শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬২
নূরজাহান আক্তার আলো
ড্যানিয়েল হ্যাডসন এবং তার স্ত্রী অলিভার হ্যাডসন কানাডার নামকরা সায়েন্টিস্ট। দিনের পর দিন নিজেদের মেধা খাটিয়ে সাফল্য অর্জন করে নামডাক কামিয়েছেন বিশ্বজুড়ে। উনাদের মেয়ে এলিসা হ্যাডসন ছিলেন কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট বা রোবোটিক্স গবেষক। স্বামী-স্ত্রী আর একমাত্র কন্যা নিয়ে ছিল ছোট্ট একটি সুখের পরিবার। এলিসা ছোটো থেকে বেশ মেধাবী। বাবা-মায়ের তৈরি করা আবিষ্কার মানবকল্যানে আর্শিবাদ হয়ে
কাজে লাগছে দেখে সেও ভাবত সায়েন্টিস্ট হবে। নিত্য নতুন রোবোটিক্স
জিনিস আবিষ্কার করবে। এমন জিনিস আবিষ্কার করবে যেটা মানুষের কাজে লাগে৷ বোরট যে কতটা চমকপ্রদ হতে পারে সে দেখাবে। এরপর
নিজের মধ্যে অদম্য এক জেদ পুষে সে দীর্ঘদিন নিজের শ্রম এবং মেধা কাজে লাগিয়ে সে একটি রোবোটিক্স পিজন (পায়রা) আবিষ্কার করে।
বর্তমান যুগে বিজ্ঞান প্রযুক্তি যে এত উন্নতি তাদের কাজ দেখে বোঝার উপায় নেই। সে একটু একটু করে পায়রাটাকে মনের মতো করে গড়ে তোলে। তার চালচলন, সৌন্দর্য, ডানা ঝাপটানো এসব কিছু নকল কিন্তু সেটা দেখে বোঝার উপায় নেই। অথচ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে শতশত
জীবন্ত পায়রা মাঝে তাকে ছেড়ে দেওয়া হলে তখন বোঝার সাধ্য থাকত না; কোনটা আসল আর কোনটা রোবোটিক্স। তাকে আরো নিঁখুতভাবে
প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এলিসা রাত-দিন এক করে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেতো। যতদিন যেতো তার মাথায় নান্দনিক কিছু ধারণা আসত। একে একে পায়রার মাঝে Gps, সেন্সর, ক্যামেরা, মাইক্রো-প্রসেসরসহ আরো নানান প্রযুক্তি এড করেছিল। কিন্তু এলিসার কষ্টের আবিষ্কার নিঁখুতরুপ দেওয়ার আগেই সেটা চুরি হয়ে যায়। কিভাবে যে চুরি হয় এত আশ্চর্যের ব্যাপার।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এবং কাজটা করে তার মামা। এতদিনের এত শ্রম বৃর্থা যাওয়ায় এলিসা হতাশ হয়ে ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকে। ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে কিছুদিন কাজ থেকে বিরতি নেয় কিন্তু মনের শান্তি কোথায় যেন হারিয়ে ফেলে। মাসের পর মাস কেটে যায় কিন্তু কাজে ফিরতে পারে না। একটা সময় নিজের উপরে অনীহা সৃষ্টি হয়। নিজেকে ব্যর্থ, অপ্রয়োজনীয় কিছু মনে হতে থাকে, সুখের ভরা পৃথিবীটা তার কাছে অসহ্য লাগে। ডিপ্রেশন
জটিল রোগ হয়ে বাসা থাকে তার মন ও মস্তিষ্কে। ড্যানিয়ে অলিভার খুব চেষ্টা করেন মেয়েকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু তা সম্ভব হয় না বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে সুইসাইড করে এলিসা। ঘুন যেমন কাঠকে কুরে কুরে খায় তেমনি ডিপ্রেশন জলজ্যান্ত মানুষকে ধীরে ধীরে শেষ করে ফেলে। হ্যাঁ,এলিসার জন্য উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলেও সেটা কাজে লাগে নি।
কারণ রোগ তখনভালো হয় যখন রোগী চায় সুস্থ হতে। মনোবল শক্তি বাড়ালে। কিন্তু এলিসা প্রেমে ধোঁকা এবং আবিষ্কার হারিয়ে নিজের মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল যার ফলে তার পরিনতি এত করুণ হলো। এদিকে একমাত্র ভাগ্নীর মারা যাওয়ায় ওর মামাও অনুতপ্ত হলো। ইগর নামের এক সায়েন্টিস্টের কাছে বেচে দেওয়া পিজন আবার
