয়ে সোজা হয়ে শুয়ে নিশাতের দিকে কঠিন নজরে চাইলো। নিশাতও রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মারওয়ান বললো,
“সমস্যা কি?”
“আপনি গ্রামে এসেও এতো ঘুমান কেন? বাপ, ভাইদের সাথে নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে পারেন না?”
মারওয়ান হামি দিয়ে বললো,

“আলসেমি লাগে। উঠে ওযু করো, মসজিদে যাও তারপর নামাজ পড় তাই মন চায়না।”
নিশাত রেগে আগুন হয়ে চিল্লিয়ে বললো,
“কবরে যখন অন্ধকারে সাপ, বিচ্ছু দংশন করবে, কবর চাপ দিবে, ফেরেশতারা ডান্ডার বারি মারবে সেদিন এসব অজুহাত দিয়েন। একটা বারি মারবে অমনি সত্তর হাত নিচে গেড়ে যাবেন। সময় থাকতে আল্লাহকে ভয় করুন নাহলে পরকালে এমন পস্তান পস্তাবেন কূলকিনারা খুঁজে পাবেন না।”
মারওয়ান বিরক্ত হয়ে বললো,

“আজব তো। আমার নামাজ, আমার কবর, আমার বিচার, আমার জবাবদিহিতা তোর এতো জ্ঞান দেয়া লাগবে কেন? আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার প্রশ্ন তোকে করবে না তাই আমাকে জ্ঞান না দিয়ে নিজের চরকায় তেল দে।”
বলে আবারও উল্টো ফিরে শুয়ে পড়লো। নিশাত ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। এই লোকটার দিকে তাকালে তার মায়া কাজ করে। সমাজে এরকম বহু মানুষ আছে যাদের পরকালের কথা বললে ফুটন্ত তেলে পানি পড়লে যেমন করে ঠিক তেমন ছ্যাঁত করে ওঠে। অবুঝ বাচ্চাদের মতো মনে হয় এদের। নাহলে কেউ কবরের আযাব, আখিরাতের কথা বললে এই কথা বলে? এতো অজ্ঞ কেন এরা? এরা কেন বুঝে না এই জীবন ক্ষণস্থায়ী? দুইদিনের দুনিয়ার জন্য কত আয়োজন তাদের? অথচ অনন্তকাল থাকার জন্য কি পাথেয় জোগাড় করছে তারা? ভয় নেই কেন তাদের মাঝে? জাহান্নামকে কি এরা মামুলি মনে করে? কেন আল্লাহর ভয় তাদেরকে নাড়াতে পারে না? কেন কেউ তাদের সরল, সঠিক পথ দেখালে সেটাকে জ্ঞান মনে করে?
নিশাতের চোখের পানি গড়িয়ে নিচে পড়ছে। নীরবে কেঁদে আল্লাহর কাছে দোয়া করলো,
“ও পরওয়ারদিগার, আরশে আজিমের মালিক, আমার স্রষ্টা আমার অবুঝ স্বামীকে আপনি হেদায়েত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করুন। তাকে সহি বুঝ দান করুন। আপনি তো যাকে ইচ্ছা তাকে হেদায়েত দেন আমার স্বামীকেও আপনি আপনার পথে কবুল করে নিন মালিক। হে রব্বে করিম এই গুনাহগার বান্দার ফরিয়াদ কবুল করুন মাবুদ।”

