মনের আড়ালে পর্ব ৩
লেখনীতে Alisha Rahman Fiza
ঠিক আধঘন্টার পর আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌছালাম।আমি গাড়ির গেইট খুলে বাহিরে চলে আসলাম।ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে যাবো তখনই মিস্টার রক্তিম পিছন থেকে বলললেন,
~অধরা,আমি অফিসে যাচ্ছি একটা জরুরি মিটিং পরে গেছে তাই রুপসার খেয়াল রাখবেন।আর শোনেন আমি না আসা পর্যন্ত ওকে একা ছাড়বেন না।
আমি বললাম,
~ঠিক আছে।
এতটুকু বলে আমি বাড়ির ভিতর ঢুকে পরলাম।আমি হলরুমে এসে দেখি পুরো হলরুমে খেলনা দিয়ে ভরা আমি অবাক হয়ে গেলাম এতটুকুন বাচ্চার এতো খেলনা।আমি এসব ভাবা বন্ধ করে চারদিকে রুপসাকে খুজতে লাগলাম কোথাও তাকে না পেয়ে একটা সার্ভেন্টকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
~রুপসা কোথায় আছে তা কি আপনি বলতে পারবেন?
সার্ভেন্ট বললেন,
~জ্বী ম্যাড্যাম।রুপসা মামণি তার রুমে গিয়েছে।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
~ধন্যবাদ।
আর পা বাড়ালাম রুপসার রুমের দিকে।
অফিসে পৌছে রক্তিম তার কাজে মনোযোগ দিলো এই প্রজেক্ট টা তার দরকার নাহলে কোম্পানির অনেক বড় লস হয়ে যাবে আর এর দায়ভার রক্তিমের বহন করতে হবে।সে অনেক চিন্তিত একদিকে মেয়ের চিন্তা অন্যদিকে অফিসের কাজ কীভাবে যে সামাল দিচ্ছে তা শুধু রক্তিম জানে।মামাও দেশের বাহিরে নাহলে মামার সাথে দুটো কথা বলে নিজের মনটাকে হালকা করতে পারতো।রক্তিম ল্যাপটপটা সাইডে রেখে চোখ বন্ধ করে চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বসে রইলো।
সে যে এখন সম্পূর্ণ একা সে এখন বুঝতে পারছে কেউ তার মনের কথা শুনতে আসে না উপরের চাকচিক্য দেখে বোঝা যায় না একটা মানুষের মনে কতো বড় একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে।বাহির থেকে হাসি খুশি টাকা পয়সা দেখে মানুষ তাই বুঝে যে সে হয়তো অনেক খুশি।এসব ভাবতেই রক্তিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে আবার ল্যাপটপ টা নিয়ে কাজ শুরু করে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বাসায়ও ফিরতে হবে অধরা এতক্ষন হয়তো থাকতে পারবেনা তার জীবনেও অনেক কাজ আছে তারও পরিবার আছে।রক্তিম এতোটাও স্বার্থপর হয়ে এই পৃথিবীতে থাকতে চায় না যে তার কারণে অন্য একটা মানুষ নিজের জীবন নিজ ইচ্ছাই চালাতে পারবে না।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আমি রুপসার রুমের দরজা ঠেলে ভিতরে ডুকে যা দেখি তাতে আমার চোখ ছানাবড়া কারণ রুপসা বিছানার মাঝখানে বসে আছে। শুধু বসে নয় তার আশেপাশে চকলেটের প্যাকেট দিয়ে ভরা রুপসা টিভি দেখছে আর চকলেট খাচ্ছে আর কার্টুন দেখে হেসে ফেলছে।আমি আস্তে করে ব্যাগটা ওর স্টাডি টেবিলে রেখে ধীরপায়ে ওর পাশে গিয়ে দাড়াতেই রুপসা আমার দিকে তাকালো।আমাকে দেখে রুপসা খুশী হয়ে বসা থেকে দাড়িয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
~ম্যাম তুমি এসেছো সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
আমি রুপসার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম রুপসা আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার গালে চুমো দিয়ে বললো,
~I miss you.
