শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১২
নূরজাহান আক্তার আলো
-‘অবিবাহিত মেয়েদের কিছু কিছু রোগের ট্রিটমেন্ট বিয়ে। বিয়ের পর অনেক মেয়ের পিরিয়ড জনিত সমস্যাগুলো ক্লিয়ার হয়ে যায়। আমি কি বলতে চাচ্ছি আশা করি এইবার বুঝতে পেরেছেন।’
-‘আমি ওর কাজিন।’
-‘কাজিন লাভ?’
ডাক্তারের কথা শুনে শুদ্ধ আড়চোখে একবার শীতলের দিকে তাকাল। শীতল চোখ বড় বড় করে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। কি আশ্চর্য!
এই ডাক্তার পাগল নাকি? না জেনেশুনে তখন থেকে ভুলভাল বকেই যাচ্ছে। পৃথিবীতে পুরুষ পেলো না বিশুদ্ধ পুরুষটাকেই তার হবু স্বামীর খেতাব দিয়ে দিলো? অন্যায়, ঘোর অন্যায়! এই অন্যায় মুখ বুঝে মেনে নেওয়া যায় না। সেও নেবে না, কখনো না, কিছুতেই না। তাই সে থমথমে মুখে জবাব দিলো,
-‘উনি আমার আপন চাচাতো ভাই। না আমাদের প্রেম ছিল, না আছে, আর না ভবিষ্যাতে কোনোদিন হবে। যদি পৃথিবীতে পুরুষ হিসেবে শুধু উনিই বেঁচে থাকে তবুও আমি উনাকে বিয়ে না।’
-‘হে, হে, আমার বোনের মেয়েও একথা বলতো। দেখতেই পারত না তার চাচাতো ভাইকে। গালমন্দ করতেও বাদ রাখত না। এখন সেই ছেলেরই বাচ্চার মা সে। হেসে-খেলে সংসার করছে দু’জন। কেউ কাউকে ছাড়া একদন্ড থাকতে পারে না। তোমরাও তাই করবে মিলিয়ে নিও।’
এবার কি বলবে ভেবে পেল না শীতল। এসব কী কোনো কথা? একসঙ্গে এক বাড়িতে বড় হয়েছে তারা। দিন-রাত ঝগড়া করে। মা’রা’মা’রিও হয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তাদের মিল অসম্ভব! মোদ্দাকথা, এই লোক আর যাই হোক ভালো বর হতেই পারবে না। সারাদিন খ্যাক খ্যাক করে। ধমকায়। মারে। যে পাগল এই লোককে বিয়ে করবে ,করুক গিয়ে। সে এর মধ্যে ছিল না ভবিষ্যতে থাকার প্রশ্নই আসে না। শীতল এসব ভেবে মনে মনে ডাক্তারের গুষ্ঠি উদ্ধার ব্যস্ত। তখন শুদ্ধ এক ভ্রুঁ উঁচু করে বিরক্তি নিয়ে বলল,
-‘বাড়তি কথার প্রয়োজন দেখছি না। তাছাড়া বললেই কী আমি তোকে বিয়ে করার জন্য ম’রে যাচ্ছি?’
-‘তাই তো যাচ্ছো! নয়তো বলছো না কেন কিছু?’
-‘কি বলব? আমি কি তোর ডাক্তারকে এসব বলতে শিখিয়ে দিয়েছি? উনিই তো এসে অবধি ভুলভাল বকে যাচ্ছে।’
-‘শুরুতেই ভুল শুধরে দিলে না কেন?’
