ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪১ (২)
মিথুবুড়ি
‘রুম থেকে বের হতেই এলিজাবেথের সম্মুখীন হলো রিচার্ড। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। পরক্ষণেই রিচার্ড সর্তকতার সহিত দেখল আশপাশ।দেখল নিচে কোনো গার্ড আছে নাকি। সৌভাগ্যক্রমে রাত গভীর, ক্লান্ত গার্ডগুলো নিজেদের দায়িত্ব ভুলে ঝিমিয়ে পড়েছে। সেই সুযোগেই এলিজাবেথ বাংকার ছেড়ে পালিয়ে এসেছে।
“বলুন না, আপনি তাকে স্পর্শ করেননি। প্লিজ ভেঙে দেবেন না আমাকে।” কণ্ঠে যন্ত্রণার চোরাস্রোত।
‘রিচার্ড এক ঝটকায় এলিজাবেথকে রুমের ভেতরে টেনে নিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করার আগে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল চারপাশে। ভেতরে বিছানার উপর অগণিত অস্ত্র আর বুলেটের স্তূপ ছড়ানো। বিছানায় কোনো শিথিলতার চিহ্ন নেই, কেবল চাপা উত্তেজনা অস্ত্রের ভারে। কোথাও লাড়ার উপস্থিতি ছিল না। এলিজাবেথ এক ঝটকায় রিচার্ডের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। ওর কণ্ঠ ভাঙা, চোখ দুটো অসম্ভব ফোলা। ভেতরে বেসামাল ঝড় বইছে।
“বলুন নাহ আপনি ঐ মেয়েটাকে স্পর্শ করেননি। আপনাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।”
‘রিচার্ড গভীর শ্বাস টেনে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,”এখানে এলে কীভাবে?”
‘এলিজাবেথ অগ্নিশর্মা হয়ে তেড়ে গিয়ে রিচার্ডের বুকে ধাক্কা দিতে দিতে বলল, “আমার প্রশ্নটা এটা ছিল না! সত্যিটা বলুন।আপনার স্পর্শ, আপনার প্রতিটি কথা সব কিছু মিথ্যে ছিল?”
‘রিচার্ড এলিজাবেথের হাত ধরে শক্ত করে চেপে ধরল। চোখে একরাশ বিষণ্নতা থাকলেও কণ্ঠে কাঠিন্যেতা,”কোনো কিছু মিথ্যে ছিল না। সবকিছু সত্যি। একচুলও মিথ্যে নয়।”
‘চিৎকার করে উঠল এলিজাবেথ, “আপনি আর কতদিন এই মুখোশ পরে থাকবেন? আমায় আর ভেঙে ফেলবেন না। ভাঙতে ভাঙতে আমি শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। ছেড়ে দিন এইসব। চলুন না, আমরা সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘রিচার্ডের চোখ আটকালো এলিজাবেথের গালে। একসময় যে মুখ ছিল লাবণ্যে পূর্ণ এখন তা বিধ্বস্ত আর আহত। গালে থাবার গভীর দাগ, নাকের পাশে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের সরু রেখা। গ্লানিতে ভরা চোখ নিচে নেমে এলো গলার দিকে। শুকনো ঢোক গিলল রিচার্ড। পায়ের চাপে গলায় কালচে দাগ বসে গেছে।এলিজাবেথের জামাও ছেঁড়া, জায়গায় জায়গায় বিদীর্ণ। বুক কাঁপল রিচার্ডের সেই সময়টার কথা ভেবে সেই কাতর চাহুনি গুলো।গভীর নিশ্বাস ফেলে রিচার্ড এগিয়ে গেল। নিজের কোটটা খুলে নিঃশব্দে এলিজাবেথের কাঁধে জড়িয়ে দিল। রিচার্ডের ঠোঁটে অম্ল স্বভাবিক হাসি ফুটে। গভীর, তিক্ততার সুরে বলল,
“আমি যেখানে বলি সেখানেই যাবে?”
‘এলিজাবেথ এক নিমিষের জন্য সব ভুলে ছটফটিয়ে উঠল,”হ্যাঁ যাবো। শুধু ছেড়ে দিন এই অন্ধকার জগৎ। ফিরে আসুন আলোর পথে।”
‘রিচার্ড এক পলক তাকিয়ে রইল। ওর কঠোরতা ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসছিল। নিঃশব্দে ঠৌঁট ছোঁয়াতে যাচ্ছিল রক্তাক্ত অধরে। তখনই হঠাৎ ফোনে টিং শব্দে মেসেজ আসলো। সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে গেল রিচার্ডের কণ্ঠস্বর, দৃষ্টি, আচরণ। শক্ত করে চেপে ধরল এলিজাবেথের কব্জি। কাঠকাঠ গলায় বলল,
“তার আগে তোকে এখান থেকে পালাতে হবে।”
“পালাতে মানে? আর বাকি মেয়েগুলো… তারা কোথায়?”
“তারা সুরক্ষিত আছে।”
“কোথায়? সত্যিটা বলুন।”
“ড্যাম ইট, কথা বাড়ানোর সময় নেই। কাম।”
‘রিচার্ড এলিজাবেথকে টেনে নিয়ে গেল জানালার কাছে। কোনো কথা না বলে হঠাৎ এক লাফে জানালার ওপাশে চলে গেল। নিচে সামান্য জায়গা ছিল পা রাখার, কিন্তু উচ্চতা এতটাই ভয়াবহ যে তা দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল এলিজাবেথ। ভয়ে শুকনো ঢোক গিলছে অনবড়ত। হাইট ফোবিয়া আছে ওর। ওপাশ থেকে রিচার্ড এলিজাবেথের কোমরে শক্ত করে হাত রাখল। অতঃপর এক নিপুণ কৌশলে এলিজাবেথকে শূন্যে তুলে নিজের দিকে টেনে নিল। এলিজাবেথের চোখ নিচের দিকে পড়তেই শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ানক শীতল স্রোত বয়ে যায়। উচ্চতার ভীতিটা শরীরে ঝড় তোলে। কাঁপা হাতে খামচে ধরল রিচার্ডের শার্ট।
‘রিচার্ডের এক হাত মজবুতভাবে পাশের পাইপ ধরা অন্য হাতে এলিজাবেথকে বুকের সাথে শক্ত করে মিশিয়ে রেখেছে ওর শরীরের প্রতিটি কাঁপন ঠেকাতে। তবুও থরথর করে কাঁপছে এলিজাবেথের গড়ন৷ সরু পথটা এত সংকীর্ণ যে এলিজাবেথের আঁকড়ে ধরা ভীতির বাঁধনে রিচার্ড আর সামনে এগোতে পারছে না। তবুও চোখে অটল প্রতিশ্রুতি। কঠিন হয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। গুনগুন করে কাঁদছে এলিজাবেথ ভয়ে। একটু পরপর শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে। হঠাৎই নিচে শোনা যায় গার্ডদের আনাগোনা। ওরা টহল দিচ্ছে একটু পরপর। রিচার্ড চেপে ধরল এলিজাবেথের মুখ। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,”হুঁশশশ! কোনো শব্দ নয়।”
‘রিচার্ডের গা থেকে ভেসে আসা পারফিউমের ডার্ক স্মেইলে আজ তিক্ততা খুঁজে পেল না এলিজাবেথ। বরংচ ওকে যেন খুব করে টানছে। একদম বৃক্ষপটে খাপটি মেরে রইল এলিজাবেথ। নড়লেই পা ফস্কে যাবে। নিভু স্বরে আওড়য়ালো,”কি করতে চাইছেন আপনি?”
“তোমাকে এই আজাব থেকে বের করতে চাইছি।”
“আর আপনি?”
‘তাচ্ছিল্যের হাসি দিল রিচার্ড। কণ্ঠে দৃঢ়তা,”আমি এখানের ই দুষ্টু রাজা। রাজারা কখনো রাজ্য ছেড়ে পালাই না।”
“রাজারা শুধু রাণীদের বিতারিত করতে পারে?”
‘রিচার্ড তাকাল এলিজাবেথের দিকে। ফোঁস নিশ্বাস ছেড়ে আলগোছে ঠৌঁট ছোঁয়াল এলিজাবেথের মাথায়। তবে সেই শুদ্ধতার মৃদু ছোঁয়া টের পেল না এলিজাবেথ। বুকের মধ্যে আরও শক্ত করে এলিজাবেথ’কে চেপে ধরল রিচার্ড।
“রাজা তার রাণীর জন্য সবকিছু করতে পারে সিংহাসনের শীর্ষে বসাতে পারে আবার রাজ্য থেকে নির্বাসিতও করতে পারে। এটি কোনো নিষ্ঠুরতা নয়, বরং ভালোবাসার এক অনন্য ও গভীর প্রকাশ। যা মাঝে মাঝে কঠোরতার ছদ্মবেশে ধরা দেয়।”
‘বুক থেকে মুখ তুলে রিচার্ডের দিকে তাকাল এলিজাবেথ। চোখে আকুলতার জোয়ার। কণ্ঠে গভীর নির্ভেজাল সমর্পণ,
“আপনার কথার মাঝে লুকানো আর্তি থাকলেও চোখে নেই। আমি আপনার চোখের ভাষা পড়তে পারি। দয়া করে আমাকে ভুল প্রমাণ করবেন না।”
‘পায়ের শব্দগুলো ক্ষীণ হয়ে মিলিয়ে গেল। রিচার্ড তীক্ষ্ণ নজরে দেখে নিল আশেপাশে আর কেউ আছে কিনা। না চারপাশ এখন নীরব। ফার্মহাউসের পেছনে আপাতত কেউ আসবে না অন্তত বিশ মিনিট। এলিজাবেথের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে রিচার্ড ধীরপায়ে এগিয়ে এল। পাইপ থেকে হাত সরিয়ে নিজের পিঠের চারপাশে এলিজাবেথের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরালো।
“লিসেন রেড। তুমি শুধু চোখ বন্ধ রাখো, একদম খুলবে না ওকে?এটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার।”
‘রিচার্ড নিজেও দু’হাতে ওকে পেঁচিয়ে ধরল। লাফ দিতে উদ্যত হলে মৃদু চিৎকার করে উঠল এলিজাবেথ। শরীরে এখনও শীতল কাঁপন বইছে। তপ্ত শ্বাস নিয়ে রিচার্ড এলিজাবেথের উপর ঝুঁকল। দুহাতের গভীরে চেপে ধরল ওর ক্ষতবিক্ষত মুখখানা।
“বেশি ভয় লাগছে?”
