ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৬
তাজরীন ফাতিহা
“রৌদ্রদগ্ধ দিবাকর আজ জ্বেলেছে পবনধারা,
সমীরণ আজ বয়ে চলে যেন উত্তপ্ত অনলপাড়া।
নৈরাজ্য আচ্ছাদিত করে প্রতিটি গাত্রকণা।
আদিত্য যেন দুর্বার গতিতে ছুঁড়ছে বহ্নিশিখা,
দেহাংশ আজ পুড়ে ছারখার জ্বলন্ত স্রোতধারা,
গ্রীষ্মের প্রলয়ে তাণ্ডব ঘটেছে ধরিত্রীর আবহাওয়া।”
~ তাজরীন ফাতিহা
জোরালো গলায় উচ্চারিত করে কপালের ঘামটুকু মুছে ফেললো কালো কাপড়ে আবৃত ব্যাক্তিটি। দুই হাতে দুটো শান দেয়া চকচকে ছুরি জ্বলজ্বল করছে। সামনে হাত, মুখ বেঁধে ফেলে রাখা তিনজন লোক। তারা ব্যক্তিটিকে দেখে থরথর করে কাঁপছে। ব্যক্তিটির পুরো শরীর ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। সে শান্ত ভঙ্গিতে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে চেয়ারে বসে ছুরির সাথে ছুরি ধার দিতে লাগলো। ছুরি ধারাতে ধারাতে ব্যক্তিটি বললো,
“অনেক গরম পড়েছে তাইনা?”
তিনজন লোক মোচড়াতে মোচড়াতে ‘উ..উ’ শব্দ করতে লাগলো। ব্যক্তিটি একেবারেই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
“আরে মোচড়ামুচড়ি করছিস কেন? বহুদিন ধরে তোদের প্রতীক্ষায় ছিলাম বুঝলি? বহুদিন ধরে। জানতাম এখানে আসলে অ্যাটাক করবি তাই তো সব পরিকল্পনা আগেই করে রেখেছিলাম আর দেখ আমি সফল। তোদের প্রত্যেকটা চালের নজর রেখেছি। তোরা এতদিন উড়তে পেরেছিস আমি ছাড় দিয়েছি বলে। সেদিনের শুনশান রাস্তায় গুলি তোরা করেছিলি তাই না?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ছুরিতে ধার দিতে দিতেই প্রশ্ন করলো। তিনজন লোক আগের মতোই শব্দ করতে লাগলো। ব্যক্তিটি ঘাড় বাঁকিয়ে তাদের দিকে চেয়ে বললো,
“তোদের ভাগ্য ভালো সেদিন যদি একটা গুলি লাগতো আল্লাহর কসম তোদের সেদিনই জ*বাই করতাম।”
শেষ কথাটা হিংস্র কণ্ঠে বললো ব্যক্তিটি। চেয়ার থেকে উঠে অবয়বটি হেঁটে লোক তিনটির সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলো। তারপর শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
“মানহার পিছনে পড়েছিলি কেন? মাহাবুব আলমকে হুমকি দিয়েছিলি কেন? ওই পরিবারের উপরে নজর রাখছিলি কেন? সব সাফ সাফ বলবি তাহলে প্রাণ ভিক্ষা দিবো নাহলে এক কোপে গলা নামিয়ে দেবো।”
কথাটুকু বলে তিনজনের মুখের কাপড় খুলে ফেললো ব্যক্তিটি। কাপড় খোলার পর তিনজন অনবরত শ্বাস নিতে থাকে। তিনজনের মধ্যে একজন শ্বাস নিতে নিতে বললো,
“আমাদেরকে অর্ডার দেয়া হয়েছিল সেই পরিবারের উপর নজর রাখতে।”
“কে অর্ডার দিয়েছিল?”
“নাম বলেনি কখনো। শুধু ফোনে অর্ডার করতো আর আমরা নজর রেখে তাকে ইনফর্ম করতাম।”
“আর গুলির অর্ডারও দেয়া হয়েছিল?”
“হ্যাঁ।”
কালো অবয়বটি কি যেন ভাবলো। তারপর ফোন বের করে কি যেন ঘাটাঘাটি করতে লাগলো। অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো,
“যে অর্ডার দিয়েছিল তার কোনো ক্লু দিতে পারবি?”
