ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪০

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪০
তাজরীন ফাতিহা

অদূরে মরা গাছটার উপরে একটা কাক অনবরত কা কা করে ডেকে চলেছে সেই সকাল থেকে। নিশাত রান্নাঘরের জানালা দিয়ে সেদিকে উদাস দৃষ্টি ফেললো। ছোটবেলায় অনেকের মুখে মুখে শুনতো কাক ডাকা ভালো লক্ষণ নয়। কাক ডাকলে নাকি বিপদ আসে। যদিও ইসলাম এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করতে নিষেধ করে দিয়েছে। এগুলো বিশ্বাস করা শিককের শামিল। তাই মুসলিম হিসেবে এসব বিশ্বাস করা আকীদাহ এর পরিপন্থী। নিশাত আর কিছু না ভেবে কিছু দোয়া পড়ে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইলো।

এই কাক ডাকা নিয়ে হঠাৎ একটা স্মৃতি তার মানসপটে উঁকি দিলো।
নিশাত তখন স্বামী সংসারে নতুন পদার্পণ করেছে। মারওয়ানের স্বভাব, ব্যবহার সম্পর্কে সে অবগত ছিল না। তাই তার উচ্ছলতা কিংবা উড়নচণ্ডী রূপ প্রায়ই প্রকাশ করে ফেলতো। মারওয়ান ভ্রু কুঁচকে বিরক্তির জানান দিতো। মারওয়ানের কাছে এসব আদিখ্যেতা লাগতো। একবার প্রচণ্ড রূঢ় ভাষায় তাকে কথা শুনিয়েছিল বলে নিশাত রাগে অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুরের সাথে বাবার বাড়ি চলে এসেছিল। টানা পনেরোদিন ছিল বাপের বাড়ি কিন্তু ওই ঘাড়ত্যাড়া পুরুষ একটা খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি। শ্বশুর, শাশুড়ি নিয়ম করে খোঁজ নিলেও মারওয়ান তাকে পাত্তাই দিতো না যেন সে বাবার বাড়ি থেকে না আসলে মারওয়ান আজাদের কিছুই হবে না উল্টো ভালো হবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তো দিন এমনই পার হচ্ছিলো। একদিন উঠোনে কাক ডাকতে ডাকতে মাথাটা ধরিয়ে দিচ্ছিলো ঐসময় শ্বশুরবাড়ি থেকে কল আসে মারওয়ান নাকি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। নিশাত তখন অভিমান ভুলে শ্বশুর বাড়িতে ছোটে। কাঁদতে কাঁদতে বেচারি তো অজ্ঞান হওয়ার দশা। নতুন বিয়ে তার উপর গ্রামের সবাই বলাবলি করছে বউটা অপয়া, ভালো না হ্যান ত্যান। সে গিয়ে দেখে মারওয়ানের সারা শরীর ব্যান্ডেজে আবৃত। গ্রামের মানুষের ভিড় লেগে আছে। নিশাত এত মানুষের সামনে ঠিকমত দেখতেও পারেনি লোকটাকে। অ্যাকসিডেন্ট নাকি করেছে দুইদিন আগে। নিশাতকে জানতে দেয়নি তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। গ্রামের মানুষ এই নিয়ে নানান কানাঘুষা করেছিল। সবাই বের হয়ে গেলে যখন সে রুমে লোকটাকে একা পেয়েছিল তখন বেশ করুণ গলায় শুধেছিল,

“কিভাবে হলো?”
ভাঙা গলায় আওয়াজ এসেছিল,
“আজরাইল মোলাকাতে এসেছিল।”
নিশাতের বুকটা কামড় দিয়ে উঠেছিল। ঠোঁট কামড়ে বলেছিল,
“আমাকে জানালে কি খুব ক্ষতি হতো?”
ব্যান্ডেজ বাঁধা পাষাণ লোকটা আস্তে আস্তে ঠোঁট নাড়িয়ে বলেছিল,
“তুমি কে? হু আর ইউ?”
নিশাতের অক্ষিপট জলে টলমল করছিল।
“আমাকে চেনেন না?”
“না।”
“স্মৃতিশক্তি নাই?”
“আছে। সেখানে তুমি নাই।”