‘এলিজাবেথের প্রকম্পিত চোখের পাপড়ি ওঠা-নামা করল। ঠৌঁট ভেঙে আসছে শুধু। রিচার্ড বুঝতে পারল তার কাছে এমন উচ্চতা থেকে লাফ দেওয়া যতটা সহজ এলিজাবেথের কাছে ঠিক ততটাই কঠিন। কিছুটা সময় নিল রিচার্ড। বিকল্প পথ খুঁজতে লাগল।
“যেই রাজ্য থেকে রাণীকে বিতাড়িত হতে হয়, সেই রাজ্য কি খুবই মূল্যবান রাজার কাছে?”
‘রিচার্ড চাইল এলিজাবেথের দিকে। ওর চোখ দুটিতে জলোচ্ছ্বাস। যেখানে চাপা আর্তি আর গভীর বেদনা একসাথে বয়ে চলেছে।
“যে রাজ্যে রাণী বিতাড়িত হয়, সে রাজ্যের মুকুটে সম্মানের কোনো দীপশিখা জ্বলে না। সেটি মূল্যবান নয় বরং এক পাপের সমুদ্র। যেখানে রাণীর পবিত্রতা মিশে যায় কলঙ্কের জলে।”
‘এলিজাবেথ আলতো করে হাত রাখল রিচার্ডের গালের গভীর কাটা দাগে। কণ্ঠ মৃদু ঝর্ণাধারা৷ আকুলতায় ঠাঁসা কণ্ঠে শুধালো, “ত্যাগ করুন এই রাজ্য। চলুন আমার সাথে। দূরে কোথাও চলে যাই। সব ছেড়ে নতুন এক পৃথিবী গড়ি।”
‘রিচার্ড বিষাদমাখা হাসি দিল। চোখে গভীর শূন্যতা। হেসে বলল, “চাইলেই কি ছাড়া যায়? ছাড়তে চাইলেই কি ছাড়তে দেয়?”
‘এক মুহূর্তের জন্য থামল রিচার্ড। এবার কণ্ঠটা বেশ তীক্ষ্ণ হলো। যেন বেদনার শিরায় শিরায় বিদ্ধ হতে চায়।
“তুই নিষ্পাপ এলি। এই পাপ নগরীতে তোর পায়ের ধুলো পড়াও পাপ। পবিত্র সত্তাদের এখানে কোনো স্থান নেই। এই রাজ্য তোর নয়।”
‘রিচার্ডের ফোনে আবারও টিং শব্দে মেসেজ এলো। এবার আর কোনো ভাবনা কিংবা দ্বিধার জায়গা দিল না।এলিজাবেথের মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে এক নিঃশ্বাসে লাফ দিল। এলিজাবেথের শ্বাস শুকিয়ে আসছিল। আতঙ্কের ঠাণ্ডা স্রোতে সারা শরীর কাঁপছিল। জাপ্টে ধরে রাখল রিচার্ড’কে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো সব কিছু থেমে গেছে। তবে সামান্য একটা ঝাঁকুনি ছাড়া আর কিছুই অনুভূত হলো না।
“বলেছিলাম না শুধু চোখ বন্ধ রাখো। তুমি নিরাপদ আছো, রেড। আমি থাকতে কিচ্ছু হবে না তোমার।”
‘রিচার্ড ওকে নিয়ে দৌড়ে গেল ফার্মহাউসের পেছনের ছোট একটা গেটের দিকে। এটাই ছিল গুপ্ত পথ, যা সোজা প্রধান সড়কে ওঠে। লোহার ঝংকানো বেড়ার কাছে পৌঁছানোর পরই এলিজাবেথ হঠাৎ থমকে গেল। তাকিয়ে দেখল একজন দাঁড়িয়ে আছে। সেই মানব টা আর কেউ না —তাকবীর।
“ভালো মানুষ আপনি?”
‘তাকবীর জঙ্গলের ভেতর থেকে ছুটে এলিজাবেথের কাছে এল। অসম্ভব রক্তজবা লাল ওর চোখ দু’টো। রিচার্ড শক্ত চোখে তাকাল তাকবীরের দিকে। কণ্ঠে বজ্রের মতো কঠিন আদেশ, “গো। ডোন্ট মেক এনি ফা’কিং মিসটেক।”
“ওকে।”
‘আজ কেউ কাউকে কোনো প্রশ্ন করল না, কোনো প্রতিশোধের চিন্তা করল না। সবকিছুই আজ নিস্তব্ধ অসহনীয়। এলিজাবেথ নির্বাক। হঠাৎ করেই চারপাশটা ওর কাছে এক জটিল গোলকধাঁধায় পরিণত হলো। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে আসছে অচেনা জন্তুর ভয়ংকর হাঁক-ডাক। তাকবীর এগিয়ে গেল রিচার্ডের চোখের ইশারা অনুযায়ী। তবে এলিজাবেথ দাঁড়িয়ে রইল থমকে। ওর চোখ রিচার্ডের উপর নিবদ্ধ। পাপড়িগুলো কাঁপছে অনবরত।
‘রিচার্ডও একইভাবে চেয়ে রইল। তাদের দৃষ্টিও যেন সময়ের সীমানা ছুঁয়ে বলছে শেষ বিদায়ের কথা। তাকবীর বাধ্য হয়ে এলিজাবেথের হাত টেনে ধরে নিয়ে যেতে লাগল। পায়ের গতিতে সাড়া দিল এলিজাবেথ কিন্তু দৃষ্টি তখনও আটকে রিচার্ডের শূন্য অভিব্যক্তিতে। ওরা দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতেই রিচার্ড ঠোঁট বাঁকিয়ে ফিচলে হাসল। বড়সড় একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেট জ্বালিয়ে এক টান দিয়ে তারাদের শূন্য আকাশের দিকে তাকাল।
“আমাদের ভাগ্যটাই এমন, যে আমরা চাইলেও কেউ কারোর হতে পারছি না।”
‘রিচার্ড ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত। প্রতিটি টানের সঙ্গে শূন্যে ছড়িয়ে দিচ্ছিল নিজের ভার। এটা শেষ হলেই তাকে ঢুকতে হবে সেই রক্তাক্ত খেলার ময়দানে।জীবন-মরণের এই খেলায় আজ অসংখ্য নাম যোগ হয়েছে মৃত্যুর খাতায়। তাদের পথের শেষপ্রান্তে পাঠানোই রিচার্ডের মূখ্য কাজ। তবুও আজ এই কঠিন রিচার্ড কায়নাতের হৃদয়ের কোথাও তুমুল ঝড় উঠেছে। শক্ত মনের কোনো এক কোণে বড়সড় ফাটল ধরেছে। চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে জায়গাটাই। ভাগ্যিস অন্তরের ব্যাথা দেখা যায় না। নাহয় আজ এই নিষ্ঠুর মানবটা তাকে পুরানোর অপরাধে সেই ফাটলে আগুন ঢালতো।
‘হঠাৎ, একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে ছুটে আসছে এলিজাবেথ। দূর থেকে ওর ভাঙা গলার চিৎকার ভেসে এলো বাতাসে,
“আমি কোথাও যাব না আপনাকে ছাড়া!”
‘জীবন-মরণের ভয় উপেক্ষা করে গুলির সম্ভাবনাকে তুচ্ছ করে ছুটে আসছে এলিজাবেথ। ওর পিছু পিছু দুই গার্ড অস্ত্র হাতে দৌড়ে আসছে। রিচার্ড বিদ্যুৎবেগে গান বের করল আর আরেক হাত প্রসারিত করে জায়গা করে দিল এলিজাবেথ’কে ওর বুকে। আর তা-ই হলো। এলিজাবেথ ছুটে এসে আঁচড়ে পড়ল রিচার্ডের বুকে। ওর ক্ষীণ শরীরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রিচার্ড। এলিজাবেথ’কে বুকের মধ্যে আড়াল করে নিয়ে গার্ডদের উদ্দেশ্য রিচার্ডের বন্দুক ওঠার আগেই পেছন থেকে দুটি হাত এসে এক গার্ডের মুখ চেপে ধরল। তাকবীর বিদ্যুতের মতো দ্রুততার সঙ্গে ওদের টেনে নিয়ে গেল জঙ্গলের গভীরে।
‘এলিজাবেথের কান্না ক্রমেই রিচার্ডের বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে। উন্মাদের মতো বারবার বলে যাচ্ছে, “ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে।”
‘রিচার্ড ওর দুই কব্জি শক্ত করে ধরে টেনে মাথা তুলে বিরক্তির স্বরে বলল, “আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড? এসব যা তা বলছ কেন?”
‘কান্নার তোড় আরও বাড়তে থাকল। আবারও মুখ গুজে দিল রিচার্ডের বুকে। ভাঙা কণ্ঠে বলতে থাকল,
“প্লিজ চলুন আমার সাথে। ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে। আমি নিজের কানে শুনেছি।”
ফ্ল্যাশব্যাক:
তাকবীরের সাথে এলিজাবেথ জড় বস্তুর মতো হাঁটছিল। কিছু দূরে দুরত্বে তাকবীরের গাড়ি রাখা। এলিজাবেথের চোখে বারবার ভেসে উঠছিল রিচার্ডের শেষ চাহুনি। সেই চোখে আকুলতা ছিল, ভয় ছিল, আর ছিল কিছু অপ্রকাশিত বাক্য । সুতীব্র আবেগের তাড়নায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল এলিজাবেথের অন্তস্তল।
ওরা প্রাচীর ঘেঁষে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই প্রাচীরের ওপাশ থেকে রাশিয়ান গার্ডদের কথোপকথনের শব্দ ভেসে এলো। এলিজাবেথ থমকে দাঁড়াল। শব্দগুলো যে ওর হৃদস্পন্দন বন্ধ করে দিল।
“Зачем ты вешаешь эту шалу? Вскоре миссия начнется. Убив этого гангстера из Шалы, наш босс тоже будет править Италией.”
