শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২১

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২১
আলিশা

শান্তকে নিয়ে যাওয়া হলো। যে মেয়ে দু’টো আমার নিকাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তারা আবারও মুখ খোলার চেষ্টা করতেই খাইরুন হাত উঁচু করে থামিয়ে দিলো তাদের। সকলকে আদেশ করা হলো নিজ নিজ কাজে রত হতে। সকলে বিনাবাক্যে তা মেনে নিলো। আমি আশ্চর্য! কেন আমাকে বন্দি করা হলো না। কেন খাইরুন এমন আচরণ করছে? কখনো মন বলছে সে আমাকে বাঁচাতে চাইছে। কখনোবা মনে হচ্ছে নাচ গার্ডেনের মালকিন যেন সে। তার কথাতেই বাজিমাত হচ্ছে। ভাবনার মাঝেই সোনার ঘড়ি হাতে গুঁজে দেওয়া লোকটার কন্ঠ কানে এলো

— খাইরুন এই মেয়ে কি নতুন? নতুন হলে এটা আমার। আমি তোকে আগেই বলে দিচ্ছি।
লোকটার উৎফুল্ল কন্ঠে আমার গা ঘিন ঘিন করতে আরম্ভ করলো। খাইরুন মুচকি হেসে লোকটার কাঁধে হাত রেখে বলল

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— এতো ভাবছেন কেন বাবু? এর চাইতে ভালো মাল আমাদের স্টকে আছে। ভেতরে যান।
কথা শেষ করে খাইরুন লোকটাকে ভেতরে প্রবেশ করিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো আমার নিকট। তার মুখাবয়বে তখন অন্য অনুভূতির খেলা। আমাকে অবাকের শেষ সীমান্তে নিয়ে গিয়ে সে আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো। অতঃপর পা বাড়ালো কোনো এক দিকে। আমার ধ্যান জ্ঞান যেন শূন্য হলো। হঠাৎই ভয় নামক জিনিসটা মন থেকে উবে গেলো। সাহস, জোর পেলাম মনে। তবে কেন? খাইরুনকে চিনি বলে?

— আপনি এখানে কেন এসেছেন?
আপন গলায় ভীত স্বরে প্রশ্ন করে বসলো খাইরুন। যেন আমায়,নিয়ে তার দুশ্চিন্তা। আমি ঝাড়ি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। শক্ত গলায় বললাম
— শান্তকে ভালোয় ভালোয় ছেড়ে দিতে বলো। নয়তো স্মরণ কে নিশ্চয়ই চেনো। আর না চিনলেও আমি পুলিশ চিনি।

খাইরুন এই ছোট কক্ষের দরজা বন্ধ করলো ধুপধাপ। দ্বোতলা ভবন থেকে কিছুটা সামনে এই কক্ষ। ওপরে ছোনের ছাউনি। তবে ইটের দেয়াল। দেয়ালে থাকা শূন্যস্থান হতে এক দু চিড় আলোক রেখার প্রবেশ কক্ষে।
— দেখুন মাথা গরম করার মতো পরিবেশ এটা নয়? এটা একটা নরখাদক হায়নাদের স্থান।
করুন চোখের চাহনি আমার নজর এড়ালো না। খাইরুন নুইয়ে পরলো। চোখে মুখে তীব্র লজ্জা রেখে সে প্রথমেই শাড়ির সরু আচল প্রশস্ত করলো। পুনরায় বলতে লাগলো

— আপনার চোখে আমি একজন খারাপ মেয়ে। ধারণা ভুল না। আমি খারাপ, আমি নাচনে৷ ওয়ালী, আমি পতিতা। আমি একজন চড়া দামে প্রতি রাতে বিক্রি হওয়া পতিতা। কিন্তু মন থেকে আমি একজন মানুষ।
— কি বোঝাতে চাইছো তুমি আমাকে?

— আমি বোঝাতে চাইছি আপনি চলে যান এখান থেকে। এরা ভালো না। আপনার ক্ষতি করবে। আপনাকে আমার দাদা দাদি বড্ড ভালোবাসে। আজও তাদের মুখে আপনার আর আপনার স্বামীর নাম। আপনারা ভালো মানুষ। আপনাদের সম্পর্ক সুন্দর। আপনাদের ভালোবাসা জীবন্ত। যেই ভালোবাসা, যেই মেলবন্ধন দেখতেও ভালোলাগে। আপনার চোখ দেখলে আমার আগের আমির কথা মনে পড়ে। আপনার চোখ দু’টো হুবহু আমার মতো। পাপমুক্ত। কিন্তু আমার চোখে, আমার সারা অঙ্গে পাপ। আমি চাই না আপনার ক্ষতি হোক।
খাইরুনের শান্ত কন্ঠের বাণীগুলো আমাকে বাধ্য করলো ওকে বিশ্বাস করতে।
আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। আচমকা ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম

— যদি তুমি আমাকে এতোটাই ভালোবাসো তবে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?
খাইরুন নীরব রইলো। আমার মনে জমা হাজার প্রশ্নের মধ্য হতে একটা প্রশ্ন আমি খাইরুনের দিকে ছুড়ে দিলাম।
— তোমাদের এই নাচ গার্ডেনের মালকিন কে?
— মালকিনের নাম কেউ জানি না। কেবল চেহারা দেখেছি। আর তাকে আমরা সবাই বুবু বলে ডাকি।
ধীর, শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলো খাইরুন। অতঃপর হঠাৎই দরজায় করাঘাত। কে যেন বলল
” কাস্টমার আইছে। বুবু তোরে ডাকে”

শান্ত ধীর খাইরুন শান্ত কন্ঠেই জবাব দিয়ে অতি ব্যস্ত হয়ে পরলো আমাকে বিদায় দেওয়ার। আমি দ্বিধাদ্বন্দের মাঝে পেন্ডুলাম হয়ে খাইরুন কে বিশ্বাস করলাম। সে আমাকে গোপন রাস্তা দেখিয়ে দিলো। আমি চিন্তায় কাতর হয়ে শান্তর কথা উচ্চারণ করতেই ও তৃতীয় বারের মতো আশ্বাস দিয়ে বলল
— কিচ্ছু হবে না ওনার। আমার ওপর আশা রাখুন। আমি শুধু চাই এই পাপের আস্তানা ভেঙে যাক। আপনার স্বামী তো গোয়েন্দা। ভেঙে ফেলতে বলেন। এখানে অনেক মেয়ে স্বপ্ন ছাড়া দিনপার করে। কিন্তু মানুষ কি স্বপ্ন ছাড়া বাঁচে?
আমিও খাইরুনকে পাল্টা অনুরোধ করলাম

— তোমাদের বুবুর একটা ছবি আমাকে পাঠাতে পারবে কোনোভাবে?
খাইরুন বলে উঠলো
— চেষ্টা করবো।
আমি তারপর বিদায় নিলাম খাইরুনের থেকে। পেছনের পথটা উঁচু উঁচু গাছের বাগান। শান্তর জন্য ভীষণ কান্না পেলো আমার। ওকে ছাড়া এখান থেকে যেতে বিবেক সাই দিচ্ছিলো না। ছেলেটা আমাকে বাঁচাতে টু শব্দ করেনি। যেন কেউ আমাকে আরো বেশি সন্দেহ না করে সে পথটাই অবলম্বন করতে চেয়েছিল ও।

বাসায় ফিরলাম বিকেল চারটার নাগাদ। শরীরের রক্ত যেন পানি হয়ে গেছে। হাত পা অবশ হয়ে আসছে। বাসায় স্মারণ আছে কিনা সে খবর না রেখেই সোজা বাসায় ঢুকে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। অতঃপর মুখ চেপে শান্তর জন্য কান্নায় ভেঙে পরলাম। কম্পমান হাত পা আর শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে কিছুসময় বসে থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে সিধান্ত নিলাম ভেঙে পরলে চলবে না। শান্তকে যেভাবেই হোক ওখান থেকে বের করতে হবে।

দেখতে দেখতে দু’টো দিন পেরিয়ে গেলো। আমি বাসায় তল্লাশি চালালাম অথৈয়ের বিষয়ে। তবে তেমন কিছুই হাতে এলো না। অদ্ভুত সাজ সজ্জার সেই ছবিটা থেকে কেবল ধারণা করলাম অথৈও খাইরুনের মতো। তবে প্রমাণ নেই আমার হাতে। ভয় হতে লাগলো ‘নাচ গার্ডেন’ এর মালকিন অথৈ কিনা ভেবে। ভাবনার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো। প্রিয়ার ফোন। রিসিভ করতেই ওপাশ হতে ছোঁয়ার কন্ঠ ভেসে এলো

— মা, বাবার সাথে কথা বলবো। অনেকবার ফোন করলাম কিন্তু ধরছে না কেন?
আমি চিন্তাগুলো একপাশে জমা রেখে ছোঁয়াকে মজা করে বললাম
— বলবো না। কারণ তুমি আমার সাথে না তোমার বাবার সাথে কথা বলতে চাও। তাই আমি কিচ্ছু বলবো না।
ছোঁয়া খিলখিল করে হাসলো। আমি স্মরণের স্টাডি রুমের দিকে পা বাড়ালাম। সব ঠিকঠাক আছে আমাদের মাঝে। কারণ যেদিন নাচ গার্ডেন থেকে বাসায় ফিরি সেদিন স্মরণ মিটিং এ ছিলো। আমি বের হওয়ার দশ মিনিট আগেই সে বেরিয়েছিল। আর আমি ফেরার দশ মিনিট পরেই সে বাসায় ফিরেছিল।

জানালার পাশ ঘেঁসে একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ আছে। আমি দাড়িয়ে তাদের রং দেখছিলাম বিষন্ন মনে। তিনদিন হতে চলল অথচ আমি শান্তর জন্য কিছু করতে পারছি না। স্মরণকেও জানানো যাচ্ছে না বিষয়টা। তীব্র মন খারাপ নিয়ে যখন বাসার নিচে কৃষ্ণচূড়ার রঙে রাঙা হয়ে ওঠা পথ দেখছিলাম ঠিক তখনই দেখা মিলল একজন বৃদ্ধর। বৃদ্ধ কে দেখে এক মুহূর্ত আমি সব ভুলে হেসে ফেললাম। এতো সেই মানুষটা, এতো আমাকে আর স্মরণকে একরাত আশ্রয় দেওয়া বৃদ্ধ, খাইরুনের দাদা মশাই। আমি তড়িঘড়ি করে নিচে নামলাম। মেইন ডোর পেরিয়ে একেবারে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে গিয়েই সাক্ষাৎ করলাম তার সঙ্গে। হাতে তার একটা ব্যাগ। আমি তা বহন করে তাকে ঘরে নিয়ে আসলাম। অজানা ভালো লাগা কাজ করছে আমার। দাদা মশাই বলে উঠলেন

— নাতনি কে দেখতে আইলাম।
কথাটা কলিজা শান্তি করে দিলো যেন। বাড়ির মেয়ের বিয়ে হলে যেমন মুরব্বিরা দেখতে আসে বাজার করে বিষয়টা এমন হয়ে উঠলো। বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। অতিথির জন্য বিশেষ আয়োজনের ব্যবস্থা করতে বললেন বাবা। স্মরণ বাসায় নেই। সে থাকলে বোধ হয় খুশি হতো। আমি রান্নাঘরে ছুটতে চাইলাম। ঠিক তখনই দাদা মশাই আমাকে থামিয়ে আমার হাতে একটা টিফিন বক্স ধরিয়ে দিয়ে বললেন

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২০

— এটা তোমারে খাইরুন দিছে। কিনাকি বিশেষ কিছু পাঠাইছে তোমার জন্য। আমারে খুইলা দেখতেও মানা করছে।
আমি ভ্রু কুঁচকে প্রথমেই কৌতুহল মেটাতে বক্স নিয়ে নিজ ঘরে আসলাম। অতঃপর বক্স খুলতেই আমার কুঁচকো ভ্রু আরো খানিকটা কুঁচকে যায়। বক্সে খাবার নেই। খাবারের পরিবর্তে আছে একটা ছবি আর একটা ভাঁজে মোড়ানো কাগজ।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২২