ব্যাস আর কিছু বলেনি সে। বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে প্রায় ঘণ্টা খানেক কেঁদেছে। মারওয়ান আজাদ ব্যথা পেলেও নিশাত বুক থেকে মাথা তোলেনি। কাঁদতে কাঁদতে মারওয়ানের বুকের উপরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভেঙেছিল মাথায় হাতের ছোঁয়ায়। চোখ উঠিয়ে দেখেছিল মারওয়ান ঘুমের ঘোরেই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হুশ নেই তার, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কে জানে আদতেই ঘুমে ছিল? নাকি নিশাতের চর্মচক্ষুর আড়ালে অন্য কিছু ঘটেছিল।
সেই থেকে কাক ডাকলেই ওই স্মৃতি মস্তিষ্কে কড়া নাড়ে তার। নিশাত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভাবনা থেকে বেরুলো। নাহওয়ান পাশে বসে হাত পা ছড়িয়ে গোশত আর আলু খাচ্ছে। নিশাত মায়াময় নজরে ছেলের পানে চাইলো।

“আব্বা?”
নাহওয়ান খাওয়ার তালেই জবাব দিলো,
“হু।”
“আরেকটু গোশত দেবো?”
“আলু ডাও। কুব মুজা মুজা।”
মাথা নাড়িয়ে জিহ্বা বের করে মজা বোঝালো। নিশাত কষানো গোশত থেকে আরেক টুকরো মুরগির ছোট পিস আর আলু উঠিয়ে দিলো। বাচ্চাটা মুখে মাখিয়ে ফেলেছে। মারওয়ান রান্নাঘরে এসে বললো,
“ওই আলুর বাচ্চা, আলু খাস?”
নাহওয়ান বাবার দিকে আলু ধরে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো।
“উলু কাবে?”
নিশাত চোখ রাঙিয়ে বললো,
“উলু বলতে নিষেধ করেছি না। আলু বলবে।”

নাহওয়ান ঘাড় নাড়িয়ে সায় জানালো। মারওয়ান বাটি হাতে নিশাতের পাশে দাঁড়ালো। তার চোখ চকচক করছে। ঘরে ভালো মন্দ রান্না হলে তার থেকে খুশি আর কেউ হয়না। নিশাত বললো,
“রান্না শেষ হলে খাবেন। আজকে গোশত কম রেঁধেছি।”
“ছেলের বেলায় কম পড়ে না। আমি চেয়েছি অমনি কম পড়ে গেলো।”
মারওয়ানের গুরুগম্ভীর উত্তর। নিশাত হতাশ হয়ে বললো,
“আপনি তো আর নাহওয়ানের মতো খান না তাই ছেলের সাথে তুলনা টানা বন্ধ করুন।”
মারওয়ান ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
“কি বোঝাতে চাইছো? আমি বেশি খাই? তুমি খাবারের খোটা দিচ্ছো আমায়? আসলে তুমি মূলত চাচ্ছো আমি না খাই।”

“ইয়া আল্লাহ! কোন কথা থেকে কি টেনে এনেছে? নিন ধরুন খান। আমি বরং ডিম ভাজি করে খেয়ে নেবো নে।”
বলেই নিশাত বাটিতে মুরগির দুই পিস সলিড পিস উঠিয়ে দিলো। মারওয়ান হাড়ের গোশত বেশি পছন্দ করে তাই হাড্ডি যুক্ত গোশত চাইলো। নিশাত একপিস হাড্ডি ওয়ালা গোশত মারওয়ানের বাটিতে দিয়ে থালাবাসন ধুতে লাগলো। মারওয়ান গোশত পেয়ে ছেলের পাশে পা গুটিয়ে খেতে লাগলো। নিশাত আড়চোখে বড় আর মিনি মারওয়ান আজাদের কান্ডকারখানা দেখছে। নিজের পাতের গোশত শেষ করে নাহওয়ানের পাতের দিকে সরু নজরে চাইলো মারওয়ান। নাহওয়ান হাত, পা ছড়িয়ে হাড্ডি কামড়াচ্ছে। ছেলের পাতের গোশত নিজের পাতে নিয়ে টুপ করে মুখে নিয়ে চিবোতে লাগলো। কুড়মুড় শব্দ হচ্ছে। নাহওয়ান ফ্যালফ্যাল নয়নে সেদিকে চেয়ে রইলো। মারওয়ান কোণা চোখে চেয়ে বললো,