তিনজনই এর বিপরীতে মৌন রইলো। ব্যক্তিটি ছুরি দিয়ে একজনের পায়ে গেঁথে দিলো। চিৎকার করে উঠলো লোকটি। বাকি দুজন মোচড়াতে মোচড়াতে বললো,
“বিশ্বাস করুন আমরা এর বেশি কিচ্ছু জানি না।”
ব্যক্তিটি তাদের কথা শুনে অট্টহাসি দিলো। তারপর হাসতে হাসতেই জবাব দিলো,
“আমাকে বলদ মনে হয় তোদের? কিছু না কিছু তো অবশ্যই জানিস। শুধু ফোনের আলাপে একটা পরিবারকে শেষ করে দিতে রাজি হয়ে গেছিস? তোদের প্ল্যান যে খুব সূক্ষ্ম সেটা বহু আগেই ধরতে পেরেছিলাম। দ্রুত বল নাহলে জান নিয়ে ফিরে যেতে পারবি না।”
তিনজনের মধ্যে একজন বলে উঠলো,
“যে আমাদের অর্ডার করতো সে পুরুষ। এর বেশি আর কিচ্ছু জানি না বিশ্বাস করুন স্যার।”
ব্যক্তিটি কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলো মনে হয়। তারপর রহস্যময় হেঁসে বিড়বিড় করলো কিছু। তারপর তিনজনের কাঁধে পর্যায়ক্রমে ছুরি গেঁথে ফিসফিস করে বললো,
“I’m Marv Zehn. জানিয়ে দিস। আমিও দেখি তোদের বসের কত বড় কলিজা। এই মার্ভ জেনের সাথে কতটুকু টক্কর দিতে পারে আমি দেখতে চাই। পিছন থেকে আঘাত করে আর কত বাহাদুরি করবে? পারলে সামনাসামনি লড়তে বলিস আয়েম ওয়েটিং।
কিছুদিন ধরে মানহার ভীষণ মন খারাপ। কোনো কাজেই মন বসছে না। পরিবারের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। শ্বশুরবাড়িতে এসেছে আজ এক সপ্তাহের বেশি হয়েছে। ফিরতি বাবার বাড়ি যাওয়া হয়নি তার। তার মন খারাপ জেনে শাশুড়ি আম্মু ইহাবকে নিয়ে যেতে বলেছেন। ইহাবের সময় হয়না। প্রতিদিনই দেরি করে ঘরে ফেরে। বেশ রাত হয়। এসেই চুপচাপ নিজের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ঘুমিয়ে পড়ে। মানহা কিছু বলতেও পারেনা। তার চোখ ফুরে জল বেরোতে চায়। কাউকে মন খুলে কিচ্ছু বলতে পারেনা।
শাশুড়ির সাথে থাকলে মন খারাপ কিছুটা কেটে যায়। এমনিতে তার দম বন্ধ লাগে। মনে হয় নিজের বাবার বাড়ির উঠোনে মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় উড়ে বেড়াতে। কিন্তু তার আশা পূরণ হয়না। ভাবিরও বুঝি এমন মন খারাপ হতো? নিজের পরিবার ছেড়ে এক সপ্তাহ কাটাতেই কেমন অস্থির অস্থির লাগছে সেখানে ভাবি চার চারটে বছর কিভাবে কাটিয়েছে? তার উপর ভাইয়ার মতোন উদাসীন স্বামী থাকলে তো সেই কষ্ট আরও তিনগুণ বেড়ে যায়। মেয়েদের জীবনটা বড্ড অদ্ভুত। স্বামীর ঘরে এসে পড়লেই তাদের ম্যাচিউরিটি আপনাআপনি বেড়ে যায়। তখন আর তারা মেয়ে থাকে না হয়ে যায় নারী। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখের কোণা বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে মানহার।
সোফায় বসে হাতে মাথা রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে এসবই ভেবে চলছে মানহা। পুরো মুখে চোখের পানি লেপ্টে রয়েছে। পানির প্রত্যেকটি ফোঁটা যেন তার মন খারাপের সাক্ষী। চোখ বুঁজে হাতে মাথা ফেলে বসে রইলো সে।
