শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪
নূরজাহান আক্তার আলো
আগামীকাল শারাফাত চৌধুরীর মা শেফালি চৌধুরীর প্রয়াতবার্ষিকী।
সেই উপলক্ষে শারাফাত চৌধুরীর নিমন্ত্রণে নিকট আত্নীয়দের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে চৌধুরী নিবাসে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যার যার মতো ঘুরে ফিরে সময় পার করছে আত্মীয়মহল। কেউ কাজে হাত লাগিয়েছেন কেউ’বা সমালোচনায় ব্যস্ত। শতরুপা চৌধুরী এখনো আসে নি। তবে জানিয়েছে কালকে সময় মতো চলে আসবে। জটিল একটা কেসের দায়িত্ব উনার ঘাড়ে তাই আজ সময় করে উঠতে পারেন নি।
খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠান যেহেতু কাল ;কালকে অবশ্যই আসবেন। নিমন্ত্রিত মানুষদের আপ্যায়নে ত্রুটি না রাখতে চৌধুরী তিনকর্তা একেকজন একেক দায়িত্ব নিয়েছেন।
এবং কাজ ভাগ করে উনারা সেসব কাজে ব্যস্ত। চৌধুরী নিবাসের বাগান এরিয়ায় প্যান্ডেল তৈরির কাজ চলছে। সারি সারি চেয়ার পেতে সেখানে বসানো হবে আমন্ত্রণিত মেহমানদের। রান্নার আয়োজন প্যান্ডেল থেকে একটুদূরে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, চেনাজানা মানুষসহ দুটো এতিম খানায় খাবার পাঠানো হবে। সব মিলিয়ে হাজার তিনেক মানুষের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। তবে এবারই প্রথম তা নয়। প্রতিবছর
এই দিনটিতে এভাবেই এত এত মানুষ খাওয়ান শারাফাত চৌধুরী। এবং
দোয়া চেয়ে নেন মৃত বাবা ও মায়ের জন্য।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঘড়িতে সময় সকাল সাড়ে দশটা। শুদ্ধ আর সাওয়ান চৌধুরী বাজার সাদাইয়ের কাজ সেরে কেবল বাসায় ফিরেছে। প্রচন্ড গরমে জান যায় যায় অবস্থা। পরণের টি-শার্ট ভিজে জবজব করছে। আজ সকাল থেকে সূর্যটা যেন মাত্রারিক্ত ক্ষেপে আছে। রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গরমের তীব্রতা দুর্ভোগ হিসেবে উগড়ে দিচ্ছে জনজীবনে। এদিকে এত মেহমান।
এত গল্পকথা, হাসাহাসির শব্দে মেজাজটা যেন আপনাআপনিই চিরচির করে বেড়ে যাচ্ছে। অসহ্য লাগছে সবকিছু। গতরাতে ঠিকঠাক ঘুম পুরো না হওয়ার কারণে মাথা ভার হয়ে আছে। চোখ লাল হয়ে আপনাআপনি বুজে আসছে। তবুও নির্বিকার হয়ে মেজো চাচ্চুর সঙ্গে বাজারের কাজ সারল শুদ্ধ। ডেকোরটরের লোকদের কাজ বুঝিয়ে দিলো। লিস্ট দেখে যেগুলো মিস গেছে সেগুলোর নতুন করে লিস্ট করল। আবার বাজারে গিয়ে সেগুলো এনে বাবুর্চিকে হাতে ধরে বুঝিয়েও দিতে হবে। ড্রয়িংরুমে অনেক মানুষের উপস্থিতি দেখে সাওয়ান চৌধুরী নিজেও ফ্রেশ হওয়ার জন্য সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শুদ্ধকে বললেন,
-‘যা ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নে। একটুপরে আবার যেতে হবে।’
-‘হুম।’
একথা বলে সাফওয়ান চৌধুরী চলে গেলে অগত্যা শুদ্ধও উঠে দাঁড়াল। উঁকিঝুঁকি মেরে মা কিংবা বোনদের কাউকে দেখতে পেল না। এত গরমে
বাইরে থেকে এলো কেউ যে একগ্লাস পানি দেবে তাও কারো হুঁশে নেই।
রান্নাঘরের সামনে আত্মীয়দের জটলা দেখে নিজেও আর সেদিকে গেল না। ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় দেখা হলো স্বর্ণের সঙ্গে। স্বর্ণকে দেখে বিরক্ত স্বরে বলল,
-‘সবগুলো একসাথে কোথায় হারাস তোরা? কাজের সময় একটাকেও পাওয়া যায় না।’
-‘সায়ন ভাইয়াকে মেডিসিন দিতে গিয়েছিলাম।’
-‘ মা কোথায়, দেখেছিস?’
-‘বড় মা রান্নাঘরে আছে বোধহয়।’
-‘মাকে গিয়ে বল আমার খাবারটা উপরে পাঠিয়ে দিতে।’
-‘ঠিক আছে।’
একথা বলে শুদ্ধ পাশ কাটিয়ে রুমের চলে গেল। তাকে যেতে দেখে স্বর্ণ
ওড়নার আড়ালে থাকা ফোনটা শক্ত করে ধরে শ্বাস ছাড়ল। ভাগ্যিস ধরা পড়ে নি নয়তো শীতলের ফোনটার মতো তার ফোনটাও অকালে অক্কা পেতো। সে আশেপাশে তাকিয়ে ফোন কানে ধরে পরে কথা বলবে বলে কল কেটে আগে ছুটল রান্নাঘরে। শুদ্ধ ভাইয়ের আদেশ মানে সঙ্গে সঙ্গে করা প্রয়োজন। নয়তো বাঁশ কখন কোনদিকে আসবে তা বলা মুশকিল।
বাড়ির গৃহিণীরা রান্নাঘরে বসে গল্পে গল্পে অনুষ্ঠানের জন্য আনা বাজার সাদাই গুছিয়ে রাখছেন। এখানে শীতল, শখও আছে। শখ মায়ের হাতে হাতে কাজ গুছিয়ে দিলেও শীতল বসে বসে কিসমিস চিবাচ্ছে। তার মন মেজাজ খুব খারাপ। এতটা খারাপ কেউ কিছু বললেই খেঁকিয়ে উঠছে।
তর্ক করছে। ঝগড়াও হয়েছে দু’জনের সঙ্গে। তারপর সকাল থেকে গাট হয়ে রান্নাঘরে বসে আছে। এখান থেকে সরে নি কারো সঙ্গে কথাও বলে
নি। কারণ কড়াভাবে আদেশ জারি করা হয়েছে তাকে যেন স্মার্ট ফোন কিনে দেওয়া না হয়। যে দিবে আগে তার বিচার হবে তারপর শীতলের।
এই সিদ্ধান্তের পরপরই বিশেষ বিবেচনায় মত পরিবর্তন’ও করা হয়েছে।
মেয়ে কলেজে পড়ে, বাইরে যাবে, কখন কী প্রয়োজন হয় বলা যায় তাই
বিশেষ বিবেচনায় তাকে বাটন ফোন দেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে।শুধু বাইরে গেলে যোগাযোগের জন্য। এছাড়া জরুরি প্রয়োজন হলে বাসার কারো থেকে ফোন নিতে পারবে তবে সেটা কিছুক্ষণ জন্য, সময় নির্ধারণ করে।
আর এই আদেশ জারি করেছে তার বাবা শাহাদত চৌধুরী। বাবার কথা শোনার পর থেকে তার মন মেজাজ ভালো নেই। রিকুয়েষ্ট করেও লাভ হয়। ইশ ! সবে টিকটক করা শুরু করেছিল। দিন দিন একটু একটু করে লাইক ও কমেন্টের সংখ্যা বাড়ছিল,বাড়ছিল তার ফ্যান ফলোয়ার। আর
এখনই ফোন হারাতে হলো। ওহ থুরি, তার ফোন তো হারায় নি আছড়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাও আবার কে ভেঙেছে? এই বাড়ির শুদ্ধ পুরুষ।
থুরি, এখানেও একট ভুল হলো শুদ্ধ পুরুষ নয় তাকে বলা উচিত দূষিত পুরুষ। কারণ এই একমাত্র পুরুষ তার জীবনের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়।
মর্জির দাম দেয় না। উল্টে তার আদেশ জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয় কিছু বলাও যায় না। বললে চ্যালাকাঠের বারি। প্রচলিত এক কথায় আছে না, ছোটো মরিচের ঝাল বেশি। তাদের এ বাড়িতে প্রবাদটি এক্কেবারে খাপে খাপ মিলে গেছে। নয়তো সায়ন তুখোড় রাজনীতিবিদ। একজন নেতাও। বাইরে মারামারি কাটাকাটি করলেও বাড়িতে যেন শান্ত জল। কই কারো সঙ্গে রুড বিহেভ করে না। রাগ দেখায় না। যখন তখন মারে না। ধমকায় না। অথচ মহামান্য শুদ্ধ পুরুষ রিসার্চার হয়ে সবার মাথা কিনে নিয়েছে।