মানহা বেশ আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। ফজরের সালাত আদায় করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশেপাশের প্রকৃতির মাঝে ডুবে গিয়েছে সে। কি সুন্দর চারপাশ! চেয়ারম্যান বাড়িটা অসম্ভব সুন্দর। রাতে খেয়াল না করলেও এখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ ভালো লাগছে তার। মা, বাবার কথাও ভীষণ মনে পড়ছে তার।
ঘড়িতে সাতটা বাজে। মানহা রুমে ঢুকে বিছানার দিকে চাইলো। দেখলো ইহাব কোল বালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। মানহা মুখ বাঁকালো। এ নামাজ কালাম পড়ে না নাকি? বড় ভাবির মতো তারও কি বেনামাজী বর জুটেছে কপালে? সে বড় ভাবির মতো অতো লুলুপুতু করতে পারবে না ডিরেক্ট একশনে যাবে। তাকে তো চেনে নি ইহাব ভুঁইয়া।
মানহা ব্যাগ থেকে সুতির একটা শাড়ি বের করলো। বার বার ব্যাগ খোলা, বন্ধ করায় বিরক্ত লাগলো তার। তাই আলমারি খুলতে গিয়ে দেখলো তালা দেয়া। রাগ উঠলো। নিজের রুমের আলমারিতে তালা দেয় কে? পাগল ছাগল সব। গোসল করে সালোয়ার কামিজ পাল্টে শাড়ি পড়লো মানহা। এখন একটু রিল্যাক্স লাগছে। ভেজা জামা কাপড় বারান্দায় মেলে দিলো। তারপর ফ্যান চালিয়ে চুল শুকিয়ে নিলো। নাটক সিনেমার মতো ভেজা চুল নিয়ে জামাইকে মধুর সুরে ডাকতে পারবে না সে। চুল শুকিয়ে মাথায় ভালোভাবে আঁচল টেনে ইহাবকে ডাকতে লাগলো,
“এই উঠুন, জলদি উঠুন।”

ইহাব রেসপন্স করলো না। মানহা কয়েকবার ডাকলো তবুও রেসপন্স নাই। রাগে কিড়মিড় করে জোরে বললো,
“ওই বেডা উঠিস না কেন? তাড়াতাড়ি ওঠ।”
ইহাব থতমত ভঙ্গিতে মানহার দিকে চোখ খুলে তাকালো। মানহা বললো,
“উঠতে এতো টাইম লাগে আপনার? আপনাকে তো ভালোভাবে ডাকা যাবে না। যাইহোক দ্রুত উঠুন। ”
ইহাব গম্ভীর হয়ে বললো,
“এটা কেমন ব্যবহার তোমার? এভাবে ঘুম থেকে কে তোলে ভাই? কটা বাজে মাত্র সাড়ে সাতটা। এতো সকালে ঘুম ভাঙানোর কারণ কি?”
মানহা একটু মিইয়ে গেলো। লোকটার কণ্ঠ ভীষণ ভয়ংকর লাগছে। যাইহোক সে ভয় পাবে না। সেও গম্ভীর মুখ করে বললো,
“একে তো ফজরের নামাজ বাদ দিয়ে আরামছে ঘুমাচ্ছেন এখন আমি ডেকেছি তাতেও প্রশ্ন?”
ইহাব ভারী গলায় বললো,
“You know what, My daily routine is completely different, so don’t overreact unnecessarily.”

মানহা ইংরেজি কম বোঝে। তাই এর মর্মার্থ করতে সময় লাগলো তার। এই লোক দেখি ইংলিশের জাহাজ! কেমনে ফটফট করে ইংরেজি বলছে। কোনভাবে যদি জানে মানহা ইংরেজি কম জানে তাহলে তার প্রেস্টিজ পাংচার হতে সময় নেবে না। একটা বুদ্ধি তো বের করতেই হবে। মানহা মুখ আরও গম্ভীর করে বললো,
“মাতৃভাষা পারেন না? বাংলার মধ্যে ইংরেজি টানেন কেন? নিজেকে শিক্ষিত রিপ্রেজেন্ট করতে চান?”
“শিক্ষিত রিপ্রেজেন্ট করতে চাই মানে? তুমি মনে হয় খুব ভাষাপ্রেমী? তাহলে রিপ্রেজেন্ট কি বাংলা শব্দ?”
ইহাবের অখণ্ড যুক্তি। মানহার রাগ লাগছে। রাগ হওয়া যাবে না। ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করতে হবে সব। তার কথায় তাকেই ঘোল খাওয়াচ্ছে ইহাব ভুঁইয়া। মানহা বললো,
“ঠিক আছে। আজকে থেকে অনলি থুক্কু শুধুমাত্র বাংলায় কথা হবে। ওকে?”
ইহাব হেঁসে উঠে বললো,

