মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪৭

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪৭
মুসতারিন মুসাররাত

উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজা বরাবর তাকাল। লম্বা লম্বা কদম ফেলে নীরব এগিয়ে আসে। প্রত্যাশার মাথা তখনও অধরার কাঁধে ঠেসে রাখা। কান্নার কারণে চোখের পাপড়িগুলো একসাথে লেগে আছে। ভেজা পল্লব তুলে বিস্ময় নিয়ে একবার নীরবের দিকে তাকাল। নীরব বউয়ের মুখের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। নীরবের কপাল বেঁয়ে ঘাম ঝরছে। ফর্সা সুশ্রী বদনখানিতে উদ্বেগ, চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তবুও চোখের পলক আলতোভাবে নামিয়ে ভরসা, আশ্বাস দিল। নিঃশব্দে চোখের ভাষায় ইশারায় কিছু বলতে চাইল, বোঝাতে চাইল— ডোন্ট ওয়ারি, আমি তো আছি।

কিন্তু পুরনো কিছু তিক্ত কথা ফের মন-মস্তিষ্কে বিরুপ প্রভাব ফেলল প্রত্যাশার। অভিমানে, অভিযোগে সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নেয় ও।
এদিকে ছেলের কথায় নীহারিকার মুখ মুহূর্তেই র*ক্তশূন্য হয়ে গেল। মাহবুব সাহেব হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নীহারিকা কঠিন দৃষ্টিতে নীরবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু গলায় বললেন,
-” তারমানে নীরব, তুইও সব জানতিস?”
নীরব চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মায়ের প্রশ্নের জবাব দিল না। নীরবের নীরবতাই যেন উত্তর হয়ে দাঁড়াল। নীহারিকার গলা আরও কড়া হলো,
-” নীরব, তুই জানতিস? আমাকে জানাসনি কেনো? এখন বুঝতে পারছি, তোরা বাবা-ছেলে একসাথে মিলে লুকিয়েছিস। তোরা বাবা-ছেলে ঠিক জানতিস এসব জানলে আমি বিয়েটা কস্মিনকালেও হতে দিতাম না। তাই জানাসনি। তাই তো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” মা তুমি ভুল বুঝছো..”
মাহবুব সাহেব নীরবকে থামিয়ে দিলেন। ধীর অথচ দৃঢ় গলায় বললেন,
-” নীরবকে আমিই নিষেধ করেছিলাম। শফিক ভাইয়ের কাছে প্রত্যাশা মা’কে চাওয়ার পর প্রথমে ওনারা দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সবটা আমায় বলেন। আমি ভেবেছিলাম এত বছর যেহেতু প্রত্যাশাকে নিজের মেয়ে হিসেবেই মানুষ করা হয়েছে। তাই কথাটা বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো দরকার নেই। তবে নীরবের জানাটা জরুরি ছিলো। কারণ ওর জীবন প্রত্যাশার সাথে জড়াবে। তাই আমি নীরবকে সব জানাই। নীরবকে সবটা জানাতেই প্রত্যাশার বয়স নিয়ে আপত্তি করলেও এ ব্যাপারে ওর কোনো আপত্তি নেই জানায়। নীরবের যেহেতু আপত্তি নেই তাই আমি চাইনি আর কেউ জানুক বিষয়টা।”
নীহারিকার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল,

-” বাহ্ খুব ভালো কাজ করেছো। বাবা-ছেলে মিলে মহৎ কাজ করেছো দেখছি। আমি এ-ও বুঝতে পারছি তুমি ঠিক জানতে আমি এরকম জন্ম আর ও বংশের র*ক্ত যার শরীরে সেই মেয়েকে মেনে নিতে পারব না। সব জেনেবুঝেও এই মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে আনার খুব কী দরকার ছিলো?”
শাশুড়ির প্রতিটি কথা প্রত্যাশার বুকে ফলার মতো বিঁধছে। নীরবে নিঃশব্দে চোখের অশ্রু গড়িয়ে পরছে। নীরব দুই আঙুলে কপাল চেপে ধরল। নীহারিকা এক মুহুর্ত থেমে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে তেরছা কণ্ঠে বললেন,
-” তোমাকে এসব বলেই বা কীই লাভ। তোমার তো আবার ওই পরিবারের প্রতি আলাদা একটা টান আছে। যতই হোক প্রথম ভালোব___”

