শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪৯
নূরজাহান আক্তার আলো
ইয়াসির শীতলকে কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই সেখানে পরপর দুটো আর্মির গাড়ির এসে থামল। ধপধপ করে শব্দ তুলে একে একে
নেমে দ্রুত ছুটল রেস্টুরেন্টের ভেতরে। আর্মির গাড়ি দেখে পোশাকধারী
লোকগুলো ততক্ষণে ভাগ ভাগ হয়ে আড়ালে চলে গেছে। ওরা আর্মিদের উপর খেয়াল রেখে ইয়াসিরকে বলল গাড়ির টান দিতে। কারণ জুবায়ের খেতে বসেই ইয়াসিরকে সন্দেহ করেছিল। এবং নিঁখুতভাবেই সে কাউকে ইনফর্ম করাই আর্মিরা এখন এখানে এসে হাজির। বেচারা জুবায়ের সব চেষ্টা করলেন শেষ রক্ষা করতে পারল না শীতলকে। ইয়াসির ওর গাড়ির ড্রাইভারকে গাড়ি টান দিতে বলে শীতলকে নিয়ে পেছনের সিটে আরাম করে বসল। ইশ! মেয়েটা এত সফ্ট কেন? কোলে তুলে মনে হচ্ছে মাখন। উঁরুর উপর থাকা অবচেতন শীতলের আপাদমস্তক পরখ করে ইয়াসির হাসল। পুরাই পুতুল একটা।দেখে মনে হচ্ছে সে সদ্য যৌবনে পা রেখেছে,
অর্থাৎ মেয়েটাকে বন্দিনী করে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারবে। যদিও ওর ভাইগুলো একটু ঝামেলা করতে পারে ওসব সামলে নেওয়া যাবে। একথা ভাবতে ভাবতে ইয়াসিক শীতলকে বুকের সাথে চেপে ধরে নাক ডুবাবো গলায়।জোরে শ্বাস টেনে পরপর একইভাবে শ্বাস টানতে লাগল।
কি যেন মিষ্টি একটা সুগন্ধ মেয়েটার গায়ে। সে এবার শীতলের ঠোঁটটা আঙুল দিয়ে স্লাইড করে বলল,
-‘আরো কিছু দিন মায়ের কোলে থাকার সময় দিতাম তোমাকে সোনা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আমি ভেবেছিলাম, আমার মতো জানোয়ারের কাছে আরো কদিন পর এসো। কারণ মানুষ যেমন ফুল ভালোবাসে আমি তেমনভাবে নারীরদেহ পছন্দ করি। কোনো মেয়ের শরীর পেলে আমার মাথা টাথা ঠিক থাকে না। এজন্য ভেবেছিলাম সদ্য যৌবন না পরিপূর্ণ যৌবনবতী হলে আমার কাছে আনতে। কেন জানো? কারণ এখন তুমি এবং তোমার সুন্দর এই শরীরটা বড্ড নাজুক। বড্ড তুলতুলে। ধরতেও ভয় লাগছে না জানি কত ব্যথা ট্যথা পাও। ভয় নেই আমি তোমাকে খুব যত্ন করব।
খুব খুব আদরে রাখব। সেন্স ফিরে একদম জেদাজেদি করবে না, ওকে? ভদ্র মেয়ে হয়ে থাকবে। এভাবে তুলেছি বলে খবরদার কান্নাকাটি করার চিন্তাও করবে না। কেন করবে বলো তো? আমি কিন্তু ইচ্ছে করে এসব করেছি নাকি? মোটেও না। বরং তোমার ভাইরাই আমাকে এসব করতে বাধ্য করেছে। জানো গতদিন আমার কোটি কোটি টাকার মাল পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। সায়ন যা করেছে করেছে। কিন্তু শুদ্ধ যা শুরু করছে এরপর তোমাকে ছাড়ি কিভাবে বলো, পাখি? শুধু শুদ্ধকে জব্দ করতে আমি আমার অগ্নিকন্যাকে চিনেও চিনলাম না। হাতের কাছে পেয়েও ছুঁলাম না। ভাবতে পারছো তোমার প্রতি কতটা আসক্তি আমি?’এইটুকু বলে থামল। তারপর শীতলের শুকনো ঠোঁটে চুমু এঁকে বলল,
-‘এ্যাই পাখি চোখ খুলো? কবুল বলতে হবে তো নাকি; নাকি বিয়ে টিয়ে ছাড়াই আমার মহলের রানী হবে?’
এদিকে কিছুক্ষণের মধ্যে শীতলের কিডন্যাপের কথা শুদ্ধর কানে পৌঁছে গেল। ল্যাব থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে এসে কেবল খেতে বসেছে সে। প্রচন্ড ক্ষুধা লাগলেও খাওয়া হলো না তার। গলা দিয়ে কিছুই নামবে না। তাকে এভাবে উঠতে দেখে সিঁতারা বার বার জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলল না।
বেসিনে দ্রুত হাত ধুয়ে উঠতেই জরুরি কলটা এলো তার ফোনে। বাড়ির কাউকে আপাতত কিছু না বলে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল দো’তলার দিকে।
ফোনের ওপর পাশের ব্যক্তি কিছু বলছে আর শুদ্ধ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চুপ করে শুনছে। কিছুক্ষণ পর কল কাটতেই শাহাদত চৌধুরীর কল ঢুকল তার ফোনে। এ মুহূর্তে কল ধরার ইচ্ছে না থাকলেও কলটা রিসিভ করতেই শাহাদত চৌধুরী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
-‘শুদ্ধ? আব্বা শীতলকে..! ‘
-‘(….)।’
শুদ্ধ কথা বলছে না তবে হাত মুঠো করে থমথমে মুখে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। শুদ্ধকে কথা বলতে না দেখে শাহাদত চৌধুরী পুনরায় বললেন,
-‘কি করব এখন? গাড়ির নং কিংবা ফোন নং কিছুই তো জানি না। আমি চট্টগ্রাম থেকে বের হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি।’
-‘(…..)’
-‘আমার মাথা কাজ করছে বাবা। কি করব বুঝতেছি না।’
-‘এখান থেকে কেক অর্ডার করে দিচ্ছি মেয়ে কিডন্যাপ হওয়ার খুশিতে
সেলিব্রেট করেন। এছাড়া আপাতত কিছু করার আছে বলে মনে হচ্ছে না।’
এই পরিস্থিতিতে এমন ধরনের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন শাহাদত চৌধুরী। কপালের ঘামটুকু মুছে তিনি নিজেকে ধাতস্থ করে বললেন,
-‘এখন কি রাগ দেখানোর সময় বাবা?’
-‘সময় না? ওহ, তাহলে আপনিই বরং ঠিক করে দেন কখন রাগ দেখাব।’
-‘বাবা রে, আমার মেয়েটাকে পাচ্ছি না।’
-‘কেন পাচ্ছেন না? রক্ষা করতে পারবেনই না যখন তখন নিয়ে গেলেন কেন? আমি বলেছিলাম নিয়ে যেতে?’
শুদ্ধর শান্ত কন্ঠে ধারালো কথা শুনে শাহাদত চৌধুরী কথার খৈ হারিয়ে ফেললেন। বুঝলেন এই ছেলেকে আপাতত থামানো যাবে না। ছেলেটা প্রচন্ড রেগে আছে তাকে ঘাটালে আরো বেঁকে বসতে পারে। তাকে শান্ত করতে হবে শীতলের কথা দিয়ে। তাই তিনি কিছু একটা ভেবে বললেন,
-‘ভুল করেছি। এবার কিছু একটা কর বাবা? আমি কথা দিচ্ছি শীতলকে পেলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আগে তোদের বিয়ে সম্পূর্ণ করব।’
একথা শুনে শুদ্ধর সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তবে বেশ কিছুক্ষণ পর গম্ভীর একটা কন্ঠ ভেসে এলো,
-‘ তাই যেন হয়!’
এরপরই কল কেটে যেই অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতে বের হয়ে সায়নের পার্টি অফিসে গেল। গিয়ে দেখে সায়ন ফোন কানে ধরে গালাগাল করছে কাউকে। গালির ধরণ আর কথা শুনে বুঝল আজমকে। তাকে দেখেও সায়ন থামল না সমানে বলে গেল,
-‘ওই মা’দা’র’চো:দ তোরে আমি রেস্টুরেন্টের ওয়েলকাম ড্রিংকস গেলার জন্য পাঠিয়েছিলাম? তোরে বলছিলাম না, সর্তক থাকতে? বলছিলাম, যে আমাদের পদে পদে বিপদ ভুলেও কাউকে বিশ্বাস না করতে।এতবার বলার পরও তুই একই ভুল কেন করলি? শহরের চাকচিক্য দেখে মাথা ঠিক ছিল না? তোরে পাঠিয়েছিলাম ওসব শাউয়া দেখতে? ওই খানকির পোলা ওই! এখন তোর কোন বাপে আমার বোনকে এনে দিবে? আমার বোনের যদি কিছু হয় তাহলে তোর পেছন দিয়ে ওয়েলকাম ডিংকস না ঢুকিয়েছি তো আমার নামও সায়ন না। আমিও দেখব কত টা লোড কত পারিস হা’রা’মজা’দা।’
একথা বলে সায়ন কল কেটে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে শান্ত সুরে বলল,
-‘ভাইয়া আছি না? একটু সময় দে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।’
-‘তা তো হতেই হবে। তবে এবার ওই বাস্টার্ডটাকে উচিত শিক্ষা দিয়েই ছাড়ব। যদি না পারি আমার নামে কুকুর পুষো।’
একথা বলে শুদ্ধ সায়নকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ল। তবে কোথায় গেল সায়ন জানে না। ভাই যে প্রচন্ড ক্ষেপেছে বুঝতে বাকি নেই তার। মায়াও লাগল ইয়াসিরের জন্য। ও বেচারি জানে তো ঠিক কার কলিজায় থাবা বসিয়েছে? জানে না বোধহয়। জানলে কি এমন দুঃসাহস দেখাতো? সে কিছু একটা ভাবল তারপর শুদ্ধকে বলল,
-‘আচ্ছা ভাই ইয়াসিরকে পেলে কি করবি? আমি কিন্তু আগেই শালাকে ধরে পটাপট চুমু খাব। শালার কলিজা আছে নয়তো দ্বিতীয়বার একাজ করে, বল?’
-‘যা করার কোরো শুধু ওর আহত ডেডবডি আমাকে দিও।’
-‘কি করবি?’
-‘ ওকে পেলে কয়েকটা ইঁদুরের আয়ু বেড়ে যাবে।’
-‘ওকে ডান।’
একথা বলে সায়ন কল দিলো রুবাবকে। কয়েকবার কল বেজে বেজেই কেটে গেল। রুবারের থেকে কিছু তথ্য পেয়ে সায়ন আজকেই আজমকে পাঠিয়েছিল শীতল স্বর্নের খেয়াল রাখতে। ক্যাম্পে তারা সুরক্ষিত হলেও বাইরে একদমই না। আজমের কাজ ছিল যেভাবেই হোক তাদের সেফটি দেওয়া। এবং স্বর্ণ শীতলের বাইরে যাওয়ার কথাটা মেসেজে জুবায়েরই
রুবাবকে জানিয়েছিল।জুবায়ের হচ্ছে রুবাবের ক্লাসমেট।অনাকাঙ্ক্ষিত
ভাবে রুবাবের সাথে চট্টগ্রামের শপিং শপে দেখা হয় জুবায়ের এর।এবং
জানতে পারে অনেক ঘটনা। এরপর জুবায়ের, রুবার, সায়ন, শুদ্ধ মিলে প্ল্যান করে। কিন্তু সে প্ল্যানে জল ঢেলে তার আগে শীতলকে নিয়ে উধাও ইয়াসির।
শীতল নিঁখোজ হওয়ার পর থেকে সিমিন পাথর হয়ে বসে আছে। কাকে
দোষ দিবেন, নিজেকে নাকি নিজের ভাগ্যকে? মেয়েটা কিডন্যাপ শুনে সিঁতারা ফোন করে যাচ্ছে তাই কথা শুনাল, বাদ যায় নি মেজো জাও।
তার পাশে বসে শাহাদত চৌধুরী শুদ্ধর সাথে কথা বলেছেন। উনি শুদ্ধর সব কথায় শুনেছেন। সুক্ষ একটা তাচ্ছিল্য ছিল শুদ্ধ কথার মাঝে। সত্যি তো রক্ষা করতে পারবে না তো নিয়ে গেল কেন? কিন্তু ছেলেটাকে উনি বোঝাবে কীভাবে এখানে আসার কারণ মোটেও একটা নয়। বরং এমন কিছু কারণ আছে যেগুলো উনি বুকের ভেতরে চাপা রেখেছেন। সেসব বুকচাপা ঘটনা উনার বুকটাকে ক্ষত বিক্ষত করে প্রতিনিয়ত। মনে মনে একথা ভাবতে ভাবতে উনার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে গেল। মাথার মধ্যে
ঘুরপাক খেতে লাগল কয়েকমাস আগের ঘটনা.. দিনটা ছিল শারাফাত চৌধুরীর মায়ের প্রয়াত বার্ষিকী..
-‘ওই দ্যাখ, সাদা পাঞ্জাবি পিন্দা আছে ওইডা সিঁতারার ছুডু পোলা। নাম শুয়াইব শুদ্ধু। নামকরা বিজ্ঞানী। পিপারে আবার ছবি টবিও বাইর হয়।
মস্ত মস্ত জিনিস তৈয়ার করে৷ পোলাডা দেখতে কেমন রাজা রাজা ভাব তাই না? হেরা কিন্তু দু’ভাই। বড়ডার নাম সায়ন। হে আবার রাজনীতির নেতা। পড়ালেহাতেও ভালো আছিল। আমাগো রিতার জুড়ি এই সায়ন। রিতা তো কেলাসে ফেইল করত পরে গফুর ব্যাডার লগে পালাইয়া গেল।
এহন মিসে ভাত রাইন্ধা খায়৷ হেই ছেঁড়ি বহুত সুন্দর আছিল তয় নিজের পায়ে কুড়াল নিজেই মারছে। কপালপুরী শুদ্ধু সায়নের মুতুন পোলারে চোখে দেখতে পায় নি? না, সে গেল ল্যাংটা বাবার লগে। উর বররে দিখা মুনে হয় কাছে ডাইক্কা দুখানা থাপ্পড় দিয়া ভিটামিনের ওষুধ কিনন্না দেই।
তয় যিডাই কইস আমগো সিঁতারার দুইডা পোলা দেখতে যেরাম সুন্দর তেমনি তাগো বিবোহারও। এরাম যদি একখান নাতজামাই পাইতাম..!”
বাড়িভর্তি অনেক মেহমান বিধায় সাবধানে কথাগুলো বললেন ষাটোর্ধ বয়সী জয়নব বেগম। উনার বয়সী আরো কয়েকজন সঙ্গে আছেন। উনি
আশেপাশে তাকিয়ে হাতে থাকা তুতপিক দিয়ে মাড়ির দাঁতগুলো খুঁচিয়ে নিলেন। দাঁতের ফাঁকে সুপারি ঢুকে গেলে খুব ব্যথা করে তাই যখনই পান খান হাতে একটা তুতপিক রাখেন। উনি দাঁত খুঁচিয়ে শাহাদত আঙুলের
ডগায় থাকা চুন জিহবায় নিয়ে পুনরায় বললেন,
-‘কদিন আগে আমার বড় নাতনি রুকাইয়ার লিগা সমন্ধ পাঠাইছিলাম। যেকোনো একজনের লগে বিয়ে দেওনের লিগা। ছাওয়াল দুইডার কেউ রাজি হয় নাই। কত ট্যাকা যৌতুক নিবো, যত যাই নিক দিমু, মুই এডিও কইছিলাম। সিঁতারাকেও কত কইরা বুঝাইছিলাম। পরে শুনি পোলারা
নাকি এহন বিয়াই করব না। তাগো নাকি বিয়ার বয়স হয় নাই। মানে কি কমু? আইজ-কাইলকার পোলাগোর কথা শুইন্না হাসিও আহে আবার দুঃখুও লাগে। অথচ এদের বয়সে আজমেরীর বাপ চার ছাওয়ালের বাপ
হইয়া গেছিস।’
জয়নব বেগমের কথা শুনে মহিলামহলের হাসির রোল পড়ল। তবে এটা শোকের বাড়ি দেখে সকলে কোনোমতে হাসি সামলে নিলেন। ফিসফিস করে অন্যদেরও সাবধান করে দিলেন।তখন কারিমুননেছা নামে আরেক
মহিলা আঙুলের ইশারা করে কাউকে দেখিয়ে বললেন,
-‘ওইডা কেডা? শাহাদতের ছুডু মাইয়া না? মাইয়াডারে ছুডু দেকছিলাম এহন দেখি মেলা বড় হইয়া গেছে। তা বিয়া সাদি দিবে না? মাইয়া ডাঙ্গর হইলে আর ঘরে রাখতে নাই।’
একথা শুনে রাবেয়া বানু শাড়ির আঁচল থেকে তৈরি করা পান মুখেগুঁজে বসলেন,
-‘আমি কুন্তু অনেকক্ষণ থিকা দেকতাছি মিয়াঁডা সিঁতারার ছুডু পোলার পিছন পিছন ঘুরতাছে। পোলাডা চোখ রাঙানি দিলেও সরতেছে না। কী
বেশরম মিয়া।’
উনার কথায় এবার বৃদ্ধাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল অদূরে দাঁড়ানো শুদ্ধ আর শীতলের দিকে। তারা কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া করছিল তখনও। তাদের দেখে জয়নব বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
-‘যুগ যা খারাপ খোঁজ নিয়া দেখো তাগো মধ্যেও ইটিশ-পিটিশ চলতাছে।শাহাদতের বউডারও কি কোনো আক্কেল জ্ঞান নাই? এই বড় মিঁয়াডারে চাচাতো ভাইয়ের লগে এত মাখামাখি করতে দেয় ক্যান? আমরা মানুষ হই নাই? আমরা আমাগো চাচাতো ভাই, মামাতো, ফুপাতো ভাই দেকলে মুখ লুকাইয়া পালাইতাম। এহনও তাই করি। আর এখনকার ছালপালে পারে না কোলে মদ্দ্যে ডুইক্কা যাইতে, ছিঃ! ছিঃ ছি!’
উনি একথা বলে পাশ ফিরতেই দেখে সিমিন দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে শরবতের ট্রে। উনাকে দেখে জয়নব বেগম একটু ঘাবড়ে গেলেও প্রকাশ করলেন না। সিমিন উনার কথা শুনে এমন প্রতিক্রিয়া দিলো যেন কিছুই শোনে নি। বাড়িভর্তি মেহমান। এখন কথা বাড়লে ব্যাপারটা অন্যরকম হবে। তাই উনি বিনয়ীভাবে সবার হাতে শরবতের গ্লাস হাতে তুলে দিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রাবেয়া বানু হঠাৎ উনাকে আঁটকে দিলেন।
তারপর ফিসফিস করে বললেন,
-‘শাহাদত কি আহে নাই বউ?’
-‘এসেছে খালাম্মা।’
-‘ তা স্বামী রাইখা এইহানে থাকো ক্যান বাপু? আমগো শাহাদত কি মেলা বুইড়া হইয়া গ্যাছে? তার কি কিছু লাগে না? তুমরা বউ মানুষ স্বামীর সব ভালো-মুন্দ খেয়াল রাখবা না? হেই যতই আর্মি হোক, ব্যাডা মানুষ তো।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বাইরে পইড়া থাহে যদি ভুল পথে পাও বাড়াই তহন কি করবা? সতীনের ঘর করার ইচ্ছা হইছে নি?’
উনার কথা শুনে সিমিনের ইচ্ছে করল মুখের উপর কিছু একটা বলতে। কিন্তু শশুরবাড়ির লোক এবং বড় জায়ের বাবার বাড়ির মানুষ দেখে চুপ করে রইলেন। কিন্তু উনার চুপ থাকা বৃদ্ধাদের বোধহয় সহ্য হলো না। তাই নরম ভেবে আরেকটু চটকাতে বললেন,
-‘আর হইছো তো দুই মাইয়ার মা। তা আর পোলাপান কী নিবা না?’
-‘না, আল্লাহ আমার মেয়ে দুইডার আয়ু বাড়িয়ে দিক তারা ভালো থাক।’
-‘শুনো বউ, স্বামীরে হাতে রাখতে চাইলে স্বামীর লগে যাও গা। মাইয়াও বড় হইছে। গায়ে গতরে ডাঙ্গর হইছে। পারলে বিয়া দিয়া দাও। শুধু মনে রাইখো, তুমার জায়ের দুইডা জুয়ান পোলা আছে। জুয়ান পোলাপান আগুন আর ঘিয়ে লাহান, এদের একলগে রাখা ঠিক না। কখন কি হয় বলা যায় না। যুগ খারাপ। এহন আবার ঢং কইরা বইলো না ভাই-বোন হেরা। শুনো মায়ের প্যাটের নাহলে ভাই-বোন হয় না।’
একথা বলে উনি থামতেই কারিমুননেছা এবার আরেকটা কথার তীর ছুঁড়লেন,
-‘শুনো আগে থিকা সাবধান হও বউ। আর যদি মুনে মুনে ভাইবা থাকো সিঁতারার পোলাগোরে জামাই বানাবা তাহলে আর কি। তয় তুমার বড় মাইয়া একটু আকটু ভদ্রোর হইলেও ছুডু মাইয়াডা পুরাই উড়নচণ্ডী। এই মাইয়ার থিকা সিঁতারা হের পোলাগোর লিগা আরো ভালো বউমা পাইব।
বাইতে ভালো পোলা আছে দিইখা তুমার কি হেগোরে জামাই বানানোর পায়তারা করছো নি বউ? না করলে তুমার ছুডু মাইয়ারে সামলাও। ওই
ছেঁড়ি দেখি সিঁতারার পোলার পেছন ছাড়ে না। এইরকম বেশরম মাইয়া
আহে দেহি নাই বাপু।’
সিমিন হতভম্ব হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলেন বৃদ্ধাদের দিকে।তবে কেন জানি
গলা দিয়ে টু শব্দ করতে পারলেন না তিনি। মাথা নিচু করে চলে যেতে যেতে আরেকটা কথা উনার কানে গেল। জয়নব আর কারিমুননেছা এত কথা বলল দেখে রাবেয়া বানু ফোঁড়ন কেঁটে বললেন,
-‘ হেরা যা মুন যায় করুক আমরা কথা না বাড়াই। ওই বউডারে সাবধান করার কথা আছিল, তুমরা করলা। এহন শুনলে ভালো না শুনলে রেডি থাকুক আরেক কেচ্ছা ঘটানোর। মাগি পাইড়া রাখছে এখন জায়ের দুই পোলার পেছনে লেলিয়ে দিক। পর মায়েও সকালে গোসল দিয়া বাইর হইয়া রান্নাঘরে যাইব। আবার তার ছেঁড়িরাও ফরজ গোসল দিয়া একই রান্নাঘরে ঢুকব। মা ও ছেঁড়িরা মিলা ভেজা চুলে সংসারের কাজ সারব। ছিঃ! ছিঃ! মিইল্লা নিও এই কাহিনিই ঘটবে নে।’
একথা শুনে সিমিনের পা চলছিল না। খুব ইচ্ছে করছিল হাউমাউ করে কাঁদতে। মেয়ের মায়েদের এত দোষ কেন? এত কথা শুনতে হয় কেন?
পরপর দুই মেয়ে হওয়ার কারণে অনেক কথায় শুনতে হয়। এজন্য উনি
কখনো মেয়ে দুটোকে প্রশয় দেন না। স্বর্ণ বুঝদার তাকে কিছু বলতে হয় না কিন্তু শীতলটা কোনো কথা শোনে না। মেয়েটা বুঝতে চায় না আগের মতো ছোটো নেই। আগের মতো ভাইয়া ভাইয়া করে সায়ন শুদ্ধর কাছে যাওয়া মানায় না। সে এখন গায়ে গতরে বড় হয়েছে। সময় এসেছে কিছু সম্পর্কে দূরত্ব টানার। কয়েকমাস আগে চৌধুরী নিবাসে উনার শাশুড়ির মৃত্যুবার্ষিকীর দিনের এই ঘটনাখানায় সিমিনের মনের গভীরভাবে দাগ কেটেছিল। বৃদ্ধাদের কটু কথা শুনে ভেতরটা জখম হয়েছিল তীব্রভাবে।
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪৮
সেদিন থেকেই উনি নিজের কাছে শপথ করেছিলেন যাই হোক, বৃদ্ধাদের নোংরা কথাগুলো সত্যি হতে দিবেন না। হ্যাঁ উনি যে, শুদ্ধ আর সায়নকে ভীষণ ভালোবাসে একথাও অস্বীকার করতে পারবেন না। তবে জামাতা হিসেবে গ্রহনও করবেন না। তাহলে সমাজকে জিতিয়ে দেওয়া হবে। সব কটু কথার জয় হবে। এছাড়াও উনি জেনে গেছেন উনার মেয়ে দুটো হবে ছেলে দুটোর প্রাণনাশের কারণ। তাদের চারজনের ভালোবাসার বন্ধনই ভাঙবে শারাফাত ও শাহাদত চৌধুরী পবিত্র বন্ধন।
আপু গল্পের পার্ট গুলো কি তাড়াতাড়ি দেওয়া যায় না অনেক অপেক্ষায় থাকি, প্লিজ প্লিজ প্লিজ আপু তাড়াতাড়ি দিয়েন ❤️❤️
অনেক ভালোবাসি এই গল্পটা
গল্পটার অপেক্ষায় থাকি। এতো দেরিতে কেন দেন। তাড়াতাড়ি করে দিবেন প্লিজ।