ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৭

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৭
তাজরীন ফাতিহা

ইহাব ভুঁইয়া শাহাবাজপুর গ্রামে বেশ দাপট নিয়েই চলে। যেহেতু চেয়ারম্যানের ছেলে সে হিসেবে সে ভিন্নরকম আচার-আচরণ, মনোভাবের অধিকারী। গ্রামের মানুষ তাকে এজন্য সমীহ করে। তার বাবা ইমতিয়াজ ভুঁইয়াও এককালে গ্রামে ক্ষমতা, দাপট দেখিয়ে চলতো। এখনো তার মধ্যে প্রভাবশালী আচরণ বজায় আছে কিছুটা তবে আগের তুলনায় বেশ শান্ত এখন। গ্রামের উন্নয়নে যথাযথ কাজ করার চেষ্টা করেন। যদিও আগে বহু ফাকিবাজি করেছেন কিন্তু এখন তা অতীত।

বিশাল এক প্রাঙ্গণে বিরাজমান ‘পদ্মালয়’ নামক একটি নান্দনিক ধাঁচের বাড়ি। এর পরিসর এতটাই বিস্তৃত যে, একে ঘিরে থাকা প্রকৃতি এবং স্থাপত্যের মিলনমেলা যেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তৈরি করেছে। পদ্মালয়ের সৌন্দর্য ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হারিয়ে যেতে চাইলেই মন বলে, এখানে যেন সময় থেমে গেছে।
চেয়ারম্যান বাড়ি বলে কথা। চারপাশে বিভিন্ন প্রকারের দেশী বিদেশী গাছের সমন্বয়ে আচ্ছাদিত এই ‘পদ্মালয়’ বাড়ি। পদ্মালয় বাড়ির গেটের উপর বিরাট দুটি কৃত্রিম পদ্ম ফুল বসানো। খুব শৌখিন এই বাড়ির মানুষ সেটা বাইরে থেকেই আন্দাজ করা যায়। বাড়িটির ভিতরে প্লেটের টুংটাং আওয়াজ আর কথা চলছে। বাড়ির কর্তা ইমতিয়াজ ভুঁইয়া নিজের আদরের পুত্র ইহাব ভুঁইয়া আর কন্যা ইনাবা ভুঁইয়ার সাথে কথা বলছেন এবং খাবার খাচ্ছেন। পাশেই তার স্ত্রী উর্মি ভুঁইয়া চুপচাপ খাবার মুখে দিচ্ছেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ইহাব তোমার বিসনেসর কি অবস্থা?”
ইহাব টেবিলে এক’হাত ঠেকিয়ে খেতে খেতেই জবাব দিলো,
“ব্যবসার কাজ আপাতত বন্ধ পাপা। কয়েকদিন নিজেকে সময় দিতে চাচ্ছি।”
“দ্রুত নিজেকে রিফ্রেশ করে আবার কাজে ব্যাক করবে আশা করি।”
উর্মি ভুঁইয়া এতক্ষণ কথা না বললেও এবার মুখ খুললেন,
“হঠাৎ করে কাজে ব্রেক দিলে কেন? নিজেকে তো তুমি এতকাল সময় দিয়েছোই তাহলে ঘটা করে নতুন ব্যবসার কাজ ছেড়ে নিজেকে সময় দেয়ার কারণ?”
ইহাব খাবার খাওয়া থামিয়ে মায়ের দিকে চাইলো। মায়ের চোখে রাগ স্পষ্ট। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
“এমনিতেই আম্মু।”
উর্মি ভুঁইয়া চোখ মুখ কঠিন করে বললেন,
“এমনিতেই নাকি কোথাও মারামারির অফার পেয়েছো?”