মাথায় কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে মানহার তন্দ্রা কেটে গেলো। চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ইহাব বসা। মানহা কিচ্ছু বললো না। ইহাব মানহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“সরি সেদিন ওভাবে রিয়েক্ট না করলেও হতো। তোমার সাথে মিসবিহেভ করার জন্য খুবই দুঃখিত। মাথা ঠিক ছিল না আমার। আসলে রাগ উঠলে কন্ট্রোল করতে পারিনা। তুমি আগ বাড়িয়ে কৈফিয়ত চাইছিলে তাই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।”
মানহা ঘাড় ঘুরিয়ে পড়েই রইলো। মাথা উঠিয়ে ইহাবের দিকে একবারও চাইলো না। ইহাব মানহার নড়চড় না দেখে তার দিকে মিশে বসলো। মানহা সেটা বুঝতে পেরে রাগী চোখে চাইলো। উঠে যেতে নিলে ইহাব বসিয়ে দিলো। শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
“রেডি হও। শ্বশুরবাড়ি যাবো।”
মানহা রোবটের মতো বললো,
“প্রয়োজন নেই।”
“অবশ্যই প্রয়োজন আছে। তোমার বড় ভাইয়ের সাথে একটু সাক্ষাৎ করে আসি। শুনলাম এখনো নাকি ঢাকায় যায়নি। তাই ভাবলাম একটু সালাম টালাম দিয়ে আসি বউয়ের বড় ভাই ব্রাদারকে।”
মানহা ইহাবের বন্ধন থেকে ছুটতে মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো। একটা পুরুষ তাকে ধরে আছে ব্যাপারটা ভাবতেই তার আবারও দুনিয়া দুলে উঠছে যেন। শরীর কাঁপতে শুরু করলো তার। ইহাব সেটা বুঝতে পেরে দ্রুত ওকে ছেড়ে দূরে গিয়ে বসলো। মানহা মাথায় হাত দিয়ে সোফাতেই শুয়ে পড়লো। চারপাশ দুলছে তার। ইহাব পানি এনে মাথায় ডলে দিতে দিতে বললো,
“আমি ভুলে গিয়েছিলাম তোমার প্যানিক অ্যাটাকের কথা। সরি।”
মানহা অনেকক্ষণ পর শান্ত হলো। ইহাব মানহাকে আর না ঘেঁটে ব্যাগে জামাকাপড় ভরতে লাগলো। মানহার কাপড় আন্দাজে নিলো সব। ব্যাগ গুছিয়ে মানহার কাছে গিয়ে বললো,
“রেডি হও দ্রুত। সকাল সকালই বেরিয়ে পড়ি পরে লেট হয়ে যাবে।”
মানহা চোখ বন্ধ করে ক্লান্ত গলায় বললো,
“আমার ভালো লাগছে না। আপনার যেতে হবে না। কালকে আমিই চলে যেতে পারবো।”
“তুমি কিন্তু ত্যাড়ামি করছো? তোমার সাথে রাগ দেখাতে চাইনা। তুমি ইচ্ছে করে আমাকে রাগিয়ে দাও। একটু বাইরে যাচ্ছি এসে যেন তৈরি দেখি।”
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। মানহা বিরক্ত হয়ে ওযু করে যোহরের নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো। ইহাব কিছুক্ষণ পর ঘরে এসে দেখলো মানহা নামাজ পড়ছে। সে খাটে গিয়ে বসলো। মানহা নামাজ শেষে দোয়া পড়ে জায়নামাজ গুছিয়ে রাখলো। মানহা ঘর থেকে বেরোতে নিলে ইহাব খপ করে মানহার হাত ধরে খিমার খুলে বোরকা গায়ে পড়ালো। মানহা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। ঘটনা বুঝতে পেরে ইহাবের দিকে কঠিন নজরে চেয়ে থাকলো। ইহাব মোটেও পাত্তা দিলো না। মুখ গম্ভীর করে বোরকার বোতাম লাগিয়ে দিলো। মানহা বললো,
“আমার আম্মুর সাথে কথা ছিল। আপনাকে আগ বাড়িয়ে পাকনামি করতে কে বলেছে?”