নীরব নিচের অধরে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। মা কেনো জানি এই একটা জায়গায় এসে অবুঝ হয়ে যায়। খুব বেশিই কঠোর বনে যান। মা এখন এমন কিছু বলে সবার সামনে বাবাকে ছোট না করে ফেলে। যে মানুষটা তার অতীত সন্তানদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছেন। জানতে দেননি। আজ ঘরভর্তি লোকের সামনে মা বাবাকে অস্বস্তিতে ফেলুক তা নীরব চায় না। তাই তো ডান হাতটা কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে তড়িঘড়ি মাকে থামিয়ে দিল,
-” ব্যস, মা যথেষ্ট হয়েছে। প্লীজ এবার থামো। এই বিষয় নিয়ে এত বাড়াবাড়ি, মিটিং ডাকার আমি কিছু দেখি না। একটা সাধারণ বিষয়কে শুধুই টেনে জটিল করা হচ্ছে। প্রত্যাশাকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি শুনতে পাচ্ছ? তারপরেও এত কথা উঠার মানেই হয় না।”

অদূরে দাঁড়ানো প্রীতির বুকে ভাঁজ করা হাত খসে পড়তে নেয়। পরপর সামলে ভাবে—এইরে এই মহিলার রাগ-জিদ সম্পর্কে আমি অবগত। ছেলে ডিরেক্ট বউয়ের পক্ষ নিয়ে এল। এটা হজম করা উনার পক্ষে কতটা কঠিন সেটা আর কেউ না জানলেও আমি জানি।
নীহারিকা থমকে গেলেন। এভাবে ছেলের মুখের উত্তর শুনে স্তব্ধ বনে যায়। মনে হচ্ছে নীরব যেন পরোক্ষভাবে বলে দিল— ওর শ্বশুরদের ডেকে বউকে নিয়ে তিনি মিটিং ডেকেছে। এসব বাড়াবাড়ি।
নীহারিকার চোখ ছলছল করে উঠল। তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠস্বরে বললেন,

-” বাহ্! এটাই বাকি ছিলো। নীরব তুইও নীবিড়ের মতো রূপ দেখালি।”
নীরবের মাথা কিঞ্চিৎ নুইয়ে এল। করুণ চাহনিতে মায়ের মুখপানে তাকিয়ে ব্যাকুল স্বরে বলল,
-” মা প্লীজ রাগ-ক্ষোভ সরিয়ে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো। প্লীজ মা ভুল বুঝো না। একবার ভাবো, বাবা-মায়ের ভুলের শাস্তি প্রত্যাশা কেনো পাবে? ওর দোষটা কী? ”
নীহারিকার শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে গেল। কোনো কথা কানে না তুলে কণ্ঠে এক সমুদ্দুর আফসোস নিয়ে বললেন,
-” এতদিন ভাবতাম আমার নীরব আলাদা। আমার নীরব মা বলতে পা”গ”ল। এখন তো আমি তোর মধ্যে শুধু চেহারায় মিল নীবিড় নয়, পুরো সেম মন মানসিকতার নীবিড়কে দেখতে পাচ্ছি। তোদের কাছে বউ আগে। মায়ের বিন্দুমাত্র দাম নেই। নীবিড়ের কাছেও ওই মেয়ের প্রায়োরিটি বেশি ছিল। তাই তো মায়ের কথা অমান্য করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওই মেয়েকে বিয়ে করেছিল।”
মাহবুব সাহেব বললেন,

-” নিভানের মা তুমি একদম চাইল্ডিশের মতোন কথাবার্তা বলছো। মানছি এই একটা ব্যাপারে তুমি ছেলেমানুষী আচরণ করে বসো। তাই বলে সবসময় এমনই থাকবে? এবার একটু চেঞ্জেস আনা প্রয়োজন।”
নীরব গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-” মা, কখনো ভেবে দেখেছো শুধু কি নীবিড়েরই দোষ ছিলো? তোমাদের কোনো ভুল ছিলো না? শুরু থেকেই যদি প্রীতিকে মেনে নিতে তাহলে নীবিড়কে আলাদা থাকতে হতো না। হয়তো সে আজ যে অবস্থায় আছে, সেখানে পৌঁছাতো না।”
নীহারিকা গম্ভীর গলায় বললেন,

