ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৯
তাজরীন ফাতিহা
ভোরের নির্মল হাওয়ায় যেন স্নিগ্ধতার গান ভেসে আসে। গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুতে ঝলমল করে সূর্যের প্রথম আলো। পাখির কূজনের মধুর সুরে প্রকৃতি যেন নতুন দিনের আনন্দ বার্তা শোনায়। নিশাত ফজরের সালাত আদায় করে মিহি সুরে কুরআন তেলাওয়াত করতে বসে গেলো পাশে নাহওয়ানও মায়ের কোলে ঘাপটি মেরে আছে। ভোরের এই মিষ্টতা নিশাতকে দারুন প্রশান্তি দেয়। নাহওয়ানের মাঝে মধ্যে ফজরের সময় ঘুম ভেঙে যায়। বাচ্চাটা তখন মায়ের সাথে সাথে নামাজ পড়ার চেষ্টা করে, মায়ের পাশে বসেই কুরআন তেলাওয়াত শোনে।
নিশাত কুরআন তেলাওয়াত শেষে কিছুক্ষণ দোয়া পড়ে নিজের ও ছেলের শরীরে ফুঁ দিয়ে মাসেহ করে দিলো। কুরআনে চুমু খেয়ে জায়গা মতো রেখে দিলো সেটা। ছেলেকে কোলে নিয়ে বিছানায় উবু হয়ে শায়িত মারওয়ান আজাদের নিকট গেলো সে। বাচ্চাটাকে বিছানায় নামিয়ে মারওয়ানের সারা শরীরে ফুঁ দিয়ে দিলো। নাহওয়ান বিছনার উপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের কার্যক্রম দেখছে। ফুঁ দেয়া শেষে নিশাত ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আব্বা, আপনি ঘুমাবেন?”
নাহওয়ান মাথা নাড়ালো অর্থাৎ ঘুমাবে। নিশাত বললো,
“আচ্ছা ঘুমান বাবার পাশে। মা নাস্তা বানিয়ে দুপুরের রান্না সেরে ফেলি গিয়ে।”
নাহওয়ান বাবার পিঠের উপর উঠে ঘুমিয়ে পড়লো। নিশাত ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। রান্নার সরঞ্জাম গুছিয়ে নিলো। আজকে সকালের নাস্তায় পাটিসাপটা পিঠা করছে নিশাত। শীতের সময়ে সকালে পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। যখন মনোযোগ দিয়ে পিঠায় ক্ষীর দিচ্ছিলো সেসময়ই একটা হাত এসে তাকে ঝাপটে অন্যপাশে সরিয়ে নিলো। নিশাত ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহ। আল্লাহ বাঁচাও জ্বিন, শয়তানের হাত থেকে বাঁচাও মাবুদ।”
নিশাত চোখ বন্ধ করে আওড়ে যাচ্ছে। একটু পর ঠাস করে মাথায় গুতো দিয়ে গমগম কণ্ঠে একজন বললো,
“মন চায় আছাড় দিয়ে নাড়িভুড়ি বের করে ফেলি। খালি বড় বড় কথা। কাজের বেলায় ঠনঠন। চুলোর একেবারে ভিতরে ঢুকে গিয়ে রান্না করতি। আগুন যে চুলে লাগতে নিয়েছিল দেখেছিলি?”
নিশাত দেখলো তার সামনে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে মারওয়ান দাঁড়িয়ে আছে। নিশাত বুকে থু থু দিয়ে বললো,
“আমাকে দূর থেকে ডেকে দিলেই তো হতো। এভাবে কোরবানির গরুর মতো ঝাপটে ধরার কি আছে? এইসময় তো আপনি কখনোই জাগেন না আজকে হঠাৎ এই সময়ে?”