“আম্মুর সাথে আমি কথা বলেছি। তোমার আবার কিসের কথা? যাও নিকাব পড়।”
মানহা খিটমিট করতে করতে নিকাব পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে শাশুড়ির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। মানহা মনে প্রাণে চাচ্ছে যেন শ্বশুর রুমে না থাকে। রুমের দরজায় টোকা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। একটু পর ইমতিয়াজ ভুঁইয়া দরজা খুলে দিলো। দরজার সামনে বোরকা পরিহিত কাউকে দেখে বললো,
“কে?”
মানহা শ্বশুরকে দেখে গুটিয়ে গিয়ে মিনমিন করে বললো,
“আব্বু আমি।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“কি চাই?”
মানহা ইতস্তত করতে করতে বললো,
“আম্মুকে।”
“ঘুমাচ্ছে।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া দেখলেন মানহা যাচ্ছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে যেন কিছু বলতে চায়। তিনি কিছুটা নরম স্বরে বললেন,
“কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ, ইয়ে ওই একটু বাবার বাড়ি যাচ্ছি।”
“শুনেছি ইহাব বলে গেছে। যাও। বেশিদিন থেকো না। তোমরা চলে গেলে পুরো বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাবে। তোমার আম্মু একা একা বোরিং ফিল করবেন।”
মানহা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া দরজা আটকে দিলেন।
বাবার বাড়ির সামনে গাড়ি থামলে মানহার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। সারাটা রাস্তায় কখন বাড়িতে পৌঁছবে সেটাই ভেবেছে। ইহাব গাড়ি থেকে নেমে মানহার দরজা খুলে দিলো। মাহদী, মাহফুজ বোনের আসার সংবাদ পেয়েছে। তাই গেট খুলে দাঁড়িয়ে ছিল। যদিও ইহাবের আসার কথায় তারা নারাজ তবুও বোন জামাইকে তো আপ্যায়ন করতেই হবে। মানহা ভাইদের দেখে দৌঁড়ে জড়িয়ে ধরলো। মাহদী, মাহফুজও ছোট বোনকে আগলে নিলো। মাহফুজ ইহাবের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে মিষ্টি, ফলমূলের প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকলো। মাহদী কিছুই বললো না। বোনকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। ইহাব সেটা দেখে বললো,
“কত বড় অকৃতজ্ঞ। আমার জিনিসপাতি নিয়ে চলে গেছে। বউ আমার, মিষ্টি আমার অথচ আমারই কোনো কদর নাই।”
মারওয়ান ঘেমে নেয়ে কোথা থেকে যেন আসলো।নিশাত পুকুরে নাহওয়ানের জামাকাপড় ধুচ্ছিলো। এটা তাদের নিজস্ব পুকুর। চারপাশে পর্দা টানানো। বাড়ির মেয়েরা এখানে গোসল করে। নিশাত বিয়ের আগে এখানেই গোসল করতো। মনোযোগ দিয়ে সাবান মেখে জমা কাপড় রগড়াচ্ছিলো। হঠাৎ পাশে ভারী কিছু পড়ার আওয়াজে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে বেচারি। এই ভর দুপুরে কে পড়লো। নিশাত ‘লা হাওলা ওয়ালা কু’য়াতা’ পড়তে লাগলো। মারওয়ান অনেকক্ষণ ডুব দিয়ে রইলো তারপর মাথা উঠিয়ে নিশাতের দিকে তাকিয়ে চোখ মারলো। নিশাত তা দেখে পাশে পড়া আম গাছের ডাল ফিক্কা মারলো। মারওয়ান হেঁসে আবারও ডুব দিলো।
নিশাত পুকুরের সিঁড়ির আরও কিছুটা নিচে নেমে জামা ধুতে লাগলো। পায়ের অর্ধেক পর্যন্ত পানি এখন তার। বোলে ছেলের শেষ জামাটা মুচড়ে রেখে মুখ ধুয়ে যেই উঠতে নিলো অমনি তার পা ধরে টেনে পুকুরে ফেললো মারওয়ান। নিশাত চিৎকার দিয়ে পানির নিচে ডুবে গেলো। মাথায় পেঁচানো ওড়না খুলে গেলো তার। আচমকা পানিতে পড়ায় সে এতো পরিমাণে ভয় পেয়েছে যে তৎক্ষণাৎ সাঁতার দিয়ে উপরে উঠতে পারলো না। মারওয়ান ডুব দিয়ে নিশাতকে ধরে উপরে ওঠালো। নিশাত মুখ দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকলো। মারওয়ান নিশাতকে ধরেই আছে। নিশাত কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে মারওয়ানের দিকে রেগে তাকিয়ে বললো,
“পাগল নাকি আপনি? আক্কেল বুদ্ধি সব খুইয়ে ফেলেছেন? আমি গোসল করেছি একবার আবারও পানিতে ফেললেন কেন?”