ইহাব গ্রামে যতোই ক্ষমতা আর দাপট নিয়ে চলুক মায়ের কাছে সে এখনো বাচ্চা। এই বয়সেও মা তাকে বাচ্চাদের মতো শাসন করে, চোখ রাঙায়। ইনাবা ভাইকে চুপসে যেতে দেখে কুনুই দিয়ে গুতো দিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বললো,
“ব্রো, তুমি জানি কেমন? নাটক, সিনেমায় দেখো না নায়ক কাউকে গণে না। সব জায়গায় পাওয়ার দেখিয়ে চলে এমনকি বাবা, মাও ভয় পায় ছেলেকে তুমি এরকম চলতে পারো না?”
ইহাব নিচু কণ্ঠেই বোনকে ভেঙিয়ে বললো,
“আসছে নাটক সিনেমাওয়ালী। মা, বাবার মুখের উপরে কথা বলাও একটা বেয়াদবি। যদিও আমি মানুষটা অতটা ভালো নই কিন্তু মা, বাবার সামনে বেয়াদবি করার মতো শিক্ষা মম আমাকে দেয়নি। আমার ক্ষমতা বাইরে আর তাদের ক্ষমতা আমার উপর।”
কথার মাঝেই উর্মি ভুঁইয়া ধমকে উঠে বললেন,
“এতো কথা কেন? খাবারে মনোযোগ দাও। আর ইহাব তোমায় কি জিজ্ঞেস করেছি?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া এবার স্ত্রীর দিকে চাইলেন। বললেন,
“আহা উর্মি ছেলেকে এতো জেরা করছো কেন? খেতে দাও ওকে।”
উর্মি ভুঁইয়া ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার দিকে তাকালো না পর্যন্ত এমনকি তার কথা শোনেনি এমন ভাব করলো। ইহাব মায়ের কঠিন চাহনির দিকে চেয়ে বললো,

“আসলে মম, এখন আমি আপাতত একটু রিফ্রেশ চাচ্ছি ব্যাস এতটুকুই।”
কথাটুকু বলেই উঠে উপরে চলে গেলো ইহাব। ইনাবা আর অল্প একটু খেয়ে উঠে পড়লো। শুধু ইমতিয়াজ ভুঁইয়া আর উর্মি ভুঁইয়া রইলেন খাবারের টেবিলে। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া তার বিপরীত দিকে বসা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমার মূল্য তোমার জীবনে ঠিক কতখানি উর্মি?”
উর্মি ভুঁইয়া শক্ত হয়ে বসে থাকলেন। কোনো কথার না জবাব দিলেন আর না তাকালেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলে স্ত্রীর নিকট আসার জন্য উঠতে নিচ্ছিলেন ঠিক তখনই শক্ত একটি কণ্ঠ ভেসে এলো তার কানে।
“ওখানেই থাকুন। আরেক পাও এগুবেন না। আমাকে দরদ দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমার মূল্য আপনার জীবনে যতটুকু ঠিক তেমনই আপনার মূল্যও আমার জীবনে ততটুকু। সবার সামনে নিজের ভালোমানুষি বাদ দিন। আপনি যে কি সেটা আমি ছাড়া আর ভালো কে জানবে? তাই ঢং করা বাদ দিয়ে নিজের চরকায় তেল দিলে বেশি খুশি হবো।”
স্ত্রীর কঠিন বাক্যের বিপরীতে কিছু বলতে পারলেন না ইমতিয়াজ ভুঁইয়া। তবে মনে মনে ফুঁসে উঠলেন। এই ত্যাড়া মহিলাকে বিয়ে করে তার জীবনটা ছারখার হয়ে গেছে। ভেবেছিলেন একটু দরদ দেখিয়ে কথা বললে বুঝি একটু নরম স্বরে কথা বলবে এই মহিলা কিন্তু সেই আগের মতোই খিটখিট করে উঠলো তার সাথে। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া এই মহিলাকে আর ঘাটবে না বলে পণ করলো। তাছাড়া নিজের স্বভাব বিরুদ্ধ যাওয়াও একটা ক্রাইম। সাইকোলজিক্যাল ক্রাইম।

ইহাব বাইক নিয়ে নিজের আড্ডাস্থলে হাজির হলো। সেখানে আগে থেকেই তার সাঙ্গপাঙ্গ উপস্থিত ছিল। ইহাব সেখানে যাওয়া মাত্র ইহাবের দুজন চ্যালা দাঁড়িয়ে গেলো। বাকিরা কেউ দাঁড়ালো না। কারণ সবাই ইহাবের বন্ধু। এখানে ইহাবের মর্যাদা তাদের মতোই। এখানে কেউ লিডার নয় তবে যে যেদিন উত্তম পরামর্শ দিতে পারবে সেই হবে সেদিনের লিডার। ইহাবের বন্ধু তালিকায় আছে সাব্বির, পল্লব, হাসান, আসিম, মুহিব। এদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা অনেক। তার সার্বক্ষণিক দুজন চ্যালা হলো শামীম ও রবিন।
ইহাব নিজের জায়গায় বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠলো। সাব্বির ইহাবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“কিরে তোর আসলে পরিকল্পনা কি? তোর মতিগতি সুবেধার লাগছে না? ইদানীং তোর কি হয়েছে বল তো? কিছু লুকাচ্ছিস নাকি?”