-” নীবিড় যদি আমার কথা শুনতো। ওই মেয়েকে বিয়ে না করতো। তাহলেও এমন হতো না।”
মায়ের এই একগুঁয়ে মনোভাব নীরবকে ক্লান্ত করে তুলছে। নীহারিকার বুকে হালকা ব্যথা হচ্ছে। বুকের উপর হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে উচ্চকণ্ঠে বললেন,
-” তোদের কাছে মা কিছুই না। বউই সব। নীবিড় যেমন মাকে ফেলে চলে গিয়েছিল, তুইও তাই করবি। যা তোর বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে থাক। তোদের কাউকে আমার চাই না।”
নীরব করুণ স্বরে বলল,

-” প্লীজ মা, থামো।”
নীহারিকা একহাতে আঁচল টেনে মুখে গুজলেন। হাত নেড়ে নেড়ে কোনরকমে বললেন,
-” নীরব সেদিনও আমি মানতে পারিনি। আজও তোর ক্ষেত্রেও মানতে পারছি না। তবে আমার মানায় তোদের কিছু আসে যায় না। তোদের কাছে মা নয়, বউ বড়। আমার সোজা কথা পরিবারকে ছেড়ে বউ নিয়ে বাসায় উঠবি? নাকি এই মেয়েকে ছাড়বি?”
হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে নীহারিকা এবার যেন জিদ হিসেবে নিয়ে নিল। ঘর শুদ্ধ সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মাহবুব সাহেব ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,

-” নিভানের মা। ব্যস! অনেক হয়েছে এবারে থামো। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।”
নীরব দুই আঙুলে কপাল চেপে ধরে মাথাটা কিঞ্চিৎ নত করল। মাথা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করল। কয়েক মূহুর্ত নিশ্চুপ থেকে কথা সাজিয়ে নিল। প্রত্যাশার বুকটা আরও ভারী হয়ে এলো। শফিক সাহেব মুখ খুলবেন অধরা ইশারায় স্বামীকে থামিয়ে দিলেন। নীরব মায়ের নিকটে এগিয়ে গেল। দুইহাতে মায়ের কাঁধ জড়িয়ে সোফায় বসিয়ে দিল। শান্ত নিচু স্বরে বলল,
-” আমার জন্য মা তুমি গুরুত্বপূর্ণ। আমার জন্য আমার স্ত্রীও গুরুত্বপূর্ণ। আমার মা হয়ে মা তোমার মুখে এ সমস্ত কথাগুলো একদম মানাচ্ছে না।‌ বড্ড বেশি বেমানান লাগছে।”
নীহারিকা জোরেজোরে শ্বাস টানতে টানতেই ছেলের মুখের দিকে ভালো করে তাকালেন। নীরব নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরে স্রেফ বলল,

-” মা আমি নীবিড় নই। আমি নীরব। তুমি রাগ করে বলবে আমিও জিদ ধরে বাড়ি ছেড়ে যাব। এমনটা ভাবলে ভুল। আমি জানি আমার মায়ের মন কতটা নরম। আমার মা দিনের পর দিন নীবিড়ের জন্য চোখের পানি ফেলেছে। অপেক্ষায় থেকেছে। সেটা কেউ না জানলেও আমি জানি। আমার কাছে আমার মা, আমার পরিবার যতটা প্রয়োজন, গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক ততটাই প্রয়োজন, গুরুত্বপূর্ণ আমার সহধর্মিণী। প্রত্যাশা আমার অর্ধাঙ্গিনী। তোমাদের কাউকে বাদ দিয়ে আমি পূর্ণ হতে পারবো না। মা আমি আবারো বলছি, প্রত্যাশার এখন একটাই পরিচয় ও তোমার নীরবের স্ত্রী। আর এই পরিচয়টাই কী ওর জন্য এনাফ নয়?”
নীহারিকা উত্তর দিলেন না। এবারে যেন ঝিমিয়ে গেলেন। এদিকে শফিক সাহেব মাহবুব সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে ভারী স্বরে বলে উঠলেন,