(এই শা’লা ঝুলছিস কেন? একটু পরেই কিন্তু মিশন শুরু হবে। শালা গ্যাংস্টার’কে আজ খালাস করে আমাদের বস এবার ইতালিতেও রাজ করবে।)
‘একজন রাশিয়ান হিসেবে ওদের কথা বুঝতে এক মুহূর্তও সময় লাগল না এলিজাবেথের। শ্বাস আটকে রইল ক্ষণিকের জন্য। চুট্টিতে তাকবীরের হাত ছাড়িয়ে অন্তরের গভীরে একসাথে ভয় আর প্রেমের ধ্বনিতে পাগলের মতো উল্টো দিকে ছুটল এলিজাবেথ। পায়ের আওয়াজে দু’জন গার্ড দেয়াল টপকে এপাশে এসে এলিজাবেথ কে দেখে ফেলে। তখন থেকেই তারা পিছু নিয়েছিল এলিজাবেথের।
‘সবটা শোনার পর আপন তাগিদে শক্ত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল রিচার্ডের হাত। শরীরের গৌড় বর্ণের শিরা উপশিরা গুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান। এলিজাবেথের সারা শরীর তখনও কাঁপছে। রিচার্ডের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কেবল বলে যাচ্ছিল, “প্লিজ, চলুন। আমি আপনাকে হারাতে চাই না।”
‘সংকটময় মুহূর্তে রিচার্ড নিজেকে ধরে রাখল। ক্রোধ চোখে প্রতিশোধের আগুন হয়ে জ্বলছে। কণ্ঠে কর্কশতা, নিঃশ্বাসেও বিষ। আবারও বুক থেকে এলিজাবেথের মাথা টেনে তুলল রিচার্ড ।
“আমার হাতে সময় নেই রেড। তোকে সকালের আগে এই অভিশপ্ত জঙ্গল ত্যাগ করতে হবে।”
‘এলিজাবেথ অনড়। একই আর্তি কণ্ঠে, “আপনাকে ছাড়া আমি কীভাবে চলে যাই? চলুন আমার সাথে। প্লিজ চলুন। ওরা খুব হিংস্র। জানে মেরে দিবে আপনাকে।”
‘এলিজাবেথের চোখ থেকে ঝরা প্রতিটি অশ্রু ই আজ রিচার্ডের নামে লেখা। রিচার্ড শক্ত ঢোক গিলল। আবেগে গা ভাসিয়ে দম বন্ধ করে আজ সরাসরি প্রশ্ন করেই বসল,
“আমাকে মেরে ফেলবে শুনে তোর এত কষ্ট হচ্ছে কেন?”
‘এই প্রশ্ন আজ আকাশ-বাতাসকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। আজ আকাশ, বাতাস, জঙ্গলের প্রতিটা গাছপালা থেকে শুরু করে কীট-পতঙ্গ গুলোও জানল এলিজাবেথের ভিতর বহু দিন ধরে বয়ে আসা গুপ্ত প্রেমের সংবাদ। সমস্ত ভয় দোটানা কে জয় করে চেঁচিয়ে উঠল এলিজাবেথ,
“কারণ আমি পাপী। পাপী হয়েছি আপনাকে ভালোবেসে।”
‘বুকের গভীরে তীব্র একটা ধাক্কা খেল রিচার্ড। বা হাত আপনাআপনি গিয়ে ঠেকল বুকের মাঝখানে। হৃদস্পন্দন থমকে থাকল এক মুহূর্তের জন্য। শরীর কিছুটা টলে উঠলেও আবেগকে গায়ে ভর করতে দিল না রিচার্ড। আজ যে তার বিরাট মিশন আছে। এই মিশনের পথে তার বেপরোয়া হওয়া প্রয়োজন, আর তার প্রথম ধাপ হলো এলিজাবেথকে এই জঙ্গল থেকে নিরাপদে সরিয়ে দেওয়া। কঠিন কণ্ঠে রিচার্ড বলে উঠল,
“কিন্তু আমি তোকে ভালোবাসি না।”
‘এই কথায় সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে গেল এলিজাবেথ। গড়ন টলে উঠল কিছুটা। তবুও শক্ত করে জাপটে ধরল রিচার্ড’কে।
“এলির বাচ্চা এখন পাগলামির সময় না। আমার দূবর্লতা হিসেবে ওদের টার্গেট তুই। তোকে পালাতে হবে এখনই,,,,,
“আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন না। তাহলে কিসের দূর্বলতা?”
‘নিজের থেকে এলিজাবেথ’কে টেনে ছাড়াতে ছাড়াতে চাপা গলায় বলতে থাকল রিচার্ড,”পালা এলি পালা। তোকে।পালাতে হবে আজ।”
‘নড়ে না এলিজাবেথ,”প্লিজ চলুন আপনি আমার সাথে। ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে।”
“আমি মরলে তোর কি?”
“আমার জীবন থেকে একটা বড় কষ্ট দূর হয়ে যাবে।”
“তোকে আমি কেন এতো ঘৃণা করি জানিস? কারণ তুই দূর্বল। দূর্বল মানুষ আমার পছন্দ না। দূরে থাকবি আমার থেকে। সরে যা।”
‘এরিমধ্য তাকবীর ছুটে আসে। ওর হাত দু’টো র’ক্তে ভেজা।
“এলোকেশী ফর গট সেক প্লিজ চলো।”
‘রিচার্ড কোনোভাবেই নিজেকে ছাড়াতে পারছিল না এলিজাবেথের বাঁধন থেকে। দূর্বোধ্য মেয়েটার আঙ্গুলগুলো রিচার্ডের অস্তিত্ব আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে। রিচার্ডের ভিতর কাঁপছে। অবশেষে এক তীব্র টানে নিজের অস্তিত্বকেই যেন ছিঁড়ে ফেলে সরে দাঁড়াল রিচার্ড। তাকবীর এসে এলিজাবেথকে টেনে ধরে। শক্ত হাতের বাঁধনে ওকে জঙ্গলের গাঢ় অন্ধকারে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল। কিন্তু এলিজাবেথ… ওর শরীর তাকবীরের সঙ্গে এগোলেও আত্মা থেকে গেল রিচার্ডের কাছে। প্রতিটা পা টানতে টানতে ও ফিরে যেতে চায়। ফিরে যেতে চায় সেই মানুষটির কাছে।যার চোখে নির্ভার শূন্যতা, আর বুকের ভেতরে চাপা পড়া ঝড়। যে মানুষটা ওকে ঘৃণা করে বলেও রক্ষা করে গিয়েছে সবসময়।
‘জঙ্গলের কোণায় কোণায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে এলিজাবেথের হাহাকার। আহাজারি ভেঙে পড়ে পাতার ফাঁকে ফাঁকে। শরীর টেনে নেওয়া যায়, কিন্তু আত্মাকে কে আটকে রাখতে পারে? এলিজাবেথ বারবার ছুটে আসতে চায়, প্রতিবার বাঁধা পায়। তবু থামে না।
“এলোকেশী দয়াকরে চলো। ওরা যেকোনো সময় এসে পড়বে।”
‘এলিজাবেথ ছটফটে চোখে তাকিয়ে থাকে রিচার্ডের পানে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, “ভালো মানুষ ওরা মেরে ফেলবে লোকটাকে। ছাড়ুন আমাকে!”
‘ওকে সামনে টেনে নিয়ে যেতে যেতে তাকবীর বলল,”পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা কর এলোকেশী।”
‘রিচার্ড দূরে থেকে নিস্তব্ধ ভাবে চেয়ে আছে এলিজাবেথের দিকে। এলিজাবেথের বুকের ভেতর ঝড় উঠে। আর্তনাদের স্বরে চেঁচাতে থাকে, “ছেড়ে দিন আমাকে? আপনি এতোটা নির্মম হবেন না। ওরা ধ্বংস করে দেবে আপনাকে! ওনাকে নিয়ে চলুন আমাদের সাথে। ভালো মানুষ নিয়ে চলুন ওনাকে!”
‘একটা সময় জঙ্গলের গহীনে হারিয়ে গেল সব আর্তনাদ, সব আহাজারি। বাতাসও যেন নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল প্রকৃতির মতো শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে। রিচার্ড দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ নির্জনতার ভারে থমকে। অকস্মাৎ ভেঙে পড়া মানুষটার মতো হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল মাটিতে। নত দৃষ্টি নিবদ্ধ করল মৃত্তিকায়। যেন সেই মাটির ভেতরেই খুঁজছে এলিজাবেথের চলে যাওয়া অস্তিত্ব। মাটির সাথেই কথা বলল রিচার্ড,
“আমাকে ভালোবাসলেও কখনো মুখে আনিস না এলি জান। আমি পাপি,আমাকে ভালোবাসি বলতে গিয়ে তুইও পাপি হয়ে যাবি। তোর শুদ্ধতা আমার মতো এক পাপীর নামে কলঙ্কিত হোক, এটা আমি চাই না।”
‘কিছু মানুষ চাইলেও পারে না অনুভূতি প্রকাশ করতে। কারো অনুভূতির গভীরতা শব্দের সীমা ছাড়িয়ে গেলেও তারা থাকে নিশ্চুপ, নিঃশব্দ। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলা বা বুক চিতিয়ে বলে দেওয়া—এসব শোভা পায় না তাদের চরিত্রে। তেমনই এক বিরল চরিত্র রিচার্ড। মুখ ফুটে বলতে পারেনি প্রিয় মানুষটার দহনে কতোটা দগ্ধ হচ্ছিল তার ভেতরটা। তাকে থাকতে হয়েছে কঠোর। তার চরিত্রের সাথে যে এটাই যাই। আকাশ সমান ভালোবাসাও রয়ে গেছে অব্যক্ত। তবুও সে ভালোবাসা রক্ষা করতে পিছু হটেনি রিচার্ড। আজ সমস্ত অহংকার ভেঙে সাহায্যের জন্য হাত পেতেছিল প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে শুধুমাত্র সেই মানুষটার জন্য।
‘রিচার্ড জানত এলিজাবেথকে এখান থেকে আজ উদ্ধার করা অসম্ভব। মার্কো পুরো জঙ্গল তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। এটা ওদের ডিলের ই একটা অংশ। কারণ এই প্রফেশনে নেই বিশ্বাস। কেউ কাউকে এক চুল পরিমাণ ছাড় দেয় না। রিচার্ডের লোকজন কাজের উপযোগী নয় এখানে। বাধ্য হয়ে সে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে তাকবীরের দিকে—যে তার চিরশত্রু। মার্কোর হাত থেকে এলিজাবেথকে বাঁচাতে তাকবীরই একমাত্র ভরসা। তাই তো সন্ধ্যায় জঙ্গলের বাইরে দেখা করে তাকবীরের সাথে। নিজের গুরুত্বপূর্ণ কার্ডটি তুলে দিয়েছিল রিচার্ড তাকবীরের হাতে। যেটি ছাড়া তাকবীরের পক্ষে জঙ্গলে প্রবেশ করাই সম্ভব ছিল না।
‘রিচার্ড চাইলেই তার ক্ষমতা জাহির করে সবার সামনে এলিজাবেথকে নিজের স্ত্রী বলে দাবি করে ওকে প্রটেক্ট করতে পারত। শক্তি প্রদর্শন করে এলিজাবেথ’কে বাঁচিয়ে নেওয়া রিচার্ডের জন্য কোনো কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু সেটাই হয়ে যেত এলিজাবেথের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। রিচার্ড জানে তার পাপ-সম্রাজ্যের কোনো সদস্য যদি এলিজাবেথের অস্তিত্ব ঘুনাক্ষরেও টের পায় তবে এলিজাবেথের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে। ওর দূর্বলতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে শত্রুরা আঘাত হানবে, আর প্রতিবার সেই আঘাত গিয়ে পড়বে এলিজাবেথের উপর।
‘তাই রিচার্ড কঠোর ছিল। ওর মুখের কঠিন শাসনের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক অদম্য ভালোবাসা। কিন্তু মার্কোর তীক্ষ্ণ চোখ সবই দেখছিল। তার সন্দেহ ক্রমাগত বেড়েই চলছিল। সেই সন্দেহকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করতেই রিচার্ড সাজিয়েছিল এই নাটক। নিজেকে শক্ত করে রেখেছিল যেন অনুভূতির এক কণা প্রতিফলিত না হয়। এলিজাবেথের জন্য এই কঠোরতার আড়ালই ছিল তার সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।
‘অকস্মাৎ রিচার্ড চুল খামচে ধরল। সন্ধ্যার সেই তিক্ত মুহূর্তগুলো মাথায় ভিড় করছে। এই প্রথম সে কারো কাছে নত হয়েছে। নিজের অহংকারের গলা টিপে প্রিয় মানুষটাকে বাঁচানোর জন্য মাথা নুইয়েছে। স্মৃতির ভার টেনে নিয়ে গেল জঙ্গলের শেষ প্রান্তের সেই অসহ্যকর মুহূর্তে।
‘জঙ্গলের কিনারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুই চিরশত্রু তাকবীর আর রিচার্ড। তাকবীরকে নিজেই ফোন করে ডেকেছিল রিচার্ড। কারণ তার প্ল্যানের একমাত্র কুশীলব তাকবীর। তবে তাকবীর এ সুযোগ হাতছাড়া করেনি। নিজের ঝাঁজ মিটিয়ে নিয়েছিল।
“তোর বউ তুই সেভ কর। আমার কাছে সাহায্য চাইছিস কেন?”