-‘সেই দায় আমার না। গলার সাউন্ড আস্তে, নয়তো থাপড়ে গাল লাল করে দেবো, বে’য়া’দব।’
তাদের দু’জনের ঝগড়া দেখে ডাক্তার নিজেই থতমত খেয়ে গেলেন। ধূর, বেশি বকার জন্য এমন হলো। পেশায় ডাক্তার হলেও উনি একটু বাচাল প্রকৃতির। পৃথিবীতে নানান রকমের মানুষের বসবাস। কেউ কেউ আছে হাসতে ভালোবাসে। কেউ খেতে ভালোবাসে। কেউবা ঘুরতে। আর উনি কথা বলতে ভালোবাসে। এর আগেও আগ বাড়িয়ে কথা বলায় বিপাকে পড়েছিলেন, আজও তাই। তবে উনি সরি বললেন না কারণ উনার অন্ধ মন এখনো চিৎকার করে বলছে এদের মাঝে কিছু ঘটবে। কারণ প্রায়ই কাজিন লাভ স্টোরির শুভারম্ভ হয় ঝগড়া/মারামারি দিয়ে। শুদ্ধর ধমক খেয়ে শীতল আর একটা কথাও বলল না। মন মেজাজ বিগড়ে গেছে। এ পাগল ডাক্তার তার ফুরফুরে মেজাজকে নিজের হাতে খুন করেছে। তাই সে রাগে ফোঁস ফোঁস করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। তখন ডাক্তার বেশ কিছু পরামর্শ দিয়ে প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিলো।
শুদ্ধ সেটাতে একবার নজর বুলিয়ে উঠে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল। শীতলও পিছু পিছু গেল। আশেপাশে সিমিনকে না দেখে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল দু’জন। মুখে রা নেই কারো। রিসিপশন থেকে কয়েক হাত দূরে সিমিন একজন মহিলার পাশে বসে আছে। ছলছল চোখে তাকিয়ে সান্তনাবাণী ছড়াচ্ছেন। যেই মহিলা কাঁদছে উনার বাবা মারা গেছে। লা’শ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। একটুপর লাশ নিয়ে চলেও গেলেন উনারা। শুদ্ধ হাসপাতালের সামনে থেকে সব মেডিসিনগুলো নিয়ে সিমিনের হাতে দিলো। তারপর
বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। ডাক্তার কি বলল না বলল শুদ্ধ থাকায় আপাতত কিছু জিজ্ঞাসা করল না সিমিন। তবে তাদের গাড়িটা কিছুদূর যেতেই শীতল গমগমে সুরে বলে উঠল,
-‘ক্ষুধা লেগেছে আমার।’
মেয়ের কথা শুনে পেছনের সিটে বসা সিমিন বললেন,
-‘বাড়ি গিয়ে খাস। এইতো প্রায় চলেই এসেছি।’
-‘না, আমি এখনই কিছু খাব।’
-‘জেদ করে না মা, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাছাড়া বাইরের খাবার বারণ না তোর? আর একটু ধৈর্য ধর বাড়ি গিয়ে পেট পুরো খাস।’
-‘না, আমি কাচ্চি খাব, মানে খাবই। তুমি গাড়ি থামাতে বলো।’
শীতলের কথা শুনেও শুদ্ধ গাড়ি থামাল না। সে তার সুবিধা মতো হুইল ঘুরিয়ে যাচ্ছে। শীতল তাকে তো বলে নি তাহলে সে কেন গাড়ি থামাবে? গাড়ি থামাচ্ছে না দেখে শীতল কটমট করে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘গাড়ি থামান শুদ্ধ ভাই, আমি নামব।’
-‘পারব না।’
-‘কেন?’
-‘জানি না।’
-‘সব সময় এমন ভালো লাগে না কিন্তু।’
-‘আমারো।’
-‘আম্মু কিছু বলছো না কেন? এবার রাগ হচ্ছে কিন্তু আমার।’
সিমিন কোনো জবাব দিলেন না। বরং তার কথা শুনে শুদ্ধ পুনরায় বাঁকাভাবে জবাব দিলো,
-‘রাগ হলে রাগ কর বারণ করেছে কে?’
-‘বললাম তো, কাচ্চি খাব।’
-‘বললাম তো, খেতে হবে না।’
-‘গাড়ি থামাবেন কি না?’
-‘না।’
-‘ বড় আব্বুকে বলে কিন্তু।’
শুদ্ধ পকেট থেকে ফোন বের শীতলের দিকে এগিয়ে দিলো। অর্থাৎ এই মুহূর্তে বলতে বলছে। শীতল ফোন ধরল না কারণ কথা বলতে বলতেই কাচ্চি ঘর পার হয়ে গেছে। শীতল মনের দুঃখে জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। ভেবেও নিলো জীবনেও কাচ্চি খাওয়ার কথা কাউকে বলবে না। নিজের মাকেও না। সব সময় এমন’ই করে এরা। জ্যাম না থাকায় শুদ্ধ একেবারে চৌধুরী নিবাসের পার্কিং লটে গাড়ি থামাল। গাড়িটা থামতেই
শীতল গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে বাসায় প্রবেশ করে দেখে শারাফাত চৌধুরী ড্রয়িংরুমে বসে ফোনে কথা বলছেন। কথা শুনে মনে হলো উনি আজ বিকেলে অফিসের কাজে দেশের বাইরে যাবেন। শুদ্ধর নামে পেট ভর্তি অভিযোগ নিয়ে সেও পাশে বসল। অপেক্ষা করতে লাগল উনার কথা শেষ হওয়ার। মিনিট দু’য়ের পরেই উনি কল কেটে মুখে হাসি এঁটে বললেন,
-‘কি কি লাগবে লিস্ট করেছো মা?’