“ওকে? ভাই সিরিয়াসলি যে নিজেই এখনো ইংরেজি থেকে বের হতে পারছে না সে আবার বলে আজকে থেকে অনলি বাংলায় কথা হবে?”
মানহা রাগী চাহনিতে তাকিয়ে আছে। এভাবে অপমান করার কি আছে? সবকিছু কি বাংলায় বলা যায়? কিছু কিছু শব্দ তো চাইলেও বাংলা মুখে আসে না। মানহা মুখ কালো করে বললো,
“কয়েকটা শব্দে ছাড় দেয়াই যায়। এটা নিয়ে এতো হাসাহাসির কিছু হয়নি।”
“তোমার ইচ্ছে হলে বইলো না বাট ইংরেজি ছাড়া আমি কথা বলতে পারবো না। ইংরেজি আমার আবেগ।”
“মাতৃভাষা আবেগ নয়?”
ইহাব একটু থামলো। তারপর বললো,
“অবশ্যই। মাতৃভাষা তো সবচেয়ে বড় আবেগ।”
“সেটা তো আপনাকে দেখে মনে হয়না। বাংলায় কথা বলবেন আমার সাথে। পুরো লাইন বাংলায় বলবেন ফড়ফড় করে ইংরেজি বলে উচ্চশিক্ষিত প্রমাণ করার কিছু নেই।”
বলেই মানহা হাঁটা ধরলো অমনি ইহাব অট্টহাসি দিয়ে বললো,
“লাইন?”

মানহা কঠিন নজরে চাইলো। ইহাব হাসি বন্ধ করে আবার ঘুমোতে নিলে মানহা বাধা দিলো। বললো,
“উঠুন। এতক্ষণ ঘুমানো ভালো নয়। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।”
ইহাব ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো,
“উঠলে কিন্তু তোমাকে ছাড়বো না। সারাদিন চিপকে থাকবো। তুমি চাও আমি উঠি?”
মানহা চোখ কুঁচকিয়ে বললো,
“প্রয়োজন নেই। ঘুমা তুই।”
শেষের বাক্যটা মিনমিন করে বললো। মানহা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রুমে থেকে বেরিয়ে দেখলো বিশাল করিডোর। কেমন ভয় ভয় করছে। এতো বড় বাড়ি পুরো নিস্তব্দ। ইনাবা আপুর রুম কোনটা? মানহা শুধু শাশুড়ির রুমটা চেনে। কালকে সেখানেই ছিল অনেকক্ষণ তাই রুমটা পরিচিত হয়ে গেছে। কেমন ভূতুড়ে পরিবেশের মতো লাগছে। কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি এখনো?

মানহার খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস কিন্তু এই বাড়ির লোকজন তো ঘুমেই বেহুঁশ এখনো। কি করবে সে এখন? এসব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে তখনই উর্মি ভুঁইয়ার ডাকে সেদিকে চাইলো। উর্মি ভুঁইয়ার হাতে বই। তিনি ছাদ থেকে মাত্র নামলেন। ফজর পড়ে তিনি ছাদে হাঁটাহাঁটি করেন তারপর বই নিয়ে বসেন। আজকেও একই নিয়মে বই পড়ে ছাদ থেকে নেমে মানহাকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে ডেকে উঠলেন। মানহা শাশুড়িকে দেখতে পেয়ে একটু স্বস্তির শ্বাস নিলো। তারপর হেঁটে শাশুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। ঘুম শেষ?”
“জ্বি। আমি ফজর পর্যন্তই ঘুমাই।”
“মাশাআল্লাহ। শুনে খুব খুশি হলাম। আসো আমার সাথে।”
মানহা উর্মি ভুঁইয়ার পিছুপিছু গেলো।

মাহাবুব আলমের বাড়িতে নতুন চমক জুটেছে। মাহদী, মাহফুজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। মাহাবুব আলমকে হুমকি ধমকি দিচ্ছে মানহাকে দেখতে আসা সেই ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের পরিবার। সকালে এসেই হুলস্থূল করে ফেলছে। তাদের কথা হলো, তাদের কাছে কয়েকদিন সময় চেয়ে মেয়েকে অন্যদিকে গছিয়ে দেয়ার মানে কি? পাত্রের বাবা উঁচু স্বরে বললো,
“আমাদের সাথে ফটকাবাজি, আপনাদের দেখে নিবো।”
“ভালো করে দেখে যান। আর জীবনেও যদি এই বাড়ির ত্রিসীমানায় আপনাদের দেখি তাহলে ভেবে নিবো আপনারা কুত্তা বাহিনী।”
পিছন থেকে মারওয়ান লুঙ্গির কোণা ধরে দাঁড়িয়ে কথাটা বললো। পাত্রের বাবা গর্জে উঠে বললো,
“কি বললে?”
মারওয়ান আলসেমি ঝেড়ে বললো,