‘তাকবীরের ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি স্পষ্ট। রিচার্ড দাঁতে দাঁত পিষে তপ্ত শ্বাস ফেলল।
“এটাকেই বলে হাত গর্তে পড়লে পিঁপড়েও কাঁদা ছোঁড়ে। এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছি। তুই জানিস তোকে মারার ইচ্ছে কতো? কিন্তু ফাদারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি আটকে রেখেছে। আর গালি? তা-ও দিতে পারছি না কারণ ওর কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি… ফা’ক, ফা’ক, ফা’ক!”
‘রাগে ফুটতে থাকা রিচার্ডকে দেখে তাকবীর হো হো করে হাসতে লাগল। কোনো উত্তর না দিয়ে পেছন ফিরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তখনই অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটল। রিচার্ডের গলা নেমে গেল। একটা নত, ভাঙা স্বর,
“কি করলে সাহায্য করবি?”
‘তাকবীর থেমে পেছনে তাকাল। বিদ্রুপ আর সুযোগের গন্ধ পেয়ে রুষ্ট গলায় বলল,”ইউ হ্যাভ টু বেগ অন মি।”
“রিচার্ড কায়নাত কারোর কাছে নত স্বীকার করে না।”
“ওকে! নট এ প্রবলেম।”
‘বলে তাকবীর আবারও উদ্যত হয় চলে যাওয়ার জন্য। দু’কদম এগোতেই হঠাৎ থেমে গেল পায়ের গতি।
“প্লিজ হেল্প মি, মি. তাকবীর দেওয়ান।”
‘তাকবীর বিস্ময়ে হতভম্ব। রিচার্ডের ঠোঁট থেকে এমন অনুরোধ?নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আবারও খাদযুক্ত কণ্ঠে অনুরোধ করল রিচার্ড।
“প্লিজ।”
‘একটা একক শব্দ, অথচ সেটা যেন রিচার্ডের সমস্ত অহংকারকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। তাকবীর প্রশান্তিময় শ্বাস ফেলে হাসতে হাসতে রিচার্ডের নিকটে এসে দাঁড়ালো।
“তুই কি ভেবেছিস শুধুমাত্র তোর কথার উপর নির্ভর করেই থেমে থাকতাম আমি? নাহ! জ্বালিয়ে দিতাম এই জঙ্গল৷”
‘সাথে সাথে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল রিচার্ড। চোয়াল শক্ত হলো তাকবীরের।
“সরে যা আমাদের মাঝখান থেকে। ভালো থাকবি। আমি সবকিছু ধ্বংস করে দিব, আমার এলোকেশীকে পাওয়ার জন্য।”
‘ঠৌঁট কামড়ে খুব মজা করে হাসল রিচার্ড,”নিজের জান’কে ছাড়ার কথা বলছিস? মোহ হলে সত্যিই ছেড়ে দিতাম বিশ্বাস কর। নারী বিষেদে আমি একদমই পড়তে চাইনি।”
“বসন্তের বাতাসে বৃক্ষ ভাঙ্গে না,বরং নতুন করে পাতা গজায়৷ এবারে ইতিহাসে কোনো বিরহ থাকবে না এলিজাবেথ থাকবে আমার।”
‘থামল তাকবীর। লম্বা শ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করল,
“আর হ্যাঁ থ্যাংকস। আমি নিজেও হয়তো আবার বাপকে এতো ভয়ংকর মৃত্যু দিতে পারতাম না। রক্তের একটা টান আছে তো! এন্ড ইয়েস হি ডির্জাবস ইট।”
‘বাঁকা হাসি দিল রিচার্ড। আরেক কদম এগিয়ে একদম তাকবীর সান্নিধ্যে দাঁড়াল। কণ্ঠে প্রতিশোধস্পৃহা,
“হিসেব বরাবর। তুই আমার দ্বিতীয় বাপ কে মেরেছিস আর আমি তোর আসল বাপ কে-ই মেরে দিলাম।”
‘হ্যাঁ তাকবীরই ছিল ফাদারের খুনি। নিজের উপর এবং এলিজাবেথের উপর পরপর আঘাতের প্রতিশোধের তাড়নাই ওকে ঠেলে দিয়েছিল সেই ষড়যন্ত্রের জালে, যেখানে ফাদারের মৃত্যু ছিল একমাত্র সমাধান। আর রিচার্ড? সে তো সব জানত শুরু থেকেই।তাহলে কেন চুপ ছিল রিচার্ড? উত্তরটা একটাই—এলিজাবেথ। ওর উপর আঘাতের ভার পৃথিবীর বুকে কোনো হৃদয় ধারণ করতে পারেনি আর কোনোদিন পারবেও না। রিচার্ডের নীরবতায় ছিল তার ভালোবাসার সবচেয়ে করুণ ভাষা। যেখানে প্রতিটি নিঃশ্বাসেও উচ্চারিত হত এলিজাবেথের নাম।
‘উঠে দাঁড়াল রিচার্ড। গম্ভীর পায়ে এগিয়ে গেল বাংকারের দিকে। চারপাশে নেমে এসেছে এক অদ্ভুত ভয়াল নিস্তব্ধতা। ভিতরের এক কক্ষ থেকে ভেসে আসছে হাড় ভাঙার খটখটে শব্দ। তাতে মিশে আছে চাপা যন্ত্রণার গুঞ্জন। কিছুক্ষণ আগে মেয়েদের বন্দরের দিকে পাঠানো হয়েছে তাই বাংকারে এখন কোনো গার্ডের টিকিটিও নেই। রিচার্ড শার্টের হাতা রোল করতে করতে পৌঁছাল সেই কক্ষে যেখানে এলিজাবেথকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
‘দরজার ফাঁক দিয়ে আলো ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে আর তার মাঝখানে বসে আছে লুকাস। মুখজুড়ে এক বিকৃত হাসি, হাতে র’ক্ত’মাখা চা’পা’তি। রিচার্ডকে দেখামাত্র চা’পা’তি নামিয়ে রেখে আরও বড় করে হাসল ঠান্ডা, শিকারির মতো হাসি। চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে তাজা র’ক্তে’র পিচ্ছিল গন্ধ। যেটা মাটি পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়েছে। রিচার্ড বড় একটা ছু’রি হাতে নিয়ে বসল। ইতিমধ্যে লুকাস কোনো অংশ অবশিষ্ট রাখনি। তাও সমাপ্তির দায়িত্ব সে নিজেই নিলো।
“বলে ছিলাম আমার জন্য কিছু রাখতে।”
‘চব্বিশ কপাটি বের করে উঠে দাঁড়াল লুকাস। হেসে মুখের র’ক্ত হাতের পিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল দরজা আঁটকে। ভিতরে ভাজতে থাকতে ছু’রির নির্মম খচখচ শব্দ আর বাতাস ঘন করতে থাকে মাং”স ছিঁ”ড়ে যাওয়ার করুন শব্দে। র’ক্তের ঝাপটা এসে পড়তে থাকে চওড়া তামুকে। প্রাণহীন দেহের অস্তিত্ব বিনাশের বর্বর উল্লাসে মেতে উঠল রিচার্ড। ধ্বংসযজ্ঞ চলছে সেই গার্ডের নিথর দেহের উপর যার দৃষ্টি আর স্পর্শের তীব্র লালসা ছুঁতে চেয়েছিল এলিজাবেথকে। কিন্তু তার সেই বাসনা পূর্ণ হওয়ার আগেই নেমে এসেছিল ভয়ঙ্কর এক শাস্তি। লুকাস আগে থেকেই অবস্থান করছিল সেই কক্ষে।তখন গার্ডের হাত এলিজাবেথের কাঁধ স্পর্শ করার আগেই আরেকটা দানবীয় থাবা পড়েছিল তার কাঁধে।
‘রিচার্ড রক্তমাখা হাত দুটো ঝাড়তে ঝাড়তে বাংকারের অন্ধকার করিডোর পেরিয়ে আসছিল। হঠাৎ সামনে পড়ল ন্যাসো আর লুকাস। তিনজনের চোখে-মুখে সেই চিরচেনা, ঠাণ্ডা, রহস্যময় হাসি।
“লেট’স বিগিন দ্য কিলিং মিশন গাইজ।
‘ন্যাসো হালকা হেসে রুমাল এগিয়ে দিল। রিচার্ড মুখের রক্তের দাগ মুছতে মুছতে নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল,
“প্ল্যান C—ডান?”
