রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ১২

রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ১২
ফারহানা চৌধুরী

-“লিসেন, শি ইজ মাই ওয়াইফ! আপনারা দু’জন দূরে থাকুন ওর থেকে। ইভেন কন্ট্যাক্টও বন্ধ রাখবেন। আদার ওয়াইজ, আমি নিজের আসল রূপ দেখাতে বাধ্য হবো, যা আমি চাইছি না।”
অরুর কিয়ৎক্ষণের জন্য মনে হলো সে ভুল শুনছে। সে কি স্বর্গে রয়েছে? এটা কি স্বপ্ন? ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে সে? ঘুম ভেঙে ভ্রম কাটলেই কি এই স্বপ্নের পতন? অরু শুভ্রর ধরে রাখা হাতের দিকে চাইল একবার। বিস্ময়ে স্তম্ভিত নয়ন জোড়া। অপ্রত্যাশিত কিছু শব্দ তরঙ্গ কানে ভাসতেই আঁখি জোড়া প্রকট হয়েছে বিস্ময়ে। অরু হতভম্ব। নিজ প্রতিক্রিয়া নিয়েও মেয়েটা দ্বিধান্বিত বটে। শুভ্র হুট করে এমন বলবে তা কল্পনাতীত। শুভ্রর কথার পিঠে জবাব বসালেন মুনিয়া বেগম৷ তিনি বুদ্ধিমতি মহিলা। শান্ত মেজাজে পরিস্থিতি হাতে নিতে পটু। এই যাত্রায়ও ব্যতিক্রম কিছু ঘটল না। তিনি বড্ড কোমল গলায় কৌশলে পরিস্থিতি সামাল দিতে বললেন,

-“তুমি শান্ত হও বাবা। ওরা হয়তো নিজেরা নিজেরা পার্সোনাল কোনো কথা বলছিলো। কাজিন হয়তো দু’জন, বলতেই পারে। তাই না?”
শুভ্রর তৎক্ষনাৎ প্রত্যুত্তর এলো,
-“না পারে না। মোটেও পারে না। কাজিন বলেই মাথা কিনে নেয় নি। যদি তা-ও ওদের একচুয়ালি ভালো কাজিনের মতো সম্পর্ক হতো তখন হয়তো এটা নর্মাল হতো। তবে তা না তো, তাই না। আর, সবচেয়ে বড় কথা; আমার বউয়ের সাথে কিসের পার্সোনাল কথা থাকবে ওর?”
শেষ প্রশ্ন ছুঁড়ল তামিমের দিকে চেয়ে। চোখ থেকে আগুনের ফুল্কি বেরোচ্ছে যেন। পারলে মূহুর্তেই ধ্বংস করে দিতো তাকে। তার দাঁত কিড়মিড় করছে। মন চাইছে বেশকিছু শক্তপোক্ত বাক্য ছুঁড়তে। তবে ভদ্রতা বজায় রাখতে নিজের কাজে সংযমের রেখা টানছে সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরুর বিস্ময় এই যাত্রায় পাহাড় ডিঙোলো। তার চোখ জোড়া বিস্ময়ে মার্বেল। ‘বউ’! দ্বিতীয়বারের মতো সকলের সামনে এমন সম্মোধন শুনে অরুর তনু-মন কাঁপলো যেন৷ অদ্ভুত লাগতে শুরু করলো। বলিষ্ঠ শরীরের ছায়ায় থেকে সে রীতিমতো ছোট্টখাট্টো কাঠবিড়ালীর মতো। মিষ্টি ফুলের মতো ঘ্রাণ নাকে ঠেকছে। চেরি ব্লোসামের একটা মিষ্টি ঘ্রাণ। অরুর নাক পিটপিট করছে। সে সরে দাঁড়ালো। ধীর হাতে শুভ্রর হাত থেকে হাত ছাড়াতে চাইলে শুভ্র আরো শক্ত করে চেপে ধরে। অরুর ছোট্ট বুকটা ছলকে উঠলো। মুনিয়া বেগমের কথা শুনলো তখন,
-“আমরা বসে, শান্ত হয়েও কথা বলতে পারি শুভ্র। তুমি যেমন ভাবছো ওমন না। আমরা অরুকে অনেক ভালোবাসি, স্নেহ করি। ও আমাদের মেয়ের মতো।”
শুভ্র অবজ্ঞা করে হাসে,

-“নমুনা তো দেখছি-ই।”
তার অবহেলার স্বরে অরুর সুনিপুণ ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। তস্ত্র বেগে ঘাড় উঁচিয়ে চাইলো শুভ্রর দিকে। তার সন্দেহভাজন দৃষ্টি এড়িয়ে গেলো শুভ্র।
মুনিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। কিছু একটা আন্দাজ করে শুভ্রকে জহুরি চোখে পর্যবেক্ষণের খাতায় নাম ঠুকিয়ে নিলেন। শরিফ খানও তখন কপাল কুঁচকে চেয়ে। তামিম হুট করে বলে উঠলো,
-“আঙুল তুলছেন কার দিকে? অরু আপনার কাছেও কতোটাই বা সেইফ আছে? আদৌ আছে তো? তথাকথিত স্বামী হোন তো ওর, দেখা গেল…..”
বাক্যে দাঁড়ি বসানোর সময় পেলো না বেচারা। তন্মধ্যেই শক্ত হাতের ঘুষি পড়লো নাকে। বেশ জোরে-শোরেই লেগেছে। তামিম ব্যথায় নাক চেপে বসে পড়ে বিছানায়। হাত সামনে তুলতেই রক্ত ভাসে চোখে। মুনিয়া বেগম আঁতকে উঠলেন। ধমকে উঠলেন শুভ্রকে,