সে যা বলবে সেটাই সঠিক। সেটাই সমীচীন। বাকিরা সব ভুল, জবরজং।
মারামারি, ধমকাধামকি, কোনোকিছুই সে বাদ রাখে না। গতবার বাসায় এসে চটাস করে বলে বসল বাড়ির কোনো মেয়ে/বউ হিজাব ছাড়া বের হতে পারবে না, পর্দা না করলেও মার্জিত পোশাকে চলতে হবে। যদি সে ভুলেও দেখে তার কথার হেরফের হয়েছে তাহলে খবর আছে। ব্যস হয়ে গেল, এরপরদিন বড়মা সবার হাতে হিজাব ধরিয়ে দিলো। এখন হিজাব ছাড়া বাইরে যায় না কেউ। গরমে চুলের গোড়ায় ঘাম জমে চুলে ভিজে যায় তাও হিজাব ছাড়া বের হওয়ার জো নেই। এখানেই শেষ নয় আরো অনেক নিষেধাজ্ঞা আছে তাদের সবার জন্য। আর এসবে সে বিরক্ত নয়, মহাবিরক্ত। মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেন শুদ্ধ ভাই, খুব প্রয়োজনে বিয়ে করে বউকে এসব প্যারা দেন।’
কিন্তু মাইরের ভয়ে বলা হয়ে ওঠে না। বললে চাপার দাঁত একটাও আস্ত থাকবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হঠাৎ কাঁধে ঝাঁকুনি খেয়ে শীতল ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো। খেয়াল করল রান্নাঘরে শুধু বড় মা ছাড়া কেউ নেই। আচমকা বাকিরা কোথায় গেল জানতে চাইলে বড় মা জানাল, প্যান্ডেল করার জন্য একটা ছেলে মই নিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে বেখেয়ালে মাটিতে পড়ে গেছে। তাকে দেখতে বাকিরা বাগানে ছুটেছে।
একথা শুনে সেও যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে সিঁতারা চৌধুরী তাকে ধরে থামিয়ে দিলেন। তারপর তার হাতে খাবারের ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-‘খাবারটা শুদ্ধর রুমে দিয়ে আয় তো মা। আমি গিয়ে দেখি ছেলেটার কি অবস্থা।’
একথা বলে উনি অ্যান্টিসেপটিক ক্রিমটা হাতে নিয়ে নিজেও দ্রুতপায়ে রান্নাঘর ছাড়লেন। শীতল বিরক্ত হয়ে রাগে গজগজ করতে করতে গেল খাবার পৌঁছে দিতে। গতদিন যার মার খেলো। তাকে এখন খাবার দিতে যেতে হচ্ছে। এটাই হচ্ছে তার নিয়তি। সে শুদ্ধের রুমে নক করে সায়নের রুমে উঁকি মারতে ভুলল না। সায়ন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কড়া মেডিসিনের প্রভাবে দু’দিন ধরে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে সায়ন। ফোনটা কাছে নেই বিধায় ঘুমাতে পারছে না। নয়তো মিনিটে মিনিট ফোন এসে কান ঝালাপালা করে দেয়। সেদিন সায়নের ব্যান্ডেজ দেখে শাহাদত চৌধুরী ভেবেছিলেন অল্প স্বল্প আঘাত। কিন্তু আদৌও তা নয়! পরদিন ডাক্তার যখন ক্ষতস্থান ড্রেসিং করিয়ে তার ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করায় তখন সেটা দেখে আঁতকে ওঠে অনেকেই। সিঁতারা চৌধুরী ডুকরে কেঁদে ওঠে। এসব ছাড়ার জন্য আবার বোঝায়। মায়ের কান্না দেখে সায়ন নিশ্চুপ থাকে। তবে আনমনে খুঁজতে থাকে তার রাগী বাবাকে। অথচ যাকে খুঁজে দুদিন পেরিয়ে গেলেও উনি আসে না। জিজ্ঞাসা করে না তার শরীরের হালহকিকত। আর না ছেলের কথা কারো থেকে জানতে চেয়েছেন। কেউ বলতে গেলে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়েছেন। এমন না ছেলেটা মহৎ কাজ করতে গিয়ে আহত হয়ে ফিরে এসেছে। সে রাজনীতি করে, মস্ত বড় রাজনীবিদ। সে থাকুক তার মতো। একথা বলে শারাফাত চৌধুরী একবারও এদিকে পা মাড়ান নি।
তবে শুদ্ধর থেকে সায়ন ভাই যে শতগুনে ভালো একথা কেউ বোঝে না কেন? বুঝলে সায়ন ভাইকে নয় বরং খাটাশ শুদ্ধকে বকাঝকা শোনাত। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে শীতল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে শুদ্ধ ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে তাকিয়ে আছে। সদ্য শাওয়ার নিয়েছে। পরনে আকাশি
টি-শার্ট ও কালো টাউজার। সে সায়নের রুমের দরজা থেকে সরে এসে শুদ্ধর মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
-‘খাবার। বড় মা পাঠাল।’
থমথমে হয়ে আছে শীতলের মুখ। বিরক্তও বটে। এ লোকটাকে তার সহ্য হয় না। চাচাতো ভাই হয়েছে তাতে কি? তার অতিরিক্ত শাষণের জন্য সে তার চক্ষুশূল। তার মুখভঙ্গি পড়ে শুদ্ধও খিটখিটে মেজাজে বলল,
-‘কোনো অসহায় মানুষকেও তো কেউ এভাবে খাবার দেয় না। মিনিমাম ম্যানার্সটুকুও কি গিলে খেয়েছিস?’
একথা বলে শীতলের বাড়িয়ে দেওয়া ট্রে টা শুদ্ধ হাতে ধরল না দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। শীতল মনে মনে তাকে গালি দিতে দিতে রুমে গিয়ে সেন্টার টেবিলে আস্তে করে ট্রে’টা রাখল। সেটা রাখতে গিয়ে চোখ গেল তার ভাঙাচোরা ফোনের দিকে। ফোনটার দিকে হাত বাড়াতে গেলে শুদ্ধ
বাহু ধরে বিছানার দিকে এক ধাক্কা মেরে বসিয়ে দিলো। শীতল তিরিক্ষি মেজাজে কিছু বলার আগে শুদ্ধ চোয়াল শক্ত করে বলল,
-‘শুনলাম আমাকে নাকি গালাগাল দিয়েছিস তুই? অভিযোগ করেছিস আমি তোকে শুধু শুধু মারি। চাচাতো বোন বলে তোর ভালো সহ্য করতে পারি না আমি।’
-‘হ্যাঁ বলেছি। এখনও বলছি, তুমি আমাকে শুধু শুধু মারো। ছোটো বোন প্রেম করলে অন্য ভাইরা বুঝিয়ে বলে আর তুমি আমাকে বোঝানো দূর ডাকাতের মতো চ্যালাকাঠ দিয়ে মেরেছো।’
-‘এত অভিযোগ?’
-‘কেন করব না অভিযোগ? এত জোরে কেউ মারে?’
-‘বেশ করেছি। আর করবি টিকটক?’
-‘করব তো। আবার করব।’
-‘মুখে তর্ক করছিস, মারের ব্যথা কমে গেছে তাই না? আরেক ঘা খাবি?’
শীতল রাগে গজগজ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। অভিমানে তার মন মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠেছে। আর কিছুক্ষণ থাকলে উল্টা-পাল্টা বলে বসতে পারে। তাই সে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই শুদ্ধ তার পথ আগলে দাঁড়াল। তারপর নিজেকে সামলে জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে লেপটপটা এগিয়ে দিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
-‘কমেন্ট বক্স দেখ।’
শীতল লেপটপ কোলে নিয়ে দু’পা তুলে বিছানার এককোণে বসল। শুদ্ধ
কথা না বাড়িয়ে খেতে বসল। কিছু খেয়ে মেডিসিন খাওয়া জরুরি তার।
শীতল গালে হাত দিয়ে কমেন্ট বক্স চেক করতে করতে হাসছে। ফ্যানরা তার টিকটক পছন্দ করেছে। প্রশংসা করছে। আরো বেশি করে টিকটক
করার জন্য উৎসাহ দিচ্ছে। এরা কত ভালো চায় তার। সে মহাআনন্দে
ঝুমঝুম করে মন দিয়ে কমেন্টগুলো চেক করতে হঠাৎ আঙ্গুলের খোঁচা লাগল তার গালে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল সে। ব্যথাতুর শব্দ শুনে শুদ্ধ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাতেই খেয়াল করল শীতলের বাম গাল দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
ক’দিন যাবৎ শীতলের কপালে, দু’গালে, থুতনীতে দু’চারটা ব্রুণ উঠেছে।
ফর্সা গালে লাল হয়ে আছে এক একটি ব্রুণ।কিশোরী থেকে সদ্যযৌবনে পা দিলে এসব খুবই ন্যাচারাল। তাছাড়া ব্রুণ নানান কারণে হতে পারে শুধু যে, সদ্য যৌবনা তা নয়। এমনও হতে পারে আজকাল সে পানি কম খাচ্ছে অথবা ঠিকমতো ঘুমাচ্ছে না। হতেও পারে পূর্বের চেয়ে তার স্কিণে ওয়েলি ভাবটা বেড়েছে। এসব নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করল না শুদ্ধ। শীতল ওড়না দিয়ে সদ্য গলে যাওয়া ব্রুণের রক্ত মুছে পুনরায় সে কমেন্ট চেক করতে গিয়ে তার চোখ আটকাল একজনের কমেন্টে ‘ সদ্য যৌবনে পা দেওয়া আবেদনময়ী প্রেমিকা আমার। খুব ভালোবাসি জান। তোমার এই যৌবনসুধা পান করার অপেক্ষায়।’
এ কমেন্ট করেছে তার ক’দিনের জন্য বানানো প্রেমিক ফারাবি। এটাই
সেই প্রেমিক যাকে সায়ন ড্যান্ডিখোর বলেছিল। ফারাবির কমেন্ট দেখে শীতল রাগে কিড়মিড় করে তাকিয়ে রইল কমেন্টটার দিকে। ফারাবি কী করে পারল এসব নোংরা কথা বলতে? তার বুদ্ধিতেই তো টিকটক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরিচিতি লাভ এবং উপার্জনের উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছিল টিকটক। অথচ পাবলিক প্লেসে এভাবে ছোটো করতে পারল? ফারাবির কমেন্টের পর ঘন্টা খানিক আগে করা আরেকজনের কমেন্টে নজর আঁটকাল তার, ‘ব্রুণ দেখে মনে হচ্ছে যৌবন জ্বালায় রাত বিরেতে ঘুমাতে পারে না।’
গতরাতে করা তৃতীয় কমেন্ট,’ হেই সেক্সি রসের আলাপ সারতে ইনবক্স প্লিজ।’
আরেকটি কমেন্ট দেখে শীতলের কথা হারিয়ে গেল। হাসি মিলিয়ে গেল।
চোখ দিয়ে ঝরতে লাগল কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল। সে ঝাপসা দু’চোখে এই কমেন্টটাও পড়ল, ‘সায়ন, শুদ্ধ বোনদের পালতে পারছে না বোধহয়
এজন্য রাস্তায় নামিয়েছে। চৌধুরী বাবুরা দেখি বাড়ির মেয়েদেরকে দিয়ে ব্যবসা চালু করেছে। চালিয়ে যাও, ভালো হচ্ছে, পরের ভিডিওতে রেটটা জানিও।’
এই কমেন্টে আরেকজন রিপ্লাই করেছে, ‘ভাই, রেট জানলে আমাকেও জানায়েন। আমরা না গেলে চৌধুরীদের ব্যবসা লাটে উঠবে তো।’
আরেকজনের কমেন্ট, ‘আর দুই বোনকেও রাস্তা নামা সায়ন। একটাকে আর কতজন মিলে খাব? ভাগে কম পাব তো ইয়ার।’
এমন বাজে বাজে কমেন্টে ভরা তার কমেন্টবক্স। এসব দেখে শীতলের কথা হারিয়ে গেল। মাথা নিচু করে বসে রইল সে। নোংরা কথায় গা রি রি করে উঠল। ছোটো থেকে কেউ তাকে নোংরা কথা বলে নি। বরং চৌধুরী নিবাসের মেয়ের বলে সব জায়গায় যথেষ্ট স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়েছে।
শুদ্ধ খেতে বসেছে ঠিকই কিন্তু এক লোকমা খাবারও গলা দিয়ে নামে নি তার। সে খাবার থেকে হাত উঠিয়ে ধারালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভীত হরিণীর ন্যায় বসে থাকা শীতলের দিকে। শীতলের সাহস নেই চোখ তুলে তাকানোর। তবুও বুঝতে পারছে কেউ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে পরখ করছে।
তখন শুদ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘ এতদিন কেউ চৌধুরী নিবাসের মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর
সাহস করে নি, নোং’রা কথা বলা তো বহুদূর। তোর বোকামিতে চৌধুরী নিবাসের প্রতিটা সদস্যের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। শিক্ষা নিয়ে কথা উঠছে। কমেন্ট গুলো দারুণ না? শান্তি পেলি এবার? মনপ্রাণ জুড়িয়েছে নিশ্চয়ই? আর কী বললি যেন আমি তোকে সহ্য করতে পারি না। তোর ভালো দেখতে পারি না। চাচাতো বোন তাই বাজে ব্যবহার করি। মারি। ধমকায়। ওকে ফাইন, এতদিন যা করি নি আজকে থেকে সেটাই করব। এই মুহূর্ত থেকে সত্যি সত্যিই চাচাতো বোন হিসেবে ট্রিট করব। যা রুমে যা।’
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩
শীতল বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে।খারাপ লাগছে। কষ্ট হচ্ছে। আগে যদি জানত এমন হবে তাহলে কি আর এসবে জড়াত। ক্ষুণাক্ষরেও আন্দাজ করে নি তাদের পাড়ার ছেলেপেলে
তাকে ফলো করে। এমনকি সায়নের প্রতিপক্ষরাও এ ব্যাপারটাকে তিল থেকে তাল করবে। জনে জনে এসে তাকে টার্গেট করে চৌধুরী বাড়ির মেয়েদের চরিত্র নিয়ে আঙুল তুলবে। শুধু তার জন্য শখ, স্বর্ণকেও বাজে কথা শুনতে হলো। বাবা, চাচা ও ভাইয়ের কষ্ট পেতে হলো। তাদের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। বাবা তাহলে কমেন্টগুলো দেখেই এত ক্ষেপেছে। নতুবা উনি তো কখনো এত কঠিন ব্যবহার করে না। সব দোষ তার,তার কারণে
এতকিছু। এসব ভেবে শীতল ফোঁপাতে ফোপাঁতে কিছু বলার আগে শুদ্ধ কাঁচের গ্লাসটা মেজেতে ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করে বলল,’ যেতে বলেছি। দূর হ চোখের সামনে থেকে।’