‘ন্যাসো একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল,”অলমোস্ট বস। মার্কোর ডিভাইস অলরেডি হ্যাক করা হয়েছে। আপনি সিগন্যাল দিলেই বার্তা গার্ডদের কাছে পৌঁছে যাবে। তারপর সবাই যখন বাংকারে জড়ো হবে, এক ব্লাস্টেই সব শেষ। ক্লিন এন্ড ফাস্ট।”
‘রিচার্ডের মুখে হালকা টান পড়ল। কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে হঠাৎই ন্যাসোর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কলার চেপে ধরল।
“তোমরা তোমাদের ম্যামের নাম্বার পেলে কোথায়? আই নো তুমিই ওর ফোনে ছবিগুলো পাঠিয়েছো। আমাদের স্টক করা হচ্ছে রাইট?”
‘প্রথমে আতঙ্কে শ্বাস আটকে এলেও পরক্ষণেই নিজের সেই সাপের মতো ঠাণ্ডা হাসি ফোটাল ন্যাসো। অবিলম্বে আওড়ালো,
“বস রিল্যাক্স! বিয়ানকে দিয়ে আপনার ফোন হ্যাক করিয়ে সেখান থেকেই ম্যামের নাম্বার কালেক্ট করেছি। এবার যদি আমরা হাত না লাগায় তাহলে এই জন্মে আপনার আর ম্যামের সংসার দেখা হবে না!”
‘রিচার্ডের আঙুলগুলো আরও শক্ত হলো ন্যাসোর কলারের চারপাশে। ক্ষীণ হাসি ঠোঁটে জমে গিয়েছিল তবে চোখে ছিল এক ধরণের নিঃশব্দ বজ্রপাত। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই ন্যাসো’কে ছেড়ে দিয়ে পেছনে সরে এল রিচার্ড।
“সংসার? আমি সংসার খুঁজতে আসিনি ন্যাসো। আমি যা চাই তা পেতে কিভাবে খেলতে হয়, সেটাই শিখে এসেছি।”
‘ন্যাসো কাশতে কাশতে গলাটা ঠিক করল। লুকাস পাশে দাঁড়িয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। রিচার্ড মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“প্ল্যান C-তে কোনো গ্যাপ যেন না থাকে। কারণ আমি কারো জন্য দ্বিতীয়বার ভাবি না—তোমাদের ম্যাম ছাড়া।”
‘লুকাস কুটিল হেসে বলল,”অওও প্রেম।”
‘ধমকালো রিচার্ড,”স্টোপ টকিং ননসেন্স। হাউ এবাউট প্ল্যান B?”
‘ন্যাসো আর লুকাসের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ন্যাসো ঠোঁট ভিজিয়ে সংযত কণ্ঠে উত্তর দিল,
“সকল মেয়েদের বন্দরের উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে বস। আপনার নির্দেশমতো পঁচিশটা মেয়েকে আলাদা ট্রাকে তোলা হয়েছে।”
“গুড জব।”
‘ ন্যাসো একটু দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করল,”কিন্তু বস ঐ মেয়েগুলোকে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?”
‘রিচার্ডের চোখে এক ধরনের নির্লিপ্ত শূন্যতা। ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল,
“ওরা ওদের ডেসটিনিতে এই নরক চাইনি। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে অন্ধকারে পা বাড়াতে চায় না, তারা আলোতেই থাকুক।”
“ডেসটিনি? তবে এমনও তো হতে পারে ম্যামের ডেসটিনিতে আপনি নেই,, তখন?”
‘রিচার্ডের ঠোঁটে এক ক্ষীণ তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেল,
“তখন ডেসটিনি শব্দ থাকবে আমার চ্যাপ্টারের বাইরে।”
‘লুকাস এবার হালকা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,”এটা কি শুধু ম্যামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য?”
রিচার্ডের চোখের পলক পড়ল না, গলায় কোনো উথল-পাথল ভাবও নেই।
“হ্যাঁ!” ‘শুধু এক শব্দে জবাব দিয়ে সামনে হাঁটা শুরু করল।পিছু পিছু গেল ওরা। লুকাস পায়ে পা মিলিয়ে রিচার্ডের পাশে হাঁটছিল। হালকা ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে জিজ্ঞাসা করল,”বস, প্ল্যান A?”
‘রিচার্ডের ঠোঁটে রহস্যের ঘনঘটা, চোখের কোণে টুকরো অন্ধকার হাসি ফুটে উঠেছে। ঠান্ডা গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আজকে রাশিয়ান ভোজন হবে লোকা। আমার পিটবুলগুলো খুবই ক্ষুধার্ত।”
‘ন্যাসো ট্যাবের স্ক্রিনে চোখ গেঁথে রেখেছিল ফার্মহাউসের সিসিটিভি ফুটেজে। আচমকা মুখের রঙ বদলে গেল। গলার শুষ্কতা গিলতে গিলতে চাপা স্বরে বলল,”বস… একটা ব্লান্ডার হয়ে গিয়েছে।”
‘রিচার্ডের পা থামে,”হোয়াট ?”
“আনলাকিলি মার্কোর ঘুম ভেঙে গিয়েছে। আমার মনে হয় মার্কো জুসটা খায়নি।”
“দ্যাটস ফা’কিং বুলশিট।” শক্ত হয়ে উঠল রিচার্ডের চিবুক।
“এখন কী হবে? মার্কো যদি জানতে পারে পঁচিশটা মেয়ে শিপে উঠছে না তখন? আর বাংকারে গিয়ে যদি ম্যামকে খুঁজে না পায় তখন তো ওকে আর আটকানো যাবে না, বস!”
‘রিচার্ডের চোখে রক্তিম ক্ষোভের ছায়া নেমে আসে। ছটফটিয়ে উঠল সে। গলায় জমা রাগ বিষের মতো চুঁইয়ে পড়ল,”কিচ্ছু করতে পারবে না আমার রেডের!”
“ভুলে যাবেন না বস। ম্যাম এখনো জঙ্গলের ভেতর। আর পুরো জঙ্গল কিন্তু মার্কো আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছে।”
‘কথাটা শুনেই ন্যাসো আঁতকে উঠল, মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো চাপা উত্তেজনা,”ওহ, শিট!”
‘রিচার্ড সাথে সাথেই চকিতে ঘুরল ন্যাসোর দিকে।চোখে বিদ্যুৎ খেলা করছে,”হোয়াট?”
“মার্কোর কিছু গার্ড মনে হয় সন্দেহ করেছে। ম্যামদের গাড়ির পিছু নিয়েছে তারা।”
‘শোনামাত্রই রিচার্ড ছুটে যেতে উদ্যত হলো। পেছন থেকে ঠান্ডা গলায় ন্যাসোর সতর্কবাণী ভেসে এল,
“বস আপনাকে না পেলে মার্কোর সন্দেহ আরও বেড়ে যাবে। তখন সেটা ম্যামের জন্য আরও বিপজ্জনক হবে। ভুলে যাবেন না—জঙ্গলে এখন মার্কোই রাজা।”
‘এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল রিচার্ড। বুকের মধ্যে ক্ষীণ দ্বন্দ্বের ঝড় কিন্তু মুখে প্রকাশ নেই। ঠিক তখনই সিঁড়ির ছায়া থেকে বেরিয়ে এলো লাড়া। এতক্ষণ নীরবে সব শুনছিল লাড়া। লাড়াকে দেখেই রিচার্ড ছুটে গেল তার কাছে। সেই কঠিন, নির্দয় গ্যাংস্টার বস, যার কণ্ঠে আদেশই শেষ কথা—সে আজ আর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। হৃদয়ের সব প্রতিরোধ গলে গেল সুতীব্র আবেগের উষ্ণতায়। রিচার্ডের কণ্ঠ ভেঙে এলো,
“লাড়া, প্লিজ… আই বেগ ইউ। ইউ নো হোয়াট টু ডু…”
‘একজন গ্যাংস্টার বস। ভয় আর মৃত্যু যার পরিচয়, সে আজ কারও কাছে ভিক্ষা চাইছে একটা মেয়ের জন্য। বুকের ভেতর কোনো অদৃশ্য তীর গিয়ে বিঁধল লাড়ার। বুক ফেটে কান্না আসলেও নিজেকে শক্ত করে নিল লাড়া। রিচার্ডের ইঙ্গিত বুঝেই লাড়া নিঃশব্দে চলে গেল। আর এক সেকেন্ডও দেরি করল না রিচার্ড। সোজা গ্যারেজে গিয়ে ধুলো ধরা এক পুরোনো বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হাওয়ার গতি ছিন্ন করে ছুটে চলল সে জঙ্গলের দিকে।তার “রেড” এর কাছে।প্রতিবারের মতো এবারও মৃত্যু তার সঙ্গী। কিন্তু এইবার?এইবার মৃত্যুর চেয়ে বড় ছিল ভালবাসা।
‘জঙ্গলের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে শেষমেশ ধরা দিয়েছে সড়ক। তবে এই নিস্তব্ধতার সড়কও সহজে ছাড় দেয় না। জঙ্গলের বুক চিরে ছুটতে ছুটতে গাড়ির তেলের কাঁটা নেমে গেছে অনেকখানি। তবু লোকালয়ের ছোঁয়া পেতে আরও কিছুটা পথ বাকি। এবড়োখেবড়ো কাঁকড়-পাথরের রাস্তা পেরিয়ে তাকবীরের গাড়ি অবশেষে পিচঢালা রাস্তায় উঠল। সামনেই কাঠের তৈরি এক প্রাচীন গেট, তার প্রহরায় দাঁড়িয়ে আছে মার্কোর গার্ডরা। রিচার্ডের কার্ড দেখালেই খুলে যাবে সেই গেট। উন্মুক্ত হবে মুক্তির পথ এই অভিশপ্ত জঙ্গল পেছনে ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার একমাত্র দিশা।
‘গাড়ির ভেতরে এলিজাবেথ পুতুলের মতো জড়সড় হয়ে বসে আছে। অল্প কিছুক্ষণ আগেও হাউমাউ করে কেঁদেছে।ওর বুকফাটা কান্নায় ভারী করেছিল চারপাশের বাতাস। এখন সেই কান্নারও আর জোর নেই, গলা শুকিয়ে গেছে। নিস্তব্ধতা গিলে খেয়েছে সব শব্দ। শুধু শূন্যতায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এক অদৃশ্য হাহাকার। তাকবীর তীব্র গতিতে গাড়ি চালাছে আর একটু পরপর এলিজাবেথ’কে দেখছে৷ ‘হঠাৎ তাকবীরের ফোন কেঁপে উঠল। রিচার্ডের নাম ভেসে উঠতেই এক মুহূর্তের জন্য গলা শুকিয়ে গেল। তবুও কাঁপা হাতে ফোন কানে তুলল। ওপাশ থেকে রিচার্ডের অস্থির, শ্বাসকষ্টে ভরা গলা ভেসে এল,
“ইজ শি ওকে? ডোন্ট মেক এনি ফা’কিং সাউন্ড। জাস্ট ব্রিদ।”
‘তাকবীর গভীর শ্বাস নিল। ওদিকে বাইকের গর্জনে রিচার্ডের কণ্ঠ চাপা পড়ছে তবুও তীব্রতা মুছে যাচ্ছে না। জঙ্গলের আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে ঝড়ের গতিতে ছুটছে রিচার্ডের বাইক। স্পিডোমিটারের কাঁটা বিপদসীমার ঠিক ওপরে থরথর করে কাঁপছে। রিচার্ডের ভারী নিঃশ্বাস হাওয়ার চেয়েও দ্রুত দৌড়াচ্ছে। তাকবীর রিচার্ডের কথা অনুযায়ী ব্লুটুথ ইয়ারপিস কানে গুঁজে নিল কোনো কথা না বলে চুপচাপ। এলিজাবেথ এক কোণে বসে আছে। নিজের জগতে ডুবে আছে, চারপাশের উত্তেজনা তার ধ্যান ভাঙাতে পারেনি। রিচার্ডের কণ্ঠ আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ভেসে এল,
“লিসেন কেয়ারফুলি। গাড়ির স্পিড কমাতে হবে। এন্ড মাস্ট উইন্ডো ক্লোজড !”
