শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৩
নূরজাহান আক্তার আলো
দুপুরের দিকে হাসপাতাল থেকে ফিরে রুম থেকে বের হয় নি শুদ্ধ। এত ডেকেও সাড়া তো দূর দুপুরের খাবারটাও খায় নি অবধি। হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত। সে বাড়ি এলে মাঝে মাঝে’ই এমন করে। বন্ধ রুমে কি করে একমাত্র সেই জানে। তার রুমের সঙ্গে লাগোয়া আরেকটা বড় সড় রুম রয়েছে। সেটা রুম না ঠিক ল্যাব বলা যায়। যেহেতু সে একজন সাইন্টিস্ট তার কাজ গবেষণা করা৷ মেধা ও শ্রম কাজে লাগিয়ে নিত্য নতুন জিনিস আবিষ্কার করা। ছেলের কথা চিন্তা করে শারাফাত চৌধুরী নিজে থেকেই এটা বানিয়ে দিয়েছেন। সাজিয়েছেন নান্দনিক উপায়ে। কৃত্রিম লাইটের ঝলকানিতে পুরো ল্যাব দিনের মতো আলোকিত থাকলেও বিশেষ এক উপায়ে বাইরের আলো বাতাস চলাচল ও বন্ধের ব্যবস্তাও রয়েছে। এবং ল্যাবেতে কাউন্টার স্পেস’ও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমানের। ল্যাবের একেক টেবিল একেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ডেটা সংগ্রহ, ও গবেষণার স্থান হিসেবে যথাযথ। এমনকি গবেষনার কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র হাতের নাগালে পাওয়ার জন্য ভেদে টেবিল কিংবা শেল্ফে থরে থরে সাজানো।
সেগুলো রিমোট কন্টোল সিস্টেমের। রিমোটের বোতাম চাপলে টেবিল তার সম্মুখে হাজির হবে। কাজ ফুরালে রিমোটের সাহায্যে পূর্বের স্থানে চলে যাবে। এক কথায় সব সুযোগ সুবিধার কথা মাথায় রেখে আধুনিক উপায়ে ল্যাবটা তৈরি করা।তবে তার রুমে ঢুকলে বোঝার উপায় এখানে ল্যাব আছে বা থাকতে পারে। ল্যাবে প্রবেশের গেটে রয়েছে প্যাটার্ন লক এবং বৈদ্যুতিক শকের বিশেষ ব্যবস্থা। একেক অধিক ভুল লক চাপলেই শুদ্ধর কাছে এ্যালার্ট নোটিফিকেশন যাবে এবং সেটা কনফার্ম মেসেজ না পেলে বৈদ্যুতিক শকে সেই ব্যক্তির পুরো শরীর ঝলসে দিতে পারে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এই মুহূর্তে মনযোগ সহকারে চোখে চশমা, মুখে মাক্স, গায়ে এ্যাপ্রোণ ও হাতে একটি মোটা সিরিঞ্জ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুদ্ধ। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কাঁচের জারের দিকে। জারে ছটফট করছে সাদা ধবধবে একটি পুরুষ ইঁদুর। মেডিসিন ট্রায়ালের জন্য ইঁদুরকেই আগে বেছে নেয় সে। কারণ জেনেটিক, জৈবিক ও আচরণগত দিক থেকে ইঁদুরের ৯০% জিন আশ্চর্যজনক ভাবে মানুষের সাথে মিলে যায়। একারণে মানুষের বিভিন্ন প্রকার জিনের মিথস্ক্রিয়ার প্রকৃতির পরীক্ষার ক্ষেত্রে মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে ইঁদুর। এবং রক্তে মাংসে গড়া মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সাথে ইঁদুরের অঙ্গের বা তন্ত্রের মিল পাওয়া যায়। এজন্যমানুষের শরীরে বিভিন্ন প্রকার ঔষধের প্রভাব সহজে নির্ণয় করা যায়। আরেকটি কারণ হচ্ছে, এরা জিনগত ভাবে পরিবর্তিত’ও হতে পারে। এদের নির্দিষ্ট জিনকে বন্ধ কিংবা খুলে রাখা যায়।ফলে কি পরিবর্তন হয় তা পর্যবেক্ষণ করা যায়।