-“কি করছো তুমি? পাগল হয়ে গেছ? আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলবে তুমি?”
-“যা করেছে, মরে যাওয়াই উচিৎ তার। ভাগ্য ভালো এখনো জীবিত আছে আপনার ছেলে।”
শরিফ খান এবার মুখ খুললেন। গমগমে গলায় গুটিকয়েক শব্দ আওড়ালেন,
-“তোমাদের ভালোবেসে ডেকেছিলাম। অরুকে নিজের মেয়ের মতো মনে করি আমি। মায়া আর অরু সমান আমার কাছে—”
আরো কিছু বলার পূর্বেই অরু বলে উঠলো,
-“নিজের মেয়ে? সিরিয়াসলি? মায়ার সাথেও আপনি একই কাজ করতেন যা আমার সাথে করতে চেয়েছিলেন?”
-“কি করেছিলাম আমি অরু?”

শরিফ খান তার দিকে চেয়ে। অগ্নিশিখার মতো উজ্জ্বল তার দৃষ্টি। চোখের ইশারায় নিরব হুমকি ছু্ঁড়ছে। শুভ্রর নজরে ঠেকল তা। সে অরুকে আড়াল করে দাঁড়ালো। শক্ত চোখে চাইল শরিফ খানের দিকে। শরিফ খান চোখ তুলে শুভ্রর দিকে চাইলেন৷ নিভৃতে হাসলেন,
-“এতটুকু ছোকরা তুমি। আমায় চোখ রাঙিও না৷ তোমার মতো চুনোপুঁটিদের আমি পায়েও মাড়াই না।”
শুভ্র হাসে,
-“আপনাকে অসম্মান করে আমি কোনো কিছুই বলতে চাইছি না। আফটার অল, চাচা শ্বশুর হন আমার। আই হ্যাভ টু রেসপেক্ট ইউ। তাই বলবো, এমন কিছু বোলেন না যাতে, নিজের সম্মান খোঁয়াতে হয়।”
তামিম রেগে গেল,

-“ঠিক করে কথা বলেন। আমাদের বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাদেরই হুমকি দিচ্ছেন। আজব লোক!”
-“তুমি আগে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা শেখো। আমি তোমার ছোট না যে যা-তা ভাবে কথা বলবে।”
-“আপনি নিজে ম্যানার্স শিখুন আগে। গায়ের জোরে শুধু মারতেই আসতে পারেন, আর কিছুই না। অরুর সাথে যা হয়েছে, সেটা পাস্ট। আমরা এতো রেষারেষি করেও তা ঠিক করতে পারবো না। আমি ক্ষমা চাইতেই চেয়েছিলাম। আপনারা ইস্যু ক্রিয়েট করলেন শুধু শুধু।”

শুভ্র ক্ষেপে গেল। রাগ সামলাতে না পেরে তার দিকে এগোতে নিলেই অরু তস্ত্র বেগে তার হাত টেনে ধরলো অপর হাতে। নৈঃশব্দ্যে থামতে বলল। সে এমন ঝামেলায় জড়াতে চায় না। এসব অসহ্য ঠেকছে তার কাছে। কেমন দম বন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে শ্বাস আটকে এই বুঝি মারা যাবে। আপাতত সে বের হতে চায় এখান থেকে।
শুভ্র হতবাক হয়ে গেল। তাকে আটকাচ্ছে কেন অরু? যাদের থামানো উচিত তাদের না থামিয়ে তাকে থামাচ্ছে? প্রচন্ড বাচ্চামো। সে কি ভয় পাচ্ছে? কাদের ভয় পাচ্ছে? এইসব লোকদের? এনাদের ভয় পাওয়ার কি আছে? মেয়েটা কবে একটু শক্ত হবে? নিজেকে সামলাতে শিখবে? শুভ্র অরুর হাত ধরে; সবার উদ্দেশ্যে বলে,

-“আসি। এতে ভালো ডিনার করালেন, পেট একদম ভরে গিয়েছে। একমাস বোধহয় খাবারের প্রয়োজন পড়বে না।”
এরপর বেরিয়ে এলো অরুকে নিয়ে। তীব্র অধিকার বোধ দেখা দিচ্ছে তার আচরণে। অরু হতভম্ব হয়ে নিজের হাতের দিকে তাকায় একবার। এতে শক্ত করে কেন ধরেছে? অরু ব্যথা পাচ্ছে তো। মনে হচ্ছে, হাড়গুলো মড়মড় করে এখুনিই ভেঙে যাবে। শুভ্রর দিকে চাইল সে। ব্যথা পেলেও ভালো লাগছে কিছুটা। মনটা হালকা লাগছে। তার পাশে কেউ দাঁড়িয়েছে। তার জন্য কেউ স্ট্যান্ড নিয়েছে। অরু হৃদপিণ্ড নামক যন্ত্রটার গতি অনুভব করতে পারছে। এতোটা জোরে লাফাচ্ছে কেন? বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে নাকি? অদ্ভুত। বে-শ অদ্ভুত!