‘তাকবীর মোটেও রিচার্ডের আদেশ মানতে রাজি নই। কিন্তু ফোনের অপর প্রান্তের ভাঙা শ্বাস আর চাপা আতঙ্ক স্পষ্ট করে দিচ্ছে এখানে আজ কোনো ইগোর জায়গা নেই। পরিস্থিতি তাদের চেয়ে বড়, ভয়াবহ। শ্বাস আটকে গাড়ির গতি কমাল তাকবীর, এক এক করে জানালার কাঁচ তুলে দিল। হঠাৎ তাকবীরের চোখ আটকে গেল রিয়ার ভিউ মিররে। দৃষ্টির প্রান্তে ধরা পড়ল দুটি গাড়ি। নিরাপদ দূরত্বে হলেও সন্দেহজনকভাবে ঠিক ওদের পেছনেই ছায়ার মতো লেগে আছে। এখন বুঝতে পারল তাকবীর রিচার্ডের অস্থিরতার আসল কারণ।
‘বুকের ভেতর হিমশীতল এক ভয় চেপে ধরল তাকবীরকে। তাকাল এলিজাবেথের দিকে। চাপটা যেন আরো বেশি অনুভূত হলো। রিচার্ডের নির্দেশ মনে পড়তেই আর দেরি না করে পিছনের হেডলাইট জ্বালিয়ে দিল তাকবীর। হেডলাইটের আলো ছুঁয়ে আসা অন্ধকারে ভেসে উঠল সেই গাড়িগুলোর ছায়া। এতে করে গাড়িগুলো ওদের গাড়ি থেকে আরেকটু পিছিয়ে থাকবে এবং সন্দেহের আশঙ্কাও থাকবে কম।
‘ওরা মার্কোর গার্ড। জঙ্গলের ফাঁকা, নিষ্প্রাণ পথ দিয়ে হঠাৎ এমন এক গাড়ি ছুটতে দেখে সন্দেহ জেগেছিল তাদের মনে। মার্কোর সাথে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে তারা আর দেরি করেনি নিজেদের গাড়ি নিয়ে পিছু নিয়েছে। প্রথম গাড়িতে বসে আছে একজন গার্ড। দ্বিতীয় গাড়িতে আরও দুইজন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা গাড়িটার দিকে একইসাথে বারবার চেষ্টা করছে মার্কোর সাথে যোগাযোগ করতে কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থতায় ফিরে আসছে। কারণ মার্কোর সকল সিকিউরিটি সিস্টেম রিচার্ড আগে থেকেই নিজ কন্ট্রোলে নিয়ে নিয়েছে। রিচার্ডের বাইক জঙ্গলের ঘন ছায়ার মধ্যে দিয়ে সাপের মতো ছুটে চলছে। ইতিমধ্যে রিচার্ড খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ওদের ধরে ফেলতে সক্ষম হয়৷ গাড়িগুলো সড়ক দিয়ে চললেও রিচার্ডের বাইক ছিল জঙ্গলে পথে। ওদের গাড়ির দিক ধরে ছুটছিল।
‘হঠাৎ তাকবীরের গাড়ি ব্রেক চেপে থেমে গেল। পেছনের দুই গাড়িও কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। গার্ডদের চোখে ভেসে উঠে সতর্কতার ছাপ। রিচার্ড ঠিক এই সুযোগটাই চেয়েছিল। গাড়ি থেকে নামল তাকবীর। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দূরের গাড়িগুলোর দিকে তেরছা নজরে তাকাল একবার অতঃপর অযথা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল গাড়ির টায়ারের কাছে। হাতের আঙুল দিয়ে টায়ারের বোল্ট ঘোরানোর ভান করল। এই সুযোগে চাপা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রিচার্ডের দিকে কথা ছুঁড়ে দিল,
“এতো ভাবার কি আছে? সামনেই গেট। অলমোস্ট এসে পড়েছি আমরা।”
‘এবার রিচার্ডের ভেতর থেকে যেন জঙ্গলের কোনো হিংস্র জন্তু গর্জে উঠল,
“ইউ ফা’কিং স্টভব্রোন! ওরা রাশিয়ান মাফিয়া। এখানে কারও উপর বিশ্বাস চলে না। ওদের চালান ওরা নিজেরা এসে নেয় আন্ডারস্ট্যান্ড ড্যামেট? এক চুল হেরফেরের সুযোগ নেই। পুরো জঙ্গল ওদের খাঁচা আর আমরা এখন সেই খাঁচার ভেতর বন্দি আছি। সম্পূর্ণ জঙ্গলে বিছিয়ে রাখা আছে হাজারটা ফাঁদ—মাইন, বোম, এমনকি স্নাইপার। রিমোট ওদের হাতে। একটুখানি সন্দেহ হলেই প্রেস করে দেবে। সব ধ্বংস হয়ে যাবে সব।”
‘তাকবীর শুকনো ঢোক গিলল। তাকবীর নিজেও এখানে আসার আগে তথ্য জোগাড় করেছিল মার্কো আর তার নেটওয়ার্কের উপর। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আবার টায়ার খুলে লাগানোর ভান করল। জঙ্গলের মাঝে বাইকের উপর নিটল হয়ে বসে থাকা মানবের ঠৌঁটের আগায় ফুটে উঠল শয়তানি হাসি। রিচার্ড নিঃশব্দে বাইক থেকে নামল। চোখে শিকারির নীরব তীক্ষ্ণতা। মুহুর্তেই বিলীন হয়ে গেল ঘন জঙ্গলের মাঝে। জঙ্গলের অন্ধকার ওর দানবীয় শরীর গিলে নিলো ক্ষণিকলই। কিন্তু সেই অন্ধকারই যে এখন ওর সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এবার শুরু হবে রিচার্ডের খেলা।নিঃশব্দ, নির্ভুল, আর রক্তমাখা।
‘তাকবীর ইচ্ছাকৃতভাবে সময় নিচ্ছিল। আঙুলের ছোঁয়ায় টায়ারের বোল্ট ঘোরানোর কাজটা অকারণেই জটিল করে তুলছিল। পেছনের গাড়িগুলোতেও ধীরে ধীরে বিরক্তি জমিয়ে তুলছে। অবশেষে দ্বিতীয় গাড়ি থেকে একজন গার্ড বিরক্ত মুখে বেরিয়ে এল। গা থেকে ভারী জ্যাকেটটা সরিয়ে হাঁটতে শুরু করল রাস্তার ধারে হয়তো প্রকৃতির ডাকেই সাড়া দিচ্ছিল বা হয়তো পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিল। টের ও পেল না কখন যে তার পকেট থেকে রিমোট’টা গায়েব হয়ে গেল।
‘অকস্মাৎ অন্ধকার থেকে বিদ্যুতের মতো দু’টো শক্ত হাত বেরিয়ে এল। মুহূর্তের ভেতরেই সেই হাতগুলো চেপে ধরল গার্ডের চিবুক। কোনো চিৎকারের সুযোগই পেল না। এক তীব্র মোচড়ে শোনা গেল হাড়ের গুঁড়ো গুঁড়ো হওয়া খটখটে শব্দ। শরীরটা নিথর হয়ে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল। সবকিছুই ঘটল নিস্তব্ধ, নিখুঁত সঞ্চালনায়।একটি নিশ্বাসও বাতাসের গায়ে লাগল না। দূরের গাড়িতে থাকা গার্ডরা এখনও কিছুই টের পায়নি। অথচ মৃত্যুর ছায়া তাদের এত কাছ দিয়ে হেঁটে গেল।
‘ঠিক একই ভাবে পরবর্তী শিকারটাও এভাবেই শিকার করা হলো নিঃশব্দে, বেদনাহীন। রিচার্ডের ঠোঁটে কোনো কথা ছিল না,। চোখে কোনো অনুভূতি নয়, শুধু শিকারির চূড়ান্ত নিশ্চিততা। এবার তার পরবর্তী লক্ষ্য ঠিক হয়ে গেছে। যুদ্ধের শুরুটা নিঃশব্দ হলেও কিন্তু শেষটা রক্তাক্ত হবে। রিমোট টা আপাতত রিচার্ডের হাতে। পৈশাচিক হাসি লেপ্টে রিচার্ডের ঠৌঁটে। তবে হঠাৎই তা মিলিয়ে গেল বিকট শব্দের সাথে। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠল সমগ্র জঙ্গল। আগুনের হলকা আর ধোঁয়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। রিচার্ডের মুখ থেকে বেরিয়ে এল একগুচ্ছ গালি। ঠোঁটের কোণে ক্রোধের তীব্র রেখা।
“শিট, লুকাস! ইউ ফা’কিং ইডিয়ট!”
‘দাত চেপে গর্জে উঠল রিচার্ড। লুকাসের অতি চালাকি সবকিছু গুলিয়ে দিল। বাংকারে আগেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলেছে সে। ফলে পুরো অপারেশনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে এখন। সামনের গাড়িটা আর ধৈর্যের পরীক্ষা দিল না। হেডলাইটের আঁচ ভেদ করে দেখা গেল গাড়িটা গ্যাসলাভার মতো তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছে। স্পষ্ট ভয় আভা দিয়ে উঠল রিচার্ডের চোখে। আঙুল চেপে ধরল ব্লুটুথের বাটন। উত্তেজিত স্বরে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে থাকল,
“ডু ইউ হিয়ার মি? রান, ফাস্ট!”