শুদ্ধ’ও এই মুহূর্তে সেটাই করছে৷ সে জার থেকে ইঁদুরটা বের করে রাখল টেবিলের উপরে। সুস্থ সবল সাদা ইঁদুর। মুখ তুলে তাকেই যেন দেখছে। একহাতে চেপে ধরে না রাখলে এতক্ষনে ছুট লাগাত। প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে লুকাতো ল্যাবের কোনো এক কোনায়। শুদ্ধ ইঁদুরটাকে শক্ত করে চেপে ধরে সিরিঞ্জের মেডিসিনটুকু ধীরে ধীরে পুশ করল ইঁদুরের শরীরে। নরম গায়ে সূচ ফুটাতেই ইঁদুরটা ছটফটিয়ে উঠল। কিন্তু ছাড়া না পেয়েও শান্ত হতে পারল না। নিজের মতো করে ছটফট করতেই থাকল। এইটুকু তার শরীর কতটুকুই বা শক্তি! অতঃপর কাজ হয়ে গেলে স্বচ্ছ কাঁচের জারে পুনরায় ইঁদুরটা রেখে জারের মুখটা বন্ধ করে দিলো। যাতে কোনোভাবে পালাতে না পারে। এরপর বাজ পাখির ন্যায় শিকারী দৃষ্টিতে লক্ষ করতে লাগল ইঁদুরের গতিবিধি। ইঁদুরটা থম মেরে বসে আছে। মেডিসিন হয়তো কাজ শুরু করেছে। সে ইঁদুরটার দিকে খেয়াল রেখেই কয়েকটি কাঁচের তৈরি গোলাকার টেস্টিটিউব নল নিলো। অদূরে রাখা কাঁচের জগের মতো বিকারটিও রাখল হাতের কাছে। আয়তন হিসেবে ২৫ ও ৫০ মিঃ লিটার এর দুটো ব্যুরেট নিয়ে পানি দিয়ে ধুয়ে আগে স্টপ কর্ক চেক করে নিলো।
সব ঠিকঠাক দেখে সেটাও রাখল হাতের নাগালে। তারপর ছোট বড় থরে থরে সাজানো কাঁচের তৈরি ক্লনিক্যাল ফ্লাক্সে থাকা সবুজ রঙা তরল পিপেটের সাহায্যে টেস্টিটিউবে রাখল। এসব করতে করতে হঠাৎ খেয়াল করল ইঁদুরটা এখনো পূর্বের মতোই স্থির আছে। গা এলিয়ে পড়ি নি অর্থাৎ এখনো সুস্থ আছে। কতক্ষণ থাকে এখন সেটাই দেখার বিষয়। যদি ইঁদুরটা সুস্থ থাকে এবং তার মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয় তাহলে ধরা যায় কষ্ট স্বার্থক। সে আপাতত দৃষ্টি সরিয়ে নোটে চোখ বুলাল। তারপর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ন সারতে ক্লনিক্যাল ফ্লাক্সের সবুজ তরলের দিকে মনোনিবেশ করল।
বিকেল পেরিয়ে এখন সন্ধ্যা সাতটা। ধরনীর বুকে গাঢ় অন্ধকার। সিরাত
সন্ধ্যার নাস্তা হিসেবে গরম গরম শিঙাড়া ভাজছেন। গরম শিঙাড়ার কথা শুনে ড্রয়িংরুম থেকে ছুটে এসেছে শীতল। মুখভর্তি হাসি নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন গরম তেল থেকে শিঙাড়া তুলে প্লেটে রাখা হবে। আর সে আগে ভাগে নিজের ভাগটা বুঝে নিবে। তাকে দেখে সিরাত আগে সতর্ক করলেন,
-‘খুব গরম, খবরদার হাত দিবি না এখন। একটু থামুক নয়তো হাত, মুখ দুটোই পুড়াবি।’
-‘আরে কিছু হবে না। একটু তাড়াতাড়ি তোলো না মেজো মা।’
-‘তুলছি, বাবা তুলছি। সবুর কর একটু।’
-‘সস কোথায়?’