“একটু আগে যা বললাম তার মান রাখছেন নাকি? ঘেউ ঘেউ করছেন কেন? কুল কুল। এখনো কিছুই বলিনি। আর এক সেকেন্ড এখানে থাকলে মুখ দিয়ে বোমা বেরোবে। সো আউট।”
মারওয়ান হাতে চুটকি বাজিয়ে বললো। পাত্রের পরিবার অপমানিত বোধ করলো। তারা আর কিছু বলে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলো। মাহফুজ বললো,
“কোথা থেকে যে এসব নমুনা আমাদের পরিবারে এসে জোটে আল্লাহ জানে। এক চেয়ারম্যান বাড়ি এখন আবার এই পাঠান বাড়ি। মানে পুরাই বিনোদন।”
মাহদী বললো,
“পাঠান না পাঠা বাড়ি বল। এসেই হম্বিতম্বি জুড়ে দিয়েছে যেন ওদেরকে আমার বোন দেয়ার জন্য ওয়াদা করেছিলাম। পাঠা কোথাকার।”
মাহফুজ তাল মিলিয়ে বললো,
“একদম।”

মারওয়ান সারাদিন বাইরে ছিল। সেই সকালে বের হয়েছে এখন রাতে ঘরে ফিরলো। নাহওয়ান সারাদিন পর বাবাকে দেখে লাফিয়ে উঠলো। নিশাত বললো,
“কই ছিলেন সারাদিন?”
মারওয়ান শার্ট খুলে বিছানায় রেখে লুঙ্গি, গামছা নিয়ে কলপাড়ে যেতে যেতে বললো,
“কাজে।”
নাহওয়ান বাবার পিছন পিছন দৌঁড়ে গেলো। নিশাত এমন উত্তরে হতাশ হলো।
মারওয়ান গায়ে পানি ঢেলে দেখলো নাহওয়ান বালতির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। সে চোখ গরম করে বললো,
“এই তুই এখানে কেন?”
নাহওয়ান ফিচফিচ করে হেঁসে বললো,
“আমি ইকানে।”
“হ্যাঁ, তুই এখানে কেন? তোর মা তোকে ছেড়েছে কেন? গোসল করছি এখন। কোনো ডিস্টার্ব করবি না। দ্রুত ঘরে যা।”
নাহওয়ান পা দাপিয়ে বললো,

“ইননা।”
মারওয়ান বললো,
“তাহলে দাঁড়িয়ে থাক। গোসলে নো ডিস্টার্ব।”
বলে পানির মধ্যে থেকে নাহওয়ানের হাত বের করে এক মগ পানি নিয়ে গায়ে ঢেলে দিলো। নাহওয়ানও বাবার দেখাদেখি পাশ থেকে মগ নিয়ে দুই হাত দিয়ে পানি ভরে নিয়ে গায়ে ঢেলে দিলো। মারওয়ান চোখ কপালে তুলে বললো,
“ওই পোটকার বাচ্চা, তুই গোসল করছিস কেন এই রাতে?”
নাহওয়ান মায়াবী নয়নে চেয়ে বললো,
“ইট্টু গুচুল কলি।”
“তোকে মাইর দিবো এখন।”
বলেই নিশাতকে ডাকতে লাগলো জোরে জোরে। নিশাত দ্রুত এসে বললো,
“কি হয়েছে?”
নাহওয়ানের দিকে নজর যেতেই নিশাত আঁতকে উঠে বললো,
“একি আপনি ওকে গোসল করিয়েছেন কেন এই রাতের বেলা?”
মারওয়ান ফুঁসে উঠে বললো,