ইহাব পায়ের উপর পা উঠিয়ে সানগ্লাস খুলে মাথার উপর দিলো। নিঃসন্দেহে ইহাব সুদর্শন বলিষ্ঠ এক পুরুষ কায়া। মুখে চাপ দাড়ির আস্তরণ, মুখে গম্ভীর হাসি। সে রহস্যময় হেঁসে বললো,
“উহু কি লুকাবো? একটা পরিকল্পনা মাথায় কিলবিল করছে বহুদিন ধরে তবে কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবো জানি না।”
পলাশ বললো,
“কি পরিকল্পনা?”
ইহাব মাথার পিছনে হাত দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনই একজনের কান টানার ব্যবস্থা করছি।”
মুহিব ভ্রু কুঁচকে বললো,
“তোর ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা পরিবর্তন হবে কবে?”
আসিম চায়ে ফুঁ দিতে দিতে বললো,
“ওয় কইবো সোজা কথা তাইলেই হইছে।”
সাব্বির বললো,

“তোরা এতো কথা বলিস কেন? ওরে কথা শেষ করতে দে।”
তারপর ইহাবের দিকে ভ্রু উঁচিয়ে চাইলো সাব্বির। অর্থাৎ বোঝাতে চাইলো খুলে বল। ইহাব রহস্যময় হেঁসে বললো,
“খুলে তো বলবো। একটু সবুর কর। একজনকে খুব শীগ্রই ঘরে আনতে চলেছি। সেই একজন হবে আমার দাবার গুটি। কানের সাথে যেন মাথাটা দ্রুতই এসে পড়ে সেই ব্যবস্থা করছি। দেখা যাক কতটুকু সফল হই। তোরা তো সবই জানবি। তোদের না জানিয়ে আমি কিছু করেছি কখনো?”
সকলের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ইহাব। ওর রহস্যময় কথা শুনে প্রত্যেকে হতাশ হলো শুধু একজন বাদে। সেই একজন খুব মনোযোগ দিয়ে প্রিচে চা ঢেলে খাচ্ছে। চোখে পাওয়ারি চশমা। বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। এসব কথায় তার মনোযোগ নেই বললেই চলে। আসিম নাক কুঁচকে বললো,
“এই শালায় এমন নির্লিপ্ত থাকে কেমনে? কেউ আমারে বুঝা? কোনো কিছুতে আগ্রহ নাই। এখন ওর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হইলো চা খাওয়া। Apathetic শা*লা।”

হাসান এটাও শুনেছে বলে মনে হয়না। কাপের অবশিষ্ট চা টুকু ঢেলে খেয়ে তাদের দিকে ইনোসেন্ট লুক নিয়ে তাকালো। পলাশ বললো,
“দেখ একবার। মনে হচ্ছে এইমাত্র আকাশ থেকে পড়লো এই বান্দা।”
হাসান বললো,
“তোরা কিছু খাবি না?”
সবাই তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে তাকালো। যেখানেই যায় এই প্রাণীর খাওয়া আর খাওয়া। মাত্র টোস্ট, বিস্কুট, চা খেলো এখন আবার তাদের খাবারের কথা বলছে। আসিম তো বলেই বসলো,
“ফুটবল কিক দিয়ে ওরে পৃথিবীর বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা কর। শা*লা silly goose!”
হাসান কথাটা গায়ে মাখলো বলে মনে হয়না। সে আরেকটা কেক আর স্যান্ডউইচ অর্ডার করে চুপচাপ ফোন দেখতে লাগলো। কেউ আর ওকে ঘাটালো না। ওরা সবাই ইহাবের দিকে জহুরী নজরে চাইলো। কিন্তু কিছুই উদঘাটন করতে পারলো না। ইহাবও আগের মতো রহস্যময় ভঙ্গিতে হেঁসে তাদের দিকে তাকালো। কি পরিকল্পনা করছে সে? কারো ক্ষতি বয়ে আনবে না তো!

কাল রাতে মারওয়ান পার্ট টাইম জব একবারে ছেড়ে চলে এসেছে শুনে নিশাত চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো বাসা মাথায় তুলেছিল। বিড়ি’খোরটা এসেই বিড়ি টেনে একেবারে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেছে। নিশাতকে কিছু বলেওনি কেন কাজ ছেড়েছে? শুধু বলেছে কাজ ছেড়ে দিয়েছি। এতকিছু ঘটিয়ে এসে এখন পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে মহাশয়। নিশাতের তার এতো আরামের ঘুম সহ্য হলো না। তাকে ঠেলে উঠিয়ে বললো,
“এই আপনি পুরুষ তো? আল্লাহ আপনাকে কোন মাটি দিয়ে বানিয়েছেন? আল্লাহ একটা মানুষ এতোটা অসহ্য কিভাবে হতে পারে? কাজ করবেন না তো পেট চলবে কি করে? কতদিন আপনাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো?”
মারওয়ান ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো,
“এসব প্যাঁচাল পাড়ার জন্য ঘুম থেকে তুলেছিস। মাথা খারাপ করার আগে এখান থেকে যা।”
নিশাত বললো,

“এই কাকে গলা উঁচিয়ে ধমকাচ্ছেন? আপনাকে আমি ভয় পাই? ভাদাইম্মা বিড়ি টানা লোক কোথাকার। সারাজীবন এরকম নাটক দেখতে দেখতে অসহ্য হয়ে গেছি। সোজাসাপ্টা বলুন আপনি কাজ ছেড়েছেন কেন?”
মারওয়ান বসা থেকে শুতে শুতে বললো,
“কাজ করতে আইলসেমি লাগে তাই।”
নিশাত চোখ কপালে তুলে বললো,
“কাজ করতে আইলসেমি লাগে মানে? সামান্য অল্প একটু সময় কাজ করেন এতেও এতো আইলসেমি কেন আপনার? আল্লাহ আমি এসব আর সহ্য করতে পারছি না। এরকম মেরুদণ্ডহীন একটা পুরুষের সাথে আমায় কেন জড়ালে মাবুদ?”
মারওয়ান ততক্ষণে আবারও ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে। নাহওয়ান মায়ের চিৎকারে ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। মায়ের চোখে পানি দেখে বাচ্চাটা ঘাবড়ে গেলো। নিশাত বিছানার কোনায় গিয়ে নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা করছে। অতিরিক্ত রাগ উঠলেই তার চোখ দিয়ে পানি বেরোয়। আজকেও ব্যতিক্রম হলো না। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে তার। নাহওয়ান বুকে ভর দিয়ে উঠে মায়ের কাছে গেলো। মায়ের চোখের পানি মুছে বললো,
“মা কাডো কিনো?”

বাচ্চাটারও চোখে পানি এসে গেলো মাকে কাঁদতে দেখে। নিশাত ছেলেকে দেখে নিজেকে সামালালো। চোখের পানি মুছে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“এমনিতেই বাবা। চোখে কি যেন পড়েছে তাই। তুমি উঠে গিয়েছো?”
“হু।”
“আসো বাবা মুখ ধুইয়ে দেই।”
নিশাত ছেলের দুই পা দুদিকে নিয়ে কোমড়ে বসিয়ে কোলে নিলো। বাচ্চাটা মায়ের কোলে ঘুম ঘুম চোখে শান্ত হয়ে বসলো। নিশাত নাহওয়ানকে ব্রাশ করিয়ে খাটের উপর বসিয়ে রান্নাঘরে গেলো। নাহওয়ান বাবাকে ঘুমাতে দেখে বাবার বুকের উপর চড়লো। তারপর ডাকতে লাগলো,
“বাবা বাবা ওটো। মা কাডে। মা কিনো কাডে?”
বাচ্চাটার অবুঝ প্রশ্ন ঘুমন্ত বাবার কাছে। নাহওয়ান বাবার গা বেয়ে নিচে নামলো আবারও উঠলো। মারওয়ান ঘুম ঘুম কণ্ঠে আস্তে আস্তে বললো,
“এই লিলিপুটের বাচ্চাটা শান্তি দিবে না আমায়। মায়ের মতো হয়েছে। সারক্ষণ আমার ঘুমের সাথে শত্রুতা এই ট্যাবলেটের।”