তখন রাত। তুষার পড়ছে চারিপাশে। এতো সুন্দর লাগছে আশপাশ, বলার বাহিরে। মনে হচ্ছে কোনো টেলিফিল্মের পর্দা চোখের সামনে ভাসছে। অথচ ভীনদেশের এ নিত্যদিনের ঘটনার সমান। শীত থাকে যেন জাঁকিয়ে। রাতের সময় মনে হয় ঠান্ডায় কেঁপে উঠবে।
প্রকৃতি চমৎকার সুন্দর। তবে ক্যালিফর্নিয়ার সুন্দরতম প্রকৃতির রূপ মিশমির মনকুঠুরিতে আধিপত্য বিস্তার করতে অক্ষম হলো। তার মন আজ খুব খারাপ। এই মুহুর্তে তার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। মন চাইছে কাউকে সামনে এনে, তার গালে পাঁচ আঙুলের ছাপের আধিপত্য বিস্তার করতে। তবে এ কাজ সে করতে পারবে না বলেই বোধহয় মনটা আরো বেশিই মেঘে ঢাকল।

আজ তার সাথে বড্ড বেশি খারাপ ঘটনা ঘটেছে।
আজকে অফিসে শুভ্র স্যার আসেননি। দূর্ভাগ্যবশত অরু নামের মেয়েটাও এলো না। একসাথে দুজনেই গায়েব। স্বাভাবিক ব্যাপার। তাদের মিলিয়ে বলার কিছুই নেই। অরু না আশায় তার মন কিছুটা খারাপ ছিলো আগে থেকেই। মেয়েটা প্রচন্ড মিষ্টি, আদুরে। একদিনেই অনেক ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল তাদের।
সবই ঠিক ছিলো তবে ম্যানেজার সাদাফের মন মেজাজ আজ বিশেষ ভালো ছিলো না। যার ফল সরূপ ছোটখাটো একটা ঝড় গিয়েছে মিশমির উপর থেকে। কাজের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন আজ। এতো এতো ফাইল জমা করে রেখেছে, সব মিশমি আর আরেকজন মেয়েকে মিলে কমপ্লিট করতে হয়েছে। কোনো ফাইলে ছোট্ট কোনো ভুল পেলে আবারো সংশোধন করিয়েছেন বসিয়ে। বলা চলে আজকে তার জন্য জঘন্যতম একটা দিন ছিলো। তার উপর একটু আগে আসার সময় দুটো ছেলে কেমন বাজে ইঙ্গিত করে কথা বলছিলো। মিশমির এতো রাগ হয়েছিলো বলার বাইরে৷ কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে এসেছে।

আপাতত ম্যাপল পাতায় ছড়িয়ে থাকা রাস্তার উপর ধীর গতিতে পা ফেলে ফেলে হাঁটছে মিশমি। হাত দুটো ওভার কোটের বড় বড় পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে উষ্ণ হওয়ার তাগিদে। কিছু কিছু শুকনো পাতার স্তুপ জমে রয়েছে রাস্তায়। তাতে পা পড়লেই কেমন কচমচ শব্দ হচ্ছে। মিশমির মন-মেজাজ প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত৷ মা ফোন করেছে বেশ ক’বার। বাড়ি ফিরতে এতো দেরি হচ্ছে, এজন্য তিনি চিন্তিত। বাবা সামলে নিয়েছেন হয়তো এতক্ষণে। মিশমির এমন চুপচাপ হাঁটার পথেই তার সামনে একটা বাইক ধুলো উড়িয়ে এসে সজোরে ব্রেক কষে।

রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ১১

মিশমি এ যাত্রায় চমকে উঠলো। হকচকিয়ে গিয়ে আশেপাশে তাকালো। পরপরই সামনে চোখ গেল। লোকটা বাইক থামিয়েছে৷ এভাবে রাস্তার ধুলো উড়িয়ে মুখের সামনে এসে ব্রেক কষা কেমন ভদ্রতা? মিশমি প্রচন্ড রেগে গেলো৷ ক্ষিপ্ত চোখে বাইকারের দিকে চেয়ে রইলো। লোকটা মাথা থেকে হেলমেট নামিয়ে বাইকের উপর রাখে। খুব সুন্দর করে লম্বা চুলগুলো ঠিক করে। বে-শি-ই ফিল্মি! লোকটা এবার সাথে থাকা এক্সট্রা হেলমেটটা বাড়িয়ে দিলো মিশমির দিকে। মিষ্টি হেসে প্রস্তাব রাখলো,
-“Let’s go on a bike ride mam?”

রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ১৩