“আমি করিয়েছি নাকি এই রকেটের বাচ্চা মাতব্বরি করে নিজে নিজে গায়ে পানি ঢেলেছে।”
নিশাত নাহওয়ানকে পিঠে জোরে থাপ্পড় মেরে কোলে তুলে নিলো। নাহওয়ান জোরে কেঁদে দিলো। নিশাত বললো,
“একদম চুপ। বেশি বেড়েছো তুমি? সুযোগ পেলেই পানি হাতানো স্বভাব হয়ে গেছে? পিটিয়ে তোমার বদমাইশি ছুটিয়ে দিবো।”
নাহওয়ান কাঁদতেই থাকলো। নিশাত ওড়না দিয়ে ছেলের মাথা মুছতে মুছতে ঘরে চলে গেলো। মারওয়ান গম্ভীর নয়নে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। নিশাত ছেলেকে বিছানায় নামিয়ে গামছা দিয়ে পুরো শরীর মুছিয়ে দিলো। নাহওয়ান ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদঁছে। নিশাত বললো,
“বেশি করছো কিন্তু নাহওয়ান। কান্না বন্ধ না করলে আরও মার খাবে। কিছু বলি না দেখে বাঁদরামি অতিরিক্ত বেড়ে গেছে তাইনা?”
নাহওয়ান হেঁচকি তুলে কেঁদে যাচ্ছে। মারওয়ান ঘরে ঢুকে ছেলেকে কাঁদতে দেখে বললো,

“এভাবে মারার কি দরকার ছিল? এমনি বুঝিয়ে বললেই হতো।”
“মার না খেলে লাগাম ছুটে যায় তাই সময় থাকতে লাগাম টানতে হয়।”
নাহওয়ান বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মারওয়ান ছেলেকে কোলে নিলো। বাবার কোলে গিয়ে আরও জোরে কেঁদে উঠলো। মারওয়ান রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
“এতো জোরে মারা লাগবে কেন? ও কি বড়? বাচ্চা মানুষ একটু আধটু দুষ্টুমি করবেই বুঝিয়ে বললেই হতো। তাই বলে জানোয়ারের মতো মারতে হবে? বাচ্চা পালতে না পারলে চলে যা।”
বলেই ছেলেকে নিয়ে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নিশাত পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। ‘চলে যা’ শব্দটা কানে বাজতে লাগলো অনেকক্ষণ। তারপর ঢোঁক গিলে মারওয়ানের শার্ট গুছিয়ে রাখতে গেলে খচখচ করে উঠলো কিছু। নিশাত শার্টের পকেট হাতড়ে দেখলো ভাঁজ করা কাগজ। সে কাগজ খুলে দেখলো একটা চিরকুটের মতো । নিশাত পড়তে লাগলো,

প্রিয় আজাদ (আমার জাদ),
আমি কাল সিনেমা হলে গিয়েছিলাম। নতুন একটা সিনেমা রিলিজ হয়েছে সেটা দেখেছি। তোমার পছন্দের নায়ক ছিল না। তাই আর বলিনি তোমায়। তুমি কি রাগ করেছো? রাগ করো না। অনেকদিন ধরে আমার হাতের রান্না খেতে চেয়েছিলে তাই অনেক ভালোবাসা দিয়ে তোমার জন্য রেসিপিটি বানিয়েছি। নতুন রান্না কেমন লাগলো জানিও। তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম। ভালো থেকো।
ইতি
তোমার একান্ত জন।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৯

নিশাত চিঠি পড়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো। লোকটা কি তলে তলে পরকীয়া করছে? এইজন্যই কি তার প্রতি এতো নির্লিপ্ত? বিয়ের আগেই সম্পর্ক ছিল লোকটার? সংসারের প্রতি এতো উদাসীন এই জন্য তাহলে। আজকে আবার সরাসরি চলে যেতেও বললো। নিশাত এতদিনের উত্তর বোধহয় চিঠি পড়ে সম্পূর্ণ পেয়ে গেলো। এতো ভালোবাসা আদান প্রদান কতদিন ধরে চলছে? চরিত্রহীন লোকের সংসার করেছে এতদিন সে? ছিঃ!

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২১