“কি হয়েছে?”
নাহওয়ান মায়ের দিকে তাকিয়ে কান্না গলায় পা দাপিয়ে বলতে লাগলো,
“মা, আমাল গুস্ত কাইচে। উহুলি গুস্ত নিচো কেনু? আমাল গুস্ত ডাও।”
মারওয়ান ছেলের চিক্কুর শুনে মুখ থেকে গোশতের টুকরো বের করে ছেলের মুখে ঢুকিয়ে দিলো। নাহওয়ান কান্না বন্ধ করে কুড়মুড় চিবোতে লাগলো। মারওয়ান মুখ লটকে বিড়বিড় করে বললো,
“ব্রিটিশের নাতি পুরাই ব্রিটিশ।”
নিশাত পিছন থেকে বললো,
“উহু, খেঁকশিয়ালের ছেলে পাতি শেয়াল।”

বিশদিন হলো ইহাব মানহাকে কাউন্সিলিং করাচ্ছে। প্রত্যেকবার ডাক্তারের রুমে মানহা একাই ঢোকে। ইহাব আর জোর করেনা। সে ওয়েটিং রুমে বসে বসে অপেক্ষা করে। কখনো পেপার পড়ে, কখনো ফোনে কাজ সাড়ে আবার কফি খায় এরকম করে সময় পেরোয়। আজকেও মানহার ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট আছে। ইহাবের জরুরি কাজ আছে বিধায় সাথে সে সাথে যেতে পারবে না। নাস্তার টেবিলে উর্মি ভুঁইয়াকে জানানোর পর উর্মি ভুঁইয়া নিয়ে যাবেন বলেছেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়াও স্ত্রীর সাথে যাবেন বলে তর্কাতর্কি করছেন নাস্তার টেবিলে। উর্মি ভুঁইয়া বললেন,
“আমাদের সাথে আপনার কি কাজ?”

“আশ্চর্য কি কাজ মানে? তোমাকে কোনো মতেই একা ছাড়া যাবে না উর্মি? তুমি নিজেও জানো তোমাকে কেন একা ছাড়তে চাইছি না আর তাছাড়া চেয়ারম্যান বাড়ির দুই বধূ একা একা বাইরে যাবে ব্যাপারটা বাজে দেখায়। আমি আর কোনো কথা শুনতে রাজি নই। আমার রাগ সম্পর্কে নিশ্চয়ই ওয়াকিফাল তুমি।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার গুরুগম্ভীর টান টান মেজাজি গলা। উর্মি ভুঁইয়া স্বামীর রাগ দেখে আর কিছু বললেন না। সকালের নাস্তা সেরে গাড়িতে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। ঢাকার বিখ্যাত মহিলা সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে কাউন্সিলিং করছে মানহা। এখন একটু আধটু নরমাল হলেও পরিপূর্ণভাবে এখনো সুস্থ হয়নি সে। তার মধ্যে একটা আতঙ্ক বিরাজ করে সবসময়।
রাত দশটা। ইহাব ঘরে এসেই হাত ঘড়ি খুলে রাখলো। মানহা তোয়ালে এগিয়ে দিলো। ইহাব মুচকি হেঁসে বললো,

“গিয়েছিলে থেরাপিস্টের কাছে?”
“জ্বি।”
“আগের থেকে বেটার ফিল করছো?”
মানহা ঘাড় নাড়িয়ে সায় জানালো। ইহাব তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ইহাব আর মানহা খাবার ডাইনিং টেবিলে খেতে এসেছে। মানহা খাচ্ছে কম প্লেটে আঁকা উকি করছে বেশি। ইহাব সবটাই লক্ষ্য করলো তবে পিতামাতার সামনে কিছুই বললো না। খাওয়া শেষে ইহাব রুমে চলে গেলো। মানহা খানিক পর এলো। ইহাব ডাকলে এখন আর মানহা আগের মতো প্যানিক অ্যাটাক করে না। তবে সুস্থ মানুষের আচরণও করেনা। অস্বাভাবিক একটা ভাব আছে তার এখনো। ইহাব ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে ডাকলো,
“মানহা এদিকে এসো।”