‘বিস্ফোরণের দগদগে শব্দে কেঁপে উঠেছিল এলিজাবেথ। গাড়ির কোণে সেঁটে থাকা কাঁপা-কাঁপা শরীরটা নিজেই নিজেকে আড়াল করতে চাইছিল। তাকবীরের বুকের ভেতরে ভয় একটা তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো বিঁধেছিল। ছুটে যায় এলিজাবেথের কাছে। শক্ত করে ধরল ওর কাঁধ। “আমাদের যেতে হবে।” গলায় কোনো কম্পন নেই শুধু শীতল দৃঢ়তা।
‘রিচার্ডের নির্দেশ ভেসে আসার আগেই তাকবীর গাড়ির ইঞ্জিনকে তর্জনী দিয়ে চাবুকের মতো মারল। স্পিডোমিটার সীমানা ভাঙতে শুরু করে। পেছনের আয়নায় স্পষ্ট দেখা গেল যাচ্ছে ধাওয়া করা গাড়ির হেডলাইটগুলো দু’টি জ্বলন্ত চোখের মতো, মৃত্যু এগিয়ে আসছে সর্বশক্তিতে। ‘রিচার্ডের চোখে জ্বলছে নেকড়ের ক্ষুধা, হিংস্রতার তীব্র লালসা। এবার জঙ্গলের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল শিকারী হিংস্র। বাতাস ছিঁড়ে গাছের ছায়া পেছনে ফেলে ছুটে চলল তার বাইক গাড়ির পিছু। সামনেই সেই কাঠের গেট, মুক্তির শেষ চিহ্ন। গার্ডের গাড়িটা তাকবীরের গাড়ি ধরতে না পেরে ফোন হাতে নিল গেটে থাকা গার্ডদের জানানোর জন্য।
‘উইন্ডো দিয়ে সেটা দেখে আর এক মুহূর্তের দ্বিধা করল না রিচার্ড। বাইক ছেড়ে আকাশে লাফ! শরীরটা শিকারি পাখির মতো বেঁকে গিয়ে সোজা গিয়ে পড়ল ঘাতক শিকারী গাড়ির সানরুফের ওপর। ঝাঁকুনিতে গাড়ি কেঁপে উঠল। রিচার্ড এক হাতে শক্ত করে সানরুফের কিনারা আঁকড়ে ধরল অন্য হাতে কোমরের কাছ থেকে পিস্তল বের করে নিশানা করল সেই গার্ডের ফোনধরা হাতের দিকে।
“নো এফিং কল, আসহোল!”
‘গার্ডের হাতে ফোনটা যেন আঠার মতো সেঁটে আছে। না থামে গাড়ি, না রাখে ফোন। অতঃপর ফের রিচার্ডের থমকে যাওয়া মস্তিষ্কে ধীরে ধীরে রুপান্তরিত হলো তার চিরচেনা পৈশাচিক প্রবৃত্তে। মাথার হেলমেট খুলে নিয়ে সেটাকেই রূপ দেয় এক বন্য অস্ত্রে। সানরুফের কাচে পড়তে থাকে ক্রমাগত তীব্র আঘাত। প্রতিটি ঘায়ে কাচের গায়ে আঁকা হয় ফাটল। শেষমেশ গ্লাসটা ভেঙে পড়ল অসহায় আত্মসমর্পণে। সঙ্গে সঙ্গে রিচার্ড সাপের মতো নিপুণ ভঙ্গিতে শরীর গুটিয়ে ঢুকে পড়ে গাড়ির ভেতর। শুরু হয় হিংস্র ধস্তাধস্তি, দেহ আর দেহের হিংসাত্মক লড়াই। একটা সময় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারায়। গতি টেনে নিয়ে যায় গভীর জঙ্গলের অন্ধকারে। এক প্রচণ্ড ধাক্কায় দু’জনই ছিটকে পড়ে সবুজ ঘাসের ভেজা গালিচায়।ওপাশ থেকে তাকবীর শুনতে পায় হাড় ভাঙার এক করুণ মটমট শব্দ, অসহায়ের মতো গোঙানি তার সাথে মিশে যায় রিচার্ডের কর্কশ প্রতিধ্বনি।
‘মৃত্যুর পূর্বের নিশ্বাসের কর্কশতা মিশে গেল বাতাসে। ফিনকি দিয়ে ছিটে আসা র’ক্তে সিক্ত হচ্ছে মৃত্তিকা। উপ্তত্ত নিশ্বাস ফেলে নিথর দেহটা ছুড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল রিচার্ড। উঠে দাঁড়িয়ে সামনে দু’কদম এগোতেই হঠাৎ পায়ের নিচে কিছু একটা পড়ল। সেখানেই স্তব্ধ হয়ে রইল রিচার্ডের পা। রিচার্ড তাকাল সামনে ইতিমধ্যে নিরাপদে তাকবীরের গাড়ি গেট পেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কলও কেটে গেছে। হঠাৎ করেই ফিক করে হেসে দিল রিচার্ড, অকারণেই। একটু পরপর নিজের পায়ের দিকে তাকাচ্ছে আর অট্টহাসিডে ফেটে পড়ছে।
‘কিছুক্ষণ মন মতো হেসে তপ্ত শ্বাস ফেলে ফোন বের করল। সাইড লকে প্রেস করতেই হোম লক স্ক্রিনে ভেসে উঠল বৃষ্টিবাদল দিনের সেই চিত্তাকর্ষক সৌন্দর্যের অধিকারী এক লাস্যময় তরণী। রিচার্ড কল করল ন্যাসোর নাম্বারে। ওপাশ থেকে রিসিভও হলো সঙ্গে সঙ্গে।
“হ্যালো বস! ইউ এভরিথিং ডান? এদিকে অলমোস্ট সব কাজ শেষ। প্ল্যান C&B ডান। উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মার্কোর সকল গার্ড। আর পঁচিশটা মেয়েদেরও লোকালয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে নিরাপদে। বাকি মেয়েগুলো এখনও হেফাজতে আছে। আপনি আসলেই মার্কোর খেলা শুরু হবে। লাড়া ডিড এ গ্রেট জব। আ,,,,,
“ন্যাসো,,,
‘কথার মাঝে থামিয়ে দিল রিচার্ড। চমকে উঠল ন্যাসো রিচার্ডের এহেন নিস্তেজ স্বরে।
“বস কি হয়েছে? ম্যাম ঠিক আছে?”
“লোকা কোথায়?”
“পাশেই।”
‘রিচার্ডের কণ্ঠে হিম শীতল হাওয়া। খুবই সবিনয়ে কথাগুলো বলল,
“তোমরা শুধু আমার সহকর্মী নও,তোমরা আমার ভাই। এই এতিমের ছোট একটা পরিবার ছিলে তোমরা। তোমাদের কৃতিত্ব আমি কখনও এড়িয়ে যেতে পারব না। তোমরা ছাড়া রিচার্ড কায়নাত অসম্পূর্ণ। তোমাদের সঙ্গেই আমি পূর্ণ।”
‘ন্যাসোর ভ্রুদ্বয় কুঁচকে উঠল, “হঠাৎ এসব কথা কেন বস? আপনি কোথায়?”
‘রিচার্ডের গলা আজ একটু বেশি গম্ভীর শোনাল।
“ভাই হিসেবে তোমাদের ওপর কিছু দায়িত্ব দিয়ে যেতে চাইছি। পারবে না আমার দায়িত্বের ভার নিতে?”
‘ন্যাসোর হাতে ধরা ফোনটা টান দিয়ে নিয়ে নিল লুকাস। নির্দ্বিধায় বলে উঠল,”আপনি বললে জান দিয়ে দেব বস!”
‘রিচার্ড হাসল,
“বোকার দল। আচ্ছা, শোনো তবে—
আমার নতুন রাজ্যে কিন্তু এখনও রাণীর আগমন হয়নি। তার আগমনের ব্যবস্থা করবে তোমরা। পুরো শহর যেন জানে, রিচার্ড কায়নাতের রাণী তার রাজ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে।”
‘একটা গম্ভীর নিশ্বাস টেনে থামল রিচার্ড। পরপরই আবার বলতে শুরু করল,
“ন্যাসো ভাই আমার! তোমার জন্য হয়তো একটু কঠিন হবে, তবু ইবরাতকে ওর সাথে থাকতে দিও কিছুদিন। পায়ে বাড়লেও এখনো বাচ্চাটাই রয়ে গেছে। খুব অভিমানী—কষ্ট পেলে মুখ ফুটে কিছু বলে না, অন্তরে আগুনের মতো জ্বলে-পুড়ে নিঃশব্দে পুড়ে যায়। ও রাতে ঘুমানোর সময় খুব নড়াচড়া করে, ঘুম গভীর হয়। গায়ে কমফোর্টার থাকে না। তোমার ওয়াইফ কে বলবে ওর একটু খেয়াল রাখতে। আর হ্যাঁ ওর ইলিশে আর কিছু সবজিতে অ্যালার্জি আছে—ভুলো না যেন।”
“বস আপনি কোথায় আছেন? বলুন, আমরা এক্ষুনি আসছি!”
‘রিচার্ড আরেক বার তাকাল পায়ের নিচে। মৃত্যু ওর পা আঁকড়ে ধরে রেখেছে। নিজের এই পরিণতি দেখে হঠাৎ করেই হাসতে ইচ্ছে করল রিচার্ডের। কিন্তু হাসি তো তার সঙ্গী ছিল না কখনও তাই গলায় ভাসাল এক টুকরো সুর,,,
“কখনো আকাশ বেয়ে চুপ করে
যদি নেমে আসে ভালোবাসা খুব ভোরে,
চোখ ভাঙা ঘুমে তুমি খুঁজো না আমায়,
আশেপাশে আমি আর নেই।
আমার জন্য আলো জ্বেলো না কেউ,
আমি মানুষের সমুদ্রে গুনেছি ঢেউ।
এই স্টেশনের চত্বরে হারিয়ে গেছি,
শেষ ট্রেনে ঘরে ফিরব না, না, না…”
“বসসস…!”দু’জনের গলা কেঁপে উঠল ফোনের ওপাশে। আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা—সব মিলেমিশে এক ভয়াল সুর বেজে উঠল সেই ডাকে।রিচার্ডের কণ্ঠ এবার একেবারেই ভেঙে এলো,
“আফসোস আর কখনও আমার এলি জানের মুখ থেকে ‘হুম’ শোনা হবে না।”
“বস, কী হয়েছে আপনার? এসব কথা কেন বলছেন?”
“একটা সিক্রেট শুনবে তোমরা?”
“হুহ?”