-‘ পাশেই তো রাখা।’
শীতল সসের পুরো বোতল আর প্লেট নিয়ে সিরাতের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। তার অবস্থা দেখে সিরাত মুখ টিপে হেসে বলল,
-‘হ্যারে শীতল এত খাস গায়ে লাগে কেন তোর?’
-‘ তাতো জানি না।’
-‘ বিয়ের আগে আমিও তোর মতো’ই ছিলাম। একটু মোটা হওয়ার জন্য কত আফসোস করতাম। কিন্তু বিয়ের পরে না খেলেও শরীর স্বাস্থ্য যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ডাউট করব তারও উপায় নেই।’
-‘কেন উপায় নেই কেন?’
-‘তোর মেজো চাচ্চু ওসব ডাউট ফাইট একদমই পছন্দ করে না। তার নাকি স্বাস্থ্যবতী গলুমলু মোটা বউই পছন্দ।’
একথা শুনে শীতল ফিক করে হেসে ফেলল। তাকে হাসতে দেখে সিরাত
নিজেও হাসলেন। সিরাত একটু বেশিই ফ্রেন্ডলি বিধায় বাড়ির মেয়েরাও তার কোলঘেঁষা একটু বেশি। তাকে যেকোনো সমস্যার কথা আগে বলে।
সমাধানও পায় চটজলদি। যেমন শীতলই গল্পে গল্পে পিরিয়ড়ের কথাটা আগে সিরাতকেই বলেছিল। সিরাত সিমিনকে জানিয়েছে। সিঁতারা শুনে সিমিনি আগে ডাক্তার দেখানোর তাড়া দিয়েছে। ছোটো মা হাসপাতালে যাবে শুনে সায়ন সিরিয়াল দিয়ে দিয়েছে। তাদের একা ছাড়বে না বলে শুদ্ধ নিজে নিয়ে গেছে। বাইরে থেকে এসে জা এবং ছেলে-মেয়ে দুটো খাবে বলে তাড়াহুড়ো করে রান্না সেরেছে সিঁতারা ও সিরাত। মোটকথা,
এই পরিবারে সম্পর্কের মেলবন্ধনটা সত্যিই খুব সুন্দর। হিংসা-বিদ্বেষ ও আত্মঅহমিকাহীন প্রতিটা মানুষ। ডুবো তেলে শিঙাড়া ভাজা হয়ে গেলে শীতল প্লেট এগিয়ে দিতেই সিরাত তাকেই আগে তুলে দিলো। শীতল পা ঝুলিয়ে কিচেন কেবিনের উপর বসল। ফুঁ দিয়ে গরম শিঙাড়ায় কামড় বসিয়ে হাতের সাহায্যে মুখের ভেতরে বাতাস করতে লাগল। গরমে জিব পুড়ে যাওয়ার দশা। তবুও সে টুকটুক করে খেতে লাগল গরম গরম শিঙাড়া।
সিমিন কেবলই শাহাদত চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে কথা বলে রান্নাঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন। সিরাতকে কিছু বলতে গিয়ে মেয়ের কান্ড দেখে কথা ভুলে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন। মনে মনে নিজের উপর বিরক্ত হলেন।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েও কী বলতে এসেছিলেন মনে করতে না শীতলের উদ্দেশ্যে বললেন,
-‘সায়ন, শুদ্ধ, শখ, স্বর্ণের আগে এটাকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করব আমি।’
একথা বলে উনি পানির জগ নিয়ে চলে গেলেন। নিজের রাগ তো আর নিজের উপর দেখানো যায় না। তাই শীতলের উপর রাগাটা দেখালেন। কিছু না করেও দোষ পেতে পেতে শীতলেরও খুব একটা গায়ে লাগে না।
তাই সিমিন চলে গেলে সে মুখভর্তি হেসে বিরবির করে জবাব দিলো,
-‘তাহলে ভালোই হবে। কষ্ট করে গরম শিঙাড়া ফুঁ দিয়ে খেতে হবে না। বর চিবিয়ে দিবে আমি শুধু গিলবো।’
তার কথা শুনে সিরাত হাসতে হাসতে চেঁচিয়ে বলতে গেলেন,
-‘এই মেয়ে কি বলে শুনে…! ‘
সিরাত আর পুরো কথা শেষ করতে পারল না শীতল মুখ চেপে ধরেছে।
সে ইশারা করে মেজো মাকে বলতে বারণ করে প্লেট নিয়ে কেটে পড়ল।
সিরাতের শিঙাড়া ভাজা হয়ে গেলে ড্রয়িংরুমে সবাইকে ডাকল। সিঁতারা
মন মরা হয়ে চায়ে কাপে চুমুক দিয়েছে। উনাদের বিয়ের এতগুলো বছর
হয়ে গেল। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ভরা সংসার। তবুও শারাফাত চৌধুরীর
অনুপস্থিতে মন ভার হয়ে থাকে। চিন্তা হয় মানুষটার জন্য। বড় জায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সিরাত আর সিমিন চোখাচোখি করে মুখ টিপে হাসল। এ নতুন কিছু নয়। শারাফাত চৌধুরী বিকেলে চলে গেছেন। কাজ শেষ করে হয়তো সপ্তাহ খানিক পরে ফিরবেন। উনি না ফেরার অবধি
সিঁতারার মুখটা ততদিন চুপসে থাকবে। সায়ন বাসায় নেই। সাওয়ান চৌধুরীর ফিরতে আরো রাত হবে। বাসায় আছে বাড়ির তিন গৃহিণী আর ছেলে-মেয়েরা। শুদ্ধ তো দুপুর থেকে নিজের কাজে ব্যস্ত। রুমটা সাউন্ড প্রুফ বিধায় বাইরে কোনো শব্দ, হাঁক-ডাক তার কান অবধি পৌঁছায় না।
সাম্য, সৃজনের হোম টিউটর পড়াতে এসেছে। তারা কিছুক্ষণ গাঁইগুঁই
করে পড়তে বসেছে। শখ আর শীতল ড্রয়িংরুমে আছে। স্বর্ণ’র মাথাব্যথা তাই শুয়ে আছে। তিন জা চায়ের কাপ হাতে সিরিয়াল দেখছে। এ সময় তাদের পছন্দের সিরিয়াল হয়। এটা দেখে রাতের খাবারের আয়োজন করতে। শখ আস্তে ধীরে চা শেষ করে উঠতেই শীতল বলল,
-‘আপু, চল ছাদে যাই?’
-‘এখন ছাদে? পড়তে বসবি না?’
-‘আমি ছোটো নাকি যে সন্ধ্যার পরপরই পড়তে বসে যাব?’
-‘ তাই তো। তা ছোটো আব্বুকে বলি, তুই বড় হয়ে গেছিস তোর বিয়ে দিতে হবে?’
-‘বলো আপু, প্লিজ বলো। পড়াশোনা ভালো লাগে না। আমি বিয়ে করব।’
শীতলের কথা শুনে শখ হেসে ফেলল। কি যে সুন্দর সেই হাসি! এ হাসির জন্য শীতল মনে মনে শখকে একটা নামও দিয়েছে, সুহাসিনী। তবে মুখ ফুটে শখ জানায় নি কখনো। যদি বোনের নামটা পছন্দ না হয় এজন্যই জানায় নি। শীতল পুনরায় ছাদে যাওয়ার কথা বললে শখ জানাল পড়া বাকি আছে। কালকে একটা পরীক্ষা আছে। একথা শুনে শীতলও জোর করল না শখকে যেতে দিলো।★★(প্রথম পর্ব লিখেছিলাম শখ অনার্স ফাইনাল বর্ষের ছাত্রী। গল্পের থিমের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ইডিট করতে বাধ্য হয়েছি। আপনারও একটু কষ্ট করে ধরে নিন শখ ডাক্তারি পড়ছে।
হবু ডাক্তার সে। এই ভুল এবং গল্পের মাঝে বাড়তি কিছু লেখার জন্য আমি সরি)★★
মা -চাচীদের মধ্যে সিরিয়াল দেখতে ইচ্ছে করছে না শীতলের। সে উঠে রুমে চলে গেল। ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াল। চোখে কাজল দিলো। কালো টিপ পড়ল। ঠোঁটে লিপবাম দিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। ঠিক সেই মুহূর্তে স্বর্ণ এসে বলল,
-‘বাম থাকলে দে তো।’
-‘কি বাম?’
-‘ঝান্ডুবাম।’
-‘ঝান্ডুবাম নাই লিপবাম আছে, নিবা?’
-‘লিপবাম কপালে দিবো?’
-‘তাই তো, তাই তো। সায়ন ভাইয়ার কাছে দেখেছিলাম ঝান্ডু্বাম।’
-‘আচ্ছা গিয়ে দেখি তাহলে। তা তুই কোথায় যাচ্ছিস?’
-‘কই কোথাও না তো।’
,-‘তাহলে সেজেছিস যে?’
-‘পড়তে বসব তাই।’
-‘পড়তে বসলে সাজতে হয়?’
-‘সাজুগুজু করলে মন ভালো থাকে। ভালো মন নিয়ে পড়লে পড়া মাথায় থাকে।’
বোনের যুক্তি শুনে স্বর্ণ বিরক্তমুখে চলে গেল। এ পাগলের সঙ্গে বকলে মাথাব্যথা বাড়বে বৈ কমবে না। তাই সে সায়নের বন্ধ রুমের দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করল। অন্ধকারে রুমটাতে লাইট জ্বালাল। ড্রয়ার, ড্রেসিং,
হাতড়ে ঝান্ডু্বাম খুঁজল কিন্তু কোথাও পেল না। এবার বিরক্তের মাত্রা বাড়ল। হঠাৎ মাথাব্যথায় চোখ খুলে রাখা দায়। মাথা ধরে সে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এত বড় বাড়ি, এত মানুষ, অথচ কারো কাছে ঝান্ডুবাম নেই! সে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেও সায়ন রুমে প্রবেশ করল। আর একটুর জন্য ধাক্কা লাগে নি দু’জনের। তাকে রুমে দেখে সায়ন ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,
-‘আমার রুমে কি?’
-‘চুরি করতে এসেছি।’
-‘রুমের মালিককে নাকি? ‘
-‘ নিজের জিনিস কেউ চুরি করে নাকি?’
সায়ন হেসে ফেলল। দরজা দিয়ে মাথা বের করে আশেপাশে তাকিয়ে কেউ আছে কি না দেখে আস্তে করে রুমের দরজা আঁটকে দিলো। স্বর্ণ বাঁধা দিতে গেলে তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে গ্রীবায় থুতনী ঠেঁকাল। তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি খোঁচাল লাগল স্বর্ণের মৃসন কাঁধে। স্বর্ণ নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে করতে বলল,
-‘এভাবে ধরতে বারণ করেছি না? ছাড়ো!’
-‘ধরলে কি হবে? ‘
-‘বারণ করেছি ধরবে না, ব্যস!’
-‘কিসের ব্যস? কোনো ব্যস, ট্যসে কাজ হবে না। যখনই ইচ্ছে হবে তখনই ধরব। পারলে আঁটকাস।’
-‘শুনলাম, ফেরার পথে ইনসানের সঙ্গে কথা বলেছিস।’
-‘হুম। ‘
-‘কি বলেছে তোকে?’
-‘অংকনের কিছু করলে তোমাকে দেখে নেবে।’
-‘শুধু দেখবে? তাতে খুশি সে? দেখবে, ধরবে, নাড়বে নাহলে ফিল পাবে কিভাবে?’
সায়নের ডাবল মিনিংয়ের কথা শুনে স্বর্ণের ছটফটানি বেড়ে গেল। নখ বসাল সায়নের হাতে। তবে সায়ন শব্দহীনভাবে হাসছে। কারণ গালি কিংবা ডাবল মিনিংয়ে বলা কথা স্বর্ণ পছন্দ করে ন। খুব চটে যায়।সায়ন তাকে রাগাতে সেই কাজ’ই বেশি করে। সায়নের শক্তপোক্ত বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়াতে না পেরে স্বর্ণ বলল,
-‘ঝান্ডুবাম থাকলে দাও।’
-‘দিতে পারি তাহলে লিপকিস করতে দে।’
-‘দিতে পারি, যদি বৈধ সম্পর্কের দলিলনামা আনতে পারো।’
-‘বিয়ের কথা বলছিস? চল এখনই বিয়ে করি?’
-‘চুরি করে?’
-‘আপাতত চুরি করে করি।’
-‘না, বাসায় জানাও। যতদিন না কেউ রাজি হবে ততদিন দূরে থাকো।’
-‘তুই খুব পাষাণ, নিষ্ঠুর, সেটা কি জানিস?’
-‘,জানি।’
-‘ অথচ পাথুরে মনের এই মেয়েটাকে আমি খুব ভালোবাসি। বউ করার স্বপ্ন দেখি। একথা নিশ্চয়ই জানিস তাই না?’
-‘না, তাও জানি না।’
-‘কেন জানিস না?’
-‘ কারণ ঘটা করে জানাও নি কখনো। ‘
-‘তাহলে ঘুরে ফিরে আমারই দোষ? ঠিক আছে মেনে নিলাম। একদিন ঘটা করেই নাহয় জানাব।’
একথা বলে সায়ন স্বর্ণকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর তার
গালে, গলায় আদর এঁকে ছেড়ে দিলো। বালিশের নিচে থেকে ঝান্ডুবাম বের করে স্বর্ণের হাতে দিতেই স্বর্ণ দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল। তবে যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘ সিদ্দিকের অফিস থেকে ই-মেইল এসেছে চেক কোরো।’
সারাদিন ল্যাবে কাজ করে শুদ্ধ রুমে এলো। সময় নিয়ে শাওয়ার নিলো। তারপর ফুল কালো ড্রেসআপে রেডি হয়ে বাইকের হেলমেটটা নিয়ে বের হতেই শীতলের মুখোমুখি পড়ল। শীতলও এঁটো প্লেট নিয়ে বের হচ্ছিল।এতরাতে কি খেয়ে বেড়াচ্ছে কে জানে! শুদ্ধকে এতরাতে এভাবে দেখে শীতল মিষ্টি করে হাসল। শুদ্ধর পোশাক দেখে বুঝে গেছে সে শুদ্ধ এখন বাইক নিয়ে লং ড্রাইভে যাবে। দীর্ঘ সময় কাজ করে মাইন্ড ফ্রেশ করতে প্রায়ই মাঝরাতে ড্রাইভে বের হয়। কারণ রাতে ঘুরার মজাই আলাদা।
শীতলকে অহেতুক হাসতে দেখে শুদ্ধ এক ভ্রুঁ উঁচু করে তাকাল। শীতল তখন ঠোঁটে হাসি এঁটে বলল,
-‘লং ড্রাইভে যাচ্ছেন বুঝি?’
-‘কেন, গেলে তোর বড় আব্বুকে নালিশ জানাবি?’
-‘না তা না।’
-‘তাহলে?’
-‘বলছি যে, আমি এতক্ষণ ধরে পড়ছিলাম। আমারও মাইন্ড ফ্রেশ করা দরকার। আমিও আপনার সঙ্গে যাই?’
-‘ যাবি বলছিস? নিয়ে গেলে খুশি হবি?’
-‘হুম।’
-‘যা রেডি হয়ে আয়।’
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১২
একথা শুনে শীতল খুশি মনে দৌড়ে রুমে চলে গেল। তাকে যেতে দেখে শুদ্ধ হেলমেটের উপর আঙ্গুলের সাহায্যে তবলার মতো করে বাজাতে বাজাতে বিরবির করে বলল,
-‘আমার নামে নালিশ, হুম? চল একবার, বিপদের চৌরাস্তা থেকে যদি ঘুরিয়ে না আনি তো আমার নামও শুদ্ধ নয়।’