মানহা রোবটের মতো এগিয়ে গেলো। ইহাব পাশে বসালো। আগের মতো অস্বাভাবিক আচরণ করছে না সে। ইহাবের জহুরী চোখ অন্যকিছু দেখছে। সে হাত ধরলো। হাতের ভাঁজে হাত নিলো। মানহা স্বাভাবিক যেন এরকম কিছুই ঘটবে সেটা সে অবগত। ইহাব আরেকটু সাহস করে পিঠে হাত দিলো। মানহা কোনো আপত্তি জানালো না। একদম শক্ত হয়ে বসে আছে যেন আশেপাশে কিছুই ঘটছে না। ইহাব ডাকলো,
“মানহা?”
“হু।”
মানহার অবচেতনে উত্তর। ইহাব মানহার হাত ছেড়ে ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। একটা নাম্বার ডায়াল করলো। খানিক বাদে রিসিভ করলে ইহাব বললো,

“ম্যাম কোনো ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে?”
অপরপাশ থেকে সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. নাজনীন আনোয়ারা বললেন,
“হচ্ছে। তবে আমি চাইবো তুমি তাকে এই সময়টাতে সাপোর্ট দাও। তার মধ্যে ভীতি আছে। তুমি আমার পরিচিত যে সেটা তাকে না জানিয়ে ভালোই করেছো নাহলে মেয়েটা আমাকে সবকিছু খুলে বলতো না। শোনো আজকে অনেককিছুই জানতে পেরেছি। ওর অতীতে বাজে কিছু স্মৃতি আছে। খুব ছোটবেলায় ও বাজে রকমের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ওর এক প্রতিবেশীর দ্বারা। এটা তার মস্তিষ্ককে এখনো তীব্রভাবে গেঁথে আছে। ওই ট্রমা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। তাই বিবাহ ভীতি কিংবা স্বামীর সাথে মেলামেশা তার মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করে সবসময়। এজন্য তোমার সাথে থাকলেই ওর প্যানিক অ্যাটাক হয় মাত্রাতিরিক্ত। ওকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে তোমার সাপোর্ট খুবই জরুরি।”

ইহাব এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ডাক্তারের কথা। তার বুকটা ভার ভার লাগছে। আরও টুকটাক কথা বলে রুমে এসে দেখলো মানহা আগের মতোই বসে আছে। আগের মানহা হলে ঘুমিয়ে পড়তো তবে এখন সে হয়তোবা ইহাবের জন্য জেগে আছে। ইহাব বারান্দা থেকে মানহাকে দেখতে লাগলো। মেয়েটা এতোবড় ঘটনা কাউকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করেনি? তাকে একবার জানিয়ে দেখতো বোকা মেয়েটা? নিজের মধ্যে এই ট্রমা আর কতবছর বয়ে বেড়াতে চেয়েছিল সে? ইহাব মানহার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“মানহা দাড়াও তো?”
মানহা উচ্চবাচ্য না করে স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়ালো। ইহাব হাত দুদিকে ছড়িয়ে বললো,
“আমাকে জড়িয়ে ধরো।”
মানহা জড়িয়ে ধরলো না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। ইহাব নিজ থেকেই ধরলো। মানহা কাঁপলো কিছুক্ষণ। তবে প্রতিক্রিয়া জানালো না আগের মতো। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ বন্ধ করলেই কিছু বিশ্রী স্মৃতি ভেসে উঠতে লাগলো চোখের সামনে। মানহা ইহাবের বন্ধন থেকে ছুটতে চাইলো। ইহাব ছাড়লো না। মানহা ভুলতে চায় অতীত। ইহাব কি পারবে তার অতীত ভুলিয়ে এই মানসিক ট্রমা থেকে বের করতে?

অফিসরুমে তর্কাতর্কি হচ্ছে। একটা ফাইল পাওয়া যাচ্ছে না। এ ওর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে। কারণ ফাইলটা গুরুত্বপূর্ণ। হেড জানলে চাকরি নিয়ে টানাটানি না পড়ে যায় আবার। জিনানের এদিকে মনোযোগ নেই। সে আয়েশ করে নুডুলস খাচ্ছে। নেওয়াজ খানিক চিল্লাচিল্লি করে এসে পাশের চেয়ারে বসলো।
“আপনি অলওয়েজ এমন শান্ত থাকেন কিভাবে আদহাম সাহেব? সবাই ফাইল খুঁজে হয়রান আর আপনি এদিকে নিশ্চিন্ত মনে মজা করে খাচ্ছেন।”

“তো কি করবো?”
“কি করবেন মানে? অন্তত চিন্তিত তো হতেই পারেন?”
নুডুলস শেষ করে জিনান মুখ মুছলো। তারপর বললো,
“এতগুলো মানুষ চিন্তিত হয়েছে তাতে কি কম পড়েছে বস? আমার চিন্তার কি দরকার? আমি চিন্তা করলে কি ফাইল ফুড়ুৎ করে হাতের মুঠোয় চলে আসবে?”
নেওয়াজ চুপ করে গেলো। ঠিকই তো বলেছে চিন্তা করলে তো ফাইল পাওয়া যাবে না। জিনান আদহাম ল্যাপটপের স্ক্রিন নেওয়াজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
“আজারাক সাইফার অ্যান্ড মার্ভ জেন।”
নেওয়াজ ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
“ওনারা দুজনই তো বয়স্ক মনে হচ্ছে। আমি তো ভেবেছিলাম ইয়াং কেউ হবে।”
জিনান চেয়ারে শরীর এলিয়ে বললো,
“আমি অবশ্য ধারণা করেছিলাম ইয়াং কেউ হবে না। ধারণা মিলে গেছে।”
“ওনারা কি শীগ্রই জয়েন হচ্ছেন নাকি? হেডের পক্ষ থেকে নোটিশ এসেছে?”
জিনান তীক্ষ্ণ নজরে পেপারওয়েট ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
“হুম।”

নিশাত স্কুল থেকে বাসায় এসে দরজা নক করতে গেলে দেখলো দরজা খোলা। অবাক হলো বেশ। এরকম দরজা খুলে তো কখনো রাখে না লোকটা তাহলে আজ এমন খোলা কেন? সে কাঁধের ব্যাগ চেপে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। পুরো ঘর চুপচাপ। শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। নিশাতের মনে কু ডাকছে। ধীরে ধীরে তাদের বেড রুমে প্রবেশ করে ঝটকা খেলো যেন। চেয়ারের উপর রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে কেউ একজন। পুরো শরীর কালো কাপড়ে আবৃত। সামনে মারওয়ানকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে পিছন দিক দিয়ে ধরে আছে তিনজন লোক। মুখ থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে মারওয়ানের। বোঝাই যাচ্ছে মারা হয়েছে তাকে। নিশাতের হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গেলো। সে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
“আপনারা কারা? এখানে কিভাবে ঢুকলেন?”

কালো কাপড়ে আবৃত লোকটি নিশাতের দিকে চাইলো। পিছনে দাঁড়ানো বর্ডিগার্ডটা লোকটার কানে কানে কিছু বললো। লোকটা বোরকা পরিহিত নিশাতের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্ক্যান করলো। তারপর জিহ্বা বের করে মারওয়ানের দিকে দৃষ্টি ফেলে বললো,
“কিরে ঘরে এত সুন্দরী বউ লুকিয়ে রেখেছিস অথচ আমাদের জানতেও দিলি না। অনেক চালাক তো তুই?”
মারওয়ান চোখ উঠিয়ে চাইলো। রক্তলাল চোখ। সামনের লোকটি তার লোকদের ইশারা দেয়া মাত্র লোকগুলো মারওয়ানকে আবারও মারতে লাগলো। নিশাত দৌঁড়ে মারওয়ানের কাছে যেতে চাইলে বসা লোকটি তার হাত ধরে ফেললো। নিশাতের গা ঘিনঘিন করে উঠলো। একজন পর পুরুষ তার হাত ধরেছে ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠলো। মারওয়ান মার খেতে খেতেই তা দেখছে। গর্জে উঠে বললো,
“ওকে ছাড় নয়তো জ*বাই করে ফেলবো তোদের। তোর সমস্যা আমার সাথে আমার স্ত্রীর দিকে হাত বাড়াচ্ছিস কেন?”

কালো কাপড়ে আবৃত লোকটি অট্টহাসিতে মেতে উঠলো।
“তোর বউ তো জানি। একদিনের জন্য নাহয় আমার হলো। সমস্যা কি? তোর সামনে আজকে তোর বউয়ের সাথে একটু মাস্তি করবো..”
কথা শেষ করতে পারলো না মারওয়ান সবাইকে ছাড়িয়ে লোকটার গলা টিপে ধরলো।
“কু***বাচ্চা তোকে আজকে শেষ করে দেবো। ওই জবান দিয়ে আমার স্ত্রীকে নিয়ে আরেকটা বাজে কথা বললে তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো জা*রজের বাচ্চা।”
পিছন থেকে মাথায় আঘাত লাগায় মারওয়ান ছেড়ে দিলো লোকটাকে। লোকটা মারওয়ানের মুখে জোরে জোরে আঘাত করতে লাগলো। মারওয়ান খুব কষ্টে বললো,
“নিশাত পাশের রুমে ছেলেকে আটকে রেখেছি দয়া করে ওকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাও।”
নিশাত কাঁদতে কাঁদতে বললো,

“আপনাকে ছেড়ে যাবো না।”
মারওয়ান প্রতিরোধ করতে করতে বললো,
“আরে আমার চিন্তা না করে নিজের চিন্তা করো। আল্লাহর কসম তুমি এখান থেকে যাও। এখানে থাকলে তোমার শরীরে হাত দেবে ওরা যা আমি সহ্য করতে পারবো না।”
মারওয়ান একা ওদের সাথে লড়তে পারছে না। নিশাত কাঁদতে কাঁদতে পাশের রুমে চলে গেলো। পিছন পিছন লোকগুলো যেতে চাইলে মারওয়ান আটকে ধরলো। রক্তে তার শার্ট রঞ্জিত। কপাল চুয়ে চুয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। ঠোঁট ফেটে চৌচির। কালো কাপড়ে আবৃত লোকটি ইচ্ছেমত মারতে লাগলো মারওয়ানকে। মারওয়ান লোকগুলোকে ছাড়ছে না তবুও। নিশাত ছেলেকে কোলে নিয়ে নিজেদের রুমের দিকে চাইলো। দেখলো মারওয়ানের রক্তে রুম ভেসে যাচ্ছে। নিশাত ডুকরে কেঁদে উঠলো। নাহওয়ান বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে কেঁদে উঠে ডাকলো,
“বাবা।”

মারওয়ান ছেলের ডাকে সেদিকে চাইলো। রক্তাক্ত চেহারায় বিষাদমাখা এক হাসি ফেরত দিয়ে বললো,
“যাও তোমরা। বাবা তোমাকে রক্ষা করছি পান্ডা।”
নিশাত ছেলেকে নিয়ে খালি পায়ে দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। পিছন পিছন লোকগুলো তাদের ধরতে চাইলে মারওয়ান নিজের শেষটুকু দিয়ে লড়াই করে গেলো। বেশ খানিক ধস্তাধস্তির পর বাসা শান্ত হয়ে গেল। মেঝের উপর নিঃশ্বাস বিহীন রক্তাক্ত মারওয়ান পড়ে রইলো একভাবে। হয়তোবা শ্বাসের স্পন্দন চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। কালো কাপড়ে আবৃত লোকটি মারওয়ানের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বললো,

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৯

“তোর স্ত্রী, সন্তানকে নাহয় আজকে বাঁচিয়ে গেলি তবে আমার নাগাল থেকে এরপর বাঁচাবে কে?”
বলেই ভয়ংকর অট্টহাসিতে কেঁপে উঠলো ছোট্ট ফ্লাটটি।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪১