শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৭
নূরজাহান আক্তার আলো
তখন বিকেল ৫:০০।
এক ধরনের নরম ও কোমল আলোয় সেঁজেছে পশ্চিমাকাশ। ক্লান্ত হয়ে ম্লান হয়ে এসেছে দিনের আলো। সূর্য্যি নেমেছে পাটে। পাখিরা ফিরছে আপনগৃহে। পাড়ার মোড়ে মোড়ে বসেছে ছোট, বড় ইফতারের দোকান।
ক্রেতাদের ভিড়ে জমজমাট দোকানপাট। কোথাও কোথাও কোরআন তেলওয়াও, গজল, ওয়াজ বাজছে। কোথাও বা হরদমে চলছে ইফতার পার্টির আয়োজন। এসবকে পেছনে ফেলে ব্যস্তপায়ে ছুটছে একদল ব্যস্ত পথচারী।
এদিকে চৌধুরী বাড়ির রান্নাঘরে তাড়াহুড়ো লেগে গেছে গৃহিনীদের। দ্রুত
হাতে কাজ সারছেন উনারা। রাতের রান্না শেষে এখন ইফতার সাজাতে লেগে পড়েছেন দুই জা। দুপুর থেকে একটানা সিঁতারা সিমিন একাহাতে সামাল দিচ্ছেন সব কাজ। সিরাত বসে আছে রান্নাঘর থেকে একটু দূরে।
মুখটা বড্ড বেজার। ঝটপট কাজ করা মানুষ কাজ ছাড়া থাকতে পারে না। অথচ অসুস্থতা উনাকে বসে থাকতে বাধ্য করছে। খুব খারাপ লাগা কাজ করছে জা দের ঘামার্ত মুখ দেখে। তবুও উনি বলেছেন বসে বসে কিছু কাজ উনাকে দিতে। একথা শোনামাত্র সিঁতারা খ্যাঁক করে বলেছে,
-‘এখানে থাকলে চুপ করে বসে থাক নয়তো খুন্তির বারি একটাও বাইরে পড়বে না।’
বড় জায়ের কথা শুনে ফিক করে ফেলে সিরাত। হাসে সিমিনও। সিঁতারা ভ্রুঁ কুঁচকে জা দের দেখে বেগুনি ভাজতে আরম্ভ করেন। সিমিন দুপুরের দিকে ফালুদার জন্য সাগুদানা রান্না করে ফ্রিজে রেখেছিলেন।এখন তা বের করে ফলমূল কেটে গুছিয়ে রাখলেন। নানান রকমের জিনিস দিয়ে
চমৎকার করে ডেকোরেশন করে শীতল। সে আবার এসব কাজ ভালোই পারে। কিন্তু এই নিয়ে তিনবার মেয়েটাকে ডাকার পরেও সাড়াশব্দ নেই।
তিনি বিরক্ত হয়ে আরেকবার হাঁক ছেড়ে ছাড়লেন,
-‘শীতল! এ্যাই শীতল! এবার গেলে মার একটাও মাটিতে পড়বে না বলে দিলাম।’
ছোটো জায়ের ডাকাডাকি শুনে সিরাত জবাব দিলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘মেয়েটা রোজা আছে থাক না একটু রেস্ট করুক।’
-‘এত বড় ধিঁঙ্গি মেয়ে ফলগুলো তো কাটতে পারে। সব কথা বলে দিতে হবে? একটা কথা যদি শোনে।’
একথা শুনে সিঁতারা আঁচলে মুখটা মুছে শরবতের চিনি গুলাতে গুলাতে বললেন,
-‘মেয়েটার শরীরটা বোধহয় ভালো না। পাখির দানা খেয়ে রোজা আছে। সেদিন রক্ত দিলো। থাক ওকে এ গরমের মধ্যে আর ডাকিস না ছোটো।’
দুই জায়ের কথা শুনে সিমিনের রাগে গজরাতে গজরাতে এঁটো থালা বাসন ধুঁতে ধুঁতে বললেন,
-‘ তোমাদের আদরে আদরে ও আরো বাদর হচ্ছে। ওর বয়সী সাদিকাকে দেখো কী সুন্দর সংসার করে খাচ্ছে। অথচ এর গড়িমসি করতে করতে বছর যায়। ভালো কথা বললেও যদি শুনতো। শুনবি না তো, শুনিস না। শশুড়বাড়ি গিয়ে শাশুড়ীর খোঁচা খেতে খেতে নাকে জল, চোখের জল, এক হবে তখন আমার কথা মনে পড়বে।’
তখন রুবাব এসে জবাব দিলো,
-‘যে বাড়িতে আমার বোনকে কাজ করে খেতে হবে সে বাড়িতে বিয়েই দেবো না। আমাদের রাজকুমারীকে যে যত্নে রাখতে পারবে আমরা তার হাতেই আমাদের বোনকে তুলে দেবো।’
-‘কল্পনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আয় বাবা। শশুড়বাড়ি গেলে রাজকুমারী যতই আদরের হোক সেই আদর আর শশুড়বাড়িতে থাকে না। এজন্য বলছি বোনের ভালো চাইলে কাজ শেখা।’
রুবাব হাসল। তারপর সিঁতাকে বলল,
-‘শীতলকে শিখিয়ে পড়িয়ে নাও বড় মামি।’
-‘ও ছোটো মানুষ ওকে আর কী কাজ শেখাব? বড় হোক একদিন সবই শিখে যাবে।’
তখন দৌড়াতে দৌড়াতে সিঁড়ি বেয়ে নামল শীতল। দুপুরে গোসল সেরে একটুখানি শুয়েছিল কখন চোখ লেগে গেছে খেয়ালই করে নি। মায়ের ডাক শুনেছিল তবে তখন আরামের ঘুম হারাম করে উঠে আসতে ইচ্ছে করছিল না। আরামে আরামে ঘুমিয়ে বিকেলও কাবাড় করে ফেলেছে।
মেয়েটাকে এভাবে ধড়মরি করে দৌড়ে নামতে দেখে সিমিন মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এমনভাব করলেন যেন খুব রেগে আছেন। তখন শীতল ওড়নায় আঙ্গুল পেঁচাতে পেঁচাতে আমতা আমতা করে বলল,
-‘ডেকেছিলে আম্মু?’
-‘হুম।’
-‘কেন?’
-‘আমরা এখানে শুয়ে আছি তুইও এসে শুঁতি তাই।’
সিমিনের কথা শুনে শীতল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বুঝল মাকে রাগিয়ে দিয়েছে। তাই মায়ের রাগ ভাঙ্গাতে এগিয়ে আসতেই দেখতে পেল কাটা ফলমূল এবং তারই পাশে ফালুদার কাপ। বুঝল একাজ তাকেই করতে হবে। তাই সে কথা না বাড়িয়ে প্রতিটা সদস্যের জন্য ফালুদা রেডি করার কাজে লেগে পড়ল। রান্নাঘরে স্পেস কম। মায়েরা অন্য কাজকর্ম করছে
দেখে সে সব সামগ্রী নিয়ে রান্নাঘরের সামনে বসল। তারপর সে বাদাম কুচি, টুটিফ্রুটি, চকলেট স্প্রিঙ্কলস, রোজ সিরাপ, স্ট্রবেরি সিরাপ,ম্যাঙ্গো বা ভ্যানিলা আইসক্রিম, হুইপড ক্রিম, কালারফুল ফলের কুচি, চকলেট সস বা ক্যারামেল সস দিয়ে মনমতো করে সাজাল। রুবাব শীতলের বা পাশে বসে চুপ করে দেখছিল। সে বুঝে পায় না সাজানো গোছানোর ব্যাপারে মেয়েরা এত এক্সপার্ট কেন? এই যে ফালুদার কাপ এত সুন্দর করে সাজাল শীতল। কত কী যে দিলো সেগুলো নাম বলতে পারবে কী না সিওর। তাড়াছা যাবে তো ওই পেটেই তাহলে এত কাহিনী করার কি আছে? সবগুলো একসাথে বড় একটা বোলে নিয়ে ঝালমুড়ির মতো সব আইটেম একসাথে দিয়ে নাড়া দিয়ে কপাকপ গিলে নিলেই হয়। অযথা টাইম ওয়েস্ট করার দরকার আছে? মানে মেয়েটা পারেও বটে! শীতল সেগুলো সাজিয়ে ফ্রিজে তুলে হাত ধুঁয়ে বের হতেই সিঁতারা বললেন,
-‘ও মা ফোনটা শুদ্ধকে একটু দিয়ে আয় না।’
-‘আচ্ছা।’
-‘বাগানের দিকে গেছে দেখ।’
-‘হুম।’
-‘আর শোন আসার সময় কয়েকটা লেবু তুলে আনিস।’
-‘আচ্ছা।’
একথা বলে রান্নাঘর পেরিয়ে বাইরে এসে পিলারের পাশে দাঁড়িয়ে গেল।
শুদ্ধর ফোনের লক খুলতে চেষ্টা করল কিন্তু হলো না। তাই বিরবির করে বকতে বকতে বাগানে গেল। বাগানে কেউ নেই। তাই গেল বাড়ির পেছন দিকের পুকুরপাড়ে। তাদের পুকুরপাড়টা শান বাঁধানো। অনেক জাতের মাছা ছাড়া বিধায় কেউ গোসল করে না। বাইরের লোক এসে মাছ মেরে দিয়ে যায়। এদিকটায় নির্জন তাই খুব একটা আসা হয় না। তবে শুদ্ধকে মাঝে মাঝে দেখা যায়। সে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে প্রায় সময়। এই যেমন এখনো দুই পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে উঠছে তার কপালের উপর পড়ে থাকার অবাধ্য চুল। পরনে সাদা টিশার্ট, টাউজার।
সে পেছনে থেকে চুপিচুপি এসে ভাও করার আগেই শুদ্ধ বলল,
-‘এখানে কি?’
-‘ফোন দিতে এসেছি।’
শুদ্ধ হাত বাড়াল। শীতল ফোন এগিয়ে দিয়ে শুদ্ধর পাশাপাশি দাঁড়াল। সে শুদ্ধর বুক বরাবর। হঠাৎ দমকা বাতাসে শীতলের চুল এলোমেলো হয়ে গেল। উড়ন্ত চুলের ঝাপটা লাগল শুদ্ধর চোখে ,মুখে। ব্যাপারটা খেয়াল করে ধমক খাওয়ার আগেই শীতল চুল গুছিয়ে হাতখোঁপা করে নিলো। সাওয়ান চৌধুরীর রাজ হাঁসের মাংস ভীসণ পছন্দ। উনি মাঝে মধ্যেই রাজহাঁস কিনে আনেন। কিছুদিন আগে খাবেন বলে এনেছিলেন
কিন্তু সাম্য সৃজনের এক্সিডেন্টের জন্য খাওয়া হয়ে ওঠে নি। ফলস্বরুপ রাজহাঁস দুটো দিনের বেশিরভাগ সময় পুকুরে ভেসে বেড়ায়। সন্ধ্যারপর দারোয়ান কাকা ওদের গ্যারেজে রাখে। শীতলের হঠাৎ নজর গেল ভেসে বেড়ানো হাঁস দুটোর দিকে। সে বলল,
‘পুকুরে ভেসে বেড়ানো হাঁসগুলো কত্ত সুখী তাই না, শুদ্ধ ভাই? ইশ! আমিও যদি হাঁস হতাম।’
আফসোসের সুরে বলা শীতলের কথা শুনে পুকুরে তাকাল শুদ্ধ। হাঁস দুটোকে আপনমনে ঘুরে বেড়াতে দেখে সত্যিই মনে হচ্ছে তারা ভীষণ সুখী। তারা পুকুরে ভাসতে ভাসতে ছোট ছোট মাছ,পোকা ধরে খাচ্ছে।
কখনো নিজস্ব ডাকছে। পাশাপাশি ভাসছে। টলটলে স্বচ্ছ জলে ধবধবে হাঁসদুটোকে দেখতে সত্যিই খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। হঠাৎ পুরুষ হাঁসটি নারী হাঁসটিকে চেপে ধরে সঙ্গমে লিপ্ত হলো।যা ঘটল সেটা ছিল অনাকাঙ্খিত।
এ দৃশ্য দেখে মুহূর্তেই ঠোঁটে হাসি এঁটে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকা শীতলের হাসি মিলিয়ে গেল। বিষ্ময়ে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। ফর্সা আদুরে গালদুটো রাঙ্গা হয়ে উঠল। কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বেরোতে লাগল। নারী হাঁসটি পালাতে গিয়ে পারল না আঁটকা পড়ল পুরুষ হাসঁটির নিচে। শুদ্ধ পাশে থাকায় সে আর তাকিয়ে থাকতে পারল না। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। কেন জানি হাত-পা ভীষণ কাঁপছে। অসীম লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতেও পারল না পাশের মানুষটার দিকে। কত শখ করেই না হাঁস হতে চেয়েছিল। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল। একরাশ লজ্জায়
একছুটে পালিয়ে যেতে যেতে বিরবির করল, ‘না, না, আমি হাঁস হতে চাই না, ছিঃ! ছিঃ!’
একথা বলতে বলতে পালিয়ে গেল ঠিকই তবে ভুলেও আর পিছু ফিরে তাকাল না। কিন্তু একবার তাকালে হয়তো দেখতে পেতো তার বিশুদ্ধ পুরুষ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসছে। হাসছে তার চোখজোড়াও। কী চমৎকার সেই হাসি। সেই হাসি নিদারুণভাবে স্বচ্ছ জলে ফুটে উঠেছে। শীতল চলে গেলে বুঝতে পেরে সে হাসতে বলল,
_’ কেবল তো শুরু লাজুকলতা। এখনই লজ্জায় ডুবলে চলবে?সর্বনাশের চিপাগলি যাওয়ার কথাও তো স্মরনে রাখতে হবে।’
একথা বলে সে মিটিমিটি হাসতে হাসতে পুকুরপাঁড়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর শীতল দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়িতে ঢুকল। মেয়েকে দৌড়ে আসতে দেখে
সিমিন কটমট করে তাকিয়ে রইলেন। সব সময় ফিঙ্গে ডানার মতো এই মেয়ে ছুটে বেড়ায়। স্থিরতা বলতে কিছু যদি থাকে এর মধ্যে। এ নিয়েও সাবধান করেছেন। সাবধান করলেই বা কী? এ মেয়ে শুধরাবে না। তবে ভেবেও নিলেন অকারণে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে যদি মুখ থুবকে পড়ে তাহলে তখনই আরেক ঘা বসাবেন। শীতল লাজুক মুখে হাসতে হাসতে এসে দাঁড়াতেই মায়ের সামনে পড়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। হাসি লুকানোর বৃর্থা চেষ্টা করে মুখ ভোঁতা করে মনে মনে ভাবল,
-‘কাজ করি না বলে আম্মু রেগে আছে। সমস্যা নেই এখন কাজ করে সব তামা তামা করে ফেলব। পরে কাজ করার উসিলায় নতুন জামার বায়না করব।’
একথা ভেবে চমৎকার করে হাসল। তারপর ছোলা বাটি হাতে তুলে নিয়ে ডায়নিং টেবিলে রাখতে গেল। কিন্তু বিধির বাম। পাপোসে পা আঁটকে ছোলার বাটি নিয়ে নিজেও উপুড় হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের বাটি ভেঙ্গে ছোলা ছটিয়ে গেল। শীতল মায়ের মার খাওয়ার ভয়ে তাড়াহুড়ো করে উঠার আগে সিমিন দ্রুত এগিয়ে গেলেন। একটা কাজও করে না। কালেভাদ্রে যা করে তাতেও অঘটন ঘটিয়ে বসে। ইফতারের সময় হয়ে গেল আর এখন এই অঘটনই ঘটাতে হলো? উনি রাগে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলেন শীতলের পিঠে। শীতল চোখ বড় বড় তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। পরমুহূর্তে আরেকটা মারতে গিয়ে সেটা মেয়েটার ঠোঁটে লেগে ঠোঁট দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে গেল। এদিকে সিঁতারা দ্রুত
সিমিনকে আঁটকাতে গেলে খেয়াল করল শীতল কেমন করছে। কিলটা এমনভাবে পিঠের উপর পড়েছে ঠিকঠাক নিঃশ্বাস নিতেও পারছে না।
রুবার আর সিঁতারা ব্যাপারটা খেয়াল করে দ্রুত বুকে আগলে নিলেন। মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বললেন। এদিকে ইফতারের সময় হয়ে যাওয়ায় শারাফাত আর সাফওয়ান চৌধুরীও নিচে এসে বসেছেন কেবল। সায়নও পার্টি অফিস থেকে ফিরে কেবল দরজা দিয়ে ঢুকেছে।
সবাইকে রান্নাঘরের সামনে হুলস্থল করতে দেখে সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল। নিচে বসে থাকা শীতল, ভাঙ্গা কাঁচের বাটি আর ছড়ানো ছিটানো ছোলা দেখে বুঝে নিলো আসল ঘটনা। শীতলের ঠোঁট থেকে রক্ত বের
হচ্ছে দেখে দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে গেটের দিকে তাকাল। শুদ্ধকে বাগানের দিকটায় ফোনে কথা বলতে দেখে এলো। সে যদি দেখে তাহলে নির্ঘাত তুলকালাম বাঁধাবে। মনে মনে একথা ভেবে সে দ্রুত পকেট থেকে রুমাল বের করে শীতলের ঠোঁটে চেপে ধরল। শীতল তখনো পিঠ বাঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। তখন সায়ন তার ঠোঁটে রক্ত মুছতে মুছতে আদুরে সুরে বলল,
-‘দেখে শুনে হাঁটবি না? ইশ! কতখানি কেটে গেছে।’
একথা বলে ফের সিমিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ছোটো আম্মু এভাবে কেউ মারে? দেখো তো ঠোঁটটা কেটে কি অবস্থা হলো। বকবা, মারবা ঠিক আছে। মারেরও তো সিস্টেম থাকা লাগে। ‘
এদিকে সিমিনও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মারটা এভাবে লাগবে উনিও বুঝতে পারেন নি। শীতল তখন রক্তমাখা ঠোঁট ফুলিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। তার চোখের দিয়ে ঝরছে অঝর অশ্রধারা। অভিমানী চোখজোড়া অভিমানে টইটুম্বর।
এদিকে চেঁচামেঁচি শুনে শারাফাত ও সাফওয়ান চৌধুরী ছুটে এলেন। সিমিন মেরেছে শুনে শারাফাত চৌধুরী থমথমে মুখে শীতলকে উঠিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসালেন। যত্ন করে রক্ত মুছে দিলেন। ভাসুরকে দেখে সিমিন মাথায় আঁচল টেনে মাথা নিঁচু করে এককোণে দাঁড়িয়েছে।
সিঁতারা এবার বকতে লাগলেন সিমিনকে। সিরাতও তাই। রুবাব সবার বকাবকি শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেখে শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। সে ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে তাকিয়ে আছে শীতলের দিকে। সিঁতারার বকাবকি শুনে বুঝল মেরেছে সিমিন। তাও আবার ছোলা ফেলে দেওয়ার জন্য। সে দাঁড়াল না বাইকের চাবিটা পকেটে পুরে তখনই বেরিয়ে গেল। এদিকে ব্যস্ত থাকায় কেউ সেদিকে খেয়াল করল না। ভাই-বোনরা হাতে হাতে ইফতার টেবিল সাজিয়ে ফেলল। শখ শীতলের ঠোঁটে এ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে দিলে সে বাবাকে কল দিলো। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগ জানাল। শাহাদত চৌধুরী থমথমে মুখে বললেন,
-‘আমি এবার ছুটিতে গিয়েই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে চলে আসব।আর থাকতে হবে না ওখানে। আমার মেয়েকে শুধু ধরে ধরে মারবে আর বসে বসে দেখব, তা হবে না।’
-‘তাই যাব। থাকব না আমি। কত কষ্ট করে সারাদিন রোজা ছিলাম অথচ শেষ মুহূর্তে এসে মেরে রক্তারক্তি করে রোজাটাকে দূর্বল করে দিলো।’
-‘থাক, কাঁদে না মা। ইফতার করে ওষুধ খেয়ে নিলেই ব্যথা সেরে যাবে।’
সিমিনও অযু করতে যেতে যেতে শুনল বাবা ও মেয়ের কথা। তবে চোখ তুলে তাকালেন না সেদিকে। তাকালেই চোখের পানি লুকানো মুশকিল
হয়ে যেতো যে। তারপর সকলে একে একে ইফতার করতে বসে খেয়াল করল শুদ্ধ নেই। কল দিলেও ধরল না সে। হঠাৎ না বলে কোথায় গেল?
তাকে নিয়ে সবার মাঝে একটু চিন্তাও কাজ করছিল তখন শুদ্ধ ফিরল।
হাতের ইয়া বড় ব্যাগটা রেখে ওর মাকে হাতে ধরিয়ে দিলো। ভারী বড় সড় ব্যাগটা ধরে সিঁতারা বললেন,
-‘এতে কি আছে বাপ? এত ভারী কেন ব্যাগটা?’
শুদ্ধ সেকথার জবাব দিলো না। শখ আর স্বর্ণকে উদ্দেশ্যে করে ভারী গলায় বলল,
-‘ বাহারি রকমের যত যা ইফতার আছে সব সরা।’
শখ ভাইয়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে তার মায়ের দিকে তাকাল।
তাকে সরাতে না দেখে শুদ্ধ জোরে একটা ধমক দিলো। সে এত জোরে ধমক দিয়ে শীতলও চমকে উঠেছে। সে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখছে সামনের বিশুদ্ধ পুরুষটাকে। ভাইয়ের ধমক শুনে শখ এবার সাহস নিযে
আমতা আমতা করে বলল,
-‘ই ইফতার করব না ভাইয়া?’
-‘কর । তবে শুধু ছোলা দিয়ে কর।’
ছেলের ত্যাড়ামিতে শারাফাত চৌধুরী এবার প্রচন্ড বিরক্ত মুখ খুললেন,
-‘এতকিছু থাকতে শুধু ছোলা দিয়ে ইফতার করবে কেন?’
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৬
বাবার কথায় শুদ্ধ সিমিনের দিকে একবার তাকিয়ে ঘুরে বাবার দিকে তাকাল। তারপর ঠান্ডা স্বরে বলল,
-‘সামান্য ছোলা নিয়ে যখন এত কান্ড ঘটে গেল তারমানে বুঝতে হবে এ ছোলা মহামূল্যবান কিছু। একদিন ছোলা না খেলে মানুষ মারা যেতেও পারে। এ পাপ কি আর জেনেশুনে করা যায়? তাই ইফতার আজ ছোলা দিয়েই হবে।’