শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৫

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৫
নূরজাহান আক্তার আলো

শীতল নিঁখোজের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সিমিনকে নিয়ে স্বর্ণ ফিরে এলো চৌধুরী নিবাসে। বাড়িতে তখনো থমথম ভাব। কিন্তু সিমিনকে দেখে যে
সিঁতারা, সিরাত রাগ ঝাক করার কথা তেমন কিছুই করলেন না। সিমিন বাড়ি ফিরে বড় জায়ের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াতেই সিঁতারা মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে শুধু থমথমে সুরে বললেন,

-‘কেউ যেন আমার সাথে কথা না বলে। যদি কথা বলতেই হয় তাহলে সে যেন ওয়াদা করে যে, যেসব কাজ করেছে সেই কাজ আর কখনো করার স্পর্ধা দেখাবে না। চৌধুরীর নিবাসের চৌকাঠ পেরিয়ে কোথাও যাবে না।
যদি যাওয়ার চিন্তা থাকে তাহলে এখনই আবার চলে যাক। আমরা তো পর। পরকে কি আর পেটের কথা বলা যায়? যায় না তো! এজন্যই পেটে কথা রেখে বিপদ নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়েছে। তাইআবার গর্ব করে বলে আমি নাকি কারো বড় বোন। আমাকে বড় বোনের মতো সন্মান করে। এ হচ্ছে সন্মানের নমুনা! কোথায় ছেলের মা হয়ে আমি মুড দেখাব তা না, সেই উল্টো আমাকে মুড দেখিয়ে ড্যাং ড্যাং করে বেরিয়ে গেল।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বড় জায়ের কথা শুনে সিমিন হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেললেন। অনুশোচনায় যে বিশ্রীভাবে দগ্ধ হচ্ছেন একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওদিকে শুদ্ধর
সঙ্গেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। শাহাদত চৌধুরী আর জুবায়ের চেষ্টা চালিয়ে ছুটেছে ওদের উদ্ধার করতে। যে শীতলকে কিডন্যাপ করেছে সে নাকি ডেঞ্জারাস মানুষ। কি যে হবে বুঝে উঠতে পারছেন না কেউ। এসব মিলিয়ে পুরো চৌধুরী নিবাসে চলছে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। এমনিতে সব এলোমেলো তার উপরের জায়ের অভিমানী কথাবার্তা শুনে সিমিন যেন
দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও পেলেন নাা। না চাইতেও বসে পড়তেই জলদি সিঁতারা আগলে নিলেন উনাকে। কাঁদতে কাঁদতে দু’জা জড়িয়ে ধরলেন।

কাঁন্নার মাতম পড়লেও এ বিপদের মাঝে পূর্বের কথা উঠালেন না কেউ।
আর না কারো প্রতি কেউ রাগ পুষিয়ে রাখলেন। শখ ছলছল চোখে শুধু দেখে গেল তিনমায়ের অভিমান ভাঙার পর্ব। সে মনে মনে দোয়া করতে লাগল আবার যেন চৌধুরী নিবাসে সুখ ফিরে আসে। আবার যেন সুখের হাঁট বসে। আবার যেন সব ভাই-বোনরা খুনশুটি আড্ডায় মেতে উঠতে পারে। তাদের প্রতি ঘনিয়ে আসা সকল বিপদ দূর হোক। সমস্ত অশান্তি কপূর্রের মতো উড়ে যাক।
মাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে স্বর্ণ ছুটেছে সায়নের পার্টি অফিসে। কিন্তু সায়ন সেখানে নেই। অফিসের দরজায় তালা ঝুলানো। রুবাব, সায়ন কোথায় জানে না কেউ। বাংলা প্রচলিত কথায় আছে,বিপদ যখন আসে চারদিক থেকেই আসে। স্বর্ণ আজমকে নিয়ে সায়নের খোঁজ করতেই জানা গেল,

শুদ্ধর গোপন ল্যাবের সন্ধান পেয়েছে ইগরের লোক। তবে কোনোভাবেই ভেতরে ঢুকতে পারছে না। বার বার ভুল পাস দেওয়াতে সেটা লক হয়ে গেছে। সারারাত ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করছে লক ভাঙার। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু কোনোভাবে যদি ওরা ভিতরে ঢুকতে পারে তাহলে শুদ্ধর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল ইগর বিনাবাধায় হাতিয়ে নেবে। যেখানে লাখ নয় হাজার কোটি টাকা চলে আসবে হাতের মুঠোয়। ইগর যে এটার উদ্দেশ্যে
আবার দেশে ফিরেছে বুঝতে বাকি নেই। তাছাড়া ঐশ্বর্যও আছে যে ওই ল্যাবে। ইগর যে পরিমানের রেগে আছে ঐশ্বর্য হাতের কাছে পেলে শ্বাস আঁটকে মেরে ফেলবে। কিন্তু থামাতে হবে,,যেকোনো মূল্যে থামাতে হবে।
এখবর শুনে স্বর্ণ লাগাতার ফোন দিতে থাকল সায়নকে। কিন্তু সায়ন বা রুবাব কেউ কল ধরছে না। একনাগাড়ে কল দিতে দিতে একপর্যায়ে কল রিসিভ করল সায়ন। বলল,

-‘এদিকে আসা লাগবে না, বাড়ি যা। আমার ভাইয়ের সম্পদ রক্ষা করার
জন্য আমিই যথেষ্ট।’
-‘রুবাব ভাই কোথায়?’
-‘রুবাব, শুদ্ধর বাকি ফ্রেন্ডরা সবাই এখানেই আছে।’
-‘থেকে করছে টা কি?’
-‘তোর বাপের বাসর সাজাচ্ছে।’
-(……)’
একথা শুনে স্বর্ণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এ ছেলে আদৌ শুধরাবে না বোধহয়।
আর তার উপরে রেগে কত কথা শুনাবে এটাও অজানা নেই। এজন্য সে কথা না বাড়িয়ে বলল,

-‘ওখানে হাঙামা করে মানুষ জানিও না কাজেই সাবধান।’
-‘ আমি তো গু খাওয়া গরু বুঝি না কিছু, ফোন রাখ। ‘
একথা বলে সায়ন গজগজ করতে করতে কল কেটে দিলো। স্বর্ণ কান থেকে ফোন সরিয়ে মৃদু হাসল। এই রাগ ভাঙাতে যে কত কী সহ্য করতে হবে! তবে শারাফাত চৌধুরী সায়নকে বাড়ি থেকে বের করেছে একথাটা বাড়িতে এসে জানল সে। কষ্টও পেলেও কাউকে কিছু বলে নি। পাগলটা বাড়ির বাইরে থাকতে পারে না খুব ভালো করে জানে না। বাড়ির খাবার না খেলে অস্থির অস্থির করে। হোক ডাল-ভাত তবুও তার বাড়ি খাবারই চায়। সে যাওয়ার পর কিছু কী খেয়েছে? নাকি ওভাবেই ছুঁটে বেড়াচ্ছে?

মনে মনে এসব ভেবে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল স্বর্ণ। আজম পেছন পেছন গিয়ে স্বর্ণকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই ছুঁটল সায়নের কাছে। কারণ সায়ন তাকে কল করে পইপই করে বলেছে স্বর্ণ যেন কোনোভাবেই এদিকে না আসে। এসেও কাজের কাজ কিছু হবে না কারণ শুদ্ধর যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। ইগর হাতভর্তি করে লুটে নিয়েছে শুদ্ধর সব পরিশ্রমের ফল।
আরেকটা দুঃখজনক ব্যাপার, ঠিক সময় পৌঁছালেও কেউ ঐশ্বর্যকে সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করতে পারে নি। ঐশ্বর্যের শরীরে একপাশ ঝলসে গেছে
এসিড জাতীয় কিছুতে। বেচারি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ভাইতুল্য শুদ্ধর
এক একটা আবিষ্কার রক্ষা করতে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি বরং গুরুতর আহত হয়ে আইসিউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। কিছু হবে বলা যাচ্ছে না। তার অবস্থা যেমন তেমন এখন রুবাবকে সামলানোই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটা পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে। ভালোবাসার
পীড়া যে এত যন্ত্রণাদায়ক আগে জানা ছিল না।

এদিকে চৌধুরী নিবাসে যা অবস্থা এখন এসব কথা কাকে বলবে? বরং শুনলে সব আরো ভেঙে পড়বে। আরেকদিকে শুদ্ধ কি করছে, পেয়েছে কী না, সেসব ভাবলে ওর মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কোনদিকে যাবে? শুরুতেই শুদ্ধকে একা ছাড়তে চায় নি সে। কিন্তু শুদ্ধ বারণ শোনে নি তাকে বাড়ির দিকে নজর রাখতে বলে একাই বেরিয়ে পড়েছে। তবে এখন স্বর্ণকে বলামাত্রই চলে আসত ঠিকই কিন্তু বাড়ির মানুষকে সামলানোর জন্য কাউকে দরকার।
এজন্যই সে ঘটনা গোপন রাখল।

কিন্তু সব ঘটনা কি চাইলে গোপন রাখা যায়? যায় না। বরং কিছু ঘটনা বাতাসের আগে ছুটতে শুরু করে। সায়নের ভাবনাকে চুরচুর করে সেটাই ঘটল চৌধুরী নিবাসে। ভোরের ফুটতেই শারাফাত চৌধুরীর কাছে খবর
চলে এলো। উনার পরিচিত এক বিজনেস ম্যান সায়নকে ভোর থেকেই
হসপিটালে ছুটাছুটি করতে দেখে এই খবরটা উনাকে জানালেন।হতবাক
হয়ে শুনে উনি ভেবেই বসলেন শীতলের কিছু একটা হয়ে গেছে। যদি না হয় তাহলে রুবাব এভাবে কাঁদবে কেন?বোনরা তো ভাইয়াদের কলিজা।
উনাকে এভাবে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সিঁতারা জায়নামাজটা গুছিয়ে উঠিয়ে রাখলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন,

-‘কি হয়েছে? কোনো খবর পেলে?’
-‘ হসপিটালের যেতে হবে সিঁতারা দ্রুত চলো।’
-‘ হসপিটালে? কেন?’
-‘আমাদের শীতলটা বোধহয় ভালো নেই, চলো, কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট কোরো না। মেজো বউ, ছোটো বউকে ডাকো দ্রুত।’
একথা বলে উনি গাড়ির চাবি নিয়ে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলেন। সিঁতারা হাক ছেড়ে বাকিদের ডাকতে ডাকতে কেঁদেই ফেললেন। উনার কান্নার আওয়াজে বাকিরা ছুটে এসে উপস্থিত হলো ড্রয়িংরুমে।সারারাত জেগে
থাকা ছোটোরা কিছুক্ষণ আগে শুয়েছিল। শুয়ে থাকতে থাকতে চোখটা কেবল বুজে এসেছিল। হঠাৎ কান্নার শব্দে ছুটে এসে বিষ্ময় নিয়ে দেখল বড় মা কাঁদছে। সিতারা, সিমিন নামাজ-কোরআন পড়ে হিজাব খোলার সময় পান নি। উনারা ছুটে এসে দাঁড়াতেই শারাফাত চৌধুরী তাড়া দিলো গাড়িতে গিয়ে বসতে। শখকে বললেন সাম্য- সৃজনের খেয়াল রাখতে।

শীতলের কিছু হয়েছে ভেবে কাউকেই বাড়িতে রাখা গেল না। বাড়িতে থাকার কথা বলতেই তারা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সকলে। অগত্যা
উনাদের সবাইকে নিয়ে ছুটলেন হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

সিক্রেট ডোন, চট্টগ্রাম।
শুদ্ধ শীতলের দিকে যেতে গিয়েও থামল দেখে ইয়াসির তাকে উস্কাতে লাগল। এমন এমন কথা বলল যে শুদ্ধর রাগের পারদ বাড়ল। ইয়াসির যদিও এটাই চাইছিল। কারণ উস্কালেই শুদ্ধ হয় তাকে মারতে আসবে নয়তো শীতলকে উদ্ধার করতে এগিয়ে যাবে। যেটাই করুক তারে পা দিলেই বিনাবাক্যে পথের কাঁটা দূর হয়ে যাবে। এজন্যই তো পালানোর মতো বোকামি করল না সে। ঠান্ডা মাথায় যদি পথের কাঁটা সরানো যায়
তাহলে শুধু শুধু এনার্জি লস করার মানেই হয় না। একথা ভেবে ইয়াসির উঠে দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
-‘কি চৌধুরী ভয় পাচ্ছিস নাকি?’
-‘কাকে? তোর মতো ভেড়াকে?’
-‘ আমি ভেড়া?’
-‘ সম্বোধন পছন্দ হলো না? গাধা কিংবা গর্তে লুকানো ইঁদুর বললে খুশি হতি?’

– তা এই ইঁদুরের গর্ত থেকে জীবিত বেঁচে দেখা দেখি? যদি পারিস মেনে নেবো চৌধুরীদের রক্তে দম আছে আর যদি না পারিস তাহলে আজকে তোরই সামনে তোরই শীতলের ভার্জিনিটি পরীক্ষা করব।’
একথা ইয়াসিরের বলতে দেরি কিন্তু শুদ্ধর এক লাফে তার ক্রস করতে সময় লাগে নি। চোখের পলকেই সে ইয়াসিরের বুক বরাবর লাথি বসিয়ে দিয়েছে। শক্ত পোক্ত এক লাথিতে ইয়াসির কয়েক পা পিছিয়েও গেছে।
শুদ্ধ তাকে সময় দিলো না বরং হিংস্র সিংহের ন্যায় তেড়ে গিয়ে যে মুখে শীতলকে নিয়ে নোংরা কথা বলেছে, সেই মুখটাই পিস্তলের গোড়া দিয়ে থেতলে দিতে থাকল। সেকেন্ডের মধ্যেই লাল রক্তে রক্তারক্তি হয়ে গেল।
শুদ্ধর শক্ত হাতের প্যাঁচে ইয়াসির এমনভাবে আঁটকে পড়ল যে নিজেকে ছাড়াতে হাঁসফাঁশ করতে লাগল ইয়াসির। শুদ্ধর শরীরেও যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে। সে বেশ কায়দা করে পিস্তলের হাতা দিয়ে বুক বরাবর
বারি মারতেই ইয়াসির মেঝেতে ছিঁটকে পড়ল।এক গড়ন দিয়ে শীতলের
কাছে গিয়ে কাশতে কাশতে রক্তমাখা থুতু ছুঁড়ে ইয়াসির তাকাল শুদ্ধর দিকে। হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁটর রক্ত মুছে আচমকা ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো শীতলের কপালে। এ দৃশ্য যেন শুদ্ধকে উন্মাদ করে দিলো। ভেতরে থাকা আরেক সত্তা যেন আজ মুহূর্তেই বেরিয়ে এলো। সে ক্ষিপ্ত গতিতে এগিয়ে গিয়ে কপালে পিস্তলের নল ঠেঁকিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,

-‘কালিমা পড়।’
ইয়াসির হাসল। রক্তমাখা দাঁতে বিশ্রী সেই হাসি। তবে কালিমা পড়া তো দূরে সে ঘাড় ঘুরিয়ে শীতলের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর থেমে থেমে বলল,
-‘তোমার বোন আমার মোহ আর তুমি আমার রন্ধে পৌঁছানো আসক্তি।
কসম করে বলছি, তোমার প্রতি আমার অনুভূতি অন্যরকম। বাবুই,তুমি তোমার শুদ্ধ ভাইকে ফিরে যেতে বলো। থেকে যাও আমার কাছে। আমি শুধরে নেবো নিজেকে। তুমি যেমন বলবে আমি সেভাবে নিজেকে চেঞ্জ করব। বিনিময়ে তুমি আমার হয়ে যাও,,আমার কাছে থেকে যাও,প্লিজ।’
একথা বলে একটু থেকে পুনরায় থুথু ফেলে বলল,

-‘ আজ যদি মারা যাই তাহলে বেঁচে গেলা আর কোনো ভাবে যদি আমি প্রাণ বেঁচে যাই তাহলে তুমি-আমি আমরা আবার মুখোমুখি হবো। এবার ঘুটকো ঝামেলা আমাদের মাঝে আসার সুযোগ পাবে না, মিলিয়ে নিও।’
একথা বলে শুদ্ধর বন্দুকের নলে চুমু খেতেই শুদ্ধও ট্রিগার চাপার আগে
হুড়মুড় করে একদল ছেলে উপস্থিত হলো। এসেই শুদ্ধকে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করল। শীতল কাটা মুরগির মতো ছটফট করলে ইয়াসির শীতলের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল,
-‘এভাবে কাঁদে না পাখি। ও মরে যাচ্ছে, যাক। আমি তো আছি। আমি ভালোবাসব তোমার।’
কোনো কথা শোনার অবস্থায় নেই শীতল। গগন বিদারী চিৎকার করে তার একটা কথায় বলে যাচ্ছে বারবার,
-‘ আপনারা থামুন না! মারছেন কেন ওকে? শুদ্ধ ভা..ই?”

একথা বলে শীতল ইয়াসিরকে ধাক্কা মেরে শুদ্ধর কাছে ছুটে গেলেও শুদ্ধকে ছুঁতেও পারল না। তার আগেই ইয়াসির তাকে ধরে বাহুডোরে আগলে নিলো। শীতলের ভেজা চোখ মুছে দিয়ে বেশ আদুরে সুরে কথা কান্না থামাতে বলল। ততক্ষণে হাসান আর শুদ্ধর মারতে মারতে শুইয়ে ফেলেছে ছেলেগুলো। হঠাৎই সেখানে বিকট শব্দে বিষ্ফোরণ ঘটতেই সকলে ছিঁটকে দূরে গেল। একের পর এক বিষ্ফোরণ হতেই ইয়াসির দ্রুত সকালকে বেরিয়ে যেতে বলে নিজেও শীতলকে কাঁধে তুলে নিলো। কিন্তু কয়েক পা এগোতেই শুদ্ধ এক পা বাড়াতেই ইয়াসির হোঁচট খেয়ে তাল হারিয়ে পড়তে পড়তেই বেঁচে গেল। শুদ্ধ অপেক্ষা না করে ইয়াসিরের বাঁ পায়ে শুঁট করে দিল। ইয়াসিরের ব্যথাতুর কন্ঠে শুনে একটু দূরে এগোনো ছেলেগুলো ফিরে আসার আগেই তার কপালে পিস্তল ধরল শুদ্ধ।

হাসান নিজেও উঠে দাঁড়িয়েছে। ইয়াসির আঁটকে গেছে দেখে বুরাক ছেলেদের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকে আড়াল করে শুট করল শুদ্ধর বুক বরাবর। শুরু থেকেই হাসান খেয়াল করছিল বুরাককে। এখন তার হাতে পিস্তল দেখে চিৎকার করতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শীতল। তার টার্গেট বুঝে হাসান আর শীতল দুজনেই তড়িৎ শুদ্ধকে এক ধাক্কা দিয়ে সরাল ঠিকই। কিন্তু গুলি বিঁধল শীতলের বাহুতে। এবং নিজেকে সামলে না নিতেই ভুলক্রমে পা দিলো বসল কারেন্টের তারে। সেকেন্ডের মধ্যেই কারেক্ট শকে শরীর কেঁপে উঠল শীতলের শরীর। শুদ্ধ তার দিকে যেতে গেলে হাসান শুদ্ধকে সরিয়ে দিলো। চিৎকার করে বলল শীতলকে এখন না ধরতে। কিন্তু শুদ্ধ শুনলে তো? সে আবার ছুটে যেতে গেলে হাসান শুদ্ধকে পেছনে থেকে শক্ত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-‘থাম ভাই, থাম। ওকে ধরিস না তুইও মরে যাবি। সুইচ খোঁজ।’
শুদ্ধর নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইয়াসির খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে সুইচ অফ করে দিলো। শীতল ধপ করে পড়ল মেঝেতে। হাসান কোনোভাবেই শুদ্ধকে ধরে রাখতে পারছে না। চিৎকার করে শুদ্ধ তাকে ছাড়তে বলছে। একপর্যায়ে শুদ্ধ হাসানকে ধাক্কা মেরেই দৌড়ে গেল শীতলের কাছে। মাথাটা তুলে নিলো নিজের কোলে। গাল চাপড়ে ডাকতে থাকল করুন সূরে। কিন্তু ততক্ষণে শীতলের চোখ বুঝে গেছে। শক্ত মেঝেতে আছড়ে পড়ে কপালে সবুজ কালশিটে পড়ে গেছে।
সে আবার ডাকল,
-‘এ্যাই..এ্যাই উঠ না,,শীতল,,এ্যাই শীতল? আমি ডাকছি তো নাকি!’
-‘(…..)’
-‘খবরদার বলছি অঙ্গান হওয়ার ভান করবি না। খুব মারব কিন্তু। ‘
একথা বলে হঠাৎ খেয়াল করল শীতল শ্বাস নিচ্ছে না। দু হাত দিয়ে বুকে চাপ দিলেও কাজ হলো না। এবার মাউট-টু মাউট রেসপিরেশন করল।
আবার ডাকল,

-‘শী…তল.. এ্যাই শীতল,..দেখ না আমি এসেছি। চোখ খোল। তাকা আমার দিকে,,,তাকা। আমার ‘আমিটাকে’ কেড়ে নিয়ে এখন আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পায়তারা করছিস তুই? কেন, আমাকে জ্বালানোর শখ মিটে গেছে? এত তাড়াতাড়ি? তুই না বলেছিলি আমার বউ হবি? আমার সঙ্গে তোর স্বপ্নের দেশ নরওয়েতে যাবি। আমার হাত ধরে গোলাপি রঙা আকাশ দেখবি। আমি এসেছি তো, তাকা, প্লিজ একবার তো তাকা!
ভেজা কন্ঠে একথা বলে শুদ্ধ থামল। জোরে জোরে ক’বার শ্বাস নিয়ে এই প্রথমবার স্বেচ্ছায় শীতলের কপালে খুব যত্ন করে আদর এঁকে দিলো। এটা করতে গিয়ে তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে কয়েক ফোঁটা অশ্র ঝরে পড়ল অবচেতন শীতলের গালে। কত যত্নে হাত বুলাল গলগল করে রক্ত বের হওয়া শীতলের বাহুতে। কাঁপা কাঁপা হাতে সে সেখানে রুমাল বাঁধল। তারপর শীতলকে কোলে তুলে বিরবির করে বলল,

-‘তোর মৃত শরীরের ভার বহন করার শক্তি কী আমার আছে বল? নেই তো। একদমই নেই। খবরদার মরার পায়তার করবি না। যদি করিসও, তবে জেনে রাখ তোর কবরের পাশের কবরটা হবে তোর বিশুদ্ধ পুরুষের।’
একথা বলে টালমাটাল পায়ে শীতলকে নিয়ে সে বেরিয়ে এলো। হাসান
নিজেও বেরিয়ে এলো শুদ্ধর পেছন পেছন। এঞ্জেলিকা উড়ে এসে বসল শুদ্ধর কাঁধে। শব্দ করে ডাকতে লাগল শীতলকে। তার ডাকে সাড়া না দিলে উড়ে গিয়ে বসল শীতলের পেটের উপর। হাতে দুটো ঠোঁকর দিয়ে
বোঝাল তাকে একটু আদর করতে। কিন্তু শীতল কি আর সেই অবস্থায় আছে? অতঃপর তারা গাড়িতে ছুটল আশেপাশের হসপিটালে। বিপদের দিনে নাকি বিপদ না এলে বিপদ মানায় না।

ছোটো খাটো হসপিটালের যা সন্ধান পেয়েছিল সেখানে নাকি ডাক্তার থাকে না। এখনো নেই। নার্স গুলো যেন ভিআইপি কোনো পারসন। তাদের কিছু বললে গুরুত্ব তো দিলোই না মুখ বাঁকিয়ে ফোন টিপায় মনোযোগ দিলো। অন্যসময় হলে
এদের সাইজ করে তবেই শুদ্ধর বের হতো। কিন্তু হাতে সময় নেই দেখে হাসান জেট হসপিটালের মাঠে আনার ব্যবস্থা করল। জেটের চালাকও আশেপাশে থাকায় দ্রুত চলে এলে তারা উড়াল দিলো ঢাকার পথে ধরে। এইটুকু সময়ে শুদ্ধ শীতলকে এমন ভাবে তার বাহুডোরে আগলে রাখল যেন ছাড়লে সে হারিয়ে যাবে। অতঃপর তারা ঢাকায় নিজস্ব হসপিটালে
পৌঁছাতেই ডাক্তার নার্সরা ছুঁটে এলো। স্টেচারে শীতলকে শুঁইয়ে ছুটে গেল ওটিরুমে। বন্ধ ওটির রুমে দরজার দিকে একবার তাকিয়ে তাকাল নিজের রক্তার হাতের দিকে। তারপর বিরবির করে বলল,

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৪

-‘ আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পায়তারা করবি না। ভুলেও না। আমি কিন্তু এসব ফাজলামি মোটেও বরদাস্ত করব না। কেননা, আমার এই জীবন ভাজা ভাজা করার জন্য হলেও তোকে প্রয়োজন। আমার অশান্ত বুকটা শান্ত করতে তোর কুৎসিত মুখের হাসিটুকু প্রয়োজন। যদি এর বিপরীত কিছুও ঘটে, তবে আমি আমার জীবনের মায়া করব না। একটুও করব না। বিশ্বাস না হলে ফাঁকি দিয়ে মিলিয়ে নিস তোর অনুপস্থিতিতে শুদ্ধর
কোনো অস্তিত্ব পৃথিবীতে থাকে কী না! আমি রাখি কী না। আমি মুখে বলেছি ভালোবাসি না, বাসবোও না, তবে ছেড়ে থাকার কথা একবারও বলি নি। বলবোই বা কিভাবে…ছেড়ে থাকতে পারলে তো!’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৬