শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৫
নূরজাহান আক্তার আলো
__’হ্যালো! কে বলছেন। হ্যা..লো!’
ফোনের ওপাশে নিশ্চুপ নীরবতা। তবে মৃদু শব্দে বাজছে উইন্ড চাইমের টুং টাং শব্দ। শখ কথা ভুলে মন দিয়ে শব্দটা শুনল। বাতাস বইছে। সেই বাতাসে উইন্ড চাইম মিষ্ঠি সুর তুলেছে। সে কোথায় যেন শুনেছিল উইন্ড চাইমের টুং টাং শব্দ নেতিবাচক শক্তি দূর করে ইতিবাচক শক্তি প্রবাহিত করে। মন খারাপ দূর করে। সেকথা ভেবে শব্দটা কানে আসামাত্রই কথা ভুলে ফোন কানে ধরে বসে রইল। মন দিয়ে শুনল। কলদাতাও বোধহয় এটাই চেয়েছিল। তবে কথা না বলে চুপ করে থাকা একপ্রকার অভদ্রতা। তাই আরো কয়েকবার হ্যালো! হ্যালো! করে সাড়া না পেয়ে কলটা কেটে দিলো। মাঝরাতে চেনা/অচেনা কেউ ফাজলামি করছে ভেবে পড়ায় মন দিলো। পড়তে পড়তে হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পড়ল। শীতলের ঘুম না এলে পাশের রুমে শুয়ে ফোন করে বকবক করে। তো একদিন মধ্যরাতে তাকে ফোন করে বলেছিল,
-‘এই আপু, তাড়াতাড়ি আমার রুমে এসো তো।’
-‘কেন, কি হয়েছে?’
-‘সিলিং ফ্যানটা অফ করে যাও শীত লাগছে খুব।’
-‘এজন্য পাশের রুম থেকে আমাকে ডাকছিস?’
-‘আমি উঠতে পারব না, অলসতা আমাকে জাপটে ধরেছে। তুমি এসো। না এলে ঠান্ডায় নিউমোনিয়ার হলে সব দোষ তোমার।’
সেদিনও জেগে পড়ছিল বিধায় গিয়ে অফ করে এসেছিল। সেকথা মনে করে শখ হাসল। বিরবির করে পড়তে পড়তে পুনরায় তার ফোন বেজে উঠল। সেই নাম্বার থেকে কল এসেছে। ধরবে না ভেবে পড়তে পড়তেই দেখল পরপর কল আসতেই আছে। একবার..দুইবার..তিনবার…করে বারো বারের বেলায় কল রিসিভ করতেই ওপর পাশ থেকে কেউ বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘তুমি এত পাষাণ কেন গো মেয়ে? বেখেয়ালে আমার মন চুরি করলে। ঘুম কেড়ে নিলে। এরপর তোমাকে পাওয়ার নে’শা’টুকু সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে দিলে। এখন না পাচ্ছি স্বস্ত্বি, না একদন্ড শান্তি। পুরো তুমিটা বি’শ্রী’ভাবে আমার মনে গেঁথে গেছো। চোখ বন্ধ করলেও তোমাকে দেখি আর চোখ খুললেও তুমি। কেন এমন হচ্ছে? কি করেছি আমি? কি দোষ আমার? কেন এভাবে বিপাকে ফেললে আমায়? এমন করাই লাগত? না করলে কি অধর্ম হয়ে যেতো, হুম?’
পুরুষালি ভারী কন্ঠস্বর শুনে শখ কান থেকে ফোন সরিয়ে নাম্বারটা চেক করল। অচেনা নাম্বার। তবে ভয়েজ শুনে চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে, পূর্বেও মানুষটার সঙ্গে কথা হয়েছে। শুনেছে এই ভয়েজ। সে কে? আর এসব বলার মানে কি? তাই সে জবাব দিলো,
-‘কে বলছেন?’
-‘তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া এক হতভাগা নাবিক।’
_’হেয়ালি কথা আমার পছন্দ নয় তাই যা বলার সরাসরি বলুন। আর ভদ্র ঘরের ছেলেরা পরিচয় না দিয়ে কাউকে কল করে এসব কথা বলে না।’
-‘এতদিন ভদ্র, সভ্য’ই তো ছিলাম। থাকতে দিলে কই? যাই হোক, এখনো চিনতে পারো নি আমায়?’
-‘না।’
-‘ আহনাফ বলছি। বিকেলে দেখা হলো, কথা হলো, এরিমধ্যে সব ভুলে গেলে?’
এবার চিনতে অসুবিধা হলো শখের। এজন্য বোধহয় ভয়েজ চেনা চেনা লাগছিল। কিন্তু এই লোক নাম্বার কোথায় পেল? সাহস দেখাতে ফোনও করেছে। তবে লোকটা তার বড় ভাইয়ের চেনা হলেও তার কাছে মানুষটা সম্পূর্ণ অচেনা। আর অচেনা কারো সঙ্গে রাত বিরেতে তার কথা থাকতে পারে না। তাছাড়া ইতিমধ্যে মানুষটার মনোভাব বুঝে ফেলেছে। এরপর আর তাকে পাত্তা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। হ্যাঁ, পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের বসবাস। এত এত মানুষের ভিড়ে হঠাৎ কাউকে ভালো লাগতেই পারে। মন হারিয়ে অপরিচিত জেনে আপন আপন লাগতেই পারে। তাই বলে মনের বিরুদ্ধি গিয়ে কাউকে সঙ্গের সঙ্গী করা অযৌক্তিক। তাছাড়া এসব বে’হা’য়া’গি’রি চৌধুরী নিবাসের মেয়েদের সঙ্গে যায় না। মনে মনে একথা ভেবে কল কেটে ফোন সাইলেন্ট করে ফেলল। ফোনের আলো
জ্বললে চোখ যাচ্ছে দেখে ফোনটা উল্টে করে রেখে দিলো। এই ব্যাপারে কিছু বলার নেই তাই কথা বাড়ানো বৃর্থা। কথার মাঝে কল কাটতে দেখে আহনাফ একের পর এক কল দিতেই থাকল। কিন্তু শখ রিসিভ’ই করল না। তাই অনেকগুলো মেসেজ করল। এরপর’ই কল দিতে গিয়ে বুঝল তার নাম্বার শখের নারীর ব্লাকলিস্টে ঠাঁই পেয়েছে। তবে কেন জানি তার রাগ হলো না। বেলকনি থেকে উঠে রুমে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুলো। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশেন শূন্য জায়গাটা দেখল। তারপর ঠোঁট কামড়ে হেসে ফোনের গ্যালারিতে থাকা অপরুপ সৌন্দর্যের অধিকারী একটি মেয়ের ছবি বের করল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মন দিয়ে দেখল। কি চমৎকার তার চোখ, নাক, ঠোঁট, হাসি। ইশ! এই পুতুলটা কবে তার হবে? জাপটে ধরে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে রাখতে পারবে? নিজের মনের ভাবনা দেখে সে এবার নিজেই হেসে ফেলল। তারপর মিটিমিটি হাসতে হাসতে ছবির মেয়েটাকে উদ্দেশ্যে করে বিরবির করল,
-‘এই যে মিষ্টির মুখের মিষ্টি মেয়ে, একটু ভালোবাসতে এত বাঁধা কিসের শুনি? এই দুরত্ব যে ভালো লাগে না। কাছে এসো। আমার হও। আমার অবুজ মন পুড়িয়ে আর পাষান হই’ও না গো, হই’ও না।’
-‘ধন্যবাদ হ্যাকার সাহেবা। আপনার কাজে আমি বিমোহিত। অভিভূত।
অপেক্ষা করুন বাসায় ফিরেই কড়া করে চুমু ট্রিট দিবো।’
সায়ন জানে এই মেসেজের রিপ্লাই আসবে না। তাই ফোনটা পকেট পুরে উঠে দাঁড়াল। পার্টি অফিস প্রায় সারারারাত খোলা থাকে। পোলাপান মিটিং করে। আলাপ আলোচনায় বসে। কখনো আমোদ ফুর্তিতে মাতে।
সায়ন ছোলার খোসা ছড়িয়ে মুখে পুরে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল। পরপর ফোনে নোটিফিকেশন না এলেও বুঝল কার মেসেজ হতে পারে। সে চৌধুরী নিবাসের কাছাকাছি মোড়ে এসে দেখে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। সে বাইকটা তার সামনে দাঁড় করালে কালো পোশাকে সর্বাঙ্গ আবৃত মানুষটা বাইকের পেছনে উঠে বসল। সায়নও বিকাবাক্যে বাইক ছুটাল ক্ল্যাবের দিকে। পেছনে বসা মানুষটা চুপচাপ দেখে সায়ন লুকিং গ্লাসে একবার তাকিয়ে চমৎকার করে ডাকল,
Show quoted text
পেয়েও সে কিছু’ই মনে করে না। ঝটপট উঠে রিকশা ডেকে উঠে বসে। রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য সে। রিকশায় বসে সে সায়নের ফোনে কল করে জানতে চায়, সে এখন কোথায়। সায়ন সেদিন একটা মিছিলে ছিল। তার ফিরতে দেরি হবে কারণ মিছিল শেষে পার্টি অফিসে যাবে। একথা শুনে স্বর্ণ সায়নের বারণ অমান্য করে পার্টি অফিসে যায়। সায়নের বরাদ্দকৃত রুমে অপেক্ষা করে। সে সায়নের বোন জেনে কেউ কিছু বলার সাহসও করে না। বরং চা/কফির সাথে নাস্তা এনে রেখে যায়। তার পার্টি অফিসে আসার কথা কনক সায়নকে জানায়। একথা শুনে সায়নও ছুটে আছে তাৎক্ষণিক। এসেই রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞাসা করে,
-‘একা এখানে কেন তুই? পায়ের নলা কাটতে হবে?’
স্বর্ণ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সায়নের চোখের দিকে। চোখ-মুখ, লাল হয়ে আছে অস্বাভাবিকভাবে। আজ তার চোখের মুখের অবস্থা দেখে সায়ন ভ্রুঁকুটি করে তাকিয়ে রইল। সাং’ঘা’তিক কিছু ঘটেছে আন্দাজ করে নিলো। নয়তো কড়া বারণ থাকা সত্ত্বেও এখানে আসার ভুল স্বর্ণ করবে না। একথা ভেবে সে নিজেকে শান্ত করল। স্বর্ণের মুখোমুখি চেয়ারে বসল। ঝকঝকে গ্লাসে ঢেকে রাখা পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,
-‘কেউ কিছু বলেছে?’
-‘আমি তোমার বেড গরম করি? তোমার সঙ্গে শুঁই? বীর্য ছাড়া আর কি কি দাও আমাকে? এর জবাব আগে দাও আমাকে!’
ক্ষীপ্ত স্বরে বলা একথা শুনে সায়নের কপাল কুঁচকে গেল। সে একবার দরজার দিকে তাকিয়ে পুনরায় স্বর্ণের দিকে দৃষ্টিপাত করল। এ কেমন কথা? স্বর্ণ, শীতল ছোটো চাচার মেয়ে হলেও শখকে যতটুকু ভালোবাসে তাদেরকেও কতটুকু ভালোবাসে। নিজের আপন বোন বলে সে কখনো শখকে আলাদা কিছু দেয় নি। আলাদা করে শাষণ’ও করে নি। যখন যা দিয়েছে তিনবোনকে একসঙ্গে। যে যা চেয়েছে সময় করে এনে দিয়েছে৷ অথচ আজ স্বর্ণের মুখে এই কথা শুনে রাগের পারদ বাড়ল। উঠে গিয়ে স্বর্ণের গাল চেপে ধরে আগুন ঝরা কন্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-‘কে কি বলেছে? বাড়তি চোপা দেখাবি না একদম। মূল পয়েন্টে আয়। কে বলেছে এসব?’
-‘কে বলেছে তাদের চিনি না আমি। তবে কেন বলেছে এর কৌফিয়ত তোমাকে দিতে হবে। নয়তো বাবাকে অন্য বাসা নেওয়ার কথা বলতে বাধ্য হবো।’
-‘এবার বাড়াবাড়ি করছিস স্বর্ণ। এখন বাড়ি যা, আমি দেখছি।’
-‘অকারণে কেন আমাকে এসব বলা হলো? তোমার কারণে কেন এসব শুনব আমি? তোমার কাজের দায় নেবো না আমি। ঠিক চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তাদের শিক্ষা দিবে নয়তো আমি বড় বাবাকে জানাতে বাধ্য হবো।বাড়ির মেয়েদের রাস্তায় এভাবে অপদস্ত করার কথা শুনে শারাফাত চৌধুরীও বসে আঙ্গুল চুষবে না নিশ্চয়ই।’
-‘আশ্চর্য তো! আমি এসব বলতে বলেছি নাকি স্বয়ং নিজে এসব বলেছি তোকে? হুদাই চোটপাট দেখাচ্ছিস কাকে, হুহ্?’
-‘এমন কাজ করো কেন যে কাজের রেশ ধরে বাড়ির মেয়েরা পথেঘাটে অপদস্থ হতে হয়?’
-‘সেই কৌফিয়ত তোকে দিতে হবে?’
-‘প্রয়োজনে তাই দিতে হবে।’
সায়ন একথার জবাব না দিয়ে চোয়াল শক্ত করে শুধু তাকিয়ে ছিল। স্বর্ণ তার রাগটুকু উগড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে রুমের দরজা বন্ধ করে বসেছিল।
পরে সায়ন খোঁজখবর নিয়ে সেই ছেলেগুলো কি করেছে একমাত্র সেই জানে। তারপর থেকে সায়নের সঙ্গে কথা বলত না। পাশে বসত না। কিছু দিলে নিতো না। এমনকি ইদের সেলামি দিলে ছুঁয়েও দেখত না। অনেকে খেয়াল করেছিল। ওদের দু’জনকে জিজ্ঞাসা করলে জবাব পাওয়া যায় নি কারো থেকে। সামান্য একটা ঘটনায় সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে দেখে একদিন সায়ন’ই তাকে ডেকে পাঠায়। সরি বলে। জবাবে স্বর্ণ অকপটে বলে বসে
-‘আমাকে তোমার সঙ্গে নাও।’
তার কথা শুনে সায়ক হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে তার ভেজা চুলে ব্যাক ব্রাশ করতে করতে হেয়ালি সুরে বলল,
-‘সঙ্গে নেবো মানে? রাজনীতিতে নাম লেখানোর কথা বলছিস নাকি?’
-‘হুম।’
-‘না নিলে?’
-‘পরিবার আলাদা হওয়ার চমৎকার দৃশ্য দেখতে নিজেকে প্রস্তুত করো।’
-‘থ্রেট দিচ্ছিস?’
-‘ধরে নাও তাই।’
-‘ যে নোং’রা ঘৃ’ণা করিস। সেই নোং’রা গায়ে মাখতে উঠে পড়ে লাগলি কেন হঠাৎ? কি উদ্দেশ্যে তোর? কি ঘোট পাকাচ্ছিস তুই?’
-‘রাজি তুমি?’
-‘চোধুরী নিবাসের মেয়ে রাজনীতি করবে স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি আমি। বাবা জানলে কি হবে বুঝতে পারছিস?’
স্বর্ণ জবাব দেয় নি। আবার নিজের জেদ থেকে তাকে টলানো যায় নি। একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল সায়ন স্বর্ণের জেদের কাছে হার মানতে। এবং সেও শর্ত জুড়ে দিয়ে বলেছিল,
-‘কাজের স্বার্থে যা করার করবি তবে আড়ালে থেকে। যত যাই হোক, সর্ব সম্মুখে কখনো তোর নিজের পরিচয় সামনে আনতে পারবি না।’
স্বর্ণ রাজি হয়েছিল। এরপর থেকে সুযোগ বুঝে স্বর্ণের সঙ্গে রাজনীতির আলাপ করত। লেপটপে ছবি দেখিয়ে চিনাতো কে কার বিপক্ষ দল। কে কেমন, কে কোন কাজের সঙ্গে জড়িত। মাঝে মাঝে হোমওয়ার্কের মতো টাস্ক পূরণ করতে হতো। আর বেশিরভাগ টাস্ক হতো কারো সম্পর্ক তথ্য কালেক্ট করা। মোটকথা, সায়নও বুঝত না তাকে দিয়ে কি কাজ করাবে।
কি কাজ করলে সবার চোখের আড়ালে থাকবে স্বর্ণ। পরে অনেক ভেবে প্রফেশনালভাবে হ্যাকিং শেখায়। মাসের পর মাস মন দিয়ে হ্যাকিং শেখে সে। বর্তমানে সে তুখর হ্যাকার। তার কাজ সায়নের চিহ্নিত করা আইডি কিংবা ফোন হ্যাক করে সেই ব্যাক্তির দূর্বলতা খুঁজে বের করা। তারপর একটি ফাইল তৈরি করে সেসব সায়নের হাতে তুলে দেওয়া। আর সায়ন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খাঁটিয়ে সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতির ফিল্ডে একাই নিজের জায়গা তৈরি করেছে। কারণ রাজনীতি করতে গেলে সর্বপ্রথম নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করা জরুরি। নয়তো ফিল্ডে টিকে থাকা মুশকিল। আর এভাবেই দিন যাচ্ছে। সময় কাটছে। ধীরে ধীরে ক্ষমতাও হাতে এসেছে। তবে এসব করতে করতে তারা কেউ টের পায় নি, তাদের সম্পর্কের বদল ঘটেছে। অজান্তে মন দেওয়া-নেওয়া হয়েছে।ভালোবাসা নামক জালে ফেঁসে গেছে। মোহ কেটে মায়াতে জড়িয়েছে। এসব যখন টের পেয়েছে কেউ আর লুকানোর চেষ্টা করে নি । বরং অকপটে স্বীকার করেছে। গ্রহন করেছে একে অপরের ভালোবাসাকে। বাড়ির সকলের সামনে থেকে চালাচ্ছে লুকোচুরি প্রেম। প্রেমের সঙ্গে রাজনীতির মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একজন স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে আরেকজন আড়াল থেকে শক্তি হয়ে।
বাইকে বসা অবস্থায় শুদ্ধ এখনো শীতলকে ধরে আছে। তার চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ছে। শীতলের চোখ বন্ধ। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস পড়ছে। এতক্ষণ ধরে থাকতে থাকতে হাতও ব্যথা হয়ে গেছে। এইদিকে শীতলকে ধরে গেলে বাইক পড়ে যাবে বাইক সামলাতে গেলে তার হাত ফসকে শীতল পড়ে যাবে। এ কোন বিপদ? কিন্তু এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়? সে আরেকবার শীতলের গাল চাপড়ে ডাকল। সাড়া নেই। নড়চড় নেই। তাই সে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বলল,
-‘ বাড়ির কেউ একসঙ্গে বের হতে দেখে নি। দারোয়ানকে নাহয় টাকা দিয়ে ক্যাচাপ করা যাবে। এক কাজ করি আপদটাকে এখানেই ফেলে যায়। শেয়ালে এসে মাংস খেয়ে ফেললে হাড় গোড় লুকানো ব্যাপার না।’
একথা বলে তাকে ছাড়তে গেলে শীতল খপ করে শুদ্ধর দুহাত আঁকড়ে ধরল। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে তাকে ছাড়তে বারণ করল।
তারপর হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘ কি করেছি আমি? সবসময় আমার সঙ্গে এমন করেন কেন?’
-‘তুই না অজ্ঞান ছিলি?’
-‘না। আপনি শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছিলেন তাই অজ্ঞান হওয়ার ভান ধরে ছিলাম।’
একথা শুনে শুদ্ধ দাঁত দিয়ে তার নিচের ঠোঁট কামড়ে এক ভ্রুঁ উচু করে তাকিয়ে রইল। সে আগেই বুঝেছিল শীতল অভিনয় করছে। কারণ আর যাই হোক, অবচেতন মানুষের চোখের দুই পাতা তিরতির করে কাঁপে না। সত্যি সত্যি ফেলে দিচ্ছে কি না দেখার জন্য মিটমিট করে চোখ খুলে না।
সে এই নিয়ে কথা না বাড়িয়ে শীতলকে ইশারা করে বাইক থেকে নামতে বলল। শীতল আশপাশ তাকিয়ে নামল। শুদ্ধ বাইক স্ট্যান্ড করে পকেটে হাত গুঁজে সামনের দিকে হাঁটা ধরল। তাকে হাঁটতে দেখে শীতলও তার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে মিনমিন করে বলল,
-‘বাড়ি যাব না?’
-‘যা, আমি কি ধরে রেখেছি?’
-‘একা একা কিভাবে যাব?’
-‘ বাতাসে উড়ে উড়ে যা নয়তো আ’ত্মা’র পিঠে ভর করে যা।’
-‘কথায় কথায় এমন খ্যাচ খ্যাচ করলে সঙ্গে নিলেন কেন?’
-‘আমি নেয় নি তুই স্বেচ্ছায় সঙ্গে এসেছিস।’
-‘এসেছি, এসেছি তাই বলে এভাবে কথা বলতে হবে?’
-‘হবে।’
-‘কেন হবে?’
-‘নয়তো বিশুদ্ধ পুরুষের জাত যাবে।’
শীতল মুখ লটকে শুদ্ধর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। চাঁদের আলোয় রাস্তা দেখা যাচ্ছে। রাত ক’টা বাজে কে জানে। শুদ্ধ হাঁটছে তো হাঁটছেই। বের হয়েছিল বাইকে করে ঘুরবে বলে অথচ এই বর্বর লোক তখন থেকে হাঁটাচ্ছে তো হাঁটাচ্ছেই। সে এবার আর না পেরে পাশাপাশি চলতে চলতে পুনরায় মুখ খুলল,
-‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন? সব অন্ধকার।’
-‘ এত সুন্দর অভিনয় করলি গিফ্ট না দিলে চলে? তোর গিফ্ট’টা তোকে বুঝিয়ে দিতে ওদিকে যাচ্ছি।’
-‘ গিফ্ট! সত্যি আমি সুন্দর অভিনয় করেছি?’
-‘হুম।’
-‘কি গিফ্ট দিবেন শুদ্ধ ভাই, বলুন না প্লিজ, বলুন বলুন।’
-‘সামনে একটা পুকুর আছে। ভাবছি,সেখানে তোকে নিয়ে গিয়ে চুবাবো। ছোটো গিফ্ট বলে মন খারাপ করিস না, এখন পুকুরে চুবাই কাল নাহয় নদীতে চুবিয়ে আনব।’
শীতল থেমে গেল। ওর নিজের পায়ের জুতো খুলে নিজের গালে মারতে ইচ্ছে করছে। সে কেন ভুলে যায় এই লোক আস্ত একটা ব’দ’মা’শ। বোম মারলেও তার মুখ দিয়ে সুন্দর কথা বের হয় না, হবেও না। কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারলে কোনোদিন এই লোকের সঙ্গে বের হবে না। এই বিশুদ্ধ পুরুষ তাকে নিয়ে বেড়ানোর জন্য কেঁদে ম’রে গেলেও যাবে-না, না, না! আসার সময় ভেবেছিল যা কিছু ঘটুক বড় আব্বুকে কিছু বলবে না৷ কিন্তু না, সে বাড়ি গিয়ে বড় আব্বুকে ফোন করবে। পাই টু পাই সব বলবে, সব। ছেলের এই কান্ডে যদি বড় আব্বু বিচার না করে তবে সেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তাকে চুপচাপ দেখে শুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। তারপর ফিচেল হেসে বলল,
-‘বড় আব্বুকে কথা লাগানোর পা’য়’তা’রা জুড়েছিস তাই না? তা তোর বড় আব্বুকে ভয় পাই নাকি আমি?’
শীতল বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে দেখল সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে। এ লোক তার মনে কথা বুঝল কিভাবে? তারমানে আশা ভরসা নেই সত্যি সত্যিই এখন পুকুরে চুবাবে। তাই সে ধপ করে বসে পড়ল। তাকে বসতে দেখে শুদ্ধ হাঁটা থামিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,
-‘বসলি কেন? দেরি হয়ে যাবে তো চল, উঠ,।’
-‘লাগবে না গিফ্ট। বাড়ি যাব।’
-‘তা বললে হয় নাকি? হয় গিফ্ট নিবি নতুবা শর্ত মানবি। বল কোনটা করবি?’
-‘কি শর্ত শুনি?’
শুদ্ধ তার পাশে বসল। পকেট থেকে দিয়াশলাই আর সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে দুটো টান দিলো। তারপর শীতলের দিকে সিগারেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘নে সুখ টান দে। ‘
আজ যেন শীতলের অবাক হওয়ার রাত। এই বিশুদ্ধ পুরুষ তাকে আজ অবাক করতে করতে মা’র’বে বোধহয়। সে খাবে সিগারেট! এই লোকটা কি পাগল হয়ে গেছে? তাকে বিষ্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে করিয়ে দিলো হয় সিগারেট খেতে হবে নয়তো পুকুরে চুবাবে….! শীতল কিছু একটা ভেবে সিগারেট হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলার আগে শুদ্ধ হাতটা চেপে ধরল। তারপর তাকে চেপে ধরে সিগারেট খাওয়াতে গেলে শীতল ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলো। তাকে কাঁদতে দেখে শুদ্ধ ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
-‘খেতে হবে না সিগারেটে শুধু ঠোঁট ছোয়াবি, নে ছোঁয়া।’
-‘ন..না।’
-‘কি, কি বললি আবার বল?’
শুদ্ধর মারকাঠ মুখভঙ্গি দেখে শীতল ফোঁপাতে ফোঁপাতে হাতে সিগারেট ধরল। তারপর জ্বলন্ত সিগারেটে ঠোঁটের কাছে আনতেই ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠল। সেই সঙ্গে শুদ্ধর বলা একটি কথা,
-‘হেই লেডি স্মাইল প্লিজ!’
হঠাৎ ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠায় শীতল দৃষ্টি তুলতেই শুদ্ধ সেই অবস্থায় ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। তারপর ছবিগুলো তাকে দেখিয়ে বলল,
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৪
-‘ এবার তোর কাজ হলো, বাবা-মাকে আমার জন্য পাত্রী দেখতে বলবি। জোর করে আমাকে যাতে বিয়ে দেয় এটা বোঝাবি। উনারা আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি সবার সামনে না, না, করব। রাগ দেখাব। চিৎকার টিৎকার করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে দেবে। তবুও তুই কাজ থামাবি না যেভাবে হোক সবাইকে রাজি করাবি, মনে থাকবে? যা বললাম পাই টু পাই করবি। যদি না করিস ছবিগুলোর তিন চৌধুরী কর্তার ফোনে চলে যাবে।’
শুদ্ধর করা কাজ ও কথা শুনে শীতল আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে আপাতত হতবাক, হতভম্ব।