-” প্রত্যাশাকে আমরা কোনোদিনও নীলার থেকে আলাদা করে দেখিনি। বরং ছোট বলে ওকে একটু বেশি আদর-আহ্লাদ দিয়ে বড় করেছি। ভালোবেসে প্রশ্রয় দিয়েছি। প্রত্যাশাকে জন্ম না দিলেও বাবা-মা হিসেবে সবটুকুই দিয়েছি, দেবো ইনশাআল্লাহ। সমাজের কাছে কে কীভাবে নেবে সেটা আমার ভাবনার বিষয় নয়। আমি বাবা হিসেবে বলছি প্রত্যাশা আমারই মেয়ে। শুধু ভরণপোষণের জন্য মেয়েকে বিয়ে দিইনি। আঠারোটা বছর যেভাবে আদরে, আবদার পূরণ করে বড় করেছি, আগামীতেও পারব। আল্লাহ আমাকে সেই সামর্থ্য দিয়েছেন। যদি আপনাদের কাছে আমার মেয়েকে মেনে নেওয়া এতটাই কঠিন হয়, তাহলে আমি ওকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। আমাদের মেয়ে ফেলনা নয়।”
নীরবের কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠল— আবার আরেকটা ঝামেলার শুরু।
মাহবুব সাহেব বললেন,

-” ভাই সাহেব আমি বুঝতে পারছি। তবে বলব এসব বিষয় আবেগে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়। মাথা গরম না করে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন। নিভানের মায়ের হয়ে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”
সহজ-সরল মেয়েটাকে মাহবুব সাহেবের বেশ ভালো লেগেছিল। এদিকে সম্পর্কটা আরো দৃঢ় করতে ছোট ছেলের জন্য প্রস্তাব রাখেন। যখন পরিচয় জানলেন, তিনিও দোদুল্যমান অবস্থায় পড়েন। পরবর্তীতে ভাবেন–শফিক সাহেব হয়তো ভাববে মেয়েটার এমন অতীত জেনেই হয়তো আর এগোলেন না। কিন্তু ভ’য় ছিলো এমন একটা দিনের। সব দোটানা একপাশে ঠেলে অবশেষে সব জেনেই ছেলের বউ করতে সম্মতি জানান। এদিকে নীহারিকা নীরবের জন্য পাত্রী দেখছিলেন তাই তো তাড়াহুড়া করে নীরবের আকদ করালেন।
প্রত্যাশা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,

-” আব্বু আমাকে নিয়ে চলো। আমি আর নিতে পারছি না।”
মেয়ের কথায় শফিক সাহেব তার কথায় অনড় অবস্থান নিলেন। মাহবুব সাহেব, শর্মিলা তাদেরকে বোঝাতে লাগলেন। প্রত্যাশা জিদ ধরেছে সে এক্ষুনি চলে যাবে। শফিক সাহেবও একগুঁয়ে ধরে রইলেন। অধরা স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করতেই শফিক সাহেব থামিয়ে দিলেন। শর্মিলা বললেন,
-” ভাই আপনি কী মেয়ের সাথে পাগল হলেন নাকি? মানছি অনেক কথা হয়েছে। তাই বলে এই রাতের বেলা এভাবে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে চলে যাবেন। মেয়ে বলছে কোথায় মেয়েকে একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে..”
কথার মাঝেই শফিক সাহেব অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,

-” ভাবী আমার মেয়েটা অসুস্থ। এখানে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। এত কথা, এত অপমান আমার সহজ-সরল মেয়েটা নিতে পারবে না। দয়া করে আর জোর করবেন না। আমরা আমাদের মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি।”
নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উঠে সোজা প্রত্যাশার সামনে দাঁড়াল। ভণিতা ছাড়াই স্রেফ বলল,
-” প্রত্যাশা রুমে চলো। তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
প্রত্যাশা মুখ ফিরিয়ে নিল। নীরবের রাগ বাড়তে লাগলো। অধরা মেয়েকে চোখের ইশারায় যেতে বলেন। প্রত্যাশা পাথরের মতন কঠিন হয়ে রইল। শর্মিলা বলল,
-” প্রত্যাশা তোমাকে তো লক্ষ্মী মেয়ে জানি। নীরব কী বলতে চায় শুনে আসো।”
নীরব আকস্মিক প্রত্যাশার কব্জি চেপে ধরল। আর একটাও টু শব্দটি না করে সোজা রুমে নিয়ে এল। রুমে এসেই দাঁত চেপে বলল,