মারওয়ান ফোঁস করে উঠে বললো,
“এইসময়ে মানে? কেন উঠতে পারিনা আমি? কখন উঠবো না উঠবো এটা তোকে বলে উঠতে হবে নাকি? আর ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকেও চুল বের হয়ে আছে কেন? ওড়না তাহলে দেয়ার দরকার কি? খোপা করে রাঁধতে পারিস না? আগুন লাগলে কি হতো? সবাই তো আমাকে দুষতো।”
কথাটুকু বলেই মারওয়ান গজরাতে গজরাতে প্রস্থান করলো। নিশাত এখনো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে গেলো মনে হলো। এই লোকের মতিগতি বোঝা বড় দায়। চুল খোপা করে মাথায় ওড়না দিয়ে পিঠা বানাতে লেগে গেলো আবারও।
এক থাল ভর্তি গরম গরম ক্ষীরে ভরা পাটিসাপটা পিঠা। নিশাতের হাতের এই পাটিসাপটা পিঠা সবারই পছন্দের। সবাই-ই বেশ প্রশংসা শুনেছে শুধুমাত্র বিড়ি’খোরটার বাদে। খাবে ঠিকই কিন্তু মুখ দিয়ে প্রশংসা বের হবে না কোনোদিন। তার কোনো রান্নারই আজ পর্যন্ত কোনো প্রশংসা করেনি এই ভাদাইম্মা। নাহওয়ান হাত পা ছড়িয়ে পিঠা খাচ্ছে। মারওয়ান মাত্র এসে বসলো। ছেলেকে পিঠা খেতে দেখে বললো,
“কিরে গোল আলু কি খাচ্ছিস?
নাহওয়ান মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো,
“পিটা কাই।”
নিশাত গ্লাস আর জগ রেখে পাটিতে বসলো। নাহওয়ানকে দুই হাতে পিঠা খেতে দেখে বললো,
“একি নাহওয়ান এভাবে পিঠা খাচ্ছো কেন? ডান হাতে খাও। বাম হাতে খাওয়া ঠিক নয়।”
নাহওয়ান ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর পিঠা ডান হাতে নিতে গিয়ে পড়ে গেলো হাত ফসকে। মারওয়ান তা দেখে বললো,
“আসছে মাস্টেরি করতে। আমার দুই বছরের দুধের ছেলেকে ডান, বাম শিখাতে এসেছে।”
নিশাত কিছু বলবে না বলবে না করেও বললো,
“এই বয়সেই বাচ্চাদের শিক্ষা দিয়ে গড়তে হয় নাহলে বড় হয়ে ভাদাইম্মা, উশৃঙ্খল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ওকে আমি আপনার মতো কিছুতেই হতে দিবো না। ও হবে আল্লাহর উত্তম বান্দা। আর স্ত্রী, সন্তানের কাছে হবে সম্মানিত।”
মারওয়ান পাটিসাপটায় কামড় দিতে গিয়েও দিতে পারলো না। নিশাত পাটিসাপটা নিয়ে ছেলেকে খাইয়ে দিতে লাগলো। নাহওয়ান নিজের হাতেরটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিলো। নিশাত ঠোঁটে মুচকি হাসি নিয়ে পিঠেই কামড় দিলো। নাহওয়ান মাকে খাইয়ে উঠে বাবার কাছে গেলো। মারওয়ানের হাতে এখনো পাটিসাপটাটা ধরা। সে স্ট্যাচু হয়ে বসে আছে। পিঠায় একটা কামড়ও দেয়নি। নাহওয়ান বাবার মুখের সামনে পিঠা ধরে বললো,
“বাবা কাও। মুজা মুজা।”
মারওয়ানের ধ্যান ভঙ্গ হলো যেন। মুখের সামনে পাটিসাপটা পিঠা দেখে ছেলের দিকে চাইলো। দেখলো স্যান্ডুগেঞ্জি পরিহিত তার দুই বছরের ছেলে পিঠা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। গেঞ্জিটা মলিন হয়ে গেছে। অনেকদিন পড়ে বাচ্চাটা তাই বোধহয়। কি ছোট্ট শরীর! ছোট্ট ছোট্ট হাতে তার দিকে পিঠা বাড়িয়ে মায়াময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! মারওয়ান বললো,
“খেতেই হবে?”