আমি বললাম,
~I miss you too baby.কিন্তু রুমের এই অবস্থা কেন সোনা?তোমার পাপা কী জানে তুমি এভাবে চকলেট খাচ্ছো?
রুপসা বললো,
~পাপা নেই দেখেই তো খেতে পারছি পাপা খেতে দেয়না চকলেট।
আমি বললাম,
~পাপার অগোচরে এসব হচ্ছে তাই না।
বলেই ওর পেটে সুরসুরি দেওয়া শুরু করলাম রুপসা হাসতে হাসতে বললো,
~ম্যাম কি করছো আমাকে ছাড়ো।আমার সুরসুরি লাগছে।
বলতে বলতে ও বিছানায় পরে গেলো আমিও বিছানায় শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে চুমো দিয়ে বললাম,
~আমার লক্ষ্মীবাচ্চা।
রুপসা ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
রুপসার সাথে আজ সারাদিন আমি অনেক কিছু খেলেছি ওর সাথে বসে আড্ডা দিয়েছি ওকে গল্প শুনেয়েছি।অনেক মজা করেছি কিন্তু আমরা একটা অঘটনও করে ফেলেছি তা হলো এখন আমরা আটার সাথে মাখামাখি হয়ে আছি কারণ রুপসা একটু আগে আমাকে বললো,
~ম্যাম,চলো না আমরা রান্না করি।
আমি বললাম,
~কী খাবে বলো?
রুপসা বললো,
~গরুর মাংসের ভূনা আর রুটি।পাপা আমাকে অনেকবার খাইয়েছে।
আমি বললাম,
~ঠিক আছে।
তারপর কী চলে আসলাম রান্নাঘরে মাংসটা রেঁধে আমি যেইনা আটার ডাব্বাটা নিচে নামাতে যাবো তখনই আমার উপর সব আটা পরে গেলো।তা দেখে রুপসার কী হাসি তাই আমি বললাম,
~তোর অনেক হাসি পাচ্ছে দাড়া দেখাচ্ছি মজা
বলেই ওর পিছে একগাদা আটা দিয়ে দেই দৌড় ওকে পুরো আটা দিয়ে গোসল করিয়ে দিলাম।রুপসা হেসে কুটিকুটি নিজের অবস্থা আর আমার অবস্থা দেখে।
আমিও বিষয়টাকে অনেক enjoy করছি সব সার্ভেন্টরাও আমাদের দশা দেখে হাসতে হাসতে শেষ কিন্তু পরক্ষণেই সবার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেলো একটা কন্ঠস্বর শোনামাত্র তা আর কারো নয় মিস্টার রক্তিমের সে চেঁচিয়ে বললেন,
~এই তোমরা এসব কী করছো?এটা বাড়ি নাকি খেলার প্লে গ্রাউন্ড।
মিস্টার রক্তিমের এমন ভয়াবহ কন্ঠ শুনে রুপসা আমাকে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটা বড্ড ভয় পেয়ে গেছে।রুপসার অবস্থা দেখে আমার রাগ হলো একটা বাচ্চা মেয়ের সামনে এভাবে চিল্লিয়ে কথা বলার কোনো মানে আছে। আমি জোড়ে নিশ্বাস ছেড়ে পিছন ফিরলাম কিছু কড়া কথা শোনার জন্য আমি পিছন ফিরতেই মিস্টার রক্তিম আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিলেন তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন।মিস্টার রক্তিমের হাসি দেখে আমার সব কথা পেটে রয়ে গেলো রুপসা আমাকে ছেড়ে দিয়ে ড্যাবড্যাব করে ওর পাপার দিকে তাকিয়ে রইলো।আমি কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলান আটা আমার পুরো শরীরে আর মুখে লেগে হয়তো ভুত সেজে আছি তাই সে হাসছে।আমি নড়েচড়ে উঠলাম রুপসা দৌড়ে মিস্টার রক্তিমের কাছে চলে গেলো সে হাসতে হাসতে মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন তারপর বললেন,