নাহওয়ান বাবাকে বিড়বিড় করতে দেখে মুখের কাছে কান এগিয়ে দিলো যেন বাবার কথা স্পষ্ট শুনতে পারে। কান এগিয়ে শুধু ট্যাবলেট কথাটুকুই শুনতে পেলো। তবে আয়ত্ত করতে পারলো না পুরো কথাটা। তারপর বাবাকে জিজ্ঞেস করলো এটা কি? কিন্তু মারওয়ান ততক্ষণে আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে। বাচ্চাটা খাট থেকে বহু কষ্টে নেমে দৌঁড়ে মায়ের কাছে গেলো। নিশাত ছেলের জন্য নাস্তা রেডি করছিল। বাচ্চাটা দৌঁড়ে এসে মায়ের পা ধরায় নিশাত ঘাবড়ে গেলো কিছুটা। তারপর ছেলেকে দেখে স্বস্তি পেলো। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বিছানা থেকে নেমেছো কেন? আমিই তো আসতাম।”
“মা টেলবেল কি?”
নিশাত ছেলের কথা বুঝলো না। বললো,

“কি বললে?”
“টেলবেল কি?”
নিশাত বললো,
“জানি না তো। এটা কোথা থেকে শুনলে?”
“বাবা বলেচে।”
“তাইলে তোমার বাবাকেই জিজ্ঞেস করো টেলবেল কি? হবে হয়তো তার বিড়ির কোনো নাম। ঘুমের মধ্যেও এসব বলে ক্লাসলেস পুরুষ কোথাকার।”
শেষ কথাটা বিরবির করে বললো। নাহওয়ান মায়ের কাছেও কোনো সদুত্তর না পেয়ে মন খারাপ করলো। সে আবারও বাবার কাছে গেলো। মারওয়ান উবু হয়ে শুয়ে ছিল। বাবার পিঠের উপর বসে নাহওয়ান বাবাকে জাগাতে লাগলো। অনেকক্ষণ পর মারওয়ানের ঘুম ভাঙলো। ছেলেকে পিঠ থেকে নিচে নামিয়ে নিজের কোলের ভিতরে নিয়ে অনবরত চুমু খেতে লাগলো। নাহওয়ান বাবার চুমুর হাত থেকে বাঁচতে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। মারওয়ান তাও থামলো না। হাতের উপরেই চুমু দিতে থাকলো। নাহওয়ান শেষে বাবার কোল থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে নিলে মারওয়ান দিলো না। বললো,

“আর ভাঙাবি আমার ঘুম? তোকে আজকে সারক্ষণ চুমু খাবো রে ফাইয়াজ।”
বাচ্চাটা মোচড়ামুচড়ি করতে করতে বললো,
“ইন না।”
“ইন না কি? কেন জাগিয়েছিস আমায়?”
নাহওয়ান উঠে বসে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“টেলবেল কি?”
মারওয়ান ভ্রু সোজা করে বললো,
“এটা আবার কি?”
“টুমিই টো বলেচো।”
“কি বলিস আমি এটা বলবো কেন? এই শব্দই তো নতুন শুনলাম।”
“না টুমিই বলেচো।”
“ধুরু এই আজগুবি শব্দ আমি বলতে যাবো কোন দুঃখে? তোর মা জানে বোধহয়। তাকে জিজ্ঞেস কর।”
“মা যানে না।”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৬

“তাইলে ওটা তোর নানা বাড়ির কেউ হবে হয়তো।”
মারওয়ান হামি দিয়ে গুরুত্বহীন ভাবে কোনরকম বললো। নাহওয়ান কথাটুকু শুনেই মায়ের কাছে দৌঁড়ে গেলো। মারওয়ান ধরতে গিয়েও পারলো না। এখন এই বিচ্ছু সব কথা মাকে সাপ্লাই করবে। মহামুসিবতে পড়লো তো। এখন লিলিপুট এসে জিজ্ঞেস করবে তার পরিবারকে এটা বলা হলো কেন? কে জানে এই টেলবেল গাঁজাখুরি শব্দ কিজন্য বলেছে সে?

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৮