“গোসল করতে। একা একা গোসল করতে ইচ্ছে করছিলো না তাই ভাবলাম তোমাকে নিয়ে করি। আমরা তো কখনো একসাথে গোসল করিনি তাই আজকে করে দেখতে চাচ্ছি কেমন অভিজ্ঞতা হয়।”
নিশাত বললো,
“আমার ওড়না খুঁজে আনুন। আজকে আপনার খবর আছে। আমি এই ভেজা জামা পড়ে কিভাবে ঘরে যাবো? আপনি কি দিন দিন ছোট হচ্ছেন?”
মারওয়ান নিশাতকে ছেড়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে বললো,
“এমন ভাব করছো যেন পরনারীর সাথে গোসল করছি। স্বামী, স্ত্রী একসাথে গোসল করা সুন্নত ভুলে গেছো। আর আমাদের দুজনের জামা কাপড়ই নিয়ে এসেছি।”
“খুব মহৎ কাজ করেছেন। দ্রুত ওড়না এনে দিন। ওড়না হারালে আপনাকে ছাড়বো না। আমার পছন্দের জামার ওড়না এটা।”
মারওয়ান আর কিছু না বলে ডুব দিলো। নিশাত বুক পর্যন্ত পানিতে ভেসে আছে। তার খোঁপা করা চুল পানিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঢেউ খেলে আছে। নিশাতের চুল অনেক বড়। তাই বেশিরভাগ সময় সে খোঁপা করে রাখে। চুল শুকাতে অনেক সময় লাগে তার। তাই একদিন পর পর চুল ভেজায়। আজকে দুইবার ভিজালো। এই চুল কখন শুকাবে কে জানে?
মারওয়ান ডুব দিয়ে উঠে বললো,
“লিলিপুট চলো সাঁতার প্রতিযোগিতা করি।”
নিশাত চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
“কোনো দরকার নেই। আমার ওড়না দিন।”
মারওয়ান কৌতুক করে বললো,
“ওড়না পাবে একটা শর্তে যদি আমার সাথে রেস করো।”
“আপনি কি আসলেই পাগল হয়ে গেছেন? বিবাহিত এক বাচ্চার মা হয়ে এখন পুকুর দাপিয়ে বেড়াবো? লজ্জা নাহয় আপনার নেই, আমারও কি নেই ভেবেছেন?”
মারওয়ান ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“ভয় পেলে নাকি লিলিপুট? আসলে বিবাহিত টিবাহিত ফ্যাক্ট না ফ্যাক্ট হলো তুমি আমার সাথে সাঁতরে কোনোদিনও জিততে পারবে না তাই ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছো। সবই বুঝি।”
নিশাতের প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে সামনের পুরুষটিকে। এই লোকটা বুঝতে চায়না কেন কেউ যদি তাকে এখন দেখে ফেলে তাহলে কি ভাববে? একটা বিবাহিত মেয়ের এরকম দাপাদাপি করাটা গ্রামের মানুষ ভালো চোখে দেখে না। এই লোককে এসব কে বোঝাবে? মারওয়ান নিশাতের চোখের ভাষা যেন বুঝলো। তাই বললো,
“এই দুপুরে কেউ আসবে না। তুমি যদি দেরি করাও তাহলে তোমারই কিন্তু কথা শুনতে হবে। তাই কেউ আসার আগে দ্রুত সাঁতারটা দিয়ে ফেলি আসো।”
নিশাত কড়া গলায় বললো,
“এতবড় চুল নিয়ে আমি সাঁতার দিবো?”
“কেন তুমি আগে সাঁতার দাওনি কখনো?”
“দিয়েছি। তবে খোঁপা করে নাহলে চুল পেঁচিয়ে যায় শরীরের সাথে।”
মারওয়ান সাঁতরে নিশাতের কাছে এসে চুলগুলো একত্র করে কোনরকম খোঁপার মতো বেঁধে দিলো। তারপর নিশাতকে নিয়ে একটা সীমানায় গেলো। মারওয়ান বললো,
“ওই পাড়ে যে আগে যেতে পারবে সে জয়ী। যদি আমি জয়ী হই তাহলে কাচ্চি রেঁধে খাওয়াতে হবে আর যদি তুমি জয়ী হও তাহলে তুমি যা চাইবে তাই দেয়া হবে।”
নিশাত ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তারপর মারওয়ান রেডি স্টার্ট বলে দুজনে সাঁতার শুরু করলো। ছোট বেলা থেকে নিশাত সাঁতারে খুব ভালো। কেউ কখনো তার সাথে পারেনি। বিয়ের আগে প্রতিদিন তার সখীদের সাথে সাঁতার রেস করতো। জিততো সেই। পাড়ে যাওয়ার আগে তার চুল খুলে গেলো। তারপর ওগুলো শরীরের সাথে পেঁচিয়ে তার গতিবিধি রোধ করলো। ডুবেই যাচ্ছিলো প্রায়। মারওয়ান পাড়ে পৌঁছিয়েই যাচ্ছিলো পিছনে ফিরে নিশাতকে এলোমেলো হাত পা ছুড়তে দেখে আবার উল্টো ঘুরে নিশাতের কাছে এলো। নিশাত মারওয়ানকে শক্ত করে ধরে বললো,
“এই লোকের জন্য আজকে বোধহয় মারাই যাবো।”
মারওয়ান মুখ গম্ভীর করে নিশাতের শরীরে প্যাঁচানো চুল ছাড়িয়ে দিতে লাগলো। তারপর নিশাতকে ধরেই ঘাটে আসলো। ঘাটের পাশেই ওড়না রাখা তার। এটা কখন রেখেছে এই লোক। নিশাত ওড়না শরীরে জড়িয়ে পুকুরের সিঁড়িতে বসে হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। একটু পর শান্ত হয়ে বললো,
“মাথামোটা গর্দভ লোক। বারবার বলেছি সাঁতরাবো না। আমাকে মেরে ফেলার ফন্দি এটেছিল। এখন কি আগের মতো কিশোরী আছি যে সাঁতরে জিতবো? এতো পানি খেয়েছি এখন আর ভাত খাওয়া লাগবে না। পানি খেয়েই পেট ভরে গেছে আজ। ইয়া আল্লাহ।”
মারওয়ান গামছা দিয়ে শরীর মুছে নিশাতের দিকে ছুঁড়ে মারলো। মুখ গম্ভীর করে বললো,
“সারাদিন কাজ করেও হালকা পাতলা শরীর করতে পারলে না? এতো মুটিয়ে গেছো কেন? তোমাকে টানতে গিয়ে আমার জান অর্ধেক বেরিয়ে গেছে।”
নিশাত ফোঁস করে বললো,
“অসভ্য লোক। বিয়ের পর মেয়েরা এমনিতেই মুটিয়ে যায়। আমি মোটেও মোটা নই। নাহওয়ান পেটে আসার পর ওজন একটু বেড়েছে এই যা। নিজে একটা বাচ্চা পেটে নিয়ে দেখুক কেমন হ্যাংলা পাতলা থাকে আমিও দেখবো।”
মারওয়ান লুঙ্গি পড়ে ভেজা প্যান্টটা নিশাতের দিকে ঢিল দিয়ে বললো,
“বাচ্চা পেটে নেয়া পুরুষদিগের কর্ম নহে। লুঙ্গিটা ধুয়ে শুকাতে দিও। আমি আমার ছাওয়ের কাছে গেলাম।”
নিশাত হালকা চেঁচিয়ে বললো,
“এই ভরদুপুরে আমাকে পুকুরে একা রেখে কোথায় যাচ্ছেন আজব তো? এখানে দাঁড়িয়ে থাকুন। কেউ এসে পড়তে পারে।”
বলেই পাশের হাম্মানখানায় ঢুকে জামা পাল্টে বেরিয়ে এলো। মারওয়ান পুকুরের ঘাটে বসে পা নাড়াচ্ছিল। নিশাতকে দেখে বললো,
“আগেই সুন্দর লাগছিল।”
নিশাত চোখ রাঙিয়ে তাকালো। তারপর জামাকাপড় ধুয়ে ঘরে আসলো। মারওয়ান বললো,
“আসার পর থেকে আমার ছাওয়ের সাড়াশব্দ পাচ্ছি না? ঘটনা কি?”