~অধরা,আমি তো জানতাম মেয়েরা মেকআপ নামের আটা-ময়দা মাখে এখন তো দেখছি আপনি সত্যি সত্যি আটা-ময়দা মেখে হাটছেন।
বলেই আবার হেসে উঠলেন।আমার রাগে শরীর জ্বলছে আমি কিছু না বলে ফোস ফোস করছি রুপসা বললো,
~পাপা এভাবে বলো না ম্যাম আমার জন্য রুটি বানাতে গিয়েই এ অবস্থা বানিয়েছে।
মিস্টার রক্তিম বললেন,
~ঠিক আছে মা আর বলবো না তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে নেও।
রুপসা কোল থেকে নেমে দৌড়ে রুমে চলে গেলো।আমি এখনও সেখানেই দাড়িয়ে আছি
মিস্টার রক্তিম আমার একটু কাছে এসে বললেন,
~অধরা,ফ্রেশ হয়ে আসুন।
আমি আর একমূর্হুত সেখানে দাড়ালাম না দৌড়ে রুপসার রুমে চলে আসলাম রুপসাকে ফ্রেশ করিয়ে নিজে ফ্রেশ হলাম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৬.২০বাজে।নাহ এখানে আর থাকা যাবে না বেশ দেরি হয়ে গেছে মা অপেক্ষা করছে আর বাবা তো তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।আমি রুপসাকে নিয়ে নিচে নামতেই দেখি মিস্টার রক্তিম সোফায় বসে কফি খাচ্ছে আর ফাইল চেক করছপ।আমি তার সামনে গিয়ে বললাম,
~আমি এখন আসি।বাসায় সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে।আমার এহেন কথা শুনে রুপসা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
~ম্যাম প্লিজ আজ থেকে যাও।
আমি বললাম,
~না সোনা আমি তোমার সাথে স্কুলে দেখা করবো।
রুপসা আমাকে ধরে কান্না করে দেয় আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম
রক্তিম অধরার সব কথা শুনে বললো,
~অধরা,আপনার নিজস্ব জীবন আছে তাই আমি আপনাকে জোর করবো না যদি রুপসার জন্য আপনার মায়া হয় তাহলে আপনি রুপসার দায়িত্ব নিতে পারেন।
মিস্টার রক্তিমের কথা শুনে কী বলবো বুঝতে পারছি না তাই বললাম,
~আমি আপনাকে ভেবে বলছি।
মিস্টার রক্তিম বললেন,
~রুপসা তুমি লক্ষ্মীমেয়ের মতো থাকো আমি ম্যামকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসি।
আমি বললাম,
~তার কোনো দরকার নেই আমি চলে যেতে পারবো।
মিস্টার রক্তিম আর কথা বাড়ালেন না আমি রুপসাকে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে আসলাম বাসা থেকে।
আনমনে হেঁটে চলছি রাস্তা দিয়ে মিস্টার রক্তিমের কথাগুলো ভাবছি রুপসার সাথে এই কদিনে আমার অনেক কাছের একজন হয়ে গেছে মেয়েটা আমার এক সাগর দুখের মধ্যে একটুকরো সুখ নিয়ে এসেছে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় রওনা হলাম বাবার সাথে কথা বলতে রুপসার ব্যাপারে।
বাসায় পৌছে ফ্রেশ হয়ে সবার সাথে বসে আছি সবাই টুকটাক কথা বলছে আমি বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
~বাবা তোমার সাথে কথা আছে।
বাবা ভ্রুকুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
~বল মা কী বলবি?