“হু, কাও।”
মারওয়ান মুখে নিলো। নাহওয়ান বাবার দিকে তাকিয়েও থাকলো। মারওয়ান বললো,
“আয় তোকে খাইয়ে দেই।”
নাহওয়ান ভদ্র বাচ্চার মতো বাবার কোলে বসলো। মারওয়ান ছেলেকে খাইয়ে দিতে লাগলো।
মানহা ব্যাগ শক্ত করে চেপে রাস্তার একপাশ দিতে হেঁটে যাচ্ছে। বাড়ির এটুকু রাস্তা তাকে একা একাই ক্রস করতে হয়। ব্রিজের গোড়া পর্যন্ত বান্ধবীরা সাথে থাকে বাকি এইটুকু পথ সে একাই যায়। মাঝে মাঝে মেঝ ভাইয়া অথবা সেঝো ভাইয়া তাকে নিয়ে যায় কলেজ থেকে। যেহেতু অনার্সে ডিগ্রি কলেজে পড়ছে সেহেতু এটাকে কলেজই উল্লেখ করে সবাই। আজকে মেঝ ভাই মাহদী আমিন ব্যস্ত বিধায় তাকে নিতে আসেনি বোধহয়। আর সেঝো ভাই মাহফুজ আরাফ রাজশাহীতে এখন।
মানহা গুটিগুটি পায়ে বাসার উদ্দেশে হেঁটে চলছে। পথিমধ্যে কতগুলো কুকুরকে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো তার। কুকুরে ভীষণ ভয় তার। এতগুলো কুকুর কোথা থেকে এলো? সে রাস্তার এককোনে দাঁড়ালো। যেন কুকুরগুলো তাকে না দেখে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও যখন কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ বেড়ে গেলো তখন মানহার কান্না পেয়ে গেলো। নিকাবের আড়ালে চোখ ভিজে একাকার। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে ইহাব ভুঁইয়া নামক লোকটাকে হেঁটে আসতে দেখে একটু সাহস পেলো যেন। মানহা ঠিক মতো লোকটার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। কারণ পরপুরুষ তার নিকট কুকুরের চেয়েও ভয়ংকর। সে ঠিক করলো ইহাব নামক পুরুষটি গেলেই সে এখান থেকে বের হয়ে বাসায় যাবে।
অন্যদিকে ইহাব এক হাত পকেটে গুঁজে কানে ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে হেঁটে আসছে। কতগুলো কুকুরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইট হাতে নিয়ে ওদের দিকে ছুঁড়ে মারলো। কুকুরগুলো পড়িমড়ি করে ছুটে পালালো। ইহাব চুলে হেয়ার স্লিকিং করতে করতে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎই তার নজরে পড়লো বোরকা পরিহিত একজন রমণীর পানে। তার চোখ সরু হয়ে গেলো। যাকে ভাবছে সেই কিনা দেখতে এগিয়ে গিয়ে দেখলো সেই। উল্টো দিকে ঘুরে আছে। ইহাব রহস্যময় ভঙ্গিতে তাকালো। কল কেটে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“কোনো হেল্প দরকার?”
মানহা আচমকা কারো কণ্ঠস্বরে থতমত খেয়ে গেলো। তাও কণ্ঠটা যদি হয় পুরুষের তাহলে তো কথাই নেই। মানহা থরথর করে কেঁপে উঠলো। মনে মনে অনেকবার আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলো যেন লোকটা চলে যায়। ইহাব আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“কথা বলছো না কেন?”
মানহা চোখ একবারে হতবাক হয়ে গেছে। চেনে না জানে না একজনকে ডিরেক্ট তুমি বলা কেমন ভদ্রতা? মানহা কোনো কথা না বলে ব্যাগ শক্ত করে চেপে ধরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। ইহাব অবাক হলো এই কাণ্ডে। চোখ মুখ কুঁচকে বিড়বিড় করে বললো,
“জাস্ট বিরক্তিকর।”
তারপর মানহার পিছন পিছন একটু গিয়ে জোরেই বলে উঠলো,
“এতো সাধুগিরি কই থাকে আমিও দেখবো। নিজেকে এতো লুকিয়ে রাখছো আবার এমন না হয় একদিন আমিই তোমাকে বোরকা ছাড়া পুরোপুরি দেখবো। কারণ যার থেকে মানুষ পালাতে চায় তার কাছেই কিন্তু ধরা দিতে হয়।”
মানহা “বেয়াদব ও অসভ্য” বলে দ্রুত কদম ফেলে প্রস্থান করলো। ইহাব চুলে ব্যাকব্রাশ করতে করতে বললো,
“যা বললে তার অপেক্ষায় থেকো মেয়ে।”
বলেই রহস্যময় ভঙ্গিতে হেঁটে উল্টোদিকে চলে গেলো।
“বাবা ডুডু কাবো।”
মারওয়ান একটা কাগজে কি যেন লিখছিল। নাহওয়ান খেলনা দিয়ে খেলছিল আচমকা এই কথা বলায় মারওয়ান বললো,
“কি বললি রে ফাইয়াজ?”
“ডুডু কাবো।”
মারওয়ান বললো,
“দুধ কই পাবো?”
নাহওয়ান পা দাপিয়ে বাবাকে ঝাঁকিয়ে বললো,
“কাবোই। ডুডু ডাও।”
মারওয়ানের মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে যেতে লাগলো। দুধ পাবে কই এখন সে? বাচ্চাটা মাঝে মধ্যে এতো জ্বালায় ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। মারওয়ান বিরক্ত হয়ে বললো,
“জ্বালাস না তো ফাইয়াজ। আমি এখন দুধ পাবো কই? তুই খেলছিস খেল না বাপ।”
নাহওয়ান কেঁদে দিয়ে বললো,
“টোমালটা ডাও।”
মারওয়ান চোখ কপালে তুলে বললো,
“সর্বনাশ এই আন্ডা কি বলে?”
মারওয়ান খাতা বন্ধ করে আবারও বললো,
“কোথা থেকে দিবো।”
“মা যে ডেয়।”
“ওই তোর মা আর আমি এক?”
“ডাও।”
বাচ্চাটা সচরাচর দুধ খাওয়ার বায়না করে না। নিশাত বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো ছেড়েছে কয়েকমাস হয় তবুও মাঝে মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে বাচ্চাটা। নিশাত বহু কষ্টে সামলায় তখন। মারওয়ান মহা মুশকিলে পড়লো যেন। ফোন নিয়ে নিশাতের নম্বরে ডায়াল করলো। নিশাত ক্লাস নিচ্ছিলো তখন তাই ধরেনি। মারওয়ান ফোন লাগাতার দেয়ার ফলে একসময় ফোন ধরলো নিশাত। মারওয়ান বললো,
“ছেলে তো দুধের জন্য কাদঁছে কি করবো?”
নিশাত বেশ বিরক্ত হলো। ক্লাসের সময় কল দিয়ে বলছে ছেলে তো দুধের জন্য কাদঁছে কি করবো? কি করবে সেটা বুঝি নিশাত জানে। আক্কেল বুদ্ধি কিচ্ছু নেই এই ভাদাইম্মা পুরুষের। কোনরকম বললো,
“নাচুন কি আর করবেন।”
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৮
বলেই ফোন কেটে দিলো নিশাত। মারওয়ান সত্যি ভেবে নাচতে লেগে গেলো। নাচা আর কি। কোমড়ে দুই হাত দিয়ে এপাশ ওপাশ করা এতটুকুই। নাহওয়ান বাবাকে এরকম উদ্ভট ভঙ্গিমা করতে দেখে কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ছেলেকে কান্না থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মারওয়ান নাচকে আরেকটু রঞ্জিত করার জন্য লাফ দিলো একটা। নাহওয়ান বাবাকে পেঙ্গুইনের মতো লাফিয়ে উঠতে দেখে খিলখিল করে হেঁসে নিজেও একটা লাফ দিলো। তারপর আরকি বুড়ো পেঙ্গুইন আর মিনি পেঙ্গুইন কিছুক্ষণ লাফালাফি করে কাটালো।