“‘হুহ’ না, ‘হুম! রিচার্ড কায়নাত প্রেমে পড়েছিল… এক দেখাতেই। নিষ্ঠুর মানবটাও ওর সরলতার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।”
“বস প্লিজ… দয়া করে বলুন, আপনি কোথায় আছেন!”
“লোকা!”
রিচার্ডের কণ্ঠে এবার এক অদ্ভুত কোমলতা খেলে গেল। কাঁপছে লুকাসের কণ্ঠস্বর,
“বস, কী হয়েছে আপনার? আপনার এমন কণ্ঠে আমার খুব ভয় লাগছে!”
‘রিচার্ড নিঃশ্বাস টানল,”দেশে ফিরে যাও, লোকা। বিয়ে করো। অনেক অনেক সুন্দর একটা সংসার গড়ে তুলো।”
‘ভয়ংকর হলেও লুকাস খুব আবেগি। ভেঙে আসছে ওর কথাগুলো, “বস, কথা ছিল আমরা সবাই একসাথে হানিমুনে যাব!”
‘ফোনের ওপাশে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল রিচার্ডের ঠোঁটে। হাসিটা ক্ষণিকের, যেন কোনো পুরনো স্মৃতির ক্ষুদ্র আলো। গলায় গম্ভীরতা এনে বলল,
“ন্যাসো শোনো। আমার লইয়ারের সাথে যোগাযোগ করবে। উনি তোমাকে কিছু ডকুমেন্টস দেবে। সেগুলো তোমার ম্যামের কাছে নিয়ে গিয়ে ওকে ফিনল্যান্ড পাঠিয়ে দিও খুব শীঘ্রই। এ জীবনে আর কখনও ওর সামনে যেও না। ওখানে ওর জন্য সব ব্যবস্থা করা আছে—বাড়ি, গাড়ি, সবকিছু। কোনো সমস্যা হবে না ওদের। ”
‘ন্যাসোর গলায় ঝরে পড়ল অস্থিরতা,”এসবের মানে কী বস? কী বলছেন এসব? আপনি কোথায়? আর ‘ওদের’ মানে?”
‘রিচার্ডের গলায় হঠাৎ অদ্ভুত গর্বের সুর। খুশি যেন ওর বুক ছাপিয়ে গলিয়ে পড়ছে কথার ফাঁক দিয়ে,
“আমার ছেলে হবে—ন্যাসো। আমার রক্ত, আমার অস্তিত্ব আসছে এই পৃথিবীতে। আই আম গোয়িং টু বি এ ফাদার।”
‘জ্বলজ্বল করে উঠল ওদের চোখ। একসাথে চেঁচিয়ে উঠে,”সত্যি?”
‘খুশিতে গলা ছেড়ে চিৎকার করল রিচার্ড। জানান দিতে চাইলো সবাইকে তার জীবনের সবথেকে বড় খুশির সংবাদ।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ আমার সন্তান ওর গর্ভে! আসছে আমার ছেলে। আকাশ-বাতাস, সবাই জানুক রিচার্ড কায়নাত বাবা হতে চলেছে! আমার রক্ত পরিশুদ্ধ হয়ে আসবে ওর গর্ভ থেকে। আমার ধ্বংসের হাতিয়ার এখন জীবন ধারণ করছে ওর পেটে। আমি খুব খুশি জানো তোমরা?”
‘সঙ্গে সঙ্গে শাসাতেও ভুলল না রিচার্ড,
“খবরদার! আমার ছেলের আশেপাশেও যাবে না তোমরা কেউ। বাপ নষ্ট হলেও সে ভালো হবে। মানুষের জাত হবে। আমার পাপ যেন ওকে স্পর্শও করতে না পারে!”
‘কথাগুলো উচ্চারণের পরও রিচার্ডের গলায় গর্বের ঝলক। নিজের বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে আশার, ভালোবাসার, আর নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছার।
“আমার হাতে সময় নেই নাহলে আমি দেখিয়ে দিতাম এই জগতের মানুষকে—শুধু জন্ম দিলেই হয় না, গড়ে তুলতে হয়, মানুষ করতে হয়। আমি ধ্বংস হলেও আমার ছেলে সৃষ্টি হিসেবে গড়ে উঠত। ওর মা ওকে আদর্শ মানুষের মতো গড়ে তুলবে। আমার পাপের ছায়া যেন কোনোদিনও না পড়ে ওদের উপর। ওদের অনেক দূরে পাঠিয়ে দিবে। আমার ভুলের, আমার রক্তের অভিশাপ থেকে অনেক দূরে। আমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে ওর মা। এলি জান পারবে। আমি জানি ও পারবেই! ওকে পারতেই হবে। সেই হিসেবেই ওকে গড়ে তুলেছি আমি।”
‘হ্যাঁ রিচার্ড চেয়েছিল চমৎকার একজন পিতা হতে।
সেই কারণেই জগতের কঠোরতা থেকে ওদের দূরে সরিয়ে রাখার সমস্ত ব্যবস্থাও করে ফেলেছিল। ওর অন্ধকার জগতের কোনো ছায়া যেন না পড়ে, সেই নিখুঁত গোপনীয়তায় রেখেছিল ওদের কথা। সুখের নরম চাদরে মুড়ে রাখতে চেয়েছিল ভালোবাসার উষ্ণতায়, নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। পৃথিবীর বুকে যেখানে সবচেয়ে বেশি শান্তি দেশ ফিনল্যান্ডের ঠিকানায় ওদের ভবিষ্যৎ এঁকেছিল রিচার্ড।একটার পর একটা স্বপ্ন সাজাচ্ছিল। ছেলের প্রথম হাঁটা, ছোট ছোট হাসি, ওর চোখে নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া।নিজের বাবাকে আবার ফিরে পাবে। কতো স্বপ্ন দেখেছিল।কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো সব স্বপ্ন পূরণ হয়ে যেত।কিন্তু সময় ছিল কম। সবকিছু প্রস্তুত ছিল, শুধু “একসাথে চলা” আর হলো না। রিচার্ড থেকে গেলো পেছনে। তার অসম্পূর্ণ স্বপ্ন, অপ্রকাশিত ভালোবাসা আর অনুতপ্ত হৃদয়ের ভার নিয়ে।
‘ভাবতেই বুকের মাঝে তীব্র ধাক্কা খাচ্ছে। ইতি টানতে চলেছে বেদনার কন্টকময় পথ, নিরবে, গোপনে বহন করা শিরা থেকে হৃদয়ে বইয়ে আসা ভালোবাসা। শেষমেশ থেকে গেল শুধু কঠোরতা, বলা হয়নি ভালোবাসি।
‘ওপাশ থেকে ন্যাসো আর লুকাসের গলা ভেঙে যাচ্ছিল চিৎকারে। রিচার্ড আবারও হাসল, একটা ক্লান্ত, ধাতব হাসি।না, অনেক ছলনার ভিড়ে ঠিক দু’জন খাঁটি মানুষ পেয়েছে সে। যারা বিশ্বাসী, অনাড়ম্বর, নির্মল।
“বস, দয়া করে বলুন কি হয়েছে,আপনি কোথায়? আমাদের এভাবে মাঝপথে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাববেন না।আমরা আপনাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ, যেমন চাঁদ অসম্পূর্ণ সূর্যের আলো ছাড়া।”
‘রিচার্ডের ঠোঁটে ম্লান হাসি। গলায় এক অদ্ভুত প্রশান্তি,
“আমার পা মাইনের উপর পড়েছে।”
‘শব্দগুলো বাজ হয়ে আঘাত হানল ন্যাসো আর লুকাসের বুকে। পায়ের নিচটা কেঁপে উঠল। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল শীতল বিদ্যুৎ। আর এক মুহূর্তও দেরি না করে দৌড়ে উঠল গাড়িতে। ওপাশ থেকে শোনা গেল রিচার্ডের আরেক দফা শক্ত, কঠিন হাসি। মৃত্যুকেও মজা করে তুচ্ছ করে দিচ্ছে।
“বস! বস, প্লিজ, কাম অন… নড়বেন না, আমরা আসছি!”
“সবটা জানার পরেও এমন কথা মানায় না তোমাদের মুখে? আমি চলে যাওয়ার আগেই আমার ট্রেনিং ভুলে যাচ্ছো?”
‘কেউ শোনে না রিচার্ডের কথা। শুধু ইঞ্জিনের কর্কশ গর্জন শোনা যাচ্ছে। একটানা, তীব্র। সময়ের প্রতিটি সেকেন্ডকে ও ওরা ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে। রিচার্ড ফোনটা কান থেকে সরিয়ে নিল শব্দের ভার সইতে পারছিল না আর।টায়ারের রুক্ষ গর্জনে লাড়া ছুটে এলো জানালার পাশে।অকারণে বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা এক অদৃশ্য ভয় বুকের মাংসপেশি চেপে ধরে। পেছনেই মার্কোর হাত লোহার শিকলের বেঁধে খাটের দুই প্রান্তে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
“শেষ… আরেকটা কথা শোন।”
‘ন্যাসোর ভিতরের অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে স্টিয়ারিংয়ের উপর চাপ প্রয়োগে। ছটফট করছে দু’টো শক্ত গোছের মানুষ। রিচার্ডের তেজ বিহীন স্বরে ওদের আরো উত্তেজিত করে দিচ্ছে। ওপাশে ফোঁপাতে ফোঁপাতে লুকাসের ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ,”হুম?”
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪১
‘রিচার্ডের কণ্ঠ হঠাৎ ঠাণ্ডা। একটা স্থির নির্লিপ্তিতা মিশে আছে তাতে। চোখ বুঁজে মৃদু হাসল। লম্বা এক শ্বাস টেনে নিল বলে দিল,
“If I die, tell her… yes, villain also fall.”
‘যন্ত্রণা হচ্ছে। বুকের ভিতর অসহ্যকর যন্ত্রণা হচ্ছে। কোথাও একটা অগ্নিকাণ্ড হচ্ছে। রিচার্ড চেপে ধরল সেই জায়গাটা যেখানে এলিজাবেথ মাথা ঠুকেছিল। হাউমাউ করে কেঁদেছি। বলেছিল ওর সাথে যাওয়ার জন্য। মৃত্যুর তাড়নায় নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছিল, হারানোর ভয় দেখেছিল নিগড়া স্বীকারোক্তি পেয়েছিল আর কিসের দুঃখ? শুধু সুখ আর সুখ। খুশিতে ঝোপের মাঝে ছুঁড়ে মারল ফোন রিচার্ড গলা ছেড়ে চেঁচাল। আকাশ-বাতাল সকলে জানলো আজ না বলা কথাটা।
“Ti amo red”