আমি শুরু থেকে সবকিছু তাকে বললাম বাবা আমার সব কথা শুনে বললো,
~রুপসা ছোট মানুষ সঙ্গ চাচ্ছে তোমার মায়ের অভাবটা তোমার দ্বারা পূরণ করতে চায়।
আমি চুপচাপ বাবার কথা শুনছি বাবা বললো,
~অধরা রুপসাকে তোমার দরকার কারণ তুমি ওর সাথে খুশি থাকো।ওর বাচ্চামি গুলোকে পছন্দ করো তাই আমার মতে রুপসার দায়িত্ব তুমি নিতে পারবে।
বাবার কথা শুনে তার দিকে তাকালাম বাবা মুচকি হেসে বললো,
~স্কুলে তো ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত ডিউটি করো এখন না হয় ফুল টাইম ডিউটি করো আর হা রাতে তুমি বাসায় চলে আসবে আমি আবার আমার মা ছাড়া থাকতে পারবো না।
বাবার কথা শুনে মা আর অরুনাও বললো,
~আপু রুপসাকে বাসায় নিয়ে আসিস একদিন ওকে দেখতে মন চাচ্ছে।
আমি বললাম,
~যদি ওর বাবা পারমিশন দেয় তাহলে নিয়ে আসবো।
মা আফসোস করে বললো,
~এতটুকু মেয়েটার মা নেই।
এভাবে অনেকক্ষন কথা বলে আমি ঘুমাতে চলে গেলাম কালকে তাড়াতাড়ি উঠে রুপসার কাছে যেতে হবে।
মনের আড়ালে পর্ব ২
রক্তিম রুপসাকে ঘুম পারিয়ে রাহির ছবিটা নিয়ে বসে আছে বারান্দায়। কালকের জন্য চিন্তা হচ্ছে অধরা কি আসবে?যদি না আসে তাহলে রুপসাকে সে কীভাবে সামলাবে রুপসাকি বুঝবে নাহ মেয়েটা অধরাকে অনেক পছন্দ করে।আসলে কেউ ঠিক বলেছে আমরা যাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি তারাই আমাদের ছেড়ে বহুদূর চলে যায়।রুপসাকে বুঝতে হবে এখন থেকেই ওকে স্ট্রং হতে হবে রুপসার কিছু হলে তার পাপা যে শেষ হয়ে যাবে।রাহির মতো আমি রুপসাকে হারাতে পারবো না রক্তিম রাহির ছবিটা আরো শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো।আর তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে থাকলো রক্তিম ভাবছে এতো কষ্ট তার ভাগ্যে এসে কেন পরলো?
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে বের হয়ে পরলাম রুপসার বাসায় যাওয়ার জন্য আজ নিজ হাতে রুপসার জন্য নাস্তা বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছি মেয়েটা কতো খুশি হবে।আর আমার গোলাপ গাছটায় একটা গোলাপ ফুটেছিল তাও রুপসার জন্য নিয়ে এসেছি আমার সোনা বাচ্চাট অনেক খুশি হবে ওর মুখে হাসি দেখলে আমারও অনেক ভালো লাগে।
রুপসার বাসার সামনে যেতেই দারোয়ান গেইট খুলে দিলো।আমি ভিতরে ঢুকে পরলাম আমি মনের খুশিতে হেটে হেটে যাচ্ছি তখনই আমার চোখ পরলো বাগানে সেখানে তাকাতেই আমি চোখ সাথে সাথে বন্ধ করে বললাম,
~নাউযুবিল্লাহ।
আমার বলা কথাটা একটু জোড়েই শোনা গেলো সামনে থাকা ব্যক্তিটি আমার দিকে তাকালো সেই মানুষটি আর কেউ নয় মিস্টার রক্তিম যে এখন খালি গায়ে আমার সামনে দাড়িয়ে আছে একটু আগে পুশ আপ করতে ব্যস্ত ছিল।আমাকে দেখে মিস্টার রক্তিম তার শার্ট গায়ে গায়ে দিতে দিতে বললেন,
~অধরা আপনি এখানে?তাহলে কী আমি আপনার জবাব হ্যাঁ ধরে নিবো?