শীতল উনার কথার জবাব না দিয়ে হড়বড় করে বলল,
-‘বড় আব্বু শুদ্ধ ভাই সিগারেট খায়। আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
সিমিনের সঙ্গে কেবলই এসে দাঁড়িয়েছে শুদ্ধ। বাবার কাছে শীতলের করা অভিযোগ শুনেও নির্বিকার সে। পাশে বসে হাঁক ছেড়ে পানি দিতে বলল। সিরাত পানি দিয়ে গেলে পান করে সোফাতে গা এলিয়ে দিলো। এদিকে একটা অভিযোগ করে থামল না শীতল বরং একের পর এক অভিযোগের ঝুঁলি খুলে বসল। মনের যত রাগ ছিল সুযোগ বুঝে উগড়ে দিলো। ছেলেরা বড় হয়েছে তার সব অভ্যাস নিয়ে কথা বলা সাজে না। তবুও তিনি শীতলের কথা শুনে গম্ভীর সুরে বারণ করলেন। শাসালেনও যেন বাড়ির ছোটোদের সামনে সিগারেট না খায়। এগুলোর শরীরের খুব ক্ষতিকর ভালো হয় এসব বর্জন করলে। শুদ্ধ বাবার কথাগুলো মন দিয়ে শুনে শীতলের দিকে তাকাল। শীতলের ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। অর্থাৎ সে খুব খুশি। শীতলকে হাসতে দেখে শুদ্ধর ঠোঁটেও ফিচেল হাসি ফুটল। সে
কেন হাসল সেই জানে। তবে তাকে বকা খাওয়া পেরে শীতল আর বসল না ফ্রেশ হতে চলে গেল। আর তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শুদ্ধ ভাবল,
-‘সিগারেট নিয়ে যার এত বিরোধিতা তাকে সিগারেট টানালে কেমন হয়?’
বিকেলের দিকে শখ আর স্বর্ণ টুকটাক কেনাকাটা করে একসঙ্গে বাসায় ফিরছিল। হঠাৎ মাঝপথে দেখা হলো আহনাফের সঙ্গে। পাশ কেটে চলে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলেও আহনাফ হাসিমুখে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। হাসি মুখে কুশল বিনিময় করল। চৌধুরী নিবাসের সবার কথায় শুধাল। ওরাও ভদ্রতার খাতিরে জবাব দিলো। আহনাফ আশপাশ দেখে মাথা চুলকে অকস্মাৎ বলে বসল,
-‘শখ, তোমাকে কিছু বলার ছিল।’
-‘জি, বলুন।’
-‘না মানে..! ‘
আহনাফ আমতা আমতা করে স্বর্ণের দিকে তাকাল। স্বর্ণ’ও আড়চোখে তাকাল শখের দিকে। আহনাফের মতিগতি দেখে সে সব বুঝে ফেলেছে।
এই অবধি অনেক প্রস্তাব পেয়েছে তাই তারও ধারণা আছে। তবে শখের কথা বলা, তাকানো, পূর্বের মতোই শান্ত ও স্থির। সে স্বাভাবিক ভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে মিষ্টি কালার থ্রি-পিস ও কালো হিজাব। হেঁটে আশায় নাকের ডগায় জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তবে বেশ লাগছে। যেন মন মাতানো কোনো ফুল। আহনাফের চোখে-মুখে মুগ্ধতা দেখে স্বর্ণ আবার বোনের দিকে তাকাল। ভাবল বোনের ইশারা পেলে সামনে হাঁটা শুরু করবে। কিন্তু শখ তাকে কোনো ইশারা না করে বলল,
-‘বলুন, আমি শুনছি।’
এদিকে হাতে খু্ব একটা সময় নেই। তাছাড়া চৌধুরী নিবাসের মেয়েদের দাঁড় করিয়ে রাখলে অনেকেই বিরক্ত করছে ভেবে তেড়ে আসতে পারে। তাই সেও ভাবল মনের কথা বলে দেবে। কিন্তু সে মুখ খুলার আগেই স্বর্ণ বলল,
-‘আপু, একটু দাঁড়াও আমি আইসক্রিম নিয়ে আসি।’
একথা বলেই স্বর্ণ সামনের দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। সুযোগ বুঝে
আহনাফ মনে মনে স্বর্ণকে ধন্যবাদ দিয়ে অকপটে বলে ফেলল,
-‘এই যে হবু ডাক্তার আমার মনের ডাক্তার হবেন?’
