শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৭
নূরজাহান আক্তার আলো
বাড়ির মেয়েরা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলে সিরাত সায়নকে একবার দেখে এলেন। মুখ ফুটে কিছু না বললেও সিঁতারার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালেন।
ছোটো জায়ের এই অভ্যাসের কথা ভালো করে জানেন সিঁতারা চৌধুরী।
সিরাত যখনই কিছু বলতে চায় তখন এভাবে ঘুরঘুর করে। বোকা বোকা হাসে। যতক্ষণ না নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন ততক্ষণ এভাবেই চড়কির মতো ঘুরতে থাকবে। আজও তাকে পাশ ঘঁষতে দেখে সিঁতারা চৌধুরী ব্যাপারটা বুঝে এঁটো প্লেটগুলো ধুঁতে ধুঁতে বলল,
-‘কিছু বলবি মেজো?’
-‘হুম।’
-‘বল, জরুরি কিছু?’
-‘বড় ভাবি বলছিলাম যে, সায়নের একটা বিয়ে দিলে কেমন হয়? বয়স তো কম হলো না ছেলেটার। এমনও হতে পারে লজ্জায় কিছু বলে না।’
সিঁতারা চৌধুরী জা’য়ের দিকে একবার তাকিয়ে প্লেট ধুয়ে মুছে সাজিয়ে রাখলেন। তারপর ডিমগুলো ফ্রিজে রেখে বললেন,
-‘হঠাৎ একথা? ভালো কোনো মেয়ের সন্ধান পেয়েছিস?’
-‘না, না, তেমন কিছু না।’
-‘সায়ন, শুদ্ধ দু’জনই প্রাপ্ত বয়স্ক। আজকে বিয়ে দিলে কালই ঘর আলো করে নাতি-নাতনি আসবে। বাচ্চাদের কলকলানিতে ভরে উঠবে চৌধুরী নিবাস। কিন্তু যাদের জন্য মেয়ে দেখব ওরাই তো গুরুত্ব দেয় না। আমিই বা মা হয়ে আর কতভাবে বোঝাব, বল দেখি?’
-‘ওয়াশরুম থেকে বের হতে গিয়ে সায়ন আহত পায়ে ব্যথা পেয়েছে। রক্ত বের হচ্ছে। একটা বউ থাকলে সেবাযত্ন করতে পারত। এত বড় ছেলের কখন কি লাগে আমরা কি বুঝব? বুঝলেও, ছেলেটাও তো লজ্জায় কিছু বলে না। ডাকে না আমাদের।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সিঁতারা চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস চেপে দুপুরের রান্নার জন্য সবজিগুলো বুয়াকে কাটতে দিয়ে জবাব দিলেন,
-‘এবার শুদ্ধ ফিরুক। দেখি ওকে দিয়ে সায়নের সঙ্গে কথা বলাব। তোর বড় ভাই তো রাগে দেখতেও যায় নি ছেলেটাকে। কিছু বললে আমাকে উল্টো খিচমিচ করে ওঠে। এদের বাপ ছেলেদের দ্বন্দে আমি মাঝখানে পড়েছি। না পারি স্বামীর কথায় সাপোর্ট দিতে না পারি ছেলেদের যুক্তির কাছে হার মানতে।’
-‘পছন্দ টছন্দ থাকলেও তো বলে না। আমরা কতদিন জিজ্ঞাসা করেছি, তোমরা দুই ছেলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। সায়ন ফাজলামো করে কথা এড়িয়ে গেলেও শুদ্ধ যেন কানেই শোনে না। বুঝি না বাপু এরা কি
চিরকুমার থাকার পণ করেছে নাকি।’
-‘এর আগে একটা মেয়ে দেখতে গেলাম। আমাদের অফিসের স্টাফের শালি। কি যে সুন্দর মেয়েটা। সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলে জ্যান্ত পুতুল যেন একটা। সায়নকে ছবি দেখালাম। সায়ন বিয়েতে রাজি না দেখে শুদ্ধকে কত করে বললাম। সে ফোঁস ফোঁস করে বলে, বিয়ের প্রয়োজন অনুভব করলে জানাব তখন আয়োজন শুরু কোরো। আপাতত এসব বলে মাথা খারাপ কোরো না।’
-‘তা প্রয়োজন অনুভব করবে কবে? অন্য বাড়ির ছেলেরা দেখি গোঁফ না গজাতেই বিয়ে, বিয়ে করে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলে। কত ছেলে মরতেও যায় বিয়ের জন্য। যত্তসব হয়েছে আমাদের বাড়ির ছেলেরা, বিয়ের কথা শুনতেই পারে নি।’
এভাবে সিঁতারা চৌধুরী সিরাতের সঙ্গে ছেলেদের নিয়ে কথা বলছিলেন।
তখন সিমিনের (শীতলের মা) কথা শোনা গেল। শীতলকে বকতে বকতে সিঁড়ি বেয়ে নামছে উনি। একগাদা জামা বের করে বিছানার উপরে স্তুপ করে রেখে গেছে মেয়েটা। পরে একটা বের করে পাঁচটা। তারপর পালা দিয়ে দলা মলা পাঁকিয়ে রেখে চলে যায়। এত বড় মেয়ে হুঁশ জ্ঞান এখন না হলে, আর কবে হবে? এসব বকতে বকতে জামা কাপড়গুলো একা হাতে গুছিয়ে ময়লা কাপড় ধুঁয়ে ছাদে মেলে এসেছেন তিনি। হাঁপিয়েও গেছেন। মেয়ের নামে অভিযোগের পসরা খুলে বসলেন। তখন সিরাত সিমিনের উদ্দেশ্য বলল,
-‘ছোটো, শীতলকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল না, কবে যাবি? সিরিয়াল দিয়েছিস?’
সিমিন তো একথা ভুলেই বসেছেন। সিরাত বলার পর উনার স্মরণ হলো
কথাটা। উনাকে মুখ দেখে সিঁতারা চৌধুরী বিরক্ত হয়ে বললেন,
-‘মা হয়ে এতভুলো মনা হলে কিভাবে হবে সিমিন? দেখিস না, মেয়েটার
পিরিয়ড়ের প্রথমদিন কী অবস্থা হয়। স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিক বলেই তো কিছু থাকে নাকি? মেয়ে মানুষের কিছু কিছু ব্যাপার নিয়ে অবহেলা করতে নেই। তুই না গেলে বল আমিই নাহয় নিয়ে যায় মেয়েটাকে? ‘
জা’য়ের কথা বকা সিমিন মুখ কাচুমাচু করে জানাল উনিই নিয়ে যাবেন।
এরপর তিন জা মিলে গল্পে-গল্পে, হাতে-হাতে সাংসারিক কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা হবে। সিঁতারা চৌধুরীর ফোনটা
হঠাৎ নিজস্ব স্বরে বেজে উঠল। উনি ড্রয়িংরুম থেকে ফোনটা হাতে তুলে নজর বুলিয়ে হাসলেন। নাম্বার দেখে মমতাময়ী মন দরদে উতলে পড়ল।
উনি কল রিসিভ করে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
-‘আব্বা, কেমন আছে?’
শুদ্ধ সদ্য শাওয়ার নিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে জানাল,
-‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো, বাড়ির সবাই কেমন আছে, আম্মু?’
-‘আমরা সবাই ভালো আছি। সকালে নাস্তা করেছো বাবা?’
-‘না, সারারাত ল্যাবে ছিলাম কেবল ফিরলাম। একটা কথা জানাতে কল করলাম। কিছুক্ষণ পরে পাঁচজন গেস্ট যাবে বাসায়। লাঞ্চ সারবে। তুমি সামলে নিও প্লিজ।’
-‘এরা পরিচয় নাকি অপরিচিত কেউ?’
-‘বিদেশী সাইন্টিস্ট। কিছু কাজের জন্য এসেছে আর কি। ‘
-‘ওহ আচ্ছা, আচ্ছা। তুমি আসবে বাবা? তোমার বাসায় তোমরা গেস্টরা আসছে, তুমি না থাকলে কিভাবে হবে?’
-‘হুম আমিও আসছি। এইতো, এয়ার টিকিট কনফার্ম করেই তোমাকে জানালাম। আর আম্মু.. ওরা কিন্তু কয়েকটা দিন থাকবে।’
-‘সমস্যা নেই বাবা, তুমি শুধু সাবধানে চলে এলো তাহলেই হবে।’
-‘হুম।’
মা ও ছেলে কথা শেষ করে কল কাটলেন। সিঁতারা চৌধুরী দুই জা’কে গেস্টদের কথা বলতেই উনারাও কাজে লেগে পড়লেন। ভাগ ভাগ করে কাজ বেছে নিলেন। আপ্যায়নে যেন ক্রুটি না থাকে সেই ব্যবস্থা করলেন। তবে কিছু জিনিস প্রয়োজন তাই লিস্ট করে শাহাদত চৌধুরীকে বাজারে পাঠালেন।
শীতল ক্লাসে যায় নি। নরম ঘাসের উপর বসে কিয়ারার আনা তেঁতুল খাচ্ছে। গল্প করছে। কিয়ারার দৃষ্টি তখনো বিদেশীদের দিকে। বিদেশীরা রিকশায় চড়ে ঘাসের উপর ঘুরছে। কখনো নিজেরাই রিকশা চালাচ্ছে, রিকশা টেনে সামনে এগিয়ে নিতে না পারলে নিজেরা হাসাহাসি করছে।
কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে কিয়ারা কামরানকে ইঙ্গিত করে বলে বসল,
-‘উনারা দাদার নাম ইমরান। বাপের নাম জুবরান। উনার নাম কামরান। তা এই রানের বংশধরদের কোথায় কুঁড়িয়ে পেলি রে শীতল?’
-‘বেল তলায়।’
-‘ওহ। তা কামরান মিঁয়া বিদেশিদের সঙ্গে করছে টা কি?’
-‘কি আশ্চর্য, আমাকে বলেছে নাকি? তুই গিয়ে জিজ্ঞাসা করে আয়।’
-‘শুদ্ধ ভাইয়া কিছু বলে নি তোকে?’
-‘নিজে বাঁচতে চাইলে খবরদার বলছি উনার নাম মুখেও নিবি না। উনার মতো বিটকেল জাতের কাজিন কারো আছে কি না জানা নেই। কপালই খারাপ বা’ল।’
-‘ এভাবে বলছিস কেন রে শীতল? শুদ্ধ ভাইয়ার মতো এত ভদ্র, ড্যাসিং, ছেলে হয় নাকি? তাও আবার সাইন্টিস। এই অবধি কি কি আবিষ্কার করেছে শুদ্ধ ভাই, জানিস কিছু?’
-‘ব্যঙের ছাতার নিচে বছরের পর বছর কিভাবে বসবাস করা যায় সেই গবেষণা চালাচ্ছে উনি।’
-‘রেগে যাচ্ছিস কেন? বল না একটু শুনি।’
-‘কি বলব? সে শুধু দেখতেই ড্যাসিং না। তার হাতের চ্যালাকাঠের বারি আরো ড্যাসিং। সুইট। টেস্টি। খাবি একবার? টেস্ট কর ভালো লাগবে।’
-‘ভাইয়া আবার তোকে মেরেছে?’
-‘শুধু মারে নি ফোনটারও জান কবজ করেছে। যাওয়ার সময় সবাইকে গিফট দিয়েছে আমাকে দেয় নি। লাগবে না তার দেওয়া গিফট। সায়ন ভাইয়া বলেছে সুস্থ হলেই আমাকে শপিং করাতে নিয়ে যাবে।’
একথা বললেও মুখ ভার করে ঘাসের দিকে তাকিয়ে রইল। শুদ্ধর এমন
ব্যবহারে ভীষণ পেয়েছে সে। শখ, স্বর্ণকে দুটো ড্রেস দিয়েছে শুদ্ধ। সঙ্গে ম্যাচিং হিজাব। সাম্য, সৃজনকে রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার আর তাকে দিয়েছে দু’ঘা চ্যালাকাঠের বারি। এবার এসে কবেকার রাগ তুলেছে কে জানে! শীতলের বেজার মুখ দেখে কিয়ারাও কিছু বলার সাহস পেল না। এখন কিছু বললেই শীতলের সমস্ত রাগ তার উপরে পড়বে। হঠাৎ শীতল
কিয়ারার হাতের ফোনটা কেড়ে নিয়ে ফটাফট নাম্বার তুলে কাউকে কল দিলো। ওপর পাশের মানুষটা কল তুলছে না। সেও হাল না ছেড়ে একের পর এক কল দিতেই থাকল। চারবারের বেলায় কল তুলে গমগমে সুরে বলে উঠল,
-‘ শোয়াইব স্পিকিং, হু আর ইউ?’
শীতল নিশ্চুপ। কারো কথা না শুনে হ্যালো, হ্যালো, করে শেষমেষ কলই কেটে দিলো ওপর পাশের মানুষটা। তাতে শীতলের রাগের পারদ দ্বিগুন বাড়ল। সে আবার কল করল সেই নাম্বারে। কিয়ারা বসে বসে শীতলের ক্নান্ড দেখছে। এবারও কল বেজে বেজে শেষ মুহূর্তে কল রিসিভ হতেই সে গলার স্বর পরিবর্তন করে ন্যাকা সুরে বলল,
-‘বিশুদ্ধ বলছেন?’
-‘না। ‘
-‘ বিশুদ্ধ সাহেব ভালো হয়ে যান ভালো হতে টাকা লাগে না।’
-‘ব্যথা কমে গেছে?’
-‘কিসের ব্যথা?’
-‘এই যে চ্যালাকাঠ দিয়ে দু’ঘা দিয়ে এলাম তার ব্যথা।’
-‘(…)’
-‘নিষেধ করেছিলাম না আমার সঙ্গে চালাকি না করতে?’
-‘(..)’
শীতল মুখ লটকে তাকিয়ে আছে কিয়ারার দিকে।ইস, মুখে ওড়না গুঁজে কথা বলে কি লাভ হলো, বুঝেই তো ফেলল। মুখ থেকে ওড়না বের করে সে কিছু বলার আগে শুদ্ধ বলল,
-‘কলের কারণ?’
-‘আপনাকে একটু দরকার ছিল।’
-‘কেন?’
-‘শোকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য। ‘
একথা বলে শীতল কল কেটে ফোনের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
-‘ দিলাম খোঁচা। এবার মারেন দেখি, কেমন পারেন।’
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬
একথা বলে শীতল সুন্দর করে হাসল। এবার শান্তি লাগছে। সেও বুঝুক কাউকে খোঁচামার্কা কথা বললে কেমন লাগে। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শুদ্ধর ফোন নাম্বার ডিলিট করে কিয়ারাকে ফোন ফিরিয়ে দিলো। আজ একটু বেশিই সাহস দেখিয়ে ফেলেছে। কারণ সে জানে শুদ্ধ এবার দেরি করে বাড়ি ফিরবে বড় মাকে তাই বলতে শুনেছে। দেরি করে এলে ভুলে যাবে আজকের কথা। একথা ভেবে একটু খোঁচাল আর কি। এখন শুদ্ধ খোঁচা খেয়ে দিন পার করুন।