নিশাত জামাকাপড় মেলে দিতে দিতে বললো,
“ও ঘুমায়। ঘুম পাড়িয়েই জামা কাপড় ধুতে গিয়েছি।”
মারওয়ান ঘরে ঢুকে ছেলেকে পেলো না। বেরিয়ে এসে বললো,
“ও তো ঘরে নাই। উঠে গেলো নাকি।”
নিশাত ভেজা কাপড় মুচড়িয়ে ঝেড়ে বললো,
“উহু ওর নানার কাছে ঘুমাচ্ছে।”
মারওয়ান নানার কথা শুনে চোখ মুখ বিকৃত করে ফেললো। এই লোক সবকিছুতে ভাগ বসাচ্ছে। নিজের মেয়েকে তো বশ করেই ফেলেছে এখন আবার ছাওয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে। মারওয়ান এসব মোটেও সহ্য করবে না। সে হনহন করে শ্বশুরের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে নাহওয়ানকে ডাকতে লাগলো। নাসির উদ্দিন নাতিকে কোলে নিয়ে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলেন। ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেলো। বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো,
“এভাবে গরুর মতো চেঁচাচ্ছ কেন?”
মারওয়ান ভীষণ অপমানিতবোধ করলো। তাকে গরু বললো। সে শক্ত গলায় বললো,
“আমার ছাওকে নিতে এসেছি। কোনো বুড়ো ষাঁড়কে ডাকিনি।”
নাসির উদ্দিন ক্ষেপে গেলেন। চেঁচিয়ে বললেন,
“বুড়ো ষাঁড় কাকে বললে? বেয়াদব কোথাকার। চাপকে সোজা করে দিবো।”
মারওয়ান ডোন্ট কেয়ার মুডে বললো,
“আমি যদি গরু হই তাহলে আপনার মেয়ে নিশ্চয়ই গাভী। গরুর সাথে নিশ্চয়ই মানুষের বিয়ে হবে না।আমি যতদূর জানি গাভীর পিতা ষাঁড় কিংবা গরুই হয়। আপনার কি ধারণা মানুষ হয়?”
নাসির উদ্দিন চিৎকার করে পুরো বাড়ি মাথায় তুললেন। নাসির উদ্দিনের চিল্লানোর সময় মারওয়ান ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। ঝাঁকিতে নাহওয়ানের ঘুম ভেঙে গেলো। বাবাকে দেখে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো,
“বাবা।”
“বল পটলের বাচ্চা।”
“ইসেচো।”
“হ্যাঁ। তুই ওই বুড়োর কাছে কি করছিলি? তোর বাপের ইজ্জত শেষ করে দিলো আর তুই যেয়ে ঘুমাস। তোকে মারি?”
নাহওয়ান চোখ কচলাতে কচলাতে বললো,
“মালবে?”
“হ্যাঁ।”
“না। ইট্টু গুমাইচি।”
মারওয়ান ছেলের ফুলো ফুলো গালে চুমু দিয়ে বললো,
“ইট্টু ঘুমিয়েছিস কেন? তাই ইট্টুই মারবো।”
নাহওয়ান গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৫
“ইননা। নানুভাই টুমাকে মালবে।”
“ওরে সেয়ানা। ওই বুড়োকে ভয় পাই নাকি?”
“বুলো কি?”
মারওয়ান হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“তুই কচি সে বুড়ো। কচির বিপরীত বুড়ো।”