ফিরিয়ে আনতে গেল। কিন্তু ইগর দেয় না বরং টাকার লোভ দেখায়। না মানলে প্রাণে মারার হুমকি দেয়।হতাশ হয়ে ফিরে আসে এলিসার মামা।
পরে ইগর পিজনটাকে খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে থাকে। এবং এর কিছুদিন পর এই ঘটনার কথা ড্যানিয়েলও জানতে পারেন। মেয়ের শেষ
আবিষ্কার নিজের কাছে রাখতে উনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। প্রশাসন এবং আরো নানানভাবে ইগরের থেকে সেটা নিজের আয়ত্তে নেন। মেয়ে মারা যাওয়ার পর উনারা স্বামী-স্ত্রী ভাবেন অবসর গ্রহন করবেন। যে কয়দিন আছেন বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করবেন। সেভাবেই একের পর এক দেশ ঘুরে বেড়ান উনারা। পরে পরিচিত এক সায়েন্টিস্টের আমন্ত্রণে তারা বিডিতে আসেন। মান্য-গন্য, ব্যাক্তিবর্গদের নিয়ে একটা পার্টির আয়োজনও করা হয়। সেই পার্টিতেই উনি পরিচয় হয় শুদ্ধর সাথে। শুদ্ধর শিক্ষক রেহমান হক বিশেষ ভাবে শুদ্ধকে পরিচয় করিয়ে দেন জ্যানিয়েল-এর সঙ্গে। খুব পছন্দ করেন শোয়াইব নামের ছেলেটাকে। বিশেষ করে ছেলেটার কথা বলার ধাঁচ, হাই-পারসোনালিটি, উপস্থিত বুদ্ধি দেখে তার প্রতি আলাদা ভাবে নজর পড়ে। অলিভারও পছন্দ হয় স্বল্প পরিচয়ে পরিচিত বাঙালি ছেলেটাকে। এর কিছুদিন পর রেহমান হকের কাছে পুনরায় শুদ্ধর সঙ্গে দেখা হয় উনাদের। তখন শুদ্ধ একটা কাজ করছিল এবং যেটা করছিল ভুল করছিল। ড্যানিয়েল আর অলিভার অদূরে বসে দেখছিল ছেলেটার ধৈর্য্য। চাইলে শুরুতে উনারা ভুল সংশোধন করে দিতে পারতেন কিন্তু তা ইচ্ছে করে করেন নি।
কারণ উনারা শুদ্ধর ধৈর্য্য দেখতে চেয়েছিলেন। যেটা এই পেশায় প্রধান হাতিয়ার। একের পর প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েও শুদ্ধ যখন আটবারের বেলায় একই ভুল করতে যাচ্ছিল তখন উনারা নিজেই উঠে গিয়ে শুদ্ধর ভুল শুধরে দেয়। হাতে ধরে শিখিয়েও দেন সঠিক পন্থা।
এরপর থেকে কারণেঅকারণে শুদ্ধকে নিজেদের কাছে ডাকতে উনারা।
ভালো-মন্দ পরামর্শ দিতেন, কাজের ব্যাপারে বেশ উৎসাহিত করতেন। একপর্যায়ে উনাদের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বেশ কিছুদিন পর অলিভার অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রথমে ভেবেছিলেন ওয়েদার খাপ খাচ্ছে না তাই ফিরে গিয়েছিলেন আপন দেশে। সেখানে গিয়ে অসুস্থতা আরো বেড়ে যায় এবং হসপিটালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বলা বাহুল্য, দীর্ঘদিন এক জটিল রোগে ভুগছিলেন তিনি। মাস ছয়েক পর, ড্যানিয়েল পুনরায়
বাংলাদেশে ফিরে আসে। রেহমান হককে জানান উনি শিক্ষক হয়ে যারা নতুন তাদের কাজ শেখাতে চান। আগে পিছে সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে। তবে মরার আগে যদি নিজের শিক্ষা কাউকে বিলাতে পারে তাহলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হবে। এতদিন অনেক কিছু করেছিলেন, অনেক টাকা কামিয়েছেন কিন্তু এ বয়সে এসে মনে হয়েছে সেসব বৃর্থা।
অতঃপর শিক্ষকপদে নিয়োজিত থাকেন এবং কাজের বিনিময়ে তিনি রেহমান হকের থেকে কোনো অর্থ গ্রহন করতেন না। উল্টে নিজের অর্থ দান সদকার কাজে লাগাতেন। বলা বাহুল্য,যতকিছুই করুক উনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকত শুদ্ধর উপরে। হাতে ধরে যেমন কাজ শেখাতেন তেমনি ভুল করলে পানিশমেন্টও দিতেন। পানিশমেন্ট হতো অন্য ধরনের। উনি ভুল ফমূর্লা দিয়ে শুদ্ধকে টাক্স পূরণ করতে বলতেন। প্রথম প্রথম ভুল ফমূর্লা দিয়ে বারবার চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারত না শুদ্ধ। পরে উনার এই চালাকি ধরে ফেলে তারপর নিজেও চালাকি করে সঠিক ফমূর্লা সঠিক ফমূর্লা খুঁজে বের করে। ড্যানিয়েল মনে মনে ভীষণ খুশি হয় শুদ্ধর প্রতি।
একাজটাও করতেন শুদ্ধ ধৈর্য্য আর বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করতে। একদিন আচমকা শুদ্ধকে নিজের ফ্ল্যাটে ডেকে নিজের পাশে বসায়।
মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এলিসার তৈরা করা সেই পায়রা শুদ্ধর হাতে তুলে দেন। খুলে বলে পুরো ঘটনা। শুদ্ধ ফিরিয়ে দিলে উনি জানান খুশি মনেই উপহারস্বরুপ দিচ্ছেন। তবে শর্ত একটাই এই পায়রা যেন ভালো কাজে ব্যবহার করা হয় এবং পায়রার কথা যেন গোপন থাকে। এরপর একদিন ড্যানিয়েলের কানাডিয়ান বন্ধু মারা যাওয়ার খবর শুনে উনিও কানাডা ফিরে বাংলাদেশে আর ফিরে আসেন নি। পরে উনার খোঁজ নিতে শুদ্ধ ও তার ফ্রেন্ডরা কানাডা গিয়ে জানতে পারে উনি খুন কারো হাতে খুন হয়েছেন। সেই কেউ টা হচ্ছে ইগর। ইগরের খোঁজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় ঐশ্বর্যের সাথে। এরপর থেকে সেই পায়রা শুদ্ধর কাছে আছে। বরং এলিসার অসমাপ্ত কাজ সেই একটু একটু করে সম্পূর্ণ করে। এবং তার নাম রেখেছে, ‘এঞ্জেলিকা।’ তবে এঞ্জেলিকাকে কখনো একটা ছাড়া হয় না। তার সঙ্গী হিসেবে রাখা হয় জীবন্ত আরেকটা সাদা পায়রাকে।
আর একের নাম এঞ্জে আর আরেকজনের নাম লিকা দুটোকে একসাথে নাম ধরে ডাকে, ‘ এঞ্জেলিকা’ যাতে কারো বিশেষ নজরে না পড়ে। শীতলকে খুঁজতেও এদের ব্যবহার করেছিল শুদ্ধ। শুদ্ধ যখন নাম ধরে ডেকেছিল তখন ফিরে এসে হাতে মাথা রেখে আদর চাচ্ছিল জীবন্ত কবুতর এঞ্জেল আর ড্রোনের মাধ্যমে উঁচু স্থান থেকে সব তথ্য পাঠাচ্ছিল লিকা অর্থাৎ এলিসার সেই রোবোটিকস পিজন। কথা হচ্ছে, সেদিনও দুটো পায়রাকে
সঙ্গে এনে একসাথে ছাড়া হয়েছিল তবে এঞ্জেল ডাক শুনে ফিরে এলেও লিকা কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। এবংওরা ইয়াসিরের সিক্রেট ডোনে প্রবেশ করার আগে জেটে থাকা ওর বিশ্বস্ত লোকের কাছে রেখে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার আদেশ করেছিল।
শুদ্ধ কথা শেষ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শীতলের দিকে। শীতল কাঁধে মাথা রেখে এক বাহু জড়িয়ে ধরে রুমের সঙ্গে লাগোয়া ল্যাবের সিঙ্গেল বেডের উপর বসে আছে। শাড়ি পরিহিত চঞ্চল ব্যাঙাচি তাকে জ্বালাতেই যে উপস্থিত সেটা বুঝতে বাকি নেই। সেজেছোও একদম মনমতো করে। স্বেচ্ছায় যখন এসেছে তাকে আর যেতে দেয় নি বরং শীতলকে এখানে এনেছে। ঘুরে দেখিয়েছেও পুরো ল্যাব। শীতল বিষ্ময় নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখেছে ল্যাবটি। সাদা ইঁদুর দেখে কয়েকটা চেয়েছে। শুদ্ধ কিছু বলে নি দুই পকেটে হাত গুঁজে শীতলের কৌতূহলী মুখটা অপলক চোখে দেখে গেছে। শীতল ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে একটা পায়রা দেখে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে,
-‘এটা কি শুদ্ধ ভাই?’
তার এ প্রশ্নে শুদ্ধ ল্যাবের এক সাইডে থাকা সিঙ্গেল বেডে বসলে শীতল পাশে এসে বসে। পুনরায় জানতে চায়। তখন উক্ত ঘটনাটি জানায় শুদ্ধ। সব শুনে শীতল কথা হারিয়ে চুপ হয়ে যায়। তার কেন জানি ভীষণ কান্না পাচ্ছে। নিজেকে এলিসার জায়গায় দাঁড় করালে কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছে। সচারাচর সে কখনো যদি শখের বশে কোনো কাজও করে খুশি মনে সবাইকে দেখিয়ে বেড়ায়। বার বার জিজ্ঞাসা করে, ‘ কেমন হয়েছো, বলো, বলো?’ সামান্য কিছু রান্না করলে নাচতে নাচতে সবাইকেখাওয়ার
তাগাদা দেয়। যতই লবণে পোড়া হোক বাবা-চাচ্চু কিংবা ভাইরা কখনো কিছু বলে না। বললে কষ্ট পাবে। তখন সাহস করে রান্নাঘরেও আর যাবে না ভেবে। কিন্তু যখন নিজের রান্না নিজেই খেয়ে বুঝে খাওয়ার অযোগ্য তখন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদে। মনে মনে একপ্রকার জেদ চাপে পরেরবার সে ভালো করবেই! এত ভালো করবে যে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে। তার মনে যদি রান্না নিয়ে এমন জেদ চাপে তাহলে এলিসার মনে কেন চাপল না? সে কেন পুনরায় নতুন করে চেষ্টা করল না?সে চাইলে অবশ্য পারত।
তার পিজন চুরি হয়েছিল কিন্তু কেউ তো তার মেধা চুরি করতে পারেনি, তাহলে? আসলে একদিকে কষ্টের ফল আরেকদিকে ভালোবাসা নামক ছলনা। সব মিলিয়ে হাসি-খুশি মেধাবী মেয়েটাও হাল ছেড়ে দিলো। মৃত্যু নামক সত্যকে গ্রহন করে চিরতরে বিদায় নিয়ে নিলো। শীতল মনে মনে এলিসাকে নিয়ে নানান কথা ভাবল। ভাবল এলিসার বাবা-মাকে নিয়ে।
তারপর হঠাৎ বলে বসল,
-‘এলিসার বাবা-মা আপনাকে খুব পছন্দ করত তাই না?’
-‘হুম।’
-‘এলিসা বেঁচে থাকলে উনারা বিয়ের প্রস্তাব দিতো। আচ্ছা আপনি কি তখন ওকে বিয়ে করতেন? বিয়ে করলে আমার কি হতো শুদ্ধ ভাই?’
শুদ্ধ বিরক্ত মুখে তাকাল শীতলের দিকে। শীতল জবাবের অপেক্ষায় না থেকে পুনরায় তাড়া দিয়ে বলল,
-‘ কি হলো বলুন? এখন কথা বলছেন না কেন শুনি?’
-‘ হাজবেন্ডের মুখে অন্য কোনো মেধাবী মেয়ের কথা শুনে খারাপ লাগা স্বাভাবিক মানলাম। বাট সেই মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আগ বাড়িয়ে যা তা ভেবে পায়ের সঙ্গে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার পায়তারা করা মোটেও সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারে না।’
-‘তারমানে আমি অসুস্থ? ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমাকে পাগল বললেন?’
-‘শুধু তুই না তোর চৌদ্দ গুষ্টি পাগল।’
-‘ঠিক আছে থাকতে হবে না পাগলের সাথে এক্ষুণি চলে যাব আমি।’
একথা বলে শীতল উঠতে গেলে শুদ্ধ আচমকা আঁচল টেনে ধরে তাকে হেঁচকা টানে কাছে এনে বেডে ফেলল। ঠোঁটে ফিচেল হাসি এঁটে শরীরের সবটুকু ভর ছেড়ে দিলো শীতলের দেহের উপর। শীতল হাঁশফাঁশ করলে শুদ্ধ বলল,
-‘কথা শেষ হয় নি আমার।’
-‘সব শুনব তো আগে সরুন না,,ওমা গো কত ভারি। জলহস্তী একটা।’
শুদ্ধ সেকথা পাত্তা দিলো না। বরং মুখটা নামাতে যাবে শীতল আচমকা
ঠোঁটের উপর হাত রেখে আরেক হাতে শুদ্ধর বুকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর বৃথা চেষ্টা করল। মুখটা কিঞ্চিৎ অন্যদিকে ঘুরিয়ে লাজুক কন্ঠে বলল,
-‘এমন করলে আর আসব না কিন্তু।’
একথা শুনে শুদ্ধ থেমে গেল। থমথমে মুখে সরে গিয়ে উঠে বসে বলল,
-‘নিজের রুমে গিয়ে ঘুমা।’
-‘আপনি ঘুমাবেন না?’
-‘আমার সাথে তোর সাথ কি?’
শীতল বুঝল বিশুদ্ধ পুরুষটার অভিমান। গত একমাসে খেয়াল করেছে কিছু নিয়ে শুদ্ধ তার উপর বিরক্ত। তবে বিরক্তের কারণ খোলাসা করেও বলে না। আজ সেটা জানতে হবে ভেবে নিজেও উঠে বসল। শুদ্ধর মুখটা
নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
-‘কি করেছি আমি? রেগে আছেন কেন আমার উপর?’
-‘(……)’
-‘ আম..আমি কি এসবে অভ্যস্ত বলুন? একটু তো সময় দেওয়া উচিত।’
-‘(……)
-‘কি হয়েছে না বললে বুঝব কিভাবে? আমার জানামতে, আমি এই এক মাস কম দুষ্টমি করেছি। আপনাকেও কম জ্বালিয়েছি। হ্যাঁ, রুমে এসেছি তবে রুম এলোমেলো করে নি। কোনো কিছু চুরিও করি নি; চুরি করব কেন যখন রুমের মালিকটাই এখন আমার, তাই না?’
একথা শুনে শুদ্ধ তাকাল শীতলের দিকে তারপর মৃদু হেসে বলল,
-‘রুমের মালিক এখন তোর বিধায় গুরুত্ব দিস না তাই তো?’
শীতল হতবাক! এ আবার কেমন কথা? নিজে কাজের বাহানায় বাড়িতে আসে না অথচ এখন তাকে দোষ দিচ্ছে। তখন শুদ্ধ ঘুরে তার মুখোমুখি বসে বলল,
-‘ বিগত একমাস ধরে সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বের হই সারাদিন কাজে ডুবে থাকি। তোর মনে হয় না বের হওয়ার সময় আমাকে সুন্দর করে বিদায় জানানো উচিত? আমি নাস্তা সেরে ঠিকই রুমে আসি কিছুক্ষণ তোর জন্য অপেক্ষাও করি কিন্তু তুই আসিস না। আচ্ছা ধর, বের হয়ে ফিরলাম না। যদিও বা ফিরলাম দেহে প্রাণ থাকল না তখন আফসোস হবে না?’
শুদ্ধর কথা শুনে শীতলের বুক ধক করে উঠল। ছলছল চোখে তাকিয়ে ঢোক গিলল। তাকে আরেকদফা হতবাক করে দিয়ে শুদ্ধ বলল,
-‘জীবনটা খুব ছোটো শীতল। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, মনের ভেতর সুপ্ত আশা নিয়ে সংযম করে চলাটা মোটেও চারটে খানিক কথা না। আমরা জয়েন ফ্যামিলির ছেলে-মেয়ে হয়ে পাশাপাশি রুমে থেকেও সর্বদা নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে গেছি। নজর সামলে চলেছি। আমি সাধু পুরুষ নই আর না কখনো ছিলাম। তবে কঠোর সংযম ছিল বিয়েরআগে নিষিদ্ধ চাওয়ার প্রতি। কখনো চাই নি আমার স্পর্শ তোর অস্বত্বির কারণ হোক। ইচ্ছে ছিল তোর মনে আমার প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে বাড়িতে জানাতে। কিন্তু কারো জীবনচক্র তো আর মর্জিমতো চলে না, তাই না? বিপদ এসেছিল কেটে গিয়ে যেভাবেই হোক আমাদের বিয়েটা হয়েছে। সম্পর্কের বদল ঘটেছে। এবার বোধহয় আমাদের মাঝে কিছু পরিবর্তন আনা দরকার।’
শীতল প্রথমে ভেবেছিল বাঁধা দেওয়াকে শুদ্ধ রাগ করেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঘটনা অন্যকিছু। তাই সে বলল,
-‘ এত কঠিন কথা বুঝি না একটু সহজ করে বলুন না,,শুদ্ধ ভাই।’
আবারও ভাই! এই সম্বোধন শুনলে আজকাল শরীর জ্বলে যায়। ইচ্ছে করে চ্যালাকাঠ দিয়ে মেরে আধমরা করে রোদে ফেলে রাখতে। নিজেই নাচতে নাচতে বিয়ে করে আবার ভাই ডাকে, ভাই! ওর আটাশ জন্মের ভাই! সেও বুঝে পুরনো অভ্যাস পরিবর্তনে সময় লাগবে তবে শুনলেই তো মেজাজ বিগড়ে যায়। সেসব নিয়ে কিছু বলা দরকার ভেবে বলল,
-‘ প্রথমত আমাকে ভাই ডাকবি না। আগের হিসাব বাদ। বিয়ে করেছি এখন বউ হয়েছিস। কবুল বলার সঙ্গে সঙ্গে তোর সঙ্গে আমার পূর্বের
সম্পর্ক শেষ। আগে তোর দিকে তাকালেও দৃষ্টি নত করে হতো। মাথায় ঘুরত সঠিক সময়ের কথা। এখন তুই আমার জন্য হালাল। এজন্য আমি চাই তুই আমার প্রতিটা কাজ নিজে থেকে করিস। খেতে দেওয়া থেকে শুরু করে কর্মস্থলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে হাসি-মুখে ভালোবেসে বিদায় জানাস। ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরে রুমে ঢুকেই যেন তোকে দেখি। এছাড়াও আমি আর একটা রাতও একা আমার বিছানায় ঘুমাতে চায় না। অসুস্থ ছিলি এজন্য এতদিন কিছু বলি নি কিন্তু এখন তুই মোটামুটি সুস্থ।’
-‘আপনার রুমে নাহয় এলাম কিন্তু অনুষ্ঠান? অনুষ্ঠানের আগে ব্যাপারটা
খারাপ দেখায় না? না মানে আর মাত্র কয়েকদিনেরই তো ব্যাপার।’
-‘অনুষ্ঠানে কি এসে যায়? অনুষ্ঠান করে বিয়ে করলে বিয়ে হসপিটালে যেটা হলো সেটা কি ছেলেখেলা? অনুষ্ঠান হোক বা না হোক আমাদের বিয়ে নিয়ম মেনে অভিভাবককে সাক্ষী রেখে হয়েছে। তবে তুই যদি চাস অনুষ্ঠানের আগে পার্মানেন্টলি আমার রুমে না আসতে। তাহলে একটা কাজ করতে পারিস, সবাই ঘুমালে আমার রুমে আসতে পারিস আসতে হবে; কিভাবে আসবি তুই জানিস।’
একথা বলে শুদ্ধ একটু থামল। তারপর শীতলের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে চেপে রাখা কথাটা অকপটে বলল,
-‘পরশুদিন রুবাবের কাছে যাচ্ছি। আমি যাওয়ার পরেরদিনই ঐশ্বর্যের সার্জারির ডেট ফিক্সড করা হয়েছে। ফিরতে ফিরতে কয়েক সপ্তাহের ব্যাপার। তবে যাওয়ার আগে আমি চাই আমাদের মাঝে কিছু একটা হোক! আর সেটা আজই; এই মুহূর্তে।’
শুদ্ধর অকপটে বলা কথার মানে বুঝতে কষ্ট হলো না। সে থতমত খেয়ে
লাজুক মুখে মাথা নত করে নিলো। বুকের ভেতর ধুকপুক করতে লাগল।
শুদ্ধ বুঝলেও মুখে তেমন কিছু না বলল না। কারণ কেন জানি তার পেট ফেটে হাসি আসছিল। কিন্তু এখন হাসলে হবে না তাই সে আচমকা হাত বাড়িয়ে শীতলের খোলা চুলের মুঠি শক্ত করে ধরল। ধীরে ধীরে মুখটা এগিয়ে এনে খুব কাছ থেকে দেখল তার সহধর্মিণীকে। কপাল, দুচোখ, গাল, নাক, ঠোঁট আর থুতনীর ভাঁজ দেখে শিরশির করে উঠল পুরুষালি দেহ। দুই হাতের আঁজলা করে শীতলের মুখটা ধরে আদর আঁকল পুরো মুখে। তারপর ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি এঁটে বলল,
-‘ বিয়ে হয়ে গেছে অনুষ্ঠানে হলে হোক নাহলে নাই। অনুষ্ঠানের অজুহাত বাদে আর কোনো সমস্যা আছে? কি বোঝাতে চাচ্ছি বুঝতে পারছিস?’
শীতল একরাশ লজ্জায় নতজানু হয়ে না বোধহয় মাথা নাড়াল। অর্থাৎ আর কোনো সমস্যা নেই। তখন শুদ্ধ ফিচেল হেসে এক ধাক্কায় বিছানায়
তাকে শুইয়ে দিলো। তড়িৎ নিজেও গেল শীতলের খুব কাছাকাছি। বারি খেলো দু’জনের নিঃশ্বাস! চোখে চোখ রাখতে গিয়েও শীতল হার মানতে
বাধ্য হলো। শুদ্ধর চাহনি আজ অন্যরকম। স্পর্শে অবাধ্যতা। কন্ঠে স্পষ্ট
মাদকতা। শুদ্ধ ততক্ষণে তার গলায় মুখ ডুবিয়ে কয়েকটা চুমু আঁকল।
দু’একটা কামড়ও বসিয়েছে গলার নরম চামড়ায়। হাতও অবাধ্যতা শুরু করেছে। শীতল মুঁচড়ে উঠল। ছটফটিয়ে উঠল পুরুষালি দেহের নিচে থেকে ছাড়া পাওয়ার আশায়। কিন্তু সেটা তো হলোই না বরং তার দুহাত শুদ্ধ একহাতের মধ্যে নিয়ে হাল্কি স্বরে বলল,
-‘ তাহলে চল সর্বনাশের চিপাগলি থেকে ঘুরে আসি? আমার বউ থাকবে কী না সেটার হিসাব তোলা আছে। আমার এন্টিনার সমস্যা কী না তাও তো জানানো হয় নি, তাই না? আজ সব হিসাব একেবারে চুকিয়ে দেই!’
একথা বলে নিজের গায়ের টি-শার্টটা ছুঁড়ে শীতলের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। শ্বাস নিতে না পারে শীতলের ছটফটানি বেড়ে গেলে শুদ্ধ সেই মুহূর্তে ছেড়ে বলল,
-‘ এতদিন কারণে অকারণে তুই অবাধ্য হয়েছিস আমি মেনে নিয়েছি।
আজ আমার দিন; আমার সময়। আর আমি চূড়ান্ত লেভেলের অবাধ্য হবো! আবারও বলছি, অর্নথ ঘটে যাক তবুও তুই বাঁধা দিবি না। দিলেও আমি শুনব না।’
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬১
শীতল লজ্জায় চোখ-মুখ খিঁচে শুধু শুনে গেল পাজি পুরুষটার কথা। ততক্ষণে তার বুকের উপর থেকে সরে গেছে শাড়ির আঁচল। শাড়ির ঠাঁই হয়েছে মেঝেতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রপুরুষের খোলস ছেড়ে উন্মাদ হয়ে উঠেছে শীতলের বিশুদ্ধ পুরুষ। গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে আদুরে ছোঁয়া। রাত বাড়ছে। বাড়ছে সময়ের গতিও। বাইরে ঝমঝমিয়ে ঝরছে অসময়ী বৃষ্টি। শোনা যাচ্ছে মেঘের গর্জন। সঙ্গে বাঁধা বিপত্তি কাটিয়ে অবশেষে ল্যাবে মত্ত হয়েছে দুটি দেহ।