শখ সাথে সাথে কোনো জবাব দিলো না। তবে তার চোখে-মুখে অস্বস্ত্বি ফুটে উঠেছে। তাছাড়া যতটুকু জানে এই মানুষটা তার বড় ভাই সায়নের চেনা কেউ। একদিন দেখা হয়েছে তাদের। খুব সামান্য কথা হয়েছে। তাই তার এমন প্রস্তাব সহসা গ্রহনের প্রশ্নই আসে না। তবে কিছু না বলে চলে যাওয়া অভদ্রতা হয়ে যায়। কিন্তু কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। তার মনের কথা বোধহয় বুঝল আহনাফ। তাই সে বলল,
-‘প্রেম করার ইচ্ছে নেই আমারও। বউ বানাব তোমায়। সায়ন ভাইয়াকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাবা। আশা করছি, পারিবারিকভাবে খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে আমাদের।’
শখ চুপ করে শুনল। তারপর অস্বস্তি থেকে বাঁচতে বলল,
-‘আসি, তাহলে।’
একথা বলে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাঁটা ধরল। দোকানে খুব ভিড় থাকায় সেও এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল স্বর্ণের পাশে। স্বর্ণের রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে কিছু বলার আগে নজর গেল পাশে পাশে দাঁড়ানো সেদিনের সেই পুলিশের দিকে। নামটা বোধহয় ইনসান। সিভিল ড্রেসে থাকলেও চিনতে অসুবিধা হলো না। তবে স্বর্ণ রেগে থাকার কারণ বুঝল না সে। দোকানে ভিড় দেখে আহনাফ পাশের দোকান থেকে আইসক্রিম কিনে দোকানের সামনে এসে স্বর্ণের নাম ধরে ডাকল। তারা তাকালে ইশারা করে তাদের
বেরিয়ে আসতে বলল। দুবোন চোখাচোখি করে বেরিয়ে এলো আহনাফ স্বর্ণের হাতে অনেকগুলো আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘বড় ভাইয়া হিসেবে দিলাম। না করলেও শুনছি না।’
স্বর্ণের মুখভঙ্গি এখন স্বাভাবিক। সে বোনের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে বলল,
-‘ঘুষ দিচ্ছেন দেন, না করছি না। তবে ঘুষের বিনিময়ে বোন চাইলে দেবো না কিন্তু।’
একথা শুনে আহনাফ হেসে ফেলল। হাসার দরুন গালে চমৎকারভাবে দুটো টোল পড়ল। শখ দেখল কি না বোঝা গেল না। কারণ সে অন্যদিকে
তাকিয়ে আছে। স্বর্ণ মজা করছে দেখে আহনাফও হাসতে হাসতে বলল,
-‘তাহলে কি দিলে বোন দেবে শুনি?’
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১১
-‘লেনা-দেনাতে কাজ হবে না। আমার বোনকে পেতে হলে পরীক্ষা দিতে হবে।’
-‘ পরীক্ষা দিতে দিতে জান জীবন কয়লা হয়ে গেল। এখন বউ পেতেও পরীক্ষা দিতে হবে?’
-‘তা তো হবেই। আমার বোনকে তো যার তার হাতে তুলে দিতে পারি না।’
-‘তা তো অবশ্যই। তা বলুন ম্যাম কি পরীক্ষা দিতে হবে?’
-‘সময় হলে জানিয়ে দেবো। আজ আসি।’
একথা বলে স্বর্ণ শখের হাতটা ধরে হাঁটা ধরল। আর দুই মিনিট হাঁটলেই চৌধুরী নিবাস তাই আর রিকশা নিলো না। তবে তাদের যাওয়ার দিকে
তাকিয়ে রইল দুই জোড়া চোখ। একেকজনের চোখে মুগ্ধতা অন্যজনের চোখে হিংস্রতা।