-” কেনো পা”গলামি করছো? এত টেনশন আমি আর নিতে পারছি না। প্লীজ তুমি অন্তত থামো।”
ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গেলেও উপরে নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে প্রত্যাশা। তাচ্ছিল্য সুরে বলল,
-” যার জন্ম এতটা কুৎসিত, বাজে তার সাথে আপনাকে মানায় না। আপনি আমার থেকে হাজারগুণ বেটার কাউকে পাবেন। আমাকে আর দয়া দেখাবেন না প্লীজ। আমি স্বেচ্ছায় এখান থেকে চলে যেতে চাই। আপনার উপর আমার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই।”

ঝটিকায় প্রত্যাশার কাঁধ দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরে নীরব। চোয়াল কঠিন করে বলল,
-” প্রত্যাশা এবারে তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো। কেনো বুঝতে চাইছো না তোমাকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। জন্ম পরিচয় দিয়ে কাউকে জাজ করা যায় না। সব জেনেশুনেই আমি তোমাকে গ্রহণ করেছি।”
প্রত্যাশা এক ঝটকায় নীরবের হাত দু’টো কাঁধ থেকে সরিয়ে দিল। দলা পাকানো কান্নারা ফের বাঁধ ভাঙল। কান্না জড়ানো গলায় চেঁচিয়ে উঠল,

-” সেটাই তো সব জেনেশুনে দয়া করেছেন। বিয়েটা করেছেন দয়া দেখিয়ে। এখন আবার আপনার মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে দয়া দেখাচ্ছেন। এত দয়া আমি আর নিতে পারছি না।”
এই বলে ধপ করে মেঝেতে বসে পরে প্রত্যাশা। দুই হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,
-” নীরব আমি আর দয়া চাই না। প্লীজ, লেট মি এলৌন। আই ওয়ান্ট টু ডিভোর্স।”
নীরবের কপালের রগ টনটন করে উঠল। রাগে সজোরে দেয়ালে ঘু*ষি মা”রল। শব্দে প্রত্যাশা কেঁপে উঠে তাকাল। জ্বলজ্বল করে আ*গুনের মতো জ্বলা নীরবের চোখদুটোয় প্রত্যাশার তাকানোর সাহস হলো না। প্রত্যাশা দৃষ্টি নামিয়ে নিল। নীরব সোজা ব্যালকনিতে চলে যায়। নিস্তব্ধ ঘরে প্রত্যাশার কান্নার বেগ বাড়ল।

নিভানের মুখের দিকে তাকাতেই নীলাশা ধরতে পারে নিভান তার উপর অসন্তুষ্ট। নীলাশা অসহায় স্বরে বলল,
-” নিভান তুমিও আমাকে ভুল বুঝলে?”
নিভান উত্তর দিল না। নীলাশা তাতে বেশি আহত হলো। নীলাশা ভারী মুখশ্রীতে বলল,
-” বিশ্বাস করো নিভান এমন কিছু হোক আমি চাইনি। নীরবের সাথে বিয়ের দিন প্রত্যাশাকে ফোর্স কিন্তু আমিই করেছিলাম। হ্যাঁ প্রত্যাশার সাথে আমার সম্পর্ক সুমিষ্ট ছিলো না। তবে ওর খারাপ হোক এ-ও চাইনি।”

নিভান তপ্ত শ্বাস ফেলে মেরুদন্ড টানটান করে দাঁড়াল। দৃষ্টি তার ব্যালকনির গ্রীল পেরিয়ে দূর অন্ধকারে। আকাশে আজ মেঘের ঘনঘটা। চাঁদ তো দূর একটা তাঁরাও দেখা যাচ্ছে না। নীলাশা অন্ধকারে দৃষ্টি মেলে ধীরে ধীরে বলে গেল,
-” প্রত্যাশা ছোট থেকেই খুব বেশি আহ্লাদী ছিলো। আব্বু আম্মু ওকে সবসময় প্রশ্রয় দিতো। আমি এটা মানতে পারতাম না। আমার কাছে অতিরিক্ত লাগতো। সেই থেকেই একটু একটু করে প্রত্যাশার প্রতি বিরূপ মনোভাব জন্মে। এখনো প্রত্যাশা বাড়ি গেলে একবেলা হাত দিয়ে ভাত খায়, দুইবেলা আম্মু খাইয়ে দেয়। আমি নিজ থেকে এমন আহ্লাদ করতে আজও পারি না। তাই ওর এমন আচরণ আমার ভালো লাগতো না। আমার মনে হতো আমার আব্বু আম্মু ওকে বেশি আহ্লাদ করে। আবার এখন এ বাড়িতে ওর বাচ্চা হওয়া নিয়ে ওর প্রতি সবার এত কেয়ার দেখে আমার নিজেকে অসহায় লাগতো।”

-” তাই তো আজ রাগ জিদ করে এমন কান্ড করলে?”
নীলাশার প্রচন্ড কান্না পেল। নিজেকে সামলে বলল,
-” নিভান আমার পুরো কথাটা আগে শোনো। প্রীতি আমাকে উস্কালেও আমি বলিনি। আমি চাইনি বলতে। তবে আজ সন্ধ্যায় আমি রাগের মাথায় মুখ ফস্কে বলে ফেলি। আমার হাত কেটে গেলেও মা কিছুই বললেন না। অথচ প্রত্যাশা পরে যেতে নেয়, এই দেখেই আমাকে কতগুলো কথা শুনালেন। আমার তখন প্রত্যাশার উপর রাগ হয়। আমি রাগ করতেই মা আমার উপর চড়াও হলেন। আচ্ছা, প্রত্যাশা তো সবার কাছে আমার বোন হিসেবেই পরিচিত। বোন কী বোনকে রাগ করে না? রাগ দেখায় না? মা তো সেই হিসেবেও নিতে পারতো। কিন্তু না মা আমাকে কড়া করে বললেন। সেই সময় আমি রাগের মাথায় বলে ফেলি। অথচ আমার নিজের আম্মু কী না আমাকে এতবড় একটা কথা বলল। আমার আম্মু বলল, আমি কোনোদিন মা হতে পারব না জন্য, প্রত্যাশার সুখ আমার সহ্য হচ্ছে না।”
ডুকরে কেঁদে উঠল নীলাশা। ভাঙা সুরে বলে,

-” একবারো কেউ আমার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে না। আম্মু কী করে পারল এমন বলতে?”
একহাতে নীলাশাকে আগলে বুকে টেনে নিল নিভান। চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে বলল,
-” নীলাশা তোমার আম্মু রাগের মাথায় বলেছেন। রাগের সময়কার কথা ধরতে নেই। আর একদিন না একদিন তো সত্য সামনে আসতোই। বাট প্রত্যাশার প্রেগনেন্সির সময় এরকমটা না হলেও পারতো। তোমার আরেকটু ভেবে চিন্তে কথা বলা উচিত ছিলো। যাইহোক, সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না। আমার মায়ের রাগ হলে আ*গুন। আবার রাগ পড়লে একদম পানি। নীরব মা’কে সামলে নিবে।”

আনিশাদের রুমে ইচ্ছে। একসাথে কার্টুন দেখছে।‌ প্রীতি রুমে এসে পায়চারী করতে করতে কিছু ভেবে ফোন হাতে নিল। ঝটপট কল দিল। রিসিভ হতেই বেশ এক্সাইটেড হয়ে বলে প্রীতি,
-” ব্রো তোর তো কপাল খুলে গেল।”
ফোনের ওপাশ থেকে সার্থক প্রশ্ন ছুঁ’ড়ল,
-” কীভাবে?”
সবটা জানিয়ে প্রীতি শেষে বলল,
-” প্রত্যাশা আমাদের কাজিন।”
গলায় প্রশ্ন ঝুলিয়ে বলে সার্থক,
-” এর সাথে আমার কপাল খুলার কী সম্পর্ক?”

-” আরে বুঝতে পারছো না। যেভাবেই হোক না কেনো প্রত্যাশা আমাদের নিজের। এ বাড়িতে ওর অপমান আমরা মানব না। ওকে ছাড়িয়ে আমাদের বাড়ির মেয়ে আমাদের কাছে নিবো। বুঝেছো? শুধু একটু বুদ্ধি খাটাও তাহলেই হবে। প্রত্যাশা যেহেতু আমাদের পরিবারের মেয়ে।‌ এখন ওর লিগ্যাল গার্ডিয়ান আমরা। ওর উপর আমাদের একটা অধিকার আছে না? বলো আছে তো?”
-” তোকে তো আমি ব্রেনি জানতাম প্রীতি। এখন তো দেখছি সেই জানা ভুল ছিলো। তুই মোটেই ব্রেনি নোস। তুই আসলে একটা গাঁধী।”
প্রীতি রেগেমেগে চেঁচিয়ে বলল,

-” ভাইয়া…আআআআ।”
-” প্রত্যাশা আমাদের কাজিন। আর নীরবের? প্রত্যাশা নীরবের বউ। প্রত্যাশার উপর সকলের থেকে নীরবের অধিকার বেশি। আশাকরি এবার বুঝেছিস?”
হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান হয় না ঠিক তেমনি তার ভাইটাও তাদের পরিবারের সবার থেকে একটু হলেও ভিন্ন। এইযে তার আর ভাইয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। সার্থক দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে বলে,
-” প্রত্যাশার নামটা নীরবের নামের পাশে জড়ানোর একদিন আগেও যদি ওর সাথে আমার দেখা হতো, তাহলে আমি উঠে পড়ে লাগতাম। প্রত্যাশাকে নিজের করে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যেতাম। কিন্তু আফসোস ও যখন অলরেডি অন্যকারো সাথে বাঁধা পড়েছে। তখনই ভুল করে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। এটা আমার জীবনের একটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে থাকবে। তারপরও চাই, আমার না হোক, অন্তত সে যার শহরেই থাকুক, ভালো থাকুক। সুখে থাকুক।”

রাগটা দমিয়ে নিঃশব্দে রুমে পা রাখল নীরব। প্রত্যাশা ফ্লোরে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে। নীরব হাঁটু গেড়ে বসল। আলগোছে প্রত্যাশার কাঁধের উপর একটা হাত রাখতেই প্রত্যাশা চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। বলল নীরব,
-” প্রত্যাশা তোমার আমার মাঝে দেয়াল কেনো দাঁড় করছো তুমি? তোমার সমস্যাটা কী?”
প্রত্যাশা কিছুপল নিশ্চুপ থেকে পরক্ষণেই অস্ফুটে বলল,
-” সমস্যা আপনি বারবার আমাকে দয়া দেখাচ্ছেন। সমস্যা আমার শরীরে আপনাদের শত্রুর র*ক্ত বইছে।”
নীরব শান্ত ভঙিতে বলল,

-” আর আমার র*ক্ত, আমার অংশ যে এখন তোমার গর্ভে।*
-” প্লীজ নীরব এসব বলে আমাকে জোর করবেন না। এত অপমান সহ্য করে আমার পক্ষে আপনার সাথে থাকা সম্ভব নয়। আর আপনি নিজেও বলেছিলেন, দয়া দেখিয়ে বিয়েটা করা ভুল হয়েছে। তখন আমি বুঝতে না পারলেও এখন ক্লিয়ার। আপনার সেই ভুল শুধরে দিতে আমি চলে যেতে চাই। এতকিছুর পরেও থাকতে চাই না আমি।”
-” থাকতে হবে না। আমি জোর করব না। শুধু আমার বাচ্চাটা আমার কাছে আসা পর্যন্ত তুমি থাকবে, ব্যস!”
প্রত্যাশা সবেগে দু’পাশে মাথা নেড়ে বলে,
-” অসম্ভব! মানে এক বছরের মতো আমাকে আটকে রাখতে চাইছেন?”
-” কে বলল এক বছর? তার সাথে আরো দু’টো বছর। বাচ্চাকে ফিড করানোর জন্য। যাও বেশি নয় আমার বাচ্চাটার জন্য তিনটে বছর থাকবে।”
প্রত্যাশা অসহায় মুখ করে বলল,

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪৬

-” বুঝতে পারছি আপনার প্ল্যান। তিন বছর বলবেন, তারপর আবার আমায় প্রেগন্যান্ট করে নতুন অজুহাত দেবেন।”
নীরবের ঠোঁটের কোণে এবারে চাপা হাসি দেখা গেল। তবে হাসিটা চেপে রেখেই নির্লিপ্ত ভঙিতে বলে,
-” এই তো দেখছি মিসেস নীরবের বুদ্ধি খুলেছে। দরকার হলে আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমাকে এভাবেই আটকে রাখব। এই প্রসেস আর অজুহাত অব